প্রশ্ন ফাঁসের ‘কেন্দ্রবিন্দুতে কোচিং বাণিজ্য

বাংলাদেশে দ্বিতীয় শ্রেণির ফাইনাল পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের ভেতর দিয়ে আরো একবার দেখা গেল যে, গত কয়েক বছরে এটি কত ভয়াবহ সমস্যায় পরিণত হয়েছে, যা অনেক দিন ধরেই বিশ্লেষকরা বলে আসছেন।
দ্বিতীয় শ্রেণির পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের কারণে দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা বরগুনায় ১৪০টি প্রাথমিক স্কুলের আজকের পরীক্ষা স্থগিত করে দেওয়া হয়েছে। তদন্ত কমিটি গঠন করেছে কর্তৃপক্ষ।
কিন্তু এসব প্রশ্ন ফাঁস কি ভাবে হচ্ছে, কোথা থেকে হচ্ছে? কিছুকাল আগে এ নিয়ে একটি গবেষণা করে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা টিআইবি। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড.ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, এ গবেষণা থেকে তাদের কাছে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, প্রশ্নফাঁসের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে কোচিং বাণিজ্য।
তবে একটি কোচিং সেন্টরের কর্মকর্তা বলেন, এর জন্য কোচিং সেন্টারগুলোকে ঢালাওভাবে দায়ী করা ঠিক হবে না।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, ছাপানো এবং বিতরণ – এ তিনটি পর্বের মধ্যে প্রায় ৪০টি ধাপ আছে। প্রতিটা ধাপেই ফাঁস হবার ঝুঁকি আছে।

ড. জামান বলেন, কোচিং বাণিজ্য হচ্ছে প্রশ্নপত্র ফাঁসের কেন্দ্রবিন্দু। “কোচিং বাণিজ্যের সাথে শিক্ষক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা এবং পাবলিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি স্টেকহোল্ডার বা অংশীজনরা এর সাথে জড়িত । এভাবে একটা সিন্ডিকেট তৈরি হয়ে গেছে।”
প্রায় সব পাবলিক পরীক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা এমনকি চাকরিতে নিয়োগ পরীক্ষারও প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ উঠেছে। ঢাকায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাথে এক বৈঠকে দুর্নীতি দমন কমিশন বলছে, প্রশ্ন ফাঁসের সাথে অসাধু কর্মকর্তা ও শিক্ষকরাই জড়িত। বৈঠকে প্রশ্ন ফাঁসের জন্য শিক্ষকদের দায়ী করেছেন শিক্ষামন্ত্রীও।
কিন্তু একের পর প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটলেও এর প্রতিকারে সরকারের কাছ থেকে কার্যকরী কোন উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। কেন এটা হচ্ছে – এ ব্যাপারেও যে সরকার খুব পরিষ্কার তারও কোন ইঙ্গিত এখনও নেই।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করার জন্য ২০১২ সালে একটা নীতিমালা হয়েছিল। এতে শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করার সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে।
“কিন্তু এটা লংঘন করে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের একাংশ এর সাথে জড়িত আছে। প্রশ্ন ফাঁস করার শাস্তি আগে ছিল ১০ বছরের কারাদণ্ড। কিন্তু ১৯৯২ সালে এটা কমিয়ে ৪ বছর করা হয়। এতে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন হল যে, অপরাধটা তত গুরুতর নয়। তাও আবার কখনো কারো শাস্তি হয় নি।”

সরকার কেন এ নিয়ে কিছু করতে পারছে না? এর জবাবে তিনি বলেন, সরকার এটা স্বীকার করতে চায় না। মন্ত্রীরা পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন ফাঁসের কথা অস্বীকার করেছেন, এমনও হয়েছে। ।
“কোচিং সেন্টার একটি লাভজনক ব্যবসা। এ ব্যবসায় শুধু শিক্ষকরা একক ভাবে জড়িত, তা নয়। প্রশ্নপত্র তৈরি, ছাপা ও বিতরণ – এ কাজ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা করেন। তাই পুরো ব্যাপারটার একটা প্রতিষ্ঠানিকীকরণ ঘটে গেছে।”
“এর প্রভাবে ছাত্রছাত্রী শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরাও এর সাথে জড়িয়ে যাচ্ছেন। যদি তার প্রতিবেশির সন্তান ফাঁস হওয়া প্রশ্ন পেয়ে যায়, তাহলে তারা পাবেন না কেন – এ প্রতিযোগিতায় তারা জড়িত হয়ে পড়ছেন। তাদের কোন উপায় নেই।”
কিন্তু কোচিং বাণিজ্য বন্ধ হলে কি আর প্রশ্ন ফাঁস হবে না?
“এটা বলা কঠিন। তবে কোচিং বাণিজ্য ই সমস্যার কেন্দ্রে রয়েছে।শুধু বন্ধ করলেই হবে না, যারা জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হতে হবে।”
তিনি বলেন, “সরকারি একটা অনুসন্ধানের রিপোর্টও প্রকাশ করে নি। কেন হয় নি? সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারি জড়িত বলেই কি প্রকাশ হয় নি? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত এ সমস্যার সমাধান হবে না।”
ঢাকার একটি কোচিং সেন্টারের কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেন, কিছু কোচিং সেন্টার বা এর সাথে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক যে এটা করছে না তা আমি বলব না, কিন্তু সবার ব্যাপারে ঢালাওভাবে এ কথা বলাটা ঠিক হবে না।
মি. রহমান বলেন, প্রশ্নপত্র তৈরি, ছাপানো ও বিতরণের পুরো পদ্ধতিতে যে ছিদ্রগুলো আছে, তা বন্ধ করতে হবে, দোষীদের শাস্তি হতে হবে। শুধু কোচিং সেন্টার বন্ধ করা এর সমাধান নয়।
সূত্রঃ বিবিসি অবলম্বনে ও কিছুটা সংশোধিত ও পরিমার্জিত।