বিডিআর বিদ্রোহ সিপাহি বিদ্রোহ নয়

March 25, 2018 10:06 pm0 commentsViews: 41

মিল্টন বিশ্বাস

২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সংঘটিত তথাকথিত বিডিআর বিদ্রোহকে অনেকেই ১৮৫৭ সালের ব্রিটিশ ভারতের সিপাহি বিদ্রোহের সঙ্গে তুলনা দিতে উৎসাহী। কেউ কেউ আবার সেনাবাহিনীর আধিপত্য ও ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর প্রসঙ্গে ওই বীভৎস ঘটনাকে বিশ্লেষণ করতে আগ্রহী। অথচ ওই তথাকথিত বিদ্রোহ দেশের সার্বভৌমত্ব নস্যাতের প্রচেষ্টা হিসেবে গণ্য হয়েছে। সম্পন্ন হওয়া বিচারের রায় সেই প্রমাণ হাজির করেছে। ২০০৯ সালেই ‘বিডিআর’ থেকে ‘বিজিবি’ নামকরণ করা হয়। তারপর বিজিবি’তে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে। ঘুরে দাঁড়িয়েছে বিজিবি। বিজিবিকে এখন আর পেছনে তাকানোর দরকার নেই। যারা ওই ঘটনার খুনের সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের বিচার হয়েছে। এখন সবাই মিলে এই দেশের সীমান্ত আরো সুরক্ষিত করার জন্য কাজ করছে। হত্যা মামলার রায় ঘোষণা হওয়ার পর এখন বিজিবি কলঙ্কমুক্ত বলা চলে।

২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর পিলখানা হত্যা মামলায় ১৫২ জনের ফাঁসি, ১৬০ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়। ওই রায় ঘোষণার সময় আদালত কী কারণে এ বিদ্রোহ হয় এবং এ বিষয়ে একটি পর্যবেক্ষণ ও অভিমত দেন। সেই পর্যবেক্ষণও প্রমাণ করে নির্মম হত্যাযজ্ঞ কোনো মানবকল্যাণ সাধন করেনি। তার ‘উদ্দেশ্য ছিল সামরিক নিরাপত্তা ধ্বংস’।

রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, ‘সামরিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা ধ্বংস করার মোটিভ নিয়ে এই বিদ্রোহের ঘটনা ঘটানো হয়েছিল। বহির্বিশ্বের কাছে আমাদের দেশকে ছোট করা, বিদেশি বিনিয়োগ না আসার জন্য কলকাঠি নাড়া হয়েছে।’ তা ছাড়া বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রির ‘অপারেশন ডালভাত’ কর্মসূচিতে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআরকে জড়ানো ঠিক হয়নি। এটা বাহিনীর ‘ঐতিহ্য’ নষ্ট করেছে। ওই ঘটনার পেছনে অর্থনৈতিক ‘মোটিভ’ ছিল। রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ‘মোটিভও’ থাকতে পারে। এই বিদ্রোহের তথ্য আগে জানতে না পারার ঘটনায় ‘গোয়েন্দা দুর্বলতা’ ছিল বলেও মনে করেছেন আদালত। আদালত মনে করেন, দেশের ‘অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড’ দুর্বল করার জন্য ওই বিদ্রোহ ঘটানো হয়ে থাকতে পারে। আর সশস্ত্র বাহিনীকে নিরুৎসাহিত করাও এর একটি কারণ হতে পারে। এই বাহিনীর সদস্যদের আবারও জাতিসংঘ শান্তি মিশনে পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া এবং পিলখানার ভেতরে স্কুলে সাধারণ বিডিআর সদস্যদের সন্তানদের ভর্তির ব্যাপারে আরো ছাড় দেওয়ার পরামর্শ দেন বিচারক। সেনাসদস্যদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ রেখে বিডিআর সদস্যরা দেশের নিরাপত্তা রক্ষার কাজে নিয়োজিত আছেন। এ জন্য প্রতিরক্ষা বাহিনীর মতো ২০ শতাংশ ভাতা তাদের পাওয়া উচিত। তাদের ঝুঁকিভাতা দেওয়া যায় কি না, তাও দেখা উচিত।’ রায়ের এই পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী বিজিবি ব্যাপকভাবে পুনর্গঠিত হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকার তাদের জন্য কল্যাণমূলক নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।

‘বিজিবি’ পুনর্গঠন হিসেবে চারটি রিজিয়ন, চারটি সেক্টর, নতুন ছয়টি ব্যাটালিয়ন গড়ে তোলা হয়েছে। এ ছাড়া বিজিবিকে আরো শক্তিশালী করে গড়ে তোলার জন্য তিন স্তরের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। বর্ডার সিকিউরিটি ব্যুরো, রিজিওনাল ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো ও ব্যাটালিয়ন ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো গঠন করা হয়েছে। বিডিআর বিদ্রোহে বিভাগীয় মামলা ও অধিনায়কের আদালতে ১৭ হাজার ৩০৬ জনকে গুরু ও লঘু দণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। এদের মধ্যে নয় হাজার ১৯ জনকে গুরু দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার কারণে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। লঘু দণ্ডে দণ্ডিত আট হাজার ২৮৭ জন পুনরায় চাকরিতে ফিরে এসেছে। বিডিআর বিদ্রোহের সময় এর সদস্য সংখ্যা ছিল ৪৪ হাজার ২৩৯ জন। বিদ্রোহের পর পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে এখন বিজিবির সদস্য সংখ্যা বেড়ে হয়েছে আনুমানিক ৪৭ হাজারের বেশি। এরই মধ্যে এর সদস্য সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি।

বিজিবির ফোর্সের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে যেমন, তেমনি রায়ের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী সীমান্ত ভাতা ৩০ ভাগ করা হয়েছে। সরকার বিজিবির সৈনিকদের মধ্যে পদোন্নতির ব্যবস্থা করেছেন। এখন থেকে যেকোনো সৈনিককে তার যোগ্যতার ভিত্তিতে সরাসরি সহকারী পরিচালক হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে। একজন সৈনিকের বয়স ৩৫ বছর হলে তিনি সহকারী পরিচালক পদে পদোন্নতির জন্য আবেদন করতে পারবেন। এর আগে সৈনিকদের মধ্য থেকে ২০১০ সালে তিন হাজার ৮২৪ জনকে বিভিন্ন পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। ২০১১ সালে তিন হাজার ৪৬ জন, ২০১২ সালে দুই হাজার ৫৮৩ জন এবং ২০১৩ সালে চার হাজার ৫৬৯ জন পদোন্নতি পেয়েছেন। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বিজিবি সদস্যরা অংশ নিতে পারবেন কি না, এ ব্যাপারে সরকারের কাছে দাবি করা হয়েছে। জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশন থেকে এ ব্যাপারে চাহিদা এলেই বিজিবি পাঠানো সম্ভব।

আদালতের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী বিজিবিতে শতভাগ রেশন নিশ্চিত করেছেন সরকার। এ ছাড়া আগে সন্তানের বয়স ২২ বছর পর্যন্ত রেশন দেওয়া হতো। এখন এই বয়স ২৫ বছরে বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিজিবি সৈনিকদের ছুটির ব্যাপারে আগে বার্ষিক এক মাস ছুটি ভোগ করতে পারত। এখন এই ছুটি দুই মাস করা হয়েছে। দেশের মোট সীমান্তের মধ্যে ভারতের সঙ্গে ৩৪১ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে অত্যন্ত দুর্গম। ওই সীমান্ত এলাকায় শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতের পক্ষেও এখনো সুরক্ষা করা হয়নি। বাংলাদেশের সীমান্তের ওই সব এলাকায় কীভাবে বিজিবি মোতায়েন করা যায়, তার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। কারণ, ওই এলাকায় কোনো মানুষ যাতায়াত করে না। সীমান্তে যারা দায়িত্বে থাকবে, তাদের সঙ্গে শুধু হেলিকপ্টার দিয়ে যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব। ঠিক এমনইভাবে মিয়ানমারের সঙ্গে দুর্গম ১৯৮ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকায় বিজিবির বিওপি (বর্ডার অবজারভেশন পোস্ট) নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিজিবি সদস্যদের এখন আরো যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। আধুনিক নতুন নতুন অস্ত্র যুক্ত করা হয়েছে।

বিজিবি পুনর্গঠনের এই বিস্তারিত তথ্যই প্রমাণ করে শেখ হাসিনা সরকার বিভিন্ন বাহিনীর স্বার্থ রক্ষা করতে সব সময়ই সচেষ্ট ও উদ্যোগী। পিলখানা হত্যাযজ্ঞের বিচার সম্পন্ন করে যেমন সৈনিকদের বিশৃঙ্খলা ও অনাচারের উচিতসাজার দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে, তেমনি নিহত সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারের কল্যাণে প্রশংসনীয় নানান কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছেন সরকার। ২০১৩ সালে রায় ঘোষিত হওয়া পিলখানা হত্যাযজ্ঞের বিচারে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা অবলম্বন করা হয়েছে। অপরাধীদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়ার পাশাপাশি নির্দোষীরা খালাসও পেয়েছেন অনেকে। নিজের দোষ স্বীকার করায় কাউকে কাউকে খালাস দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধা বিবেচনায় কারো কারো শাস্তি হ্রাস করা হয়। অন্যদিকে, অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় অনেকেই মামলা থেকে মুক্ত হয়েছেন। দেশব্যাপী বিদ্রোহের ঘটনায় বিভিন্ন জেলায় করা ৪০টি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা থেকে ১৮৩৭ জন আসামির নাম প্রত্যাহার করেন সরকার। উল্লেখ্য, বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় তিন ধরনের মামলা করা হয়েছিল। এগুলোর মধ্যে ঢাকার বাইরে ২৮ জেলার ৩৭ থানায় ৪০টি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা, বিডিআরের নিজস্ব আইনে ৫৮টি এবং প্রচলিত আইনে পিলখানায় হত্যা, লুটপাট, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন অভিযোগে একটি মামলা ছিল।

কেবল ‘বিজিবি’ পুনর্গঠন নয় কিংবা শহীদ সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া নয়, পিলখানা হত্যাযজ্ঞের ঘটনাকে সামাল দিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২৬ তারিখে পরিস্থিতি শান্ত হয়। সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্বব্যাপী শেখ হাসিনার কৃতিত্ব প্রচার হয়ে গেছে। ঢাকাস্থ তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি ২৭ ফেব্রুয়ারি পাঠানো এক গোপনীয় তারবার্তায় লেখেন : ‘২৬ ফেব্রুয়ারি শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে এক টেলিভিশন ভাষণে আধাসামরিক বাহিনী বাংলাদেশ রাইফেলসের বিদ্রোহী জওয়ানেরা আত্মসমর্পণ না করলে তাদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের হুমকি দিলে বিডিআরের মধ্যকার সামরিক অফিসারদের বিরুদ্ধে জওয়ানদের সক্রিয় বিদ্রোহের অবসান ঘটে।…’ ওই ঘটনায় বাংলাদেশের প্রশংসা করে তিনি আরো উল্লেখ করেন, ‘রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সামরিক বাহিনী এমন পরিপক্বতা ও গণতান্ত্রিক রীতিনীতির প্রতি শ্রদ্ধা বজায় রেখে বিদ্রোহ মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছেন, যেমনটি বাংলাদেশে সচরাচর দেখা যায় না।’ সামরিক অভিযান না চালিয়ে রক্তপাত ছাড়াই সংকট উত্তরণের জন্য শেখ হাসিনাকেই তিনি কৃতিত্ব দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘অধিকাংশ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে বিদ্রোহের শুরুতে; সংবাদমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক মহল মনে করে, আরো রক্তপাত যে এড়ানো গেছে, তার কৃতিত্ব হাসিনার।’ পরিস্থিতি সামাল দেবার এই কৃতিত্ব পিলখানা হত্যাযজ্ঞের সপ্তমবার্ষিকী পূর্ণ হওয়ার দিনেও প্রশংসিত হচ্ছে।

মূলত শেখ হাসিনা আমাদের দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব-বিরোধী শক্তিকে শক্ত হাতে মোকাবেলা করেছেন; জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাস, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে নির্মূলে সবসময় সতর্ক থেকেছেন। তাঁর সরকার জনগণের দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সপক্ষে থেকে যথাযথ উদ্যোগ নিয়েছেন। এজন্য জনগণের শত্রুপক্ষ, দেশবিরোধী অপশক্তি ও মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি বারবার পরাজিত হবে এটাই স্বাভাবিক। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর হচ্ছে; সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ মুক্ত করা হয়েছে। এ জন্য রাজনৈতিক অপশক্তি জঙ্গীবাদিদের প্ররোচনা ও সহায়তা নিয়ে এগিয়ে এলেও বারবার পিছু হটচ্ছে। কারণ জনগণের নিরাপত্তা ও উন্নয়নে সেনাবাহিনী, বিডিআরসহ বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনী দায়িত্ব পালনে সচেতন। কোনো ধরনের বিভ্রান্তি, উস্কানি ও ষড়যন্ত্র তাদের লক্ষ্যভ্রষ্ট করেনি। তথাকথিত বিডিআর বিদ্রোহের মাধ্যমে যে রাজনৈতিক অপশক্তি কৌশলে দেশকে অস্থিতিশীল ও অনিরাপদ করতে চেয়েছিল তা শেখ হাসিনার নেতৃত্বের গুণে বানচাল হয়ে গেছে।

লেখক : অধ্যাপক  এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

Leave a Reply

You must be logged in to post a comment.

Editor in Chief: Dr. Omar Faruque

Editor: Dr. Morjina Akhter

All contact: 400E Mosholu Parkway South Apt # A23,The Bronx, New York 10458, USA

Mob. 001.347.459.8516
E-mail: dhakapost91@gmail.com