তিন মুখার্জি’র কবলে বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায়।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় কারাগারে আটক বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রধান মন্ত্রী খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে ভূমিকা নিয়েছিলেন সে সময়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি ওরফে শৈশবে ডাকা পল্ট ু । তিনি দুজনকে মুক্ত করার জন্য হস্তক্ষেপ করতে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশকেও অনুরোধ করেন। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হবে—এমন আশঙ্কা ছিল ওই সময়ের সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদের। তবে হাসিনা ফিরে আসার পর তেমনটা ঘটবে না বলে নিজে দায়িত্ব নিয়েছিলেন প্রণব মুখার্জি।
প্রণব মুখার্জির আত্মজীবনীমূলক বই দ্য কোয়ালিশন ইয়ারস ১৯৯৬-২০১২তে এসব কথা তুলে ধরেছেন ভারতের সাবেক এই রাষ্ট্রপতি। এ বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ তুলে ধরা হয়েছে ভারতের প্রভাবশালী ইংরেজি সাময়িকী ইন্ডিয়া টুডে’র অক্টোবর ২০১৭ সালের একটি সংখ্যায় এভাবেঃ
’বাংলাদেশের রাজনীতিতে ১/১১-এর সেনানিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়টা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। প্রতিবেশী দেশ ভারতের রাজনীতির শক্তিশালী চরিত্র প্রণব মুখার্জির লেখায় সেই প্রসঙ্গ উঠে এসেছে সংগত কারণেই। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন। তিনি ড. ফখরুদ্দীন আহমদকে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেন। সে সময় আরও অনেক রাজনৈতিক নেতার মতো এখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকেও কারাগারে যেতে হয়।
প্রণব মুখার্জি লিখেছেন, ‘আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখার পাশাপাশি একটি শান্তিপূর্ণ, গ্রহণযোগ্য, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দিকে জোর দিয়েছিলাম।’
প্রণব মুখার্জির বইয়ে উল্লেখ আছে, ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদ ছয় দিনের ভারত সফরে যান। এ সময় প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় মইনের। এ প্রসঙ্গে প্রণব মুখার্জি লিখেছেন, ‘অনানুষ্ঠানিক আলোচনার সময়, আমি তাঁকে রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির গুরুত্ব বোঝাই। তিনি এই ভয় পাচ্ছিলেন যে শেখ হাসিনা বের হয়ে আসার পর তাঁকে (জেনারেল মইন) চাকরিচ্যুত করতে পারেন। কিন্তু আমি ব্যক্তিগত দায়িত্ব নিই এবং শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলেও তাঁর বহাল থাকার ব্যাপারে তাঁকে আশ্বস্ত করি।’
প্রণব মুখার্জি লিখেছেন, ‘আমি খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা উভয়ের মুক্তির ব্যাপারে হস্তক্ষেপের অনুরোধ জানাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউর (বুশ) সাক্ষাৎ চাই। তৎকালীন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এম কে নারায়ণনের মাধ্যমে আমার হস্তক্ষেপে আমি সব রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তি এবং দেশটির স্থিতিশীল পরিস্থিতিতে প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করেছিলাম।’
এর কয়েক বছর পর জেনারেল মইন ক্যানসারে আক্রান্ত হলে যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর চিকিৎসার বিষয়টিতেও সহায়তা করেন বলে প্রণব মুখার্জি তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেছেন।
প্রণব মুখার্জি লিখেছেন, ‘শেখ হাসিনা আমাদের ঘনিষ্ঠ পারিবারিক বন্ধু। আমি পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকার সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য পর্যাপ্ত আন্তর্জাতিক চাপ তৈরির মাধ্যমে ভারত তাঁর দাবি পূরণে সহায়তা করার চেষ্টা করেছে। শেখ হাসিনা কারাগারে থাকার সময় আওয়ামী লীগের কিছু নেতা তাঁকে পরিত্যাগ করলে আমি তাঁদের ভর্ৎসনা করে বলি, কেউ যখন এমন বিপদে থাকে, তখন তাঁকে ত্যাগ করা অনৈতিক। ২০০৮ সালে বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন হয়। শেখ হাসিনা বিপুল বিজয় পান।’
এখন যতবারই প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশ সফরে আসবেন বলে ঘোষণা দেন, ততবারই এদেশের দেশপ্রেমিক সচেতন জনগণ উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় কাটে। এবারও তিনি যে সফরে আসলেন, দেশের জনগণকে তিনি এ দেশ ও জাতির ওপর ভারতীয় আগ্রাসন ও সম্প্রসারণবাদের বার্তাই দিয়ে গেলেন।
এরপর আর দু’জন মুখার্জি হলেনঃ ০১. আশুতোষ মুখার্জি ও ০২. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি, আশুতোষ মুখার্জিরই ছেলে। বলতে গেলে তো এভাবে বলা যায়ঃ ‘Like Father, Like Son।’
কে এই আশুতোষ মুখার্জি! তিনি একজন খুব নামকরা শিক্ষাবিদ। ১৯০৬ সাল থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বাঙালি মুসলমানকে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ করে দেয়ার জন্য প্রস্তাবিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতাকারী হিসেবে বহুল পরিচিত একটি নাম। তিনি মূলতঃ উগ্রপন্থী হিন্দুদের অন্যতম নেতা ছিলেন । ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ তার ঢাকা সফর শেষে কলকাতায় ফিরে এলে ১৯১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ড. রাশবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল তার সাথে দেখা করে এবং ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতামূলক একটা স্মারকলিপি দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সব থেকে বিরোধিতা করেছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় আর রাজনীতিক সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী।
প্রসঙ্গক্রমে বলি রবীন্দ্রনাথ দাদুও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন! ”১৯১২ সালের ২৮শে মার্চ কলিকাতা গড়ের মাঠে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিবাদে এক বিশাল জনসভার আয়োজন করা হয়।” [আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবাহিকতা এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথাঃ মেজর জেনারেল (অবসর প্রাপ্ত) এম এ মতিন, বীরপ্রতীক, পিএসসি।। আহমদ পাবলিশিং হাউস। (২০০০)।।
ডিকশনারি লেখক আশুতোষ মুখার্জির ব্যাপারে ড. শেখ আব্দুর রশীদ তার ‘সেই সিভিল সার্ভিস সেইসব সিভিলিয়ান’ বইয়ে লিখেছেন–