বাংলাদেশ কি সোশ্যাল মিডিয়া-চালিত রাষ্ট্র?
বাংলাদেশকে নিয়ে শান্ত মনে আলোচনা করা সহজ নয়। সবাই কোন না কোন মন্তব্য, মতামত প্রকাশ ও কটুক্তি করতে ব্যাকুল অথবা এগুলোর পাল্টা জবাব দিতে চায়। গভীর চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন এমন যেকোন কিছু এড়িয়ে যাওয়া হয় এবং সাড়া দানের অত্যন্ত সাধারণ একটি ধরন হলো তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। আলোড়ন সৃষ্টির জন্য অযথা বিখ্যাত হয়নি এমন একটি সমাজে ডিজিটাল ইন্সট্যান্ট ও মিডিয়া সুপারফিসিয়ালিটির মধ্যে সাতরাচ্ছে বাংলাদেশ।
ভার্চুয়াল বা কল্পবাস্তবের সত্যিকারের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সমাজে। এক বিবেচনায় এটি সামাজিক গণমাধ্যমের সমাজ ও রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। যখন ডিজিটাল ও ভার্চুয়ালের শাসন কায়েম হয় তখন বাস্তবতাই হয়ে দাঁড়ায় জীবনের সবচেয়ে অবাস্তব রূপ।
তিনটি মেটা-রিয়েলিটির সবগুলোতেই এর প্রভাব দেখা যায়: ক. রাজনীতি, খ. গণমাধ্যম, ও গ. শাসনব্যবস্থা। বাস্তবতা হলো এর সবগুলোই নিশ্চিত বলে ধরে নেয়া হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষই এর অনুশীলন করে। যার মধ্য দিয়ে এর প্রভাবের গভীরতা ও সর্বব্যাপী প্রকৃতি অনুধাবন করা যায়।
রাজনীতি
বাংলাদেশের রাজনীতি পরিচালনা করছে দুটি দল, বর্তমানে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ ও ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি। এ যাবতকাল পর্যন্ত তারা একে অপারের দুর্ভোগ সৃষ্টির জন্য খুনসহ হেন কিছু নেই করেনি এবং তা করার জন্যও অনেক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তাই সমঝোতা বা সহাবস্থানের কোন প্রশ্নই আসে না।
কিন্তু ১৯৯০-এর দশকে এমন এক সময় ছিলো যখন তারা ঐক্যবদ্ধ ছিলো যা তৎকালিন প্রেসিডেন্ট এরশাদ ও তার জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করে। দুই মেরুর এই সখ্যতা মাত্র কয়েক মাস টিকেছিলো, শাসন ব্যবস্থা প্রেসিডেন্ট থেকে সংসদীয় পদ্ধতিতে পরিবর্তন পর্যন্ত। কিন্তু অতি শিঘ্রই তারা লড়াইয়ের ময়দানে হাজির হয়, যা তাদেরকে ভালো মানায়। এর পর থেকে শত্রুতা শুধু প্রবল হয়েছে, কখনো শান্তি আসবে এমন সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না।
এমন বিষাক্ত সম্পর্কে যোগ হয়েছে ফেস বুকিংয়ের স্টলকিং ও ট্রলিংসহ সবগুলো নেতিবাচক দিক। পরস্পরের বিরুদ্ধে ঘৃণা উদ্রেককারী বার্তা এমন সর্বব্যাপী যে গত তিন দশকে এক দল আরেক দল সম্পর্কে কোন ইতিবাচক কথা বলতে পারেনি। নির্দলীয় কোন ব্যক্তি যদি নিরপেক্ষ বক্তব্যও দেন তাকেও দলীয় মনে করে কোন পক্ষ।
সামাজিক গণমাধ্যম তার চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে এই ঘৃণার বার্তা আরো দ্রুত ছড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে ধরন ও বিষয় – দুটিই একই বাস্তবতার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাজার হাজার এফবি গ্রুপ তৈরি হয়েছে, তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক মক্তব্য ছড়ানোর পেছনে পুরো সময় ব্যয় করছে। এর সঙ্গে ইউটিউব ও লাইভ (সরাসরি) সম্প্রচারের সুযোগ যুক্ত হয়ে শত্রুতাকে নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে। আমরা সোশ্যাল মিডিয়াকে যেভাবে দেখছি তা না থাকলে বাংলাদেশ দেখতে একেবারে অন্যরকম হতো।
সুশাসন
সুশাসনের মডেলগুলোকে সোশ্যাল মিডিয়া ইথিকসের সঙ্গে তুলনা করার চিন্তা উদ্ভট মনে হবে। কিন্তু লাইক ও ইমোজির মাধ্যমে মনোভাব প্রকাশের সংস্কৃতি নির্ধারণ করে দিচ্ছে কিভাবে নীতির রূপায়ন ঘটবে। বাংলাদেশীরা ‘লাইক’ দিতে ভালোবাসে এবং কেউ কেউ বলেন বিশ্বের ফেস বুকারদের মধ্যে বাংলাদেশীরাই নাকি সবচেয়ে বেশি ‘লাইক’ দিয়ে থাকে। এফবি’র ‘লাইকিং’ ধরন নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে যে মন্তব্যের সারবস্তুর ভিত্তিতে সুশাসনের সিদ্ধান্ত হচ্ছে না, বরং পোস্টের মনযোগ যেদিকে আকৃষ্ট করতে চায় তার ভিত্তিতে হচ্ছে।
তাই বাংলাদেশ বেশি বেশি লাইক পছন্দ করে, এটি আরো বাড়বে বলে আভাস দেয়া হয়, যদিও এর সঙ্গে বাস্তব উন্নয়নের কোন সম্পর্ক নেই। কর্মসংস্থান তৈরি হবে এমন সাধারণ প্রকল্পের চেয়ে কোন হাই প্রফাইল প্রকল্প তার পছন্দ, ছবি থাকলে তা আরো বেশি পছন্দের।
বেশিরভাগ মানুষের পছন্দ কুপন ও উপহার- পড়ুন ঘুষ ও দুর্নীতি এবং এর উপর দাঁড়িয়ে আছে তার পুরো অর্থনৈতিক বিশ্বটি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো শাসন ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক – এর সবগুলোরই সোশ্যাল মিডিয়ার মতো নেটওয়ার্ক, কারো কাছে যার জবাবদিহিতা নেই। সুশাসনের বিশ্বে কল্পবাস্তবের শাসন এখন নিখাদ বাস্তবতার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে, এর একটি আরেকটির প্রতিফলন।
গণমাধ্যম
সম্ভবত গণমাধ্যমের জগতেই সব কনফিগারেশন একত্রিত হয়ে সবচেয়ে বেশি কল্পবাস্তবের বাস্তবতা তৈরি করে। তবে, পেশাদার মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়া মিলে এক নতুন ধরনের মিডিয়া তৈরি হচ্ছে বলে মনে হয় যেখানে নিয়মকানুন কদাচিৎ প্রয়োগ করা যাবে। এই কনফিগারেশনে নিয়মকানুনের অভাব নতুন সংকট সৃষ্টি করছে।
বাংলাদেশে সর্বশেষ ২০১৮ সালের আগস্টে যে আন্দোলন চলে সেখানে গুজব, ভুয়া খবর ও সুস্পষ্ট প্রপাগাণ্ডা একটি রীতি হয়ে দাঁড়ায় এবং সেগুলো আন্দোলনের অনেক ধরন নির্ধারণ করে। ভুয়া খবর হয়ে যায় আসল খবর এবং আসল খবরকে মনে করা হয় নিম্নমানের বস্তু।
মিডিয়া কর্মীরা এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে নিজেরাই এর শিকার হয়েছে, যা ভার্চুয়াল ভুয়া খবরের একটি ক্লাসিক বাস্তব সংস্করণ, যা তার উপর কোন ভুয়া হামলাকারীর মতো। যে কিনা হেলমেট মাথায় দিয়ে, পুলিশের সঙ্গে মিশে তাকেই পেটানোর জন্য যাচ্ছে যাকে সরকারের শত্রু বলে মনে করা হচ্ছে।
তাদের হাতে অনেক কর্মী ও সাংবাদিক গুরুতর আহত হয়েছে, পুলিশ নির্বিকার পাশে দাঁড়িয়ে এমনভাবে দেখেছে যেন তারা বাস্তব কেউ নয়। তারা আসলে ছিলো বাস্তবতাকে ছাড়িয়ে কোন কল্পবাস্তবতা (ভার্চুয়ালিটি)। ফেসবুক, ফেক আইডি’র চূড়ান্ত হেঁয়ালি তারা। তারা আছে, কিন্তু নেই।
আসল কথা হলো বাংলাদেশ বস্তুগত বাস্তবতার স্বাভাবিক সীমানা ছাড়িয়ে গেছে এবং যেখানে সোশ্যাল মিডিয়ার বাস্তবতার প্রতিফলণ ঘটছে, যা অরো অন্যান্য প্রতিযোগিতামূলক বাস্তবতার চেয়ে বেশি করে রাষ্ট্র ও সমাজের প্রকৃতি নির্ধারণ করছে। সাউথ এশিয়ান মনিটর