ধর্ষণ।। এর আসলেই প্রতিকার কী?
বাংলাদেশে ধর্ষণের পরিসংখ্যান দেখলে যে কারোরই আঁতকে ওঠার কথা। সুস্থ মনের মানুষের ভীষণ কষ্ট পাওয়ার কথা এবং সেটাই হচ্ছে। আমরা যারা এই সমাজিক অনাচার, সহিংতার বিরুদ্ধে কথা বলি, লিখি বা ভাবি, তারা সবাই ভীষণ বিষণ্ণ, ক্ষুব্ধ। তারপর আবার যখন এই ধর্ষকদের পক্ষে ক্ষমতাশালীরা দাঁড়ায় তখন মনের যন্ত্রণা কত তীব্র হয়, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশেষ করে নারীদের যন্ত্রণা মাপার সাধ্য আমার নেই, মনে হয় পৃথিবীর কোনো পুরুষেরই নেই। কারণ নারীই এই সহিংসতার শিকার। আর এ ঘটনা যখন নিয়মিতভাবে ঘটেই চলছে তখন নারীর চলার পথ স্বভাবতই ভরে যাচ্ছে ধর্ষকের কাঁটায়।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বলছে, এ বছরের মার্চ পর্যন্ত সারা দেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১২০টি। এর মধ্যে ধর্ষণের পর পাঁচজনকে হত্যা করা হয়েছে। ধর্ষণ করা হয়েছে ৯৩ জনকে। আর ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন একজন। আর শিকার সবাই নারী।
২০১৬ সালে সারা দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭২৪ জন নারী। এর মধ্যে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১৯৭টি। আর ২০১৫ সালে সারা দেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২৩৬টি। এর মধ্যে ২৩২ জন নারী ও চারজন পুরুষ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।
এ ধরনের পরিসংখ্যান বলে দেয় ধর্ষণ আমাদের দেশের একটা নিয়মিত ঘটনা। এই বাস্তবতা আমাদের সবার কম-বেশি জানা। সম্প্রতি বনানীতে দুই নারীকে ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত ধর্ষণকারীদের গ্রেপ্তার নিয়ে যখন গড়িমসি চলছে, তখন এর বিরুদ্ধে সারা দেশের মানুষই সোচ্চার হয়েছে। কিন্তু ক্ষমতার দাপটে অনেকটা সময় ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল ধর্ষণে অভিযুক্তরা।
ধর্ষণকারীদের দ্রুত আইনের আওতায় না আনার ঘটনা এই প্রথম নয়। আর এর বিরুদ্ধে নানা আন্দোলনও হয়েছে বিভিন্ন সময়। আবার অনেক ধর্ষণের বিচারও হচ্ছে। যারা ধর্ষণ করে, তারাও জানে এর শাস্তি কঠিন। কিন্তু তবুও কেন দিনের পর দিন ঘটেই যাচ্ছে ধর্ষণের মতো জঘন্য কাজ। আইন, বিচার এমনকি ধর্মেও বর্ম , কোনো কিছুই কমাতে পারছে না ধর্ষণের হার। সমাধান চাইলে অবশ্যই আমাদের কারণ শনাক্ত করতে হবে, তারপর পথ্য।
১.
ধর্ষণের পর পরই কিছু লোক ইনিয়ে বিনিয়ে প্রশ্ন করা শুরু করেন, যাকে ধর্ষণ করা হয়েছে তার কি কোনো দোষ নেই? তার চরিত্র ভালো ছিল না, পোশাক উগ্র ছিল, এত রাত্রে মেয়ে হয়ে বাইরে কি করে ইত্যাদি ইত্যাদি। এই বিভ্রান্তদের জন্য আমি শুধু কয়েকটি তথ্য দিতে চাই। তারপর আরো কিছু বলব।
২০১৬ সালের ধর্ষণের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ওই বছর যারা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তার মধ্যে ৫০ জনই ০-৬ বছরের শিশু। আর ১৪৪ জন ছিল ৭-১২ বছরের শিশু। এবার বলুন, এদের চরিত্র নিয়ে কি প্রশ্ন তোলার বয়স হয়েছে? এদের পোশাক আর কতটুকু উগ্র হতে পারে? এরা কি অসময়ে বাইরে ঘোরাঘুরি করছিল? এরা কি পার্টিতে যেত? তাহলে সমস্যাটা কোথায়? এই পরিসংখ্যানের পর আমার মনে হয় আর খোলাসা করে কিছু বলতে হবে না। চরিত্র খারাপ বা পোশাক উগ্র এসব আসলে ধর্ষকের অজুহাত। মূল কারণ তার ধর্ষণ করার ইচ্ছা। সেটা অনেক কারণেই হতে পারে।
২.
ধর্ষণের একটি বড় কারণ রাজনৈতিক। এর একটা বড় প্রমাণ যুদ্ধ ময়দান। পৃথিবীর তাবৎ যুদ্ধে দখলদার ও আক্রমণকারী বাহিনী দুর্বল প্রতিপক্ষের এলাকায় নারীদের ধর্ষণ করেছেন। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদারবাহিনী কম করে হলেও ছয় লাখ বাংলাদেশিকে ধর্ষণ করেছেন। এর মাধ্যমে সৈনিকরা যে শুধু তাদের যৌন চাহিদা পূরণ করেছেন তা নয়, তারা এর মাধ্যমে একটা জাতির মনোবল দুর্বল করার চেষ্টা করেছেন। পাকিস্তানের জেনারেল খাদিম হোসাইন রাজা তাঁর লেখা ‘আ স্ট্রাঞ্জার ইন মাই ওন কান্ট্রি’ বইয়ে লিখেছেন, ‘নিয়াজী ধর্ষণ করার জন্য তার সেনাদের এত চাপ দিতেন যে, তা সামলে উঠতে না পেরে এক সেনা অফিসার আত্মহত্যা করে বসেন।’ কোনো কোনো মেয়েকে একবার দুবার নয় একরাতে ৭০ থেকে ৮০ বার ধর্ষণ করা হয়েছে। চরম পৈশাচিক নির্যাতন করা হয়েছে এই নারীদের ওপর। বলতে পারেন কী দোষ ছিল তাঁদের?
৩.
রাজনৈতিক এই কারণ ছাড়া ধর্ষণের আরো অনেক কারণ আছে। একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে, ধর্ষণ পুরোটাই ধর্ষকের মানসিক বিকৃতি এবং পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা চর্চা।
মানসিক বিকৃতির অন্যতম বড় কারণ হলো নারীকে ভোগ্য পণ্য হিসেবে দেখার সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির বড় প্রমাণ মিলবে এক পুরুষের একসঙ্গে একাধিক বিয়ের মধ্যে। খুব বেশি দিন নয় আমাদের সমাজেও এটি হর-হামেশাই ঘটত। এখনো বিশ্বের অনেক দেশে পুরুষের একাধিক বিয়ের ঘটনা স্বাভাবিক। তারা আসলে নারীকে যৌন চাহিদা পূরণ আর সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবেই দেখে থাকেন।
আধুনিকতা এক বিয়ের ধারণা নিয়ে এসেছে ঠিক। কিন্তু সমাজে পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকায় নারীকে গৃহবধু, ভোগ্যপণ্য বা যৌন চাহিদা পূরণের উপায় হিসেবে দেখার সংস্কৃতি থেকে অনেক পুরুষই বের হতে পারেনি। হালে এই সংস্কৃতিকে আরো শক্তিশালী করেছে, করপোরেট দুনিয়া। বিজ্ঞাপনে নারীকে যেমন পণ্যায়িত করা হচ্ছে তেমনি তথাকথিত সিনেমায়। একদিকে একটা গোষ্ঠী যখন নারীকে তেঁতুল ভাবছেন, তখন অন্যরা নারীকে পরিণত করছে স্রেফ আইটেম গার্লে। এই দুই ক্ষেত্রে দুই দলই নারীকে তাদের মতো নিয়ন্ত্রণ করছে। একদল যেখানে নারীকে শুধু সেবাদাসী করতে চাইছে , অন্য দল তখন শিল্পের নামে নারীকে কেবল দৃশ্যবস্তুতে পরিণত করতে চাইছে। আর এসবের ফল হচ্ছে বিষম। এসবের কোনো কিছুই ধর্ষণকে জায়েজ করবে না সত্য, কিন্তু পুরুষের ধর্ষণ মনস্তত্ব তৈরিতে এসবের ভূমিকা আছে বটে! এবং মনে রাখতে হবে এসব নির্মাণও হচ্ছে পুরুষের হাতেই, পুরুষতন্ত্রের মন্ত্রেই।
৪.
আমাদের মতো অনেক সমাজেই নারীকে এখনো মাপা হয় তার সতীত্ব দিয়ে। তাকে মাপা হয় সে কতটা নম্র সুরে কথা বলে, পর্দা করে, স্ত্রীকার্য পালন করে, সন্তান লালনপালন করে, স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির দেখাশোনা করে ইত্যাদি দিয়ে। পুরুষ যেহেতু এই সমাজের চালকের ভূমিকায় আছে, তাই সব আইন, মূল্যবোধ, রীতিনীতি তার মতো করেই সাজিয়ে নিয়েছে।
এ জন্যই আমরা দেখি ‘ইজ্জত’ ‘সম্ভ্রম’ ‘সতীত্ব’ শব্দগুলো নারীর জন্য বরাদ্দ করে দিয়েছে মহামান্য পুরুষ সমাজ। কী অদ্ভুত ! ধর্ষণের শিকার নারীরই কি না ইজ্জত নষ্ট হয়। আর ধর্ষকদের ইজ্জত বলে কিছু নেই। বরং এই সমাজপতিরা এখনো ধর্ষকের সঙ্গে ধর্ষণ হওয়া নারীর বিয়ে দিয়ে, ধর্ষককে পুরস্কৃত করেন। আর সমাজের বাকি মানুষগুলো সারাজীবন আড়চোখে, আড়ালে-আবডালে সেই স্ত্রীর নিন্দা করে যায়।
আমাদের পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ধর্ষিত নারীই অপবিত্র হয়ে যায়। আর ‘পুরুষ মানুষ একটু আধটু করতেই পারে’তেই সীমাবদ্ধ। তাই এই সমাজ এখনো ধর্ষকের পক্ষে। এটা হয়তো আমাদের সবারই জানা, একজন ধর্ষণের শিকার নারী মামলা করার পরও বিভিন্নভাবে বারবার ধর্ষিত হয়। কী নির্মম পরিহাস! ডাক্তারি পরীক্ষা থেকে শুরু করে নানা উপায়ে একজন ধর্ষিতাকে বারবার প্রমাণ করতে হয় সে ধর্ষিত। এ জন্যই দেখা যায় যত ধর্ষণের ঘটনা ঘটে তত মামলা হয় না। কারণ, এই সমাজ যখন ধর্ষিতার দিকে আড় চোখে তাকায়, তখন তা চেপে না গিয়ে তার বিরুদ্ধে লড়াই করার সাহস এত সহজ নয়, বলা যতটা সহজ। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ২০১৬ সালে ৭২৪টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটলেও মামলা হয়েছে মাত্র ৩৯৬টির।
৫.
যেহেতু এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীকে প্রতি মূহূর্তেই সতীত্বের পরীক্ষা দিয়ে যেতে হয়, পুরুষরা যেহেতু নারীকে তার একগামীতা দিয়ে বিচার করতে চায়, তাই নারীকে ভালনারাবল বা অসহায় করে তোলার মোক্ষম অস্ত্র আসলে তাকে ‘পুরুষের ভাষায় অপবিত্র করে দেওয়া’। পুরুষের ইজ্জত ক্ষমতায়, আর নারীর শরীরে। তাই ‘ধর্ষক পুরুষ’ তার ক্ষমতা দেখানোর জন্যই নারীকে ধর্ষণ করে। এর ভূড়ি-ভূড়ি নজির আমাদের সমাজে আছে। অতীতেও ছিল। পুরুষ তার আঁতে ঘাঁ লাগলে তার প্রতিশোধ নেয় ধর্ষণের মাধ্যমে। নারীকে সমাজে হেয় করার জন্য ধর্ষণ করে। ধর্ষণের শিকার নারী ও তার পরিবার যাতে সমাজে মুখ তুলে দাড়াঁতে না পারে, সেজন্য ধর্ষণ করা হয়। এমনকি যেসব নারী পুরুষতান্ত্রিক রোগে আক্রান্ত তারাও কখনো এই ধর্ষণকেই ব্যবহার করেন। নিজের ‘কান কেটে’ সে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে চায়। তাই ধর্ষণ নামের অসুখটি আসলে পুরুষতান্ত্রিক অহমিকা বা ক্ষমতা কাঠামোর পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া বলা যায় ‘বাই প্রডাক্ট। তাই যৌনতার জন্য আসলে যতটা না ধর্ষণ হয়, তার কয়েকশত গুণ বেশি হয় ক্ষমতা চর্চার জায়গা থেকে।
৬.
একজন ধর্ষণের শিকার নারীর জন্য অবস্থা কতটা সঙ্গীন হয়, তার বিবরণ আমরা বনানীর ঘটনাতেও পাই। একদিকে যেমন ক্ষমতাশালী চক্র ধর্ষকের পক্ষে অবস্থা নিয়েছে। অন্যদিকে ধর্ষণের শিকার একটি পরিবার ঘর থেকে বের হতে পারছে না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সমাজের শিক্ষিত, যুক্তিবাদী, অগ্রসর অংশ হিসেবে পরিচিত সাংবাদিকরা নাকি তাদের বাড়ির বাইরে অবস্থান করছিল। হোক অখ্যাত গণমাধ্যমের মূর্খ সাংবাদিক। কিন্তু তারা শুধু সাংবাকিতার মানই ডোবাচ্ছে না, এটাও বুঝতে সহয়তা করছে যে, তারাও শেষ পর্যন্ত ‘ধর্ষকের’ পক্ষে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে যখন ধর্ষণের শিকার এক তরুণীর মা বলেন, ‘আপনাদের (সাংবাদিকদের) সহযোগিতা সব সময় চাই। তবে এজন্য আমাদের জীবনটা যেন দূর্বিষহ না হয়, সেটাও আপনারা বিবেচনা করবেন।’ এই সাধারণ জ্ঞান যদি আমরা না দেখাতে পারি, তাহলে ধর্ষক বা ধর্ষণের মানসিকতা নিয়ে বসবাসকারী (অ)মানুষগুলোর কাছ থেকে কি আলাদা হতে পারব?
সবশেষে, আবারও বলব একটা খুনের জন্য যেমন খুনিই দায়ী, কোনো কিছু দিয়ে যেমন আপনি এটাকে জায়েজ করতে পারবেন না, তেমনি একটা ধর্ষণের জন্য শুধু ধর্ষকই দায়ী। পৃথিবীর এমন কোনো কারণ নেই, যাকে এর জন্য আপনি দায়ী করতে পারবেন। আমাদের সামনে তাই ধর্ষণের বিরুদ্ধে আরো একাট্টা হওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই। সেই ধর্ষণ মনস্তত্ব তৈরিকারী পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধেও আমাদের কথা বলতে হবে। না হলে শুধু আইন বা বিচার দিয়ে একে ঠেকানো যাবে না। আর মনে রাখতে হবে, ধর্ষণের পক্ষে সাফাই গাওয়া, ধর্ষণের শিকার নারীর দোষ খোঁজা এক ধরনের ধর্ষণ মানসিকতা!