তিন মুখার্জি’র কবলে বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায়।

January 18, 2018 10:52 pm0 commentsViews: 334
নিউইয়র্ক থেকে ড. ওমর ফারুক।। স্থানীয় সময়ঃ ১৯ জানুয়ারি রাত প্রায় এগারটা।।
বাংলাভাষী মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য তিন মুখার্জি যেন এক আতঙ্কের নাম। আগের দিনে মারাঠা বর্গীদের এখানকার জনগোষ্ঠীর ওপর ‍যখন তখন হামলা, ‍অত্যাচার, নির্যাতন,  লুট ও সন্ত্রাসের কথা যেন সর্বজনবিদিত। তখনকার মায়েরা তার ছোট্ট শিশুমনিকে ঘুম পাড়াত মারাঠা বর্গী আসছে, এমন ভয় দেখিয়েই। আর এখনকার স্বাধীন দেশ ’বাংলাদেশ’ ভূখণ্ডের সচেতন নাগরিক ও দেশপ্রেমিক মানুষদের জন্য ’প্রণব মুখার্জি’ নামটিও যেন সাক্ষাত একটি আতঙ্কের নাম। তিনি ভারতের রাষ্ট্রাপতি এখন নেই। হলেও কী হবে, এখনও এ নামটি এদেশের ভারতীয় দালালদের কাছে নমস্য একটি খোদ দেবতার নাম হলেও দেশপ্রেমিক জনগণ যেন চমকিয়ে ওঠে। তিনি বাংলাদেশের একজন জামাই। আমাদের প্রধানমন্ত্রীও তাঁকে পিতৃবত শ্রদ্ধার ঢালি উপহার দেন। সেরা সব খাবার রান্না করে তিনি রন্ধনশিল্পেও যে অত্যন্ত সিদ্ধহস্ত, সেটি অন্তত প্রণব বাবুকে ভূরিভোজ করাতে তা প্রমাণ করার একটা সুবর্ণ সুযোগ পান। আমি ব্যক্তিগত ভাবে এটি উপভোগ করি। কেননা কাউকে পিতৃবত শ্রদ্ধা করাতে মনটি নিরানন্দ করার কোন কারণ কারোরই নেই। তাছাড়া তিনি তো শ্বশুর বাড়ি এলে একটু আদর আপ্যায়ন পেতেই পারেন, সে নিয়ে আমাদের কারোরই গোস্বা করার দরকারই বা কী!
এবার আসুন, দেখি- এ প্রণব’টা আসলে কে?
বিশ্বের কথিত বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি তিনি। জুলাই ২০১২-তে কার্যভার গ্রহণকারী প্রণব মুখার্জি  ভারতের  ত্রয়োদশ রাষ্ট্রপতি। তাঁর রাজনৈতিক কর্মজীবন ছয় দশকব্যাপী। তিনি ছিলেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা। বিভিন্ন সময়ে ভারত সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছিলেন। ২০১২ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে প্রণব মুখোপাধ্যায় ছিলেন ভারতের অর্থমন্ত্রী ও কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয় সমস্যা-সমাধানকারী নেতা। ১৯৬৯ সালে তদনীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাহায্যে প্রণব মুখোপাধ্যায় ভারতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় কংগ্রেসের টিকিটে নির্বাচিত হন। এরপর রাজনৈতিক কর্মজীবনে তাঁর দ্রুত উত্থান শুরু হয়। তিনি ইন্দিরা গান্ধীর একজন বিশ্বস্ত সহকর্মীতে পরিণত হন এবং ১৯৭৩ সালে ইন্দিরা গান্ধীর ক্যাবিনেট মন্ত্রিসভায় স্থান পান। ১৯৮২-৮৪ পর্বে তিনি ছিলেন ভারতের অর্থমন্ত্রী। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত তিনি রাজ্যসভার দলনেতাও ছিলেন। প্রণব মুখোপাধ্যায় বিভিন্ন সময় ভারতের বিদেশ, প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ, রাজস্ব ইত্যাদি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন।  ভারত-মার্কিন অসামরিক পরমাণু চুক্তি সাক্ষরের মত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। দলের প্রতি আনুগত্য ও অসামান্য প্রজ্ঞা এ বাঙালি রাজনীতিবিদকে কংগ্রেস দলে ও এমনকি দলের বাইরেও বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র করে তুলেছে। দেশের প্রতি অবদানের জন্য তাঁকে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান পদ্মবিভূষণ ও শ্রেষ্ঠ সাংসদ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। ১৯৮৪ সালে যুক্তরাজ্যের ইউরোমানি পত্রিকার একটি সমীক্ষায় তিনি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ পাঁচ অর্থমন্ত্রীর অন্যতম হিসেবে বিবেচিত হন।
শুধু তাই নয়, ভারতীয় রাজনীতির এক উজ্জ্বল নক্ষত্র বললেও ভুল বলা হবে না। জীবনে শুরুর দিকেএকজন ডাক ও টেলিগ্রাফ বিভাগের উচ্চমান কেরানি হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। তারপর তিনি হন কলেজ শিক্ষক। এরপর তিনি সাংবাদিকতাও করেছেন বেশকিছু দিন। এ সময় তিনি ভারতের শীর্ষ একটি পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তারপর জীবন সংগ্রামের বিভিন্ন অধ্যায় পেরিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন ভারতের রাষ্ট্রপতি। তিনি প্রণব মুখোপাধ্যায়, ভারতের প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি। ২০১২ সালের ২৫ জুলাই তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন। ত্রয়োদশ রাষ্ট্রপতির আসনটি পেতে বেশ প্রতিযোগিতাও তখন হয়েছিল। বিরোধীদলীয় প্রার্থী ছিলেন লোকসভার সদ্য বিদায়ী স্পিকার পিএস সাংমা। প্রণব মুখার্জি বিপুল ভোটে তাকে পরাজিত করে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। দীর্ঘ সাড়ে ৪ বছর তিনি রাষ্ট্রপতির আসনে ভারতের মত একটি বৃহত  দেশটিতে আসীন থেকে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বলতে গেলে বিশ্বের বুকে ভারতের মর্যাদা তিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন কালে বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।  ‍পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার মিরাটের এক ছোট্ট ছেলে পল্ট ‍ু একদিন ভারতের রাষ্ট্রপতি হবে, সেটি কেই বা ভেবেছিল।
১৯৩৫ সালের ১১ ডিসেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের (তত্কালীন বাংলা) বীরভূম জেলার মিরাটে কুলীন ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন পল্ট ‍ু। বাবা কিংকর মুখার্জি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য (১৯৫২-১৯৬৪)। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসে এমএ এবং আইন বিষয়ে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। প্রণব মুখোপাধ্যায় প্রায় পাঁচ দশক ভারতীয় সংসদের সদস্য। ১৯৬৯ সালে তিনি প্রথমবার কংগ্রেস দলের প্রতিনিধি হিসেবে রাজ্যসভায় নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৭৫, ১৯৮১, ১৯৯৩ ও ১৯৯৯ সালেও তিনি রাজ্যসভায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালে কেন্দ্রীয় শিল্পোন্নয়ন উপমন্ত্রী হিসেবে তিনি প্রথম ক্যাবিনেটে যোগদান করেন। ক্যাবিনেটে ক্রমান্বয়ে পদোন্নতির পর ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয় নি। তিনিেএগিয়ে গেছেন তার নিজস্ব  যোগ্যতা ও মেধায়।  লাভ করেছেন ভারতে বড়সড় সকল পদ।
এসব কথা পল্ট ‍ু বাবুকে নিয়ে কেন এমন বিস্ত ‍ৃত করে লিখলাম। আমি তো আসলে তাঁর জীবনী লিখতে বসি নি। আমি বুঝাতে চাইছে, এই মুখার্জি বাবুর রোষাণলে আমাদের ভূখণ্ড। কী তার যোগ্যতা যে, আরেকটি দেশে থাবা বিস্তারের জন্য ভারতের মত দেশ তার মত এক বাঙালিকে বেছে নিলেন। ভারত আর যাই কিছু করে, দেশপ্রেমে উজ্জীবিত এক বিশাল জনগোষ্ঠীর দেশ মানেই ভারত। তারা কোনরকমই ব্যক্তি স্বার্থকে উর্দ্ধে স্থান দিতে নারাজ। সকল সময়ই দেশপ্রেমিক মেধাবী মানুষগুলোকেই যে কেনা ইস্যুতে দেশটি বেছে নেয়। বাংলাদেশে সাম্রাজ্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদের ছোবল নিক্ষেপ করতে প্রণব মুখার্জিকে বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক পজিটিভ দিক আছে। নম্বর ১.এ দেশে তার শ্বশুর বাড়ি। নম্বর ২. শেখ ফ্যামিলির সাথে সখ্যতা। ০৩. শেখ হাসিনাকে কন্যাসম মর্যাদা ও তিনিও প্রণব বাবুকে পিতৃসম মর্যাদা দেন। আরও কিছু বিষয় আছে, তা আমি এ মূহুর্তে স্পর্শ করতে চাই না।
সময়ে অসময়ে প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশের  রাজনীতিতে কী ভূমিকা রাখেন, সে নিয়ে অল্প একটু আলোচান করতে চাই। লেখার কলেবর বৃদ্ধি থেকে রক্ষার জন্য আমি বিস্তারিত বিষয় উল্লেখ ‍করতে চাইছি না।

বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় কারাগারে আটক বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রধান মন্ত্রী খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে ভূমিকা নিয়েছিলেন সে সময়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি ওরফে শৈশবে ডাকা পল্ট ‍ু । তিনি দুজনকে মুক্ত করার জন্য হস্তক্ষেপ করতে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশকেও অনুরোধ করেন। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হবে—এমন আশঙ্কা ছিল ওই সময়ের সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদের। তবে হাসিনা ফিরে আসার পর তেমনটা ঘটবে না বলে নিজে দায়িত্ব নিয়েছিলেন প্রণব মুখার্জি।

প্রণব মুখার্জির আত্মজীবনীমূলক বই দ্য কোয়ালিশন ইয়ারস ১৯৯৬-২০১২তে এসব কথা তুলে ধরেছেন ভারতের সাবেক এই রাষ্ট্রপতি। এ বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ তুলে ধরা হয়েছে ভারতের প্রভাবশালী ইংরেজি সাময়িকী ইন্ডিয়া টুডে’র  অক্টোবর ২০১৭ সালের একটি  সংখ্যায় এভাবেঃ

’বাংলাদেশের রাজনীতিতে ১/১১-এর সেনানিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়টা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। প্রতিবেশী দেশ ভারতের রাজনীতির শক্তিশালী চরিত্র প্রণব মুখার্জির লেখায় সেই প্রসঙ্গ উঠে এসেছে সংগত কারণেই। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন। তিনি ড. ফখরুদ্দীন আহমদকে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেন। সে সময় আরও অনেক রাজনৈতিক নেতার মতো এখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকেও কারাগারে যেতে হয়।

প্রণব মুখার্জি লিখেছেন, ‘আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখার পাশাপাশি একটি শান্তিপূর্ণ, গ্রহণযোগ্য, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দিকে জোর দিয়েছিলাম।’

প্রণব মুখার্জির বইয়ে উল্লেখ আছে, ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদ ছয় দিনের ভারত সফরে যান। এ সময় প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় মইনের। এ প্রসঙ্গে প্রণব মুখার্জি লিখেছেন, ‘অনানুষ্ঠানিক আলোচনার সময়, আমি তাঁকে রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির গুরুত্ব বোঝাই। তিনি এই ভয় পাচ্ছিলেন যে শেখ হাসিনা বের হয়ে আসার পর তাঁকে (জেনারেল মইন) চাকরিচ্যুত করতে পারেন। কিন্তু আমি ব্যক্তিগত দায়িত্ব নিই এবং শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলেও তাঁর বহাল থাকার ব্যাপারে তাঁকে আশ্বস্ত করি।’

প্রণব মুখার্জি লিখেছেন, ‘আমি খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা উভয়ের মুক্তির ব্যাপারে হস্তক্ষেপের অনুরোধ জানাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউর (বুশ) সাক্ষাৎ চাই। তৎকালীন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এম কে নারায়ণনের মাধ্যমে আমার হস্তক্ষেপে আমি সব রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তি এবং দেশটির স্থিতিশীল পরিস্থিতিতে প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করেছিলাম।’

এর কয়েক বছর পর জেনারেল মইন ক্যানসারে আক্রান্ত হলে যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর চিকিৎসার বিষয়টিতেও সহায়তা করেন বলে প্রণব মুখার্জি তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেছেন।

প্রণব মুখার্জি লিখেছেন, ‘শেখ হাসিনা আমাদের ঘনিষ্ঠ পারিবারিক বন্ধু। আমি পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকার সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য পর্যাপ্ত আন্তর্জাতিক চাপ তৈরির মাধ্যমে ভারত তাঁর দাবি পূরণে সহায়তা করার চেষ্টা করেছে। শেখ হাসিনা কারাগারে থাকার সময় আওয়ামী লীগের কিছু নেতা তাঁকে পরিত্যাগ করলে আমি তাঁদের ভর্ৎসনা করে বলি, কেউ যখন এমন বিপদে থাকে, তখন তাঁকে ত্যাগ করা অনৈতিক। ২০০৮ সালে বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন হয়। শেখ হাসিনা বিপুল বিজয় পান।’

এখন যতবারই প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশ সফরে আসবেন বলে ঘোষণা দেন, ততবারই এদেশের দেশপ্রেমিক সচেতন জনগণ উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় কাটে। এবারও তিনি যে সফরে আসলেন, দেশের জনগণকে তিনি এ দেশ ও জাতির ওপর ভারতীয় আগ্রাসন ও সম্প্রসারণবাদের বার্তাই দিয়ে গেলেন।

এরপর আর দু’জন মুখার্জি হলেনঃ ০১. আশুতোষ মুখার্জি ও ০২.  শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি, আশুতোষ মুখার্জিরই ছেলে। বলতে গেলে তো এভাবে বলা যায়ঃ ‘Like Father, Like Son।’

 কে এই আশুতোষ মুখার্জি! তিনি একজন খুব নামকরা শিক্ষাবিদ। ১৯০৬ সাল থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব পালন  করেছিলেন। বাঙালি মুসলমানকে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ করে দেয়ার জন্য প্রস্তাবিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতাকারী হিসেবে বহুল পরিচিত একটি নাম। তিনি মূলতঃ উগ্রপন্থী হিন্দুদের অন্যতম নেতা ছিলেন । ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ তার ঢাকা সফর শেষে কলকাতায় ফিরে এলে ১৯১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ড. রাশবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল তার সাথে দেখা করে এবং ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতামূলক একটা স্মারকলিপি দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সব থেকে বিরোধিতা করেছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় আর রাজনীতিক সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী।

প্রসঙ্গক্রমে বলি রবীন্দ্রনাথ দাদুও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন! ”১৯১২ সালের ২৮শে মার্চ কলিকাতা গড়ের মাঠে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিবাদে এক বিশাল জনসভার আয়োজন করা হয়।” [আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবাহিকতা এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথাঃ মেজর জেনারেল (অবসর প্রাপ্ত) এম এ মতিন, বীরপ্রতীক, পিএসসি।। আহমদ পাবলিশিং হাউস। (২০০০)।।

 ডিকশনারি লেখক আশুতোষ মুখার্জির ব্যাপারে ড. শেখ আব্দুর রশীদ তার ‘সেই সিভিল সার্ভিস সেইসব সিভিলিয়ান’ বইয়ে লিখেছেন–

“কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় মহল হতে ছিল সবচেয়ে বেশি প্রতিবন্ধকতা। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর স্যার আশুতোষ মুখার্জীর বিরোধিতা ছিল একেবারে সর্বজনবিদিত ও অতি প্রকাশ্য। এক্ষেত্রে তার পরম সুহৃদ ও বন্ধু পন্ডিত মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ছিলেন একাট্টা। কিন্তু অবশেষে ঢাকায় যখন বিশ্ববিদ্যালয় হয়েই গেল, তখন এর ভাইস-চ্যান্সেলর হার্টগের মেধা-শিকারযজ্ঞের প্রথম দিকের পাত্রই হয়ে গেলেন এই বিখ্যাত পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। অনেকে অবাক হলেন। আশুতোষ মুখার্জী তো ক্ষেপে অস্থির হ’য়ে গেলেন। ক’দিন আগেই না দু’বন্ধু মিলে প্রস্তাবিত ঢাকা ইউনিভার্সিটিকে ব্যঙ্গ ক’রে ‘মক্কা ইউনিভার্সিটি’ নামে অভিহিত করেছেন। কত যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিতে সচেষ্ট হয়েছেন যে, ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করার কোন প্রশ্নই ওঠে না। আর ক’দিনের ব্যবধানে হরপ্রসাদ সেই প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিলেন। হরপ্রসাদের ছুটি বা রিলিজ নেয়া ও তার পাওনাদি আদায়ের আবেদনের ওপরও বাগড়া বাঁধানো হয়েছিল তখন।”
 
“…. মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার পর ছুটিতে একবার কলকাতায় গিয়ে বন্ধুর সাক্ষাতের চেষ্টা ক’রেও ব্যর্থ হন। যে ক’বছর বেঁচে ছিলেন স্যার আশুতোষ মুখার্জী আর হরপ্রসাদের মুখদর্শন করেননি। বাক্যালাপ তো দূরের কথা, পত্রালাপও হয়নি কখনো।” (মুক্তচিন্তা প্রকাশনা, ২০১১, পৃষ্ঠা ২২৬-২২৭)
 
আরেক উগ্রবাদী হিন্দুত্ববাদী মুখার্জি হলেন আশুতোষ মুখার্জির-ই পরম স্নেহের ছেলে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি।
তিনি হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল বিজেপি এর বাপ। শ্যামাপ্রসাদ বিজেপির পূর্বসংস্করণ ‘ভারতীয় জনসংঘ’ প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৫১ সালে। ১৯৪৩ থেকে ৪৬ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন উগ্রপন্থী গ্রুপ ‘হিন্দু মহাসভা’র সভাপতি। এবং সবাই জানে ৪৭ এর বাংলা ভাগের নায়ক ছিলেন এই মুখার্জি।
#বাঙালি মুসলমানের শিক্ষাগত জাগরণের পেছনে মূল ভূমিকা রাখা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করেছেন আশুতোষ মুখার্জি। 
#মুসলমানবিদ্বেষ থেকে বাংলা ভাগে নেতৃত্ব দিয়েছেন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি।
আর বাংলাদেশিদের কাছে প্রণব মুখার্জির সবচেয়ে বড় পরিচয় কী সেটি তো আগেই বিধৃত করেছি। 
 
প্রণব মুখার্জির সব থেকে পরিচয় হচ্ছে, এরশাদের সেই স্বৈরশাসনের পর একটি অবাধ ও গ্রহণযোগ্য সাধারণ নির্বাচন ১৯৯১ সালের মাঝামাঝিতে অনুষ্ঠানের পর বাংলাদেশে যে ধারাবাহিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চলছিল, সেই প্রক্রিয়াকে ভারতের স্বার্থে থামিয়ে দিতে প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন প্রণব মুখার্জি। তবে কাকতালীয় বিষয় হল এই তিন মুখার্জিই কিন্তু পশ্চিবঙ্গের লোক! অতীত থেকে বর্তমান- বাংলাদেশিদের আধিপত্যবাদের বেড়াজাল টকাতে পশ্চিমবঙ্গের এরকম কিছু বাঙালি শাসক ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণি সব সময় নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। বন্ধুত্ব ও জামাই বাবুর আড়ালে ষড়যন্ত্রের গুটি চালানো  প্রণব মুখার্জি হল সর্বশেষ সংস্করণ।
[ড. ওমর ফারুক।। লেখক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও সামজিক গবেষক। ইংরেজি সাপ্তাহিক ঢাকা পোস্ট সম্পাদক। অনলাইন পোর্টালঃ ডেইলিঢাকাপোস্টডটকম এর প্রধান সম্পাদক। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক নির্বাহী সদস্য।]

Leave a Reply

You must be logged in to post a comment.

Editor in Chief: Dr. Omar Faruque

Editor: Dr. Morjina Akhter

All contact: 400E Mosholu Parkway South Apt # A23,The Bronx, New York 10458, USA

Mob. 001.347.459.8516
E-mail: dhakapost91@gmail.com