দেড় হাজারের বেশি বিজ্ঞানীর ‘সেকেন্ড নোটিস’
জি. মুনীর
মানবজাতির প্রতি বিশ্বের দেড় হাজারেরও বেশি বিজ্ঞানী সম্প্রতি তাদের ‘সেকেন্ড নোটিস’ জারি করেছেন। ১৮০টিরও বেশি দেশের এসব বিজ্ঞানী এই নোটিসে মানবজাতিকে জানিয়ে দিয়েছেন : ‘টাইম ইজ রানিং আউট’- সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কিসের সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে? এরা বলছেন, গ্রিন হাউস গ্যাসের নিঃসরণের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় আজ বিশ্বে যে জীববৈচিত্র্যের ওপর ভয়াবহ হুমকি সৃষ্টি হয়েছে, তা বায়ুমণ্ডলকে ভঙ্গুর পরিস্থিতির মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে।
এই নতুন ‘সেকেন্ড নোটিস’ তথা সতর্কবার্তা প্রকাশিত হয়েছে BioScience নামের আন্তর্জাতিক জার্নালে, এর ১৩ নভেম্বর, ২০১৭ সংখ্যায়। আসলে এই ‘সেকেন্ড নোটিস’ হচ্ছে ২৫ বছর আগে বিশ্বের ১৭০০ বিজ্ঞানীর জারি করা ‘প্রথম নোটিস’ তথা ‘World Scientists’ Warning to Humanity’-এর হালনাগাদ করা সতর্কবার্তা। ১৯৯২ সালে প্রকাশ করা সেই প্রথম নোটিসে এসব বিজ্ঞানী মানবজাতির প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন- Earth was on track to be ‘irretrievably mutilated’ baring ‘fundamental change’। সোজা কথায়, সেদিন বিজ্ঞানীরা বলেছিলেন- পৃথিবীটাকে মৌলিক পরিবর্তনের মাধ্যমে বিবস্ত্র করে তুলে এর এমনভাবে অঙ্গছেদন ঘটানো হচ্ছে, যা কখনোই পুনরুদ্ধার করা যাবে না। কিন্তু, তাদের এই সতর্কবার্তা বিশ্ববাসী আমলে নেয়নি।
এই সেকেন্ড নোটিসের প্রধান প্রণেতা ওরিগন স্টেট ইউনিভার্সিটির কলেজ অব ফরেস্ট্রির অধ্যাপক উইলিয়াম রিপল বলেন, কিছু লোক আমাদের বক্তব্যকে উড়িয়ে দিতে পারেন এবং বলতে পারেন আমরা শুধুই ‘অ্যালারমিস্ট’। তিনি আরো বলেন, বিজ্ঞানীদের কাজ হচ্ছে ডাটা বিশ্লেষণ করা, সেই সাথে দেখা- দীর্ঘমেয়াদে এর পরিণতি কী হতে পারে। যারা এই সেকেন্ড নোটিসে স্বাক্ষর করেছেন, তারা শুধু একটি মিথ্যা সতর্কবার্তা দিচ্ছেন না। এরা স্বীকৃতি জানাচ্ছেন সুস্পষ্ট কিছু আভাস-ইঙ্গিতের প্রতি। আর এই আভাস-ইঙ্গিতটি হচ্ছে- আমরা এগিয়ে যাচ্ছি একটি ভঙ্গুর পথের দিকে।
বিজ্ঞানীদের এই নতুন সতর্কবিবৃতির শিরোনাম হচ্ছে ‘সেকেন্ড নোটিস টু হিউম্যানিটি’। এতে বলা হয়, এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জনের কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ দেখা যায়নি। যেমন পদক্ষেপ আসেনি ওজোন গ্যাস নিঃসরণ কমানোর, ১৯৯২ সালের প্রথম নোটিসের পর পদক্ষেপ নেই গরিবতা কমিয়ে আনার। কিন্তু মোটামুটিভাবে মানবজাতি অন্যান্য অগ্রগতির ক্ষেত্রে দারুণ কাজ করেছে। আসলে, যেসব পরিবেশগত বিষয়ে জরুরি পদক্ষেপ নেয়া দরকার ছিল, তা এই সিকি শতাব্দী সময় পরে আজকের দিনে আরো খারাপ পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়িয়েছে। এই সেকেন্ড নোটিসে বিজ্ঞানীরা কিছু ‘especially troubling trends’’-এর কথা উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে আছে : ক্রমবর্ধমান হারে গ্রিনহাউস গ্যাসের উদগীরণ বেড়ে চলা, বন উজাড়, কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব এবং চলমান sixth mass extinction-এর ঘটনা।
অপেক্ষমাণ ধ্বংসযজ্ঞ ঠেকাতে যেসব পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন তার মাঝে আছে : আমাদের নজর দিতে হবে প্ল্যান্ট-বেইজড ডায়েটের ওপর; কমিয়ে আনতে হবে সম্পদের বৈষম্য; থামাতে হবে বন উজাড় করা, পদক্ষেপ নিতে হবে জীববৈচিত্র্য রক্ষায়, বাড়াতে হবে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার। এই সেকেন্ড নোটিসে বিশ্বজুড়ে পরিবেশ ও আবহাওয়া সম্পর্কিত সচেতনতা বাড়ানোর তাগিদও দেয়া হয়েছে।
আজ থেকে ২৫ বছর আগে ১৯৯২ সালে ‘দ্য ইউনিয়ন অব কনসার্নড সায়েন্টিস্টস’ এবং ১৭০০ স্বতন্ত্র বিজ্ঞানী প্রণয়ন করেন মানবজাতির প্রতি ‘World Scientists’ Warning to Humanity’ শীর্ষক ‘ফার্স্ট নোটিস’। এসব বিজ্ঞানীর মধ্যে তৎকালে জীবিত বেশির ভাগ নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানীও ছিলেন। এসব উদ্বিগ্ন বিজ্ঞানী মানবজাতির প্রতি আহ্বান রাখেন পরিবেশ বিনাশ কমিয়ে আনতে এবং মানুষের চরম বিপর্যয় এড়াতে হলে আমাদের পৃথিবীটাকে ব্যবহারের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে। বিজ্ঞানীরা তাদের ইশতেহারে আরো দেখান- মানুষ এখন প্রকৃতির সাথে যুদ্ধে নেমেছে। এরা উদ্বেগ প্রকাশ করেন পৃথিবী নামের গ্রহটি ধ্বংসের পথে এগিয়ে চলার ব্যাপারে। তাদের মতে, ওজোন স্তরের ক্ষয়, বিশুদ্ধ পানির প্রাপ্যতা কমে যাওয়া, জলজপ্রাণী ফুরিয়ে যাওয়া, সমুদ্রের ডেড জোনের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া, বন উজাড়, জীববৈচিত্র্যের ধ্বংসসাধন এবং জনসংখ্যার অব্যাহত প্রবৃদ্ধি পৃথিবী নামের গ্রহটিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আমাদের উচিত এই বিপর্যয় এড়াতে এসব বিষয়ে জরুরি পদক্ষেপ নেয়া। সে জন্য আমাদের কর্মকাণ্ডে জরুরি ভিত্তিতে মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে।
১৯৯২ সালের সেই ঘোষণার প্রণেতারা তখন আশঙ্কা করেছিলেন, মানবজাতি আমাদের পরিবেশ-প্রতিবেশ ব্যবস্থাকে ঠেলে দিচ্ছে এর সক্ষমতার বাইরে। ফলে পরিবেশ-প্রতিবেশ মানবজীবনকে আগের মতো ইতিবাচক সহায়তা দিতে পারছে না। এই ঘোষণায় বিজ্ঞানীরা বর্ণনা দেন, কী করে আমরা পৃথিবীর সাথে বিভিন্ন আচরণে দ্রুত অনেক সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছি। তখন বিজ্ঞানীদের দাবি ছিল, জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধি একটি স্থিতিশীল পর্যায়ে রাখতে হবে। কিন্তু তা রাখতে মানবজাতি সক্ষম হয়নি। বিগত সিকি শতাব্দী সময়ে বিশ্বের জনসংখ্যা বেড়ে গেছে ২০০ কোটি, আগের চেয়ে ৩৫ শতাংশ বেশি। এর ফলে পৃথিবীকে জনসংখ্যার একটি অতিরিক্ত চাপ বহন করতে হচ্ছে। তখনো তাদের পরামর্শ ছিল, গ্রিন হাউস গ্যাসের উদগীরণ কমাতে হবে। কমাতে হবে ফসিল-জ্বালানির ব্যবহার। থামাতে হবে বন ধ্বংস। রক্ষা করতে হবে জীববৈচিত্র্য।
বিজ্ঞানীদের সেই ‘ফার্স্ট নোটিস’-এর ২৫ বছর পূর্তির এই সময়ে আমরা ফিরে তাকাতে পারি তাদের দেয়া সেসব সতর্কবার্তা ও প্রাপ্ত ডাটার ওপর। ১৯৯২ সালের পর থেকে স্ট্রাটোস্ফিয়ারের ওজোন স্তরের ক্ষয়রোধে কিছুটা স্থিতিশীলতা আনার বিষয়টি বাদ দিলে, মানবজাতি পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দৃশ্যমান তেমন কোনো অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনি। অধিকন্তু প্রায় সব ক্ষেত্রেই পরিস্থিতির আরো উদ্বেগজনক অবনতি ঘটেছে। বিশেষ করে ক্রমবর্ধমান হারে ফসিল জ্বালানি ব্যবহার করে বায়ুমণ্ডলে বিপজ্জনক গ্রিন হাউস গ্যাস বাড়িয়ে তোলা হয়েছে। এর ফলে সৃষ্ট আবহাওয়ার ধ্বংসকর পরিবর্তন মানুষের জন্য বয়ে এনেছে ভয়াবহ দুর্ভোগ। অধিকন্তু আমরা মোটামুটি ৫৪ কোটি বছরের মধ্যে মুখোমুখি হয়েছি ‘সিক্সথ মাস এক্সটিঙ্কশন’-এর। এর ফলে বর্তমান শতাব্দী শেষ হওয়ার আগেই অনেক প্রাণের বিলুপ্তি ঘটবে।
১৯৯২ সালের পর থেকে কী করে বিভিন্ন হুমকি সূচিত হয়েছে এর পরিসংখ্যানগত দিকে তাকিয়ে বিজ্ঞানীরা উল্লেখ করেছেন- বিশ্বের মানুষ এই সিকি শতাব্দীতে আগের তুলনায় মাথাপিছু ২৬.১ শতাংশ বিশুদ্ধ পানি কম পাচ্ছে। ‘ডেড জোনোর’ সংখ্যা বেড়েছে ৭৫.৩ শতাংশ। বছরে ৬২.১ শতাংশ হারে কার্ব ডাই-অক্সাইডের উদগীরণ বেড়েছে। একই সময়ে বিশ্বের জনসংখ্যা বেড়েছে ৩৫.৫ শতাংশ। বিজ্ঞানীরা উল্লেখ করেন- জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধি পর্যাপ্ত পরিমাণে কমিয়ে আনা, অর্থনীতিভিত্তিক প্রবৃদ্ধির ভূমিকা উপলব্ধি, গ্রিন হাউস গ্যাস কমিয়ে আনা, নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রতি জোর দেয়া, বসতি সংরক্ষণ, প্রতিসাম্য সংরক্ষণ, দূষণ কমিয়ে আনা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যর্থতা ঢাকতে মানবজাতি কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। ধ্বংসের মুখোমুখি এসে দাঁড়ানো বায়ুমণ্ডলকে আমরা প্রয়োজনীয় সুরক্ষা দিতে পারিনি।
পরিবেশ-প্রতিবেশের বিদ্যমান উদ্বেগজনক এসব প্রবণতাদৃষ্টে বিজ্ঞানীরা এখন মানবজাতিকে দিলেন সেকেন্ড নোটিস। আসলে আমরা নিজেরাই বিপন্ন করে তুলছি নিজেদের ভবিষ্যৎ। প্রকৃতির সাথে করেছি আগ্রাসী আচরণ। বিজ্ঞানীদের মতে, আমরা জনসংখ্যা বেড়ে চলার গতি থামাতে কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছি না। অথচ এই জনসংখ্যা বেড়ে চলাই হচ্ছে পরিবেশ-প্রতিবেশ বিনষ্টের অন্যতম কারণ। অপরিকল্পিতভাবে জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার মধ্যে সামাজিক হুমকিও রয়েছে। প্রথম নোটিসের মতো সেকেন্ড নোটিসেও বিজ্ঞানীরা একই তাগিদ রেখেছেন : অর্থনীতিভিত্তিক প্রবৃদ্ধির দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে, গ্রিন হাউস গ্যাসের উদগীরণ, ফসিল জ্বালাানির ব্যবহার ও দূষণ কমাতে হবে। বাড়াতে হবে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার। প্রাণীর স্বাভাবিক বসত অক্ষত রাখতে হবে। বায়ুমণ্ডলের ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে।
এটা ঠিক- রাজনীতিবিদেরা চাপের মুখে না পড়লে কিছুই করতে চান না। তাই বিজ্ঞানী, গণমাধ্যম, এনজিও ও এমনকি সাধারণ নাগরিককেও সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে সরকার পরিবেশ-প্রতিবেশ বিনাশী কোনো পদক্ষেপ নিতে না পারে। প্রয়োজনে তৃণমূল পর্যায়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে পরিবেশবিরোধী কর্মকাণ্ড থামিয়ে দেয়ার জন্য। সাধারণ মানুষের সচেতনতাই হতে পারে সরকারের বা অন্য কোনো মহলের পরিবেশবিরোধী যাবতীয় কর্মকাণ্ড থামানোর উত্তম হাতিয়ার। মনে রাখতে হবে, এতদিন আমরা যেভাবে গাছাড়া ভাব দেখিয়ে চলেছি, এখন আর তা চলতে দেয়া যাবে না। কারণ, প্রকৃতির বিরুদ্ধে মানুষের চলমান কর্মকাণ্ডে প্রকৃতি এখন মানুষের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। এখন চলছে মানুষের ওপর প্রকৃতির প্রতিশোধ নেয়ার পালা। সময়ের সাথে এই প্রতিশোধের তীব্রতা আরো ভয়াবহ হয়ে উঠবে, যদি মানুষ ভবিষ্যতে যথাযথ উপলব্ধি নিয়ে তা প্রতিরোধ করতে না পারে। এখানে মানুষকে হতে হবে প্রকৃতির বন্ধু। বুঝতে হবে প্রকৃতির ক্রিয়া-প্রক্রিয়া। প্রকৃতির সাথে আচরণ করতে হবে দরদি মন নিয়ে। তখন প্রকৃতিও মানুষকে বন্ধু হিসেবে নেবে।
আলোচ্য সেকেন্ড নোটিসে বিজ্ঞানীরা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কথা তুলেছেন। সে বিষয়টি হচ্ছে sixth mass-extinction event। এর অর্থ ‘বায়োলজিক্যাল অ্যানিহিলেশন’ তথা জৈবিক বিলুপ্তি সাধন। এর সরল অর্থ- আগামী শতাব্দী আসার আগেই পৃথিবীর তিন-চতুর্থাংশ প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটবে। সত্যিই ভয়াবহ এক পরিণতি হবে এটি। আর এর জন্য দায়ী মানুষের কর্মকাণ্ড। বিজ্ঞানীরা বলছেন, সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সের প্রসিডিংয়ে প্রকাশিত (১৩ নভেম্বর, ২০১৭) একটি সমীক্ষা মতে, এটিই প্রকৃতির ওপর মানবসৃষ্ট বায়োলজিক্যাল অ্যানিহিলেশনের পুরো চিত্র নয়। Universidad Nacional Autónoma de México-ও ইকোলজির অধ্যাপক জেরারডো সেবালস নতুন সাক্ষ্য-প্রমাণ তুলে ধরে বলেছেন, বিশ্ব প্রজাতি এখন যে ধরনের দুর্ভোগের মধ্যে রয়েছে, যা এর আগে আমরা কখনোই দেখিনি।
তারা মুখ্যত জানতে পেরেছেন- ভূমিভিত্তিক ২৭ হাজার ৬০০ স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখি, উভচর প্রাণী ও সরীসৃপ প্রজাতির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এখন বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে চলেছে। বিজ্ঞানীরা এ বিষয়টিকে একটি ‘extremely high degree of population decay’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বিজ্ঞানীরা ১৭৭টি স্তন্যপ্রাণী প্রজাতির ওপর একটি সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছেন এগুলো ১৯০০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে তাদের বসবাসের স্থান ৩০ শতাংশ হারিয়ে ফেলেছে। তাদের সমীক্ষামতে, এসব প্রজাতির ৪০ শতাংশেরও বেশি সবচেয়ে বেশি হারে বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ৮০ শতাংশ প্রজাতিকে তাদের ভৌগোলিক আবাস অবস্থান পরিবর্তন করতে হয়েছে।
এই বিলুপ্তি সঙ্কটের ব্যাপারে বিজ্ঞানীদের মন্তব্য হচ্ছে- আগে এ সম্পর্কে যেমনটি ভাবা হয়েছিল তার চেয়েও ভয়াবহভাবে চলছে এই সিক্সথ এক্সটিঙ্কশন। আর এই বড় ধরনের বিলুপ্তির ঘটনা এখনো চলমান। এটি ভয়াবহ এক বিষয় যে, বিগত ৪০ বছরে মানুষের অবিবেচনাপ্রসূত কর্মকাণ্ডের ফলে বিশ্বের অর্ধেক বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আর এভাবে প্রতি ৪০ বছরে ৫০ শতাংশ করে বন্যপ্রাণী বিলুপ্তির দিকে ঠেলে দিয়ে যেতে থাকি, তবে খুব বেশি সময় লাগবে না সব বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হওয়ার জন্য। আসলে আমাদের হাতে খুব বেশি হলে আর দুই দশক সময় আছে এই মাস এক্সটিঙ্কশন ঠেকানোর জন্য। এই সময়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হলে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
নর্থ ক্যারোলিনার ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের কনজারভেশন ইকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান স্টুয়ার্ট পিম এই ধারণার সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন এভাবে : ‘যখন আমি আমার জানালা দিয়ে বনের দিকে তাকাই, তখন এই বনে এখন আর খেকশিয়াল, চিতা কিংবা কালো ভালুককে ঘুরে বেড়াতে দেখি না। কারণ, বিপুল বন এলাকায় আমরা প্রচুর প্রজাতির প্রাণীকে নিঃশেষ করে দিয়েছি।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, গ্রামের পাঠশালায় একসময় আমরা সজারুর কাঁটা দিয়ে ঘরে বানানো কলম কিংবা বাজার থেকে কেনা নিব-হ্যাণ্ডেলে কালি লাগিয়ে লিখতাম। আর তখন প্রতি বছর বিভিন্ন সময়ে আমাদের গ্রামে বেশ কয়েকটি সজারু ধরা পরত। প্রায়ই শোনা যেত, অমুক বাড়ির মুরগির খোঁয়াড় থেকে শিয়াল মুরগি চুরি করে নিয়ে গেছে। তখন আমরা দলবেঁধে পাটক্ষেত বা জঙ্গলের ভেতর থেকে খেকশিয়াল মারার অভিযানে নামতাম। প্রতিটি অভিযানে পাঁচ সাতটি করে খেকশিয়াল মারা পড়ত। আবার কখনো কখনো বলা হতো, গ্রামে বাঘ ঢুকেছে। তখন বড়রা বন্দুক নিয়ে পাটক্ষেতের ভেতরে বাঘ মারা অভিযানে নামত। কিন্তু আমার দেখা এমন কোনো অভিযানে বাঘ ধরার ঘটনা ঘটতে দেখিনি। তবে গ্রামের অনেকে উত্তরের পাহাড়ি এলাকায় বন কাটতে গিয়ে বাঘের পেটে গেছেন, এমন কয়েকজনের কথা শুনেছি। আর এখন সেই বেতঘর, জঙ্গল কিছুই নেই। আর সজারু, খেকশিয়াল কিংবা এ ধরনের কোনো প্রাণী গ্রামের মানুষ চোখেও দেখতে পায় না। এটি বন্যপ্রাণী বিলুপ্তি প্রবণতার একটি ছোট্ট উদাহরণ।
আসলেই মানজাতি আজ এক বড় ধরনের পরিবেশিক ও প্রতিবেশিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। একদিকে আমরা প্রাণীকুলের বিলুপ্তির দিকে যাচ্ছি, অপর দিকে আমরা ডেকে আনছি ভয়াবহ সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যা আমাদের জন্য প্রশস্ততর করবে দুঃসহ দুর্ভোগের পথ। বাড়াবে মানুষের অভাব অনটন। সেই সূত্রে মানুষে মানুষে বড়বে দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত, যুদ্ধ-বিগ্রহ। এটি গোটা মানবজাতির জন্য একটি চরম উদ্বেগের বিষয়। সেই উদ্বেগ থেকেই বিশ্ববিজ্ঞানীরা এই সময়টায় মানবজাতির উদ্দেশে জারি করেছেন তাদের সেকেন্ড নোটিস। প্রতিটি দেশের নীতিনির্ধাক ও সেই সাথে ব্যক্তিগতভাবে সবারই উচিত এই নোটিস মনোযোগ দিয়ে পড়া এবং তা হৃদয়ঙ্গম করে বাকি আগামী জীবনের কর্মপন্থা সাজানো। সেই তাগিদটুকু দিতেই এই লেখা।