নবনীতারা আওয়ামী লীগ নন, উনারা হলেন কৃষ্ণ
08 Jan, 2018
নবনীতার পরিচালিত রাজকাহন নামক টকশো টি বাংলাদেশের এক তিক্ত বাস্তবতাকে উলঙ্গ করে দিয়েছে। আমি সেই রাজকাহনের কথা বলছি, যেখানে ছাত্রলীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় সভাপতি সোহাগ, একজন সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি এবং ছাত্রদলের এককালের ডাকসাইটে নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল উপস্থিত ছিলেন। আপনারা নিঃসন্দেহে বলতে পারেন রাজকাহনের এই পর্বটিই আজকের নৈতিক ভিত্তিহীন এক শাহবাগী বাংলাদেশ। যেখানে নীতি-নৈতিকতা, সততা, ন্যায় ও সুবিচার অনির্দিষ্টকালের জন্য সুদূর পরাহত। ব্যাপারটা এই পর্যন্ত থাকলে হয়তো সেটা সীমা বা মাত্রার বেশি অতিক্রম হতো না। কিন্তু ব্যাপারটা এই পর্যন্তই শেষ নয়, এটা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে- যে পর্যায়ে এসে বাংলাদেশের মানুষ এগুলোকে ধর্তব্য কোনও সমস্যাই মনে করে না। এটা হল বাংলাদেশের ‘দ্যা নিউ নরমাল”।
ধর্মের ভিত্তিতে পাক ভারত আলাদা হওয়ার পর, অর্থাৎ একটা দেশ জন্ম নেয়ার মাত্র ২৪ বছর পর যখন আবার ভেঙে নতুন একটা দেশ গড়ার আওয়াজ যখন উঠলো, তখন পক্ষ ও বিপক্ষ উভয়ের জন্যই এটা ছিল একটা অনিশ্চিত জুয়া। এ জুয়ায় যে জিতবে সে সব পাবে, আর যে হারবে সে সব হারাবে- সমস্ত দায়ের পর্বত-সম বোঝা তাঁর ঘাড়ে চাপবে। এটা হল ইতিহাসের ন্যাক্কার জনক অবিচার। ইতিহাস সব সময়ই বিজয়ীর পক্ষে সুর তোলে, পরাজিতকে নিক্ষেপ করে ভাগাড়ে। কিন্তু মানুষ তো আর ইতিহাস নয়, মানুষ ও মানব সভ্যতা সহস্রবার ইতিহাসের বসন্তের কোকিল সাজাকে উপেক্ষা করে ইহসানের মানদণ্ডে সত্য, ন্যায় ও মানবিকতাকে বিজয়ী করেছে। কিন্তু ইতিহাসের এই বাসন্তী সূরের পূর্নাঙ্গ সুযোগ লুটে নিয়েছে বাংলাদেশের সেক্যুলার জান্তারা। ইতিহাসের সূত্র ধরে আজকে স্বাধীনতা উত্তর সময়েও সকল দায়ের দায়ভার অন্যের ঘাড়ে চেপে যায় শুধু এই অজুহাতে যে, তারা একটি জুয়ায় বিপক্ষের দিকে সমর্থন দিয়েছিল।
গত পর্বের রাজকাহনে আমরা ইতিহাসের সেই বাসন্তী সূরকে ঢাল হিসেবে ব্যাবহার করে সাত খুনের দায় থেকে মুক্তি পাওয়ার এক নির্লজ্জ নজির উপভোগ করেছি। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদানের গৌরব উজ্জ্বল অর্জনের বিনিময়ে সমস্ত জঘন্যতম অপরাধের দায়মুক্তির এই সিলসিলা মাথা নত করে একধরনের বৈধতা দিয়ে দিতে দেখা গেছে মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল কে, নবনীতা কে এবং দর্শক থেকে যারা প্রশ্ন করেছেন তাদের থেকেও। ছাত্রলীগের ছেলেরা যতো অপরাধই করুক, তাঁর কোনও দায় ছাত্রলীগের উপর বর্তায় না। হোক সে অপরাধ জ্বালাও-পোড়াও, খুন, লুটপাট, ধর্ষণ এবং এর চেয়ে হেনতরো কিছু। ছাত্রলীগের যেই সদস্য এ কাজগুলো করবেন তারা অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার সাথে সাথে ‘অনুপ্রবেশকারী’ হয়ে যাবেন। অনুপ্রবেশকারী হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে ছাত্রলীগের সাত খুন মাফ। এই সাত খুন মাফ হয়ে তিন সাতে একুশ খুনের ভার হয়ে সেটা পতিত হবে ছাত্রশিবিরের ঘাড়ে। পালের গোদা বলেন আর বলির পাঠা বলেন- জামায়াত-শিবির বলে একটা কিছু তো আছেই।
আমার মনে হয় ওয়ামীলীগের ‘অনুপ্রবেশকারী’ এবং ‘কেষ্ট ব্যাটা’ নামে দুইটা গোপন গ্রুপই আছে। সমস্ত কুকর্মের মধ্যে যেগুলো প্রকাশ হয়ে যাবে সেগুলো এই দুই গ্রুপের মধ্যে ভাগ হয়ে যাবে এবং সমস্ত দায় ভার জামায়াত-শিবিরের উপরে বর্তাবে। তার মানে হল আওয়ামীলীগের ইউনিভার্সাল নীতি হল “চুরি বিদ্যা বড় বিদ্যা,যদি না পড়ো ধরা”। অর্থাৎ অপরাধ করে যেহেতু অনেক স্বার্থ হাসিল হয়ে যায় সেহেতু অপরাধ বন্ধ হবে না। কারণ অপরাধ বন্ধ হলে তো অপরাধের সুযোগটা নেয়া যাবে না। সুতরাং ধরা পড়ার আগ পর্যন্ত অপরাধ চলুক। ধরা পড়ে গেলে তো কেষ্ট ব্যাটারা (জামায়াত-শিবির) আছেই। এই নীতির জননী হল অন্য আরেকটা বিশ্ব বিখ্যাত ঘৃণিত নীতি, যাকে বলা হয় “এন্ড যাস্টিফাইস দ্যা মিনস”। অনৈতিকতা, অনাচার, অবিচার, মিথ্যা, চৌর্যতা, হঠকারিতা ও জুলুমের মাধ্যমে স্বার্থ হাসিল হলে সেটা কোনও অপরাধ নয়। স্বার্থের কারণে এগুলোও বৈধ হয়ে যাবে। এই নীতির উপর দাঁড়িয়ে শাহবাগ আন্দোলন হয়েছে, ওয়ার ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল হয়েছে, গুম হচ্ছে, খুন হচ্ছে, ব্যাংক লুট হচ্ছে, ব্যাংক দখল হচ্ছে… হচ্ছে এরকম আরও অনেক (বাঙালী দৃষ্টিকোণ থেকে) ‘উচিৎ’ কাজ।
গত পর্বের রাজকাহনের মাধ্যমে নৈতিক ভিত্তিহীন এক শাহবাগী বাংলাদেশের বাস্তব দৃশ্য ফুটে উঠেছে। ছাত্রলীগ সভাপতি যখন দাবী করলেন, প্রশ্ন ফাঁসই হয় নাই তখন তাঁকে এই ডাহা মিথ্যাচারের জন্য কেউই চ্যালেঞ্জ করতে সাহস করেন নাই। উপস্থাপিকা কিছুটা বাকহারা হয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে অদৃশ্য কোনও কারণে ছাত্রলীগ সভাপতি কে জোরালো ভাবে এ নিয়ে প্রশ্ন করেন নাই, যেটা তারা হেফাজত, জামায়াত ও বিএনপির লোকদেরকে নগ্ন ভাবে করে থাকেন। যখন ছাত্রলীগের সকল অপকর্মের দায়ভার অনুপ্রবেশকারী তথা জামায়াত-শিবিরের ঘাড়ে চাপানো হল, তখন অত্যন্ত আশ্চর্যজনক ভাবে মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল সাহেব একজন বিরোধী ও নির্যাতিত দলের প্রতিনিধি হয়েও জোরালো কোনও বক্তব্য দেন নাই।
কথা প্রসঙ্গে ছাত্রলীগ সভাপতি যখন বললেন মাঠে অন্যান্য ছাত্র সংগঠন গুলো নেই তখন এটা নিয়ে কেউ দ্বিতীয় কোনও প্রশ্নই তোলেন নাই। অন্যান্য ছাত্র সংগঠন গুলো কেন মাঠে নেই? কার ভয়ে তারা মাঠে নামে না? কে তাদেরকে বাধা দেয়? একটা গণতান্ত্রিক দেশে শুধুমাত্র ক্ষমতাসীন দল (আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগ) মাঠে থাকতে পারে কিন্তু অন্যরা থাকতে পারে না কেন? এই প্রশ্ন গুলো করার মতো সুপুরুষ না টকশোতে কেউ ছিলেন! আর না টেলিফোনে কেউ ছিলেন! এতগুলো মানুষের মধ্যে যদি সবগুলোই কাপুরুষ হয় তাহলে দেশের কি অবস্থা হয়ে আছে তা সহজেই অনুমেয়। উপরন্তু মনে হয়েছে যে একটা গণতান্ত্রিক দেশে শুধুমাত্র ক্ষমতাসীন দলের (আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগ) মাঠে থাকতে পারা এবং বাদ বাকি অন্য কারও না থাকতে পারাটা শুধু স্বাভাবিক বিষয়ই নয় বরং বিষয়টা এমনই হওয়া উচিৎ। এরকম মেরুদণ্ডহীন একটি বাংলাদেশেই আমরা এখন বসবাস করছি।
মূলত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাঙালীর দাস মনকে খুব নিবিড় ভাবে পর্যবেক্ষণ করে নিয়েছেন। সে অনুযায়ী তিনি বাঙালীর দাস মানসিকতার সুযোগটাই কাজে লাগাচ্ছেন। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ কে নিয়ে তারা এমন ভাবে চেতনাকে সাজিয়েছেন যে, এখানে আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগের কোনও দোষ থাকতে নেই। তারা একেবারে হিন্দু ধর্মের কৃষ্ণের আসন বাগিয়ে নিয়েছেন। কৃষ্ণ যখন যে নারীর সাথেই চাইবেন যৌন কর্ম করবেন। এটাকে কিছুতেই অপরাধ ভাবা যাবে না। বরং যেই নারীকে কৃষ্ণ লুটে খেলেন সে নারী নিজেকে ধন্য মনে করবে। কারণ কৃষ্ণ তাঁর ডেরায় এসেছিল এবং তাঁকে পূজ্য করেই রাখতে হবে।
বাংলাদেশেও আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগ এরকম একটি অবস্থান বাগিয়ে নিয়েছে। এরা যখন যা ইচ্ছে করবেন, আর দাস মানসিকতা সম্পন্ন বাঙ্গালীরা সেটাকে তাদের প্রাপ্য হিসেবে মেনে নিয়ে মাথা নিচু করে পূজা করতে থাকবে। এজন্যই কেন অন্য দলগুলো মাঠে নামতে পারে না, কেন সব দোষ কেষ্ট ব্যাটার উপর চাপিয়ে দেয়া হবে এগুলো কোনও ধর্তব্য বিষয়ই নয়। গুম, খুন, ব্যাংক লুট এবং অন্যান্য জঘন্য অপকর্মের জন্য বরং ভিকটিমদের গর্বিত হওয়া উচিৎ যে লীগ তাদের ডেরায় এসেছিল। এটা তাদের সাত কপালের ভাগ্য। এজন্যই বলেছিলাম- যদি ডাইনীটা হবে সৎ, তবে ষোলকোটি বাঙ্গালীই অসৎ। তা না হলে এতো অপকর্ম করছে কারা?