দিলহুদা গুল গুল! বার বার বাব্বা!
বালকবেলায় আমি যখন গানটি প্রথম শুনেছিলাম তখন বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে কেউ হিন্দি গান শুনত না। সত্তর দশকের মাঝামাঝি আবহমান বাংলার গ্রামগঞ্জ এবং সেখানে বসবাসরত বালক-বালিকাদের চিন্তা-চেতনার সঙ্গে হিন্দি ভাষা ও সংস্কৃতির কোনো সংযোগ ছিল না। আমাদের গ্রামে প্রথম যখন ক্যাসেট প্লেয়ারে হিন্দি গান বেজে উঠল তখন আরও অনেক সমবয়সীর সঙ্গে আমিও বেশ আশ্চর্য মনোযোগ নিয়ে তা শুনতে আরম্ভ করলাম। আমার এক ধনাঢ্য চাচাতো ভাই আমাদের গ্রামে প্রথম ক্যাসেট প্লেয়ার এবং বেশকিছু হিন্দি ক্যাসেট নিয়ে এলেন বিদেশ থেকে। ক্যাসেটে অনেক হিন্দি গান ছিল। এর মধ্যে একটি গান আমার ভারি পছন্দ হলো। গানের কথামালার কিছুই আমি বুঝতে পারিনি। তবে তার সুর আমাকে এমনভাবে মোহিত করল যে, আমি সুরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হিন্দি কথামালার ভাবার্থ নিজের মতো বানিয়ে নিলাম এবং সেমতে, নিজের স্বপ্নবাসর রচনা করতে থাকলাম।
গানটি ছিল পুরনো দিনের হিন্দি চলচ্চিত্রের একটি জনপ্রিয় মেলোডি যা কিংবদন্তি শিল্পী কিশোর কুমারের কণ্ঠে সুর লহরি ছড়িয়ে আমার মতো অনেককে অহেতুক স্বপ্নে বিভোর করেছিল। গানের প্রথম কয়েকটি লাইন ছিল এরূপ— ‘মেরা নাম আবদুর রেহমান, রিকশাওয়ালা মাহবুব খান, খানে ওয়ালেকা দিল হুদা গুল গুল— বার বার বাব্বা!’ গানটির ভাবার্থ যে আমি বুঝিনি তা আগেই বলেছি। কিন্তু তার সুর শুনে মনে হলো আবদুর রহমান নামের এক যুবক মাহবুব খান নামের একজন রিকশাওয়ালার মেয়েকে বেজায় ভালোবাসেন। মেয়েটির গুল গুল চেহারা অর্থাৎ তার মুখমণ্ডল গোলাকৃতি যা কিনা বার বার বাব্বা অর্থাৎ অনেক সুন্দর এবং বার বার দেখতে ইচ্ছা করে। বালকবেলার সেই কোমলমতি চিন্তা-ভাবনার দ্বারা আমি কীভাবে প্রভাবিত হয়েছি তা নিয়ে সংক্ষেপে দু-চারটি কথা বলে আজকের মূল প্রসঙ্গ আলোচনা শুরু করব।
বালকবেলা অতিক্রম করে আমি যখন কৈশোরে পা দিলাম তখন মাঝেমধ্যে সময় পেলে খান বংশের রিকশাওয়ালা এবং তার কোনো গোলগাল মুখের কন্যা সন্তান আছে কিনা সে ব্যাপারে খোঁজখবরের চেষ্টা করতাম। কয়েক বছর চেষ্টার পরও মাহবুব খানের দিল হুদা গুল গুল কন্যার দেখা পেলাম না বটে কিন্তু নিজের মন ও মানসে ভবিষ্যৎ প্রিয়ার ছবি আঁকতে গিয়ে বহু যতনে একখানি গোল মুখের ছবি এঁকে নিলাম এবং খান বংশে বিয়ে শাদি করব বলে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে বসলাম। আমার ঘনিষ্ঠজনরা খুব ভালো করে জানেন যে, আমার বালকবেলার স্বপ্ন ও কৈশোরের প্রতিজ্ঞাকে আমি আমার জীবনে কীভাবে বাস্তব রূপ দিয়েছিলাম। আজ এত বছর পর হঠাৎ করে ঘটনাটি মনে পড়ল সাম্প্রতিক সময়ের স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের যুগান্তকারী বিপ্লবের পূর্বাপর ঘটনার কথা ভাবতে গিয়ে সাম্প্রতিককালে অর্থাৎ ২০১৮ সালের আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহজুড়ে বাংলাদেশে যা ঘটল তার নজির এ দেশ তো বটেই পুরো দুনিয়ার কোথাও কোনোকালে ঘটেনি। বাংলাদেশের স্কুল-কলেজের লাখ লাখ ছেলেমেয়ে যাদের বয়স সাত থেকে কুড়ি বছরের মধ্যে। তারা নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নেমে যে কাণ্ডকারখানা করল তাতে সমসাময়িক সমাজ-কাল-দেশ ও জাতি রীতিমতো বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়।
এসব ছেলেমেয়ের আন্দোলন কেউ বলেছেন শিশু বিদ্রোহ আবার কেউ বলেছেন কিশোর বিপ্লব। তারা দলে দলে শত শত কিংবা হাজারে হাজারে সমবেত হয়ে রাজধানী ঢাকা, বিভাগীয় শহর, জেলা শহর থেকে শুরু করে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলের রাস্তায় নেমে নিজেদের নয় দফা দাবি আদায়ের জন্য অবস্থান নেয়। পরবর্তীতে তারা দক্ষ পুলিশ কর্মকর্তাদের ন্যায় রাজপথে চলাচলকারী যানবাহনের কাগজপত্র এবং ড্রাইভারের লাইসেন্স তল্লাশি ও যাচাই-বাছাইয়ের নামে যা করে তা আমাদের সবাইকে রীতিমতো অবাক করে দেয়। এ ঘটনার দু-তিন দিন পরে বিষয়টি নিয়ে সরকার, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল এবং বিরোধী দলসমূহ একযোগে ত্রিমাত্রিক স্বার্থসিদ্ধির মন্ত্রযোগে ঝাড়ফুঁক শুরু করলে একটি নিষ্পাপ, আন্তরিকতাপূর্ণ ও যুগান্তকারী শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর হয়ে ওঠে।
আজকের আলোচনায় আমি কথিত শিশু বিদ্রোহ বা কিশোর বিপ্লবের পূর্বাপর রাজনীতি, স্বার্থের সংঘাত ও বুড়োদের কূটনীতির কূটচাল নিয়ে কিছুই বলব না। আমি শুধু দেশের কয়েক কোটি বালক-বালিকা এবং কিশোর-কিশোরী যাদের বয়স সাত থেকে কুড়ি বছরের মধ্যে, তাদের মন ও মানসে ঘটনাটি কীরূপে স্মৃতি হয়ে থাকবে সে ব্যাপারে সাধ্যমতো আলোচনার চেষ্টা করব। তারা তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে আগামী দিনগুলোয় অবশ্যই দেশের রাজনৈতিক দল, নেতা, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে ভালোবাসবে অথবা ঘৃণা করবে। তারা কোনো অবস্থাতেই এই স্মৃতি ভুলবে না এবং আগামীতে মরে গেলেও বালকবেলা বা কিশোরবেলার ভালোলাগা বা ঘৃণার অনুভূতিতে কোনো পরিবর্তন ঘটবে না। ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সমাজ ও রাষ্ট্র দেশের কয়েক কোটি কোমলমতি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে চিরদিনের জন্য তাদের শত্রু বানিয়ে দিল, নতুবা বন্ধু বানিয়ে নিল।
আমরা যদি আলোচ্য বিষয়টি সত্যিকারভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে চাই তবে অবশ্যই আমাদের সংবেদনশীল মনের অধিকারী হতে হবে। একই সঙ্গে আমাদের শারীরিক-মানসিক সুস্থতা ও বিচার-বিবেচনার শক্তি অক্ষুণ্ন থাকা আবশ্যক। বিষয়টি বিবেচনার জন্য আমাদের দাম্ভিকতা, স্বার্থপরতা এবং শত্রুভাবাপন্ন মনমানসিকতা ত্যাগ করতে হবে। আর তখনই আমরা অনুধাবন করতে পারব যে, কত বড় বিজয় অথবা কত বড় পরাজয়ের জালে আমরা আবদ্ধ হয়ে পড়েছি। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার আগে বর্তমানকালের শিশু-কিশোরদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন সম্পর্কে কিছু বলা অবশ্যক। যেসব শিশু-কিশোর নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নেমে এসেছিল তারা প্রায় সবাই মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। দেশের চলমান অর্থনৈতিক অবস্থা ও আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, আন্দোলনকারীদের পরিবারে এমন কোনো অর্থসংকট বা খাদ্যসংকট নেই যা তাদের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ করে তুলতে পারে।
আমাদের দেশে ইদানীংকালের নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোয় ঢুঁ মারলে আপনি দেখতে পাবেন, প্রতিটি পিতা-মাতা তাদের সন্তানকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা জজ-ব্যারিস্টার বানানোর জন্য যুদ্ধ করতে করতে প্রায় মৃত্যুপথযাত্রী হতে চলেছে। কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়েকে পর্যন্ত তাদের পিতা-মাতা আদর করে নিজ হাতে খাইয়ে দেয় এবং তাদের সব অভাব-অভিযোগ পূরণ করার জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করে। বিপরীতে ছেলেমেয়েরা বাবা-মার আশা-আকাঙ্ক্ষা-ইচ্ছার গুড়ে বালি দিয়ে মোবাইল, কম্পিউটার, টিভি, ভিডিও গেম ইত্যাদি নিয়ে মেতে ওঠে। ফলে প্রত্যেক পিতা-মাতাই মনে করেন তাদের সন্তানটি বড্ড স্বার্থপর ও এককেন্দ্রিক। তারা আরও মনে করেন, তাদের সন্তানগুলোর বাস্তব জ্ঞান নেই, দুনিয়া সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই এবং অন্তরে কারও জন্য মায়া-দয়ার লেশমাত্র নেই। তারা সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে যেমন উদ্বিগ্ন থাকেন তেমন নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়েও আশঙ্কায় থাকেন। বেশির ভাগ পিতা-মাতা মনে করেন, তাদের সন্তান মোবাইল, ফেসবুক ইত্যাদি নিয়ে এতটাই ব্যস্ত যে, দুনিয়ার কারও দিকে তাকানোর ইচ্ছা বা শক্তি কোনোটাই তাদের নেই। এমনকি তারা মরে গেলেও তাদের মুখে পানি দেওয়ার সময়ও যে ছেলেমেয়েরা পাবে না সে ব্যাপারে খিস্তিখেউর করে অনেক পিতা-মাতা সকাল-সন্ধ্যায় সরগরম করে ফেলেন।
উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যের বাইরে অতিভোজন অথবা ভোজনে অরুচির মতো অভ্যাসও এ যুগের স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়েকে পেয়ে বসেছে। অধিক নিদ্রা ও অনিদ্রার মতো বদভ্যাসে আক্রান্ত হয়ে কেউ কেউ সারাক্ষণ ঘুমায়, আবার কেউ কেউ সারা রাত জেগে থাকে। অসলতা, দায়িত্বহীনতা, অনৈতিক কর্মকাণ্ডের মতো বহু বহু অভিযোগ তুলে অনেক পিতা-মাতা দিনরাত হাপিত্যেশ করেন। সংসারের কাজকর্মে সহযোগিতা, ছোটদের স্নেহ, বড়দের শ্রদ্ধা করা, নিজের কাজ নিজে করা অথবা বইপত্র, জামা-কাপড় গুছিয়ে রাখার মতো সাধারণ কাজগুলো বেশির ভাগ ছেলেমেয়ে তাদের পিতা-মাতার বাল্যকালের মতো পারে না বলে এ যুগের সন্তানদের প্রায়ই তাদের অভিভাবকদের কাছ থেকে ভর্ত্সনা শুনতে হয়। ছেলেমেয়েদের অন্তর বলে কিছু নেই, সবাই পাষাণ বা পাষাণিতে পরিণত হয়েছে এবং দায়িত্বজ্ঞান ও কর্তব্যবোধের অভাবের কারণে তাদের যে আগামী দিনে ভিক্ষে করে খেতে হবে এ ধরনের অভিশাপ দু-চার বার শোনেনি এমন ছেলেমেয়ে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
আমরা যদি আমাদের বর্তমান প্রজন্মের কয়েক কোটি স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীর সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলোকে এক পাশে রাখি এবং অন্য পাশে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের পূর্বাপর ঘটনাগুলোকে রেখে তুলনামূলক পর্যালোচনা করি তবে দেখতে পাব যে, বালক-বালিকা ও কিশোর-কিশোরীরা তাদের স্বাভাবিক বৃত্ত থেকে বের হয়ে এমন কারও জন্য অশ্রু ফেলেছিল যে কিনা তাদের আত্মীয় নয়। সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া একজন তরুণী এবং তরুণের জন্য যে দরদ তারা অনুভব করেছিল তেমনটি তাদের জীবনে হয়তো অন্য কারও ক্ষেত্রে ঘটেনি। তারা তাদের অলসতাকে কবর দিয়ে ক্ষুধা, পিপাসা ও ঘুমকে বস্তাবন্দী করে এমন একটি বিষয়ের জন্য রাস্তায় নেমে এসেছিল যার সঙ্গে তাদের একবিন্দু ব্যক্তিগত স্বার্থ, কিংবা সামান্যতম লোভ-লালসা, পদ-পদবি ও ক্ষমতার মোহ জড়িত ছিল না। যে আন্তরিকতা, নিষ্ঠা ও সততা নিয়ে তারা ড্রাইভিং লাইসেন্স চেক করেছিল তার শতভাগের একভাগ হয়তো তারা কোনো দিন নিজের জন্য, আপজনদের জন্য অথবা সমাজ-সংসারের জন্য করেনি।
নিরাপদ সড়ক চাই স্লোগানসংবলিত আন্দোলন করতে গিয়ে আমাদের ছেলেমেয়েরা দেশমাতৃকাকে ভালোবাসতে শিখেছিল। তারা জাতীয় পতাকা, জাতির জনক এবং দেশপ্রেমকে একত্র করে বুকের মধ্যে ধারণ করতে আরম্ভ করেছিল। তারা ইতিহাস ঘেঁটে জানতে আরম্ভ করেছিল— আমাদের মহান ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং মহান স্বাধীনতার রক্তাক্ত প্রেক্ষাপট। তারা সংবিধান, আইন-কানুন, রাস্তাঘাটে লোকজন ও নির্মম বাস্তবতা শেখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। তারা দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধে তাড়িত হয়ে হাসপাতালগামী রোগীকে নিরাপদে পৌঁছানো, রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে দায়িত্ব পালন এবং সত্যকে সত্য ও মিথ্যাকে মিথ্যা বলার দুর্বার সাহস অর্জন করেছিল। গত ৪০ বছরের ইতিহাসে যাদের সামনে কথা বলা, যাদের টিকি স্পর্শ করা অথবা যাদের আইন পালনের ব্যাপারে বাধ্য করার কথা আমরা স্বপ্নেও কল্পনা করতাম না সেসব মহাশক্তিধর লোকদেরও তারা আইন মানতে বাধ্য করেছিল অভিনব কৌশল, ব্যতিক্রমী সাহস ও উদাহরণযোগ্য দৃঢ়তা প্রদর্শনের মাধ্যমে।
আন্দোলন করতে গিয়ে আমাদের ছেলেমেয়েরা একটিবারের জন্যও তাদের মুখ দিয়ে কোনো রাজনীতির কথা বলেনি। কোনো রাজনৈতিক দলের তাঁবেদারি যেমন করেনি তেমন কারও বিরোধিতা করেনি। তারা সরকার, রাষ্ট্র কিংবা সরকারপ্রধান অথবা রাষ্ট্রপ্রধান সম্পর্কে একটি টুঁশব্দটি উচ্চারণ করেনি। তারা ভদ্রলোকের সঙ্গে ভদ্রতা দেখিয়েছে, গুণীজনকে সম্মান করেছে এবং কাউকে ব্যক্তিগত আক্রোশে আক্রমণ করেনি। তারা হেসেখেলে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছে এবং অবসরে জাতীয় পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরে সমবেত কণ্ঠে মনোগ্রাহী সুরে জাতীয় সংগীত গেয়েছে। তারা দেশকে ভালোবেসেছে এবং রাষ্ট্রকে সুসংহত, আধুনিক ও যুগোপযোগী করার স্বপ্ন নিয়ে দাবিনামা পেশ করেছে। বাংলাদেশের যেসব এলাকায় সরকারদলীয় সংসদ সদস্যের জনপ্রিয়তা আছে এবং যারা আন্দোলনরত ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন সেসব স্থানে পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। জনপ্রিয় এমপিদের আশ্বাসে এবং আহ্বানে সাড়া দিয়ে আন্দোলনকারীরা শান্তিপূর্ণভাবে ঘরে ফিরে গিয়েছিল। এ অবস্থায় আমরা কেন তাদের মারলাম, কেন তাদের মনে কষ্ট দিলাম! অপমান করে কেন তাদের হাসিমুখে বেদনার স্পর্শ লাগিয়ে দিলাম, তাদের সৎসাহসে কেন ভয় ঢুকিয়ে দিলাম এবং যে বুকে স্বাধীনতার স্থপতি ও জাতির জনককে ধারণ করেছিল সেই স্থানটিতে আঘাত করলাম?
আমাদের কোমলমতি ছেলেরা এবং মেয়েরা ঘরে ফিরে গেছে। তারা গত কয়েক দিনে অনেক রূঢ় বাস্তবতার পাশাপাশি চক্রান্তকারী দিলহুদা গুল গুল বুড়োদের বহুরূপী চরিত্র দেখেছে। নিশ্চয়ই তারা এমন কিছু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে যার আলোকে তারা আগামী দিনে এ দেশের রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী ও স্বার্থবাদী চক্রকে হয় ভালোবাসবে, নয়তো ঘৃণা করবে। মানুষের মন ও মানসিকতার যে অনাদি রূপ ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে যার প্রভাবে শিশু বিদ্রোহ বা কিশোর বিপ্লবের স্মৃতি তারা কোনো দিন ভুলবে না এবং কোনো দিন তাদের ঘৃণাকে মাটিচাপা দিতে পারবে না যেমনটি পারেনি এ দেশের মুক্তিযোদ্ধা রাজাকার, আলবদর ও পাকিস্তানিদের ব্যাপারে।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও কলামিস্ট।