নির্যাতিত সৌদি ফেরত নারীর সংখ্যা বাড়ছেই
সৌদি আরবে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফেরা নারীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। নির্যাতিত এসব নারী বাংলাদেশের প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করলেও তা আমলে নেওয়া হচ্ছে না অভিযোগ ওঠেছে। ফলে প্রতি মাসেই নির্যাতিত হয়ে দেশে ফেরা নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাস কল্যাণ ডেস্ক থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী গত সাড়ে চার মাসের পরিসংখ্যান বলছে গত ৩ মে থেকে ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে ৪৯৪জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরেছেন। এর মধ্যে গত ৩ মে ৩৫জন, ১২ মে ২৭জন, ১৯ মে ৬৬জন, ২৩ মে ২১জন, ২৭ মে ৪০জন এবং ৩ জুন ২৯জন, ১৮ জুন ১৬জন এবং ১৯ জুন ২৭জন এবং ২৬ জুন ২২জন, ১০ জুলাই ৪২জন, ২১ জুলাই ৩৪জন, ২৮ জুলাই ৪২জন, ৩ আগস্ট ২৮জন, ১৩ সেপ্টেম্বর ৬৫জন নারী শ্রমিক দেশে ফিরেছেন।
গত পাঁচ মাসে দেশে ফেরা শতাধিক নারীর সঙ্গে প্রিয়.কমের এই প্রতিবেদকের কথা হয়েছে। তাদের অধিকাংশই জানিয়েছেন, তারা কোন বাসায় নির্যাতনের শিকার হলে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিকার পান না। উল্টো তাদের হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। কখনো দেশটির মক্তবে (রিক্রুটিং এজেন্সির অফিস) আবার কখনো পুলিশের হাতে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে।
নির্যাতনের শিকার বেশিরভাগ সৌদি ফেরত গৃহকর্মী জানিয়েছেন, বাসার কফিল (বাসার মালিক) নির্যাতনের পর তাদেরকে মক্তবে দিয়ে আসতো। পরে তাদের আবারও মক্তব থেকে ওই বাসায়ই দিয়ে আসা হতো। সর্বশেষ নির্যাতন সইতে না পেরে বাধ্য হয়ে তারা রাস্তায় পালিয়ে আসেন। সেখান থেকে পুলিশ তাদের উদ্ধার করে বাংলাদেশ দূতাবাসে দিয়ে আসে। এভাবেই সৌদি আরবে নির্যাতনের শিকার নারীদের মুক্তি মেলে।
দীর্ঘদিন দূতাবাসের সেভহোমে রাখার পর তারপর নারীদের দেশে পাঠানো হয়। কিন্তু সেই সেভহোমও তাদের কাছে অনেক সময় নিরাপদ হয়ে উঠে না। যার প্রমাণও মিলেছে বিভিন্ন সময়। কিন্তু সেই অভিযোগও আমলে নেয়নি প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।
গত সাড়ে চার মাসে ৪৯৪জন নারী দেশে ফিরেছেন। তার মধ্যে ১২জন মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন। তাদের অনেকে এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি বলে জানা গেছে। এসব নারীদের পেছনে চিকিৎসা করতে গিয়েও পরিবার নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে।
বেসরকারি এনজিও ব্র্যাকের তথ্য অনুযায়ী ১৩ সেপ্টেম্বর (বৃহস্পতিবার) রাত সোয়া ৮টায় ইত্তিহাদ এয়ারওয়েজের একটি বিমানে সৌদিতে নির্যাতনের শিকার হয়ে ৬৫ জন নারী গৃহকর্মী দেশে ফিরেছেন। তবে প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক থেকে বলা হয়েছে ৪৬জন নারী শ্রমিকের দেশে ফেরার কথা।দেশে ফিরে নারী শ্রমিকরা জানিয়েছেন, তারা যে বিমানটিতে ফিরেছেন সেটিতে প্রায় ৭৮জন নারী শ্রমিক ছিল বলে তারা জানতে পেরেছেন।
ওইদিন দেশে ফেরা ৪০ বছর বয়সী নারী সালমার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। স্বামী ছাড়া এক মেয়েকে নিয়ে বাবার বাড়িতেই থাকেন তিনি। মেয়েটাকে মানুষের মতো মানুষ করবেন সেই স্বপ্নে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে সৌদিতে পাড়ি জমান তিনি। সেই সময় সুমন নামের এক দালালের মাধ্যমে টাকা দিয়ে তিনি ট্রেনিং কার্ডও (বিএমইটি কার্ড) করিয়ে নেন। কথা ছিল সেখানে গিয়ে তিনি ১ হাজার ২০০ রিয়েলে কাজ করবেন। কিন্তু সেই টাকা তাকে দেওয়া হয়নি। প্রথম দুই মাস তিনি ৯০০ রিয়েলে কাজ করেছেন। পরে শুরু হয় তার ওপর শারীরিক নির্যাতন। তার ন্যায্য পাওনা এবং পাঁচ মাসের বকেয়া বেতন চাইলেই বাসার কফিল (মালিক) তাকে মারধর করতো।
সালমার ভাষায়, ‘কাজ করসি পাঁচ মাস কিন্তু বেতন সব রাইখা দিসে। বেতনের কথা কইলে ম্যাডাম (কফিলের স্ত্রী) আমারে মারতো। আমি আরবি ভাষায় তাদের কাছে কইতাম আমার বাড়িতে টাকা পাঠাতে হবে কিন্তু কেউ শুনতো না, খালি মারতো।’
সালমার সঙ্গে একই ফ্লাইটে আসা অন্য নারীরাও নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশটির সেভহোমে ছিলেন। তাদের কেউ ছিলেন এক বছর, কেউ ছয় মাস আবার কেউ তিন মাস। পরে তাদের পর্যায়ক্রমে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ফেরত আসা এসব নারীরা জানিয়েছেন, তারা দেশে দরকার হলে ভিক্ষা করবেন। কিন্তু কখনো আর সৌদি আরব যাবেন না। তাদের নির্যাতনের কথা জানিয়ে তা অন্যের কাছে তুলে ধরতেও তারা অনুরোধ করেন। সেই সঙ্গে তারা সরকারকে সৌদিতে নারী গৃহকর্মী না পাঠাতেও অনুরোধ করেন।
অনেক স্বপ্ন নিয়ে চার মাস আগে সৌদি গিয়েছিলেন হাজেরা। যাওয়ার সময় তিনি অনেক কষ্টে দালালকে ৪০ হাজার টাকাও দেন। কিন্তু কাজ পেলেও কাজের পরিবেশ পাননি। কথা ছিল তাকে সেখানে একটি ফলমূলের দোকানে কাজ দেওয়া হবে। সেখানে গিয়ে দেখেন পুরো তার বিপরীত। তাকে কাজ দেওয়া হয় একটি বাসা বাড়িতে। কাজ করার পর তাকে খাবার দেওয়া হতো না। পরে তিনি কাজ করতে না চাইলেই তাকে মারধর করা হতো। একদিন বাসার কফিল (মালিক) ভাঙা গ্লাস দিয়ে তার পা কেটেও দেন।
কেউ নির্যাতনের শিকার হয়ে যখন সেভহোমে আশ্রয় নিচ্ছেন ঠিক তখনই কারও আবার কাজ করতে গিয়ে জেলখানায় থাকতে হচ্ছে। তাও আবার বিনা অপরাধে। বাসার মালিকের কথা না শুনলেই মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করে দেশটির পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এমনই একজন জাহানারা। তিনি সেখানে কাজ করতে গিয়ে উল্টো দুই মাসের জেল খেটে সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন। এর আগে জাহানারা মিশরে ছিলেন। কিন্তু সৌদির বাসা বাড়িতে কাজের অভিজ্ঞতা তার কাছে বড় তিক্ত। তিনি জানান, পান থেকে চুন খসলেই মারধর করা হয়। কথা না শুনলেই পরে পাঠানো হয় মক্তবে। আর সেখানেও চলে পাশবিক নির্যাতন।
সৌদি ফেরত এসব নারীরা জানান, তাদের বাসা বাড়িতে কাজ দেওয়া হতো ঠিকই কিন্তু কাজ শেষে খাবার দেওয়া হতো না। মাস শেষে বেতনও দেওয়া হতো না। বেতন চাইলে তাদের মারধর করা হতো। শুধু এসব সমস্যাই নয়, খাবার হিসেবে তারা পেতেন একটি রুটি আর পানি। শারীরিক নির্যাতন, বাসস্থানগত সমস্যা, খাবারের সমস্যা, বেতন না পাওয়াসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে দেশে ফিরে আসতে রীতিমত বাধ্য হচ্ছেন তারা। দেশটির বাসা বাড়িতেই শুধু নয়, পরে তাদের দেশটির মক্তবে নিয়ে যাওয়া হলেও সেখানেও তারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন বলে অভিযোগ করেন।
দেশটির আব্দুলাহর মক্তবে সবচেয়ে বেশি শারীরিক নির্যাতন হতে হয় তাদের। সেখানে আরও ৫০-৬০জন বাংলাদেশি নারী শ্রমিক বর্তমানে অবস্থান করছেন। তাদের ওপর বর্বর শারীরিক নির্যাতন চালানো হচ্ছে বলেও অভিযাগ তাদের।
নির্যাতন সইতে না পেরে অনেকে মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলছেন। তেমনি একজন নারী গত ১৩ সেপ্টেম্বর (বৃহস্পতিবার) রাতে দেশে ফিরেছেন। সুনামগঞ্জের রুজি নামের সেই নারী বিমানবন্দরে নেমেই উদ্ভট আচরণ করতে শুরু করেন। পরে তার সঙ্গে আসা নারীরা তাকে ধরেন এবং পরে ব্র্যাকের সহায়তায় রুজিকে তার পরিবারেরর কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সৌদি থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফেরা নারীদের ভাষ্যমতে, তারা সেখানে কাজ পাচ্ছেন ঠিকই কিন্তু কাজের পরিবেশ পাচ্ছেন না। মাস শেষে কাজের বেতন চাইলে মিলছে মারধর। শুধু কী তাই, কাজ করতে গিয়ে অনেকে যৌন নির্যাতনের শিকারও হচ্ছেন। কিন্তু সেই অমানবিক নির্যাতনের গল্প দেশে আসলে অনেকে মুখ ফুটে বলতে পারছেন না। এমনকি প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে অভিযোগও করছেন না। নির্যাতনের এসব গল্প ও অভিযাগ বেশ পুরনো। প্রতি মাসে সেখানকার বাসা বাড়িতে কাজ করতে গিয়ে অনেক নারী নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে ফিরছেন। তারা দেশে ফিরে যেসব অভিযোগ করছেন সেগুলোকে বরাবরই অস্বীকার করেছে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ সংশ্লিষ্টরা। তারা অনেক বার বলেছে, এসব অভিযোগ ঠিক না। মেয়েরা সেখানে থাকতে না পেরে দেশে ফেরার জন্য এসব অভিযোগ করে।
এসব নারী প্রথমে দেশটিতে গৃহকর্মী হিসেবে গিয়েছিলেন। পরে তাদের বাসা বাড়িতে নানা ধরনের কাজ দেওয়া হয়। কাজ করতে গিয়ে অধিকাংশ নারী কফিলের (মালিক) খারাপ আচরণ, মারধর, নির্যাতন এবং যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। কেউ কেউ এসব নির্যাতন সইতে না পেরে সেই বাসা থেকে পালিয়ে এসেছেন। ধরা দিয়েছেন দেশটির পুলিশের কাছে। সর্বশেষ তাদের আশ্রয় হয়েছিল সেভহোমে। সেখান থেকেই পর্যায়ক্রমে তাদের দেশে পাঠানো হয়।
সরকারি ছাড়াও অনেক নারী বেসরকারিভাবে নিজের খরচে দেশে ফিরেছেন। কিন্তু সেসব নারীর অনেকে গল্প গণমাধ্যমে উঠে আসেনি। এমনকি সরকারি খাতায়ও তাদের হিসেব বা নাম নেই।গত মাসে এক নারী সৌদিস্থ বাংলাদেশি দূতাবাসের সেভহোমে থাকাকালীন সময়ে কয়েকজন পুরুষের মাধ্যমে যৌন নির্যাতনের শিকার হন। পর তাকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। দেশে ফেরার পর সেই নারী আর ওই ব্যক্তিকে খুঁজে পাননি। এমনকি বিমানবন্দরে আসার পর তার লাগেজও খুঁজে পাননি। শেষে বাধ্য হয়ে তিনি বিমানবন্দরের টয়লেটে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। পরে ঘটনাটি জানাজানি হয়ে যায়। অতঃপর সেই ঘটনায় নির্যাতিত ওই নারী একটি মামলাও করে। যে ঘটনায় ইতোমধ্যে দূতাবাসের সেভহোমের কয়েকজন কর্মীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। যদিও বিষয়টি এখনো তদন্ততাধীন রয়েছে।
ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, ‘যারা মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে দেশে ফিরছেন তাদের আমরা কাউন্সিলিং করে সুস্থ করে তুলছি। এ ছাড়াও যারা সেখানে আছেন তাদের উদ্ধার করে দেশে আনারও ব্যবস্থা করছি।’জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক সেলিম রেজার সঙ্গে কয়েক দফা মুঠোফানে যোগাযোগের চেষ্টা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
অন্যদিকে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব সৈয়দা সাহানা বারী প্রিয়.কমকে বলেন, ‘এই মুহূর্তে কতজন নারী দেশে ফিরেছেন সেই পরিসংখ্যানটা বলা যাচ্ছে না। তবে অফিস সময়ে তা বলা যাবে। আর যারা নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরেছেন বলে অভিযোগ করছেন তাদের প্রত্যেকটি অভিযোগই যাচাই-বাছাই করা হয়।’
সৌদি আরব, ‘সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান, কাতার, বাহরাইন, লেবাননসহ বিশ্বের ১৮টি গৃহকর্মী হিসেবে দেশে যাচ্ছেন বাংলাদেশি নারীরা। এর মধ্যে সৌদি আরব থেকে প্রতি মাসেই নারীরা নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরছেন। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যমতে, ২০১৭ সাল পর্যন্ত অভিবাসী নারীর সংখ্যা ছিল ১২ লাখ ১৯ হাজার ৯২৫জন। যা মোট অভিবাসীর ১৩ শতাংশ।
সূত্র: প্রিয় ডটকম