প্রথম কিস্তি
২০১৩ সালের ডিসেম্বরের খুবই অনিশ্চিৎ এবং উত্তেজনাকর সময়ে আমি ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের যে কারাগারটিতে বন্দী ছিলাম সেখানেই ২০১৮ সালের মে মাসে বেগম খালেদা জিয়া আছেন। এই পাঁচ বছরে অবশ্য দেশের একদা প্রধান সেন্ট্রাল জেলটির মান-মর্যাদার প্রভূত পরিবর্তন ঘটেছে। এটি বর্তমানে আনুষ্ঠানিকভাবে এক পরিত্যক্ত, ভাঙা-চোরা স্থাপনা। দুইশ বছরের পুরনো এই ধবংসাবশেষের হাজার কোটি টাকারও মূল্যের অধিক বিশাল এলাকার প্রতি শকুনী দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রয়েছে আওয়ামী লুটেরা বাহিনী। কেবল আর একটি ৫ জানুয়ারী মার্কা নির্বাচনী তামাশার অপেক্ষা। তারপর ভাগাভাগি হতে আর সময় লাগবে না। একজন ব্যক্তি, একটি পরিবার এবং একটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ কয়েকজন ব্যক্তি দ্বারা একটি রাষ্ট্রের সকল সম্পত্তি দখলের এই উদাহরন বর্তমান বিশ্বে বাংলাদেশ ছাড়া খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। রাজনীতির বয়ান শেষে এই সীমাহীন লুটপাট নিয়েও আলোচনার ইচ্ছে রইলো।
২০১৩ সালে ওই সময় ঢাকা ব্যতীত সমগ্র বাংলাদেশ জনগনের স্বত: স্ফূর্ত আন্দোলনে কম্পমান। নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবীতে রাজধানীর সুবিধাবাদী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং শহুরে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেনি ছাড়া দেশের সকল অঞ্চলের মানুষ রাজপথে নেমে এসেছিল। বেসুমার মামলায় ঢাকার আদালতে হাজিরা থাকার কারনে আমাকে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে কাশিমপুর কারাগার থেকে নাজিম উদ্দিন রোডে আনা হয়। ডিভিশন প্রাপ্ত বন্দীদের জন্যে নির্ধারিত কর্ণফুলী সেলে আমার ঠাঁই মিলেছিল। সেখানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্রিগেডিয়ার (অব:) হান্নান শাহ, ঢাকা মহানগর বিএনপির তৎকালিন আহবায়ক সাদেক হোসেন খোকা এবং টাঙ্গাইলের প্রবীন বিএনপি নেতা আব্দুস সালাম পিন্টু ছাড়াও মেজর জেনারেল (অব:) রেজ্জাকুল হায়দার ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) আব্দুর রহীম বন্দী ছিলেন। দিল্লির একনিষ্ঠ সেবক হাসিনা সরকার তখন একদিকে ৫ জানুয়ারীর ভুয়া নির্বাচনের আয়োজন এবং অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর নেতা আবদুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসিতে ঝোলানের তোরজোরে ব্যস্ত। জেলের ভিতর থেকেই জানতে পারলাম যে বাংলাদেশে নির্বাচনী সমঝোতার মিশন নিয়ে জাতিসংঘের বিশেষ দূত অস্কার তারানকো এবং যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন টোরি দলের চেয়ারপার্সন ব্যারোনেস সৈয়দা ওয়ারসি ঢাকা সফর করবেন। আমি নাজিমউদ্দিন রোডের কারাগারে থাকা অবস্থাতেই উভয় গুরুত্বপূর্ন ব্যক্তি ঢাকা সফর করলেন এবং শেখ হাসিনাকে একতরফা নির্বাচন করবার এক প্রকার সবুজ সংকেত দিয়েই বিদায় নিলেন। দিল্লির ইশারার বাইরে গিয়ে কোন ন্যায্য অবস্থান নেয়ার ক্ষমতা দুই কূটনীতিকের সেদিন হয়নি। সে রকম কোন ইচ্ছাও তাদের ছিল কি না সেটা আমার জানার কথা নয়। বিএনপির যে সব নীতি নির্ধারকরা সেই সময় তাদের সাথে আলোচনা চালিয়েছিলেন বিষয়টি তারাই ভাল জানেন। বিবিসির বাংলা সংবাদে সেই সকল নেতাদের সাক্ষাৎকার থেকে আমার মনে হয়েছিল প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে এক ধরনের সিদ্ধান্তহীনতা এবং সমন্বয়হীনতা হয়ত বিরাজ করছিল। ব্যারোনেস ওয়ারসি যে সন্ধ্যায় বিদায় নিয়েছিলেন সেই রাতেই কাদের মোল্লাকে উচ্চ আদালতে কোন রিভিউ পিটিশনের সুযোগ না দিয়েই ফাঁসি দেয়া হলো। যে কোন মূল্যে বিজয় দিবসের আগেই সরকার অন্তত: একটি ফাঁসি কার্যকর করতে খুবই উদগ্রীব ছিল। অবশ্য রিভিউ করলেও আওয়ামী এজেন্ডা বাস্তবায়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত আপীল বিভাগে সেটা যে খারিজ হয়ে যেত তাও নিশ্চিৎ করেই বলা যায়। কিন্তু সেই আইনী আনুষ্ঠানিকতাটুকু শেষ করতে গেলে ১৬ ডিসেম্বর পেরিয়ে যেত যেটা দিল্লি এবং শেখ হাসিনার কাছে একেবারেই গ্রহনযোগ্য ছিল না। আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি প্রসঙ্গে একটি ঘটনা জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান নেতৃত্বের জন্যে প্রাসঙ্গিক হতে পারে মনে করে এখানে উল্লেখ করর্ছি।
নাজিমউদ্দিন রোডে আমার বন্দী থাকাকালিন সময়ে জামায়াতে ইসলামীর বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতাও একই জেলে ছিলেন। ডিভিশন প্রাপ্ত বন্দী হওয়া সত্ত্বেও জায়গার অভাবে জেল কর্তৃপক্ষ তাদেরকে কর্ণফুলীর পরিবর্তে ৭ নম্বর সেলে রেখেছিল। ২০১০ সালে প্রথম দফার জেল জীবনে আমিও ওখানে চার মাস ছিলাম। সেই বন্দীত্বের কথকতা আমার ‘জেল থেকে জেলে’ বইতে লিখেছি। যাই হোক, ডিসেম্বরের ৯ কিংবা ১০ তারিখে আমার পুরনো আবাসস্থল দেখতে আমি ৭ নম্বর সেলে গেছিলাম। সেখানে জামায়াতে ইসলামীর মাওলানা ইউসুফ (বন্দী অবস্থায় বার্ধক্যজনিত কারনে মৃত), আজহারুল ইসলাম এবং মীর কাসিম আলী (ফাঁসিতে মৃত) ছাড়াও দলটির কয়েকজন তরুন নেতা ছিলেন। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গল্পের এক পর্যায়ে আমি তাদেরকে যুদ্ধাপরাধের মামলায় আইনী লড়াইয়ের অসারতা নিয়ে সতর্ক করেছিলাম। রাজনৈতিক মামলা রাজনৈতিকভাবে লড়তে ব্যর্থ হওয়ার পরিনতি সম্পর্কে আমার মনে কোন সন্দেহ ছিল না । আমি তাদেরকে এটাও বলেছিলাম যে আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি দিল্লি এবং তাদের এ দেশীয় তাবেদারদের জন্যে টেস্ট-কেস। একটি ফাঁসি কার্যকর করতে পারলে জামায়াতের সকল নেতার জন্যেই ফাঁসির দড়ি অপেক্ষা করছে। আইনী লড়াইয়ে অংশগ্রহনের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামী দলীয়ভাবে তথাকথিক আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে বৈধতা দিয়েছে। সেদিন আলাপ-আলোচনা শেষে আমার কাছে মনে হয়েছিল যে, সেই ১৯৭১ সাল থেকেই দলটি ভুলের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। সেই সময় দেশবাসীর বিপক্ষে গিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা, ১৯৮৬ সালে শেখ হাসিনার অনুগামী হয়ে এরশাদের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহন, ১৯৯১ সালে প্রফেসর গোলাম আজমকে দলীয় প্রধান নির্বাচনের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধ ইস্যুকে উসকে দেয়া, ১৯৯৫ সালে বিষ্ময়করভাবে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে সহিংস আন্দোলন, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে সকল সংসদীয় আসনে প্রার্থী দিয়ে বিএনপিকে পরাজিত করার মাধ্যমে নির্বোধের মতো শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী হতে সহায়তা প্রদান, ২০০৮ সালে জেনারেল মইনের অধীনে নির্বাচনে অংশগহনে অতি উৎসাহ প্রকাশ এবং সর্বশেষ যুদ্ধাপরাধের অর্ভিযোগকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করার ব্যর্থতা- এতগুলো ভুল করে রাজনীতিতে টিকে থাকা কঠিন। সেদিন আলোচনার এক পর্যায়ে এক তরুন নেতা খানিকটা দম্ভভরেই আমাকে বেেলছিল যে আবদুল কাদের মোল্লাকে অন্যায়ভাবে ফাঁসি দেয়া হলে তারা তীব্র আন্দোলনের মাধ্যমে আওয়ামী সরকারের পতন ঘটাবে। সেদিন সে তরুনটির নাম জানা হয়ে ওঠেনি। আমার প্রবীণ বয়সের ভারে তার চেহারাও অনেকটা ভুলে গেছি। এখন পর্যন্ত যদি তরুনটি ফ্যাসিস্ট সরকারের গুম অথবা বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার না হয়ে থাকে এবং আমার আজকের লেখাটি পড়ার সুযোগ যদি তার ঘটে তাহলে সে হয়ত বুঝবে যে শুধু আবেগ দিয়ে ফ্যাসিবাদের মোকাবেলা করা যায় না। ভারতীয় আধিপত্যবাদ এবং বাংলাদেশী ফ্যাসিবাদ, এই দুই দানবের সাথে লড়তে হলে আপোষহীন দেশপ্রেম, অপরিসীম সাহস, সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের মানসিকতা এবং শীসাঢালা ঈমানের সংযুক্তি প্রয়োজন।
আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের পরের দিন আমাকে কাসিমপুর জেলে ফেরত পাঠানো হলো। বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আন্দোলিত বাংলাদেশ পরিস্কারভাবে তখন দুই ভাগে বিভক্ত। একদিকে তাবৎ রাষ্ট ক্ষমতা হাতে ভারতের তৎকালিন কংগ্রেস সরকারের সমর্থনপুষ্ট, জনবিচ্ছিন্ন শেখ হাসিনা। অন্য পক্ষে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে আপন অধিকার প্রতিষ্ঠায় সংগ্রামরত বাংলাদেশের আপামর জনগন। ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজধানী ছাড়া সমগ্র বাংলাদেশ কার্যত: জনগনের দখলে। প্রশাসনের আওয়ামী দালালরা পালাবার পথ খুঁজছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী গনমানুষের বিজয় ঠেকাতে মরিয়া ভারতের আধিপত্যবাদী নেতৃত্ব ঢাকা এবং ওয়াশিংটনে ঘন ঘন তাদের কূটনীতিকদের পাঠাচ্ছে। মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের দক্ষিন এশীয় সহযোগী হওয়ার অহমিকায় ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং ঢাকায় এসে জেনারেল এরশাদকে হাসিনার পক্ষে থাকার জন্য প্রকাশ্যে চরমপত্র দিয়ে গেলেন। তারপরেই ডিজিএফআই এর সামরিক কর্তারা দিল্লির কর্তার নির্দেশে এরশাদকে তার বারিধারার বাসা থেকে তুলে নিয়ে সিএমএইচে বন্দী করে। এতকিছুর পরেও নতজানু রকিব কমিশনকে দিয়ে শেখ হাসিনার একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রচেষ্টা যে ফলপ্রসূ হচ্ছে না সেটা প্রতিদিনই যেন পরিস্কার হয়ে উঠছিল। ওয়াশিংটনসহ পশ্চিমা রাষ্ট্রসমূহের রাজধানীতে এবং জাতিসংঘে ভারতীয় লবি তাদের বাংলাদেশী মক্কেলকে রক্ষার জন্য সর্বোচ্চ তৎপড়তা চালিয়ে অনেকাংশে সফল হয়। জনগনের ভোটাধিকার প্রয়োগের ন্যায্য দাবীকে উপেক্ষা করে অনেকটা আকষ্মিকভাবেই জাতিসংঘের কর্মকর্তারা আন্দোলনে সহিংসতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এই জাতিসংঘই ২০০৭ সালে একতরফা নির্বাচনের অজুহাতে জেনারেল মইনের সেনা অভ্যুত্থানে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল। সেই সময় আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডাররা সুপরিকল্পিতভাবে ঢাকায় দিনে-দুপুরে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে নৃশংসভাবে মানুষ হত্যা করলেও জাতিসংঘের কোন কর্মকর্তা নিন্দা জানানোর প্রয়োজন বোধ করেননি। আন্তর্জাতিক মহলকে আশ্বস্ত করবার লক্ষ্যে সম্ভবত অনেকটা বাধ্য হয়েই বেগম খালেদা জিয়া আন্দোলনে ভিন্ন মাত্রা আনতে চাইলেন। তিনি দেশব্যাপী অবরোধ প্রত্যাহার করে ২৯ ডিসেম্বর ঢাকায় ‘গনতন্ত্রের জন্য যাত্রা’ (March for Democracy) কর্মসূচীর ঘোষনা দিলেন। আন্দোলন কৌশলের এই অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন কোনঠাসা সরকারকে হারানো ভূমি পুনরুদ্ধারের সুযোগ করে দিল। দেশব্যাপী অবরোধ শিথিল হয়ে পড়লো। ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনী তামাশা প্রতিরোধের মূল লক্ষ্য থেকে সকলের দৃষ্টি ঢাকা অভিমুখে যাত্রার দিকে ঘুরে গেল। সেই যাত্রাও রাজধানীর নেতৃত্বের ভীরুতা, সমন্বয়হীনতা এবং প্রশ্নবোধক নির্লিপ্ততার ফলে ব্যর্থ হলো। বেগম খালেদা জিয়া কার্যত গৃহবন্দী হয়ে রইলেন। ঢাকার নেতাদের খুঁজে পাওয়া গেল না। ফ্যাসিস্ট সরকার নতুন করে অবর্ননীয় দমন-পীড়ন আরম্ভ করলো। ইতোমধ্যে আওয়ামী জোটের ১৫৪ জন প্রার্থীকে রকিব কমিশন নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় বিজয়ী ঘোষনা করেছে। তৎকালিন শাসন ব্যবস্থার গনতান্ত্রিক, নৈতিক ও সাংবিধানিক অবৈধতা এবং সরকারের অপকৌশলের চিত্র আর একটু পরিস্কার করতে খানিকটা ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়োজন।
পাঠকের স্মরনে থাকার কথা যে, সংসদীয় গনতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সকল রীতি-নীতি বিসর্জন দিয়ে আগের সংসদ বহাল রেখেই শেখ হাসিনা পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করেছিলেন। ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত দশম সংসদের প্রথম অধিবেশন বসেছিল ২৩ জানুয়ারী ২০১৪, যেদিন নবম সংসদের স্বয়ংক্রিয় অবলুপ্তি ঘটেছিল। অর্থাৎ প্রায় এক মাস ধরে বাংলাদেশের বেশ কিছু সংসদীয় আসনে দুজন করে সংসদ সদস্য প্রতিনিধিত্ব করেছেন। শেখ হাসিনার দেশী এবং বিদেশী পরামর্শকরা কেন এই আজগুবী প্রথার প্রচলন করেছিলেন? কেনই বা ১৫৪ জনকে বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় বিজয়ী ঘোষনার প্রয়োজন পড়েছিল? প্রথম প্রশ্নের জবাব হলো, একতরফা ভোটারবিহীন নির্বাচন শেষ পর্যন্ত করে উঠতে পারা যাবে কি না এনিয়ে নীতিনির্ধারকদের মনে সংশয় ছিল। আমি মনে করি, আন্দোলনের চুড়ান্ত পর্যায়ে অবরোধ প্রত্যাহার করে গনতন্ত্রের জন্য ঢাকা যাত্রা কর্মসূচি দেয়া না হলে শেখ হাসিনার পক্ষে ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনী নাটকের মঞ্চায়নটুকু করাও সম্ভব হতো না। সেক্ষেত্রে শেখ হাসিনা সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে পূর্বের সংসদের আয়ু বাড়িয়ে নেয়ার অপচেষ্টা করতেন। সে উদ্দেশ্যেই পূর্বের সংসদ বহাল রাখা হয়েছিল। দিল্লি পাশে থাকলে শেখ হাসিনা আইনগত বৈধতা কিংবা সংসদীয় রীতি নীতির যে কোন পরোয়া করেন না সেটা বহুবার প্রমানিত হয়েছে। নির্বাচনের আগেই ১৫৪ জনকে বিজয়ী ঘোষনা করা হয়েছিল অবৈধ শাসন বহাল প্রক্রিয়ার দ্বিতীয় পন্থা হিসেবে। যদি অবস্থার গতিকে ৫ জানুয়ারী নির্বাচন একেবারে করাই না যেত, তাহলে নির্বাচন কমিশন দাবী করতে পারতো যে যেহেতু ১৫৪ জনকে আগেই নির্বাচিত ঘোষনা করা হয়েছে কাজেই শেখ হাসিনা দশম জাতীয় সংসদে সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেয়ে গেছে। অতএব, সরকার গঠনে তার কোন বাধা নেই। বিএনপির নীতিনির্ধারকবৃন্দ শেখ হাসিনার এই চালগুলো ধরতে পেরেছিলেন কিনা আমার জানা নেই।
যাই হোক, অবরোধ প্রত্যাহার করায় আন্দোলনের তীব্রতা কমে যাওয়া এবং একতরফা নির্বাচনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পরোক্ষ সহযোগিতা সত্ত্বেও শেখ হাসিনা কিন্তু, জনগনকে ভোটকেন্দ্রে নিতে পারেননি। যে সেনাবাহিনী ২০০৭ সালে একতরফা নির্বাচন ঠেকাতে অভ্যুত্থান করেছে তারাই বিষ্ময়কর ভাবে এ দেশে ভারতীয় মক্কেলের ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে ২০১৪ সালে দেশবিরোধী শক্তিকে সার্বিক নিরাপত্তা প্রদান করেছে। এই দিকটি বিবেচনায় মিসরের সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতির অদ্ভুত মিল লক্ষ্য করা যায়। মিসরেও সেনাবাহিনীর সহযোগীতাতেই ইসরাইলের দালাল জেনারেল সিসি মুসলমানদের স্বার্থ জলাঞ্জলী দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় টিকে থাকতে পারছেন। শেখ হাসিনার অবৈধ শাসন টিকিয়ে রাখতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হলেও ৫ জানুয়ারী বাংলাদেশের জনগন ঠিকই দেশপ্রেমের পরীক্ষায় গৌরবের সাথে উত্তীর্ন হয়েছেন। ঢাকার বাইরের কেন্দ্রগুলোর কথা ছেড়েই দিলাম। খোদ রাজধানীর কোন কেন্দ্রে ভোটার খুঁজে পাওয়া যায়নি। ভোট কেন্দ্রগুলোতে কুকুর পাহারা দিচ্ছে, পুলিশ এবং পোলিং ও প্রিসাইডিং অফিসাররা হাই তুলে মশা-মাছি তাড়াচ্ছেন- এ জাতীয় চিত্রের কোন অভাব ৫ জানুয়ারীতে হয়নি। অর্থাৎ তাবেদার ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে দেশপ্রেমিক জনগন তাদের ঘৃনা প্রকাশে কোন কার্পন্য করেনি।
বিএনপির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়াপারসন তারেক রহমান যে কটি সঠিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তার মধ্যে ৫ জানুয়ারী তার অবস্থানের কথা অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। কোন সময়ক্ষেপন না করে সেদিনই তিনি শেখ হাসিনা সরকারকে অবৈধ ঘোষনা দেন এবং সেই অবৈধ সরকারের সাথে কোনরূপ আলোচনায় যেতে দৃঢ়তার সঙ্গে অস্বীকৃতি জানান। তিনি আন্দোলন অব্যাহত রাখারও ঘোষনা দেন। দূর্ভাগ্যজনকভাবে ঢাকার নেতৃবর্গ তারেক রহমানের অবস্থান থেকে সরে আসে এবং পরবর্তী ৭২ ঘন্টার মধ্যে আন্দোলন প্রত্যাহার করে ফেলেন। কাশিমপুর জেলে সেই সময় আমার সঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, জামায়াতে ইসলামীর আজহারুল ইসলাম এবং মীর কাসিম আলী বন্দী জীবন কাটাচ্ছেন। আমরা সেদিন সকলেই একমত হয়েছিলাম যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবী আদায় না করেই আন্দোলন স্থগিত করার সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী হয়েছে। বিএনপির আন্দোলন স্থগিতের ঘোষনার পর তৎকালিন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা বেশ কিছুদিন মিডিয়াতে যথেষ্ট সক্রিয় ছিলেন। তিনি প্রচার করতে লাগলেন যে ২০১৪ সালের জুন মাসের মধ্যেই বাংলাদেশে সকল দলের অংশগ্রহনে একটি স্বচ্ছ এবং গ্রহনযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশে তার দায়িত্বের মেয়াদ শেষ করে ড্যান মোজেনা সেই বছরই স্বদেশে চলে গেলেও ফ্যাসিবাদের কবল থেকে বাংলাদেশের জনগনের মুক্তিলাভ করা আজো সম্ভব হয়নি। তবে কী, ছয় মাসের মধ্যে নতুন নির্বাচনের সেই ঘোষনা বাংলাদেশের ১৬ কোটি জনগনের সাথে ওয়াশিংটনের নিছক প্রতারনা ছিল? নাকি ওয়াশিংটন নতুন নির্বাচন চাইলেও দিল্লির বাধার মুখে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়? মার্কিন এবং ভারত সরকার নিজেদেরকে যথাক্রমে বিশে^র সবচেয়ে শক্তিশালী গনতন্ত্র এবং সর্ববৃহৎ গনতন্ত্র হিসেবে প্রচার করে থাকে। দূর্ভাগ্যজনক ভাবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে শক্তিশালী গনতন্ত্র এবং বৃহৎ গনতন্ত্রের দাবীদাররা মিলে ১৬ কোটি জনগনের গনতান্ত্রিক অধিকার হরন করেছে। (১ জুন, ২০১৮)
সম্পাদক, দৈনিক আমার দেশ।