ঢাকা এবং কলকাতা দুই মহানগরীর তুলনামূলক ঐতিহাসিক পর্যালোচনা।।
ঢাকা মেগাসিটিঃ ঢাকা এখন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের রাজধানী এবং বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ মেগাসিটি। ঢাকা ৬৫০ বছর সময় ধরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজ্য/সাম্রাজ্য/রাষ্ট্রের গ্রামীণ শহর, জেলা মহকুমা, বিভাগীয় সদর, প্রাদেশিক/রাষ্ট্রীয় রাজধানী হিসাবে গড়ে উঠেছে। বাংলায় মুসলিম আগমনের পূর্বে সেন যুগ থেকে ঢাকায় নগর সভ্যতার পত্তন এবং নাগরিক জীবনযাত্রার কথা ইতিহাস পাঠে জানা যায়। মধ্যযুগে বাংলায় স্বাধীন আফগান সুলতানদের শাসনামলে ঢাকা আফগান শাসকগোষ্ঠীদের প্রশাসনিক কার্যালয় ছিল। তখন দোলাই নদীর তীর/ধোলাই খাল এবং নারিন্দা অঞ্চলে ঢাকার সর্ব প্রাচীন বিনত বিবির মসজিদ ও প্রাচীন মুসলিম জনবসতি গড়ে উঠেছিল। এই সময়ে শাখারীবাজার ও তাঁতীবাজার হিন্দু পট্টি গড়ে উঠেছিল। আধুনিক ঢাকা শহরের ইতিহাস পাওয়া যায় মূলত মুঘলদের হাতে রাজধানী হিসাবে ঢাকা শহরের পত্তনের পর থেকে। সুবেদার ইসলাম খান সদলবলে ১৬১০ সালে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে আগমন করেন এবং ঢাকাকে সুবা বাংলার রাজধানী হিসাবে ঘোষনা করেন। এই সময় থেকে ঢাকা একটি উন্নত মুঘল নগরী হিসাবে বিকাশ লাভ করতে শুরু করে। যা আজকে পুরান ঢাকা হিসেবে পরিচিত। এজন্য সুবেদার ইসলাম খানকে ঢাকা নগরীর প্রতিষ্ঠাতা এবং ১৬১০ সালকে ঢাকা শহরের প্রতিষ্ঠা বছর ধরা হয়। পরে সুবেদার মুর্শিদকুলী খান ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে সুবা বাংলার রাজধানী স্থানান্তর করেন। এতে ঢাকা রাজধানীর মর্যাদা হারালেও মুর্শিদাবাদ নগরের পাশাপাশি ঢাকা একটি উন্নত ব্যবসা সমৃদ্ধ মুসলিম প্রধান মুঘল নগরী হিসাবে টিকে ছিল। তখন এখানকার ঢাকাই মসলিন কাপড়ের খ্যাতি ছিল বিশ্বব্যাপী। ঢাকা থেকে সারা বিশ্বে মসলিন রপ্তানী করা হোত। মুঘল আমল থেকেই ঢাকায় সুবেদার, নায়েব নিজাম, আমীরদের নেতৃত্বে ও পৃষ্ঠপোষকতায় ঈদের আমন্দ মিছিল, মহরমের তাজিয়া মিছিল, সাকরাইনে ঘুড়ি উড়ানো প্রভৃতি প্রথার প্রচলন হয়েছিল। ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর নতুন ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর কাছে মুসলিম প্রধান ও মুসলিম প্রভাবিত মুর্শিদাবাদ নগরীর গুরুত্ব কমতে থাকে। তারা নিজেদের নানাবিধ সাম্রাজ্যবাদী প্রশাসনিক, আর্থ- রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক, নিরাপত্তা, রণকৌশলগত সুবিধার্তে নতুন ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর প্রতি মিত্রভাবাপন্ন ও তাদের অনুগত হিন্দু অধ্যুষিত বাংলার দক্ষিণাঞ্চলের কলকাতা অঞ্চলকে তাদের প্রশাসনিক অঞ্চল হিসাবে গুরুত্ব দিতে ও গড়ে তুলতে শুরু করে।যার ধারাবাহিকতায় তারা ১৭৭২ সালে মুর্শিদাবাদ থেকে রাজধানী কলকাতায় স্থানান্তর করে। এই সময় থেকে কলকাতাই হয়ে উঠে ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্যের এবং তার সর্ববৃহৎ ফোর্ট উইলিয়াম বেঙ্গল প্রেসিডেন্সী প্রভিন্সের/প্রদেশের নতুন কেন্দ্রীয় রাজধানী এবং সকল কর্মকান্ডের কেন্দ্রস্থল। এতে করে মুঘল যুগের মুসলিম প্রধান মুর্শিদাবাদ ও ঢাকা শহর দুটি প্রশাসনিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ব্যবসায়িক, সাংস্কৃতিক গুরুত্ব হারায়, অধঃপতিত হয় এবং সাধারণ জেলা মহকুমায় পরিণত হয়। ঢাকা বিভাগীয় সদরের মর্যাদা আরো অনেক পরে পেয়েছিল।
মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ববাংলার সর্ববৃহৎ, প্রধান গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসেবে কলকাতার পরে ঢাকার আর্থ-রাজনৈতিক গুরুত্ব সব সময়ই আলাদা ছিল এবং ধীরে ধীরে এর গুরুত্ব বাড়ছিল। ফলে অষ্টাদশ শতকের দিকে ঢাকা জেলা মহকুমা থেকে বিভাগীয় সদরে পরিণত হয়। ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ ও অভিজাতদের পরামর্শে বাংলার গভর্নর লর্ড কার্জন ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্যের সর্ববৃহৎ, সবচেয়ে জনবহুল, ব্যাপক প্রশাসনিক, সামাজিক, রাজনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত ফোর্ট উইলিয়াম বেঙ্গল প্রেসিডেন্সী প্রদেশকে দ্বিখণ্ডিত করে প্রথমে তা থেকে পূর্ববাংলাকে বিচ্ছিন্ন করে, আসামকে পূর্ববাংলার সাথে যুক্ত করে এবং ঢাকাকে রাজধানী করে নতুন মুসলিম প্রধান পূর্ববাংলা ও আসাম নামক প্রদেশ গঠন করেন। এরপর অবশিষ্ট পশ্চিমবঙ্গ-বিহার-উড়িষ্যাকে নিয়ে সাবেক বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি প্রদেশ ক্ষুদ্র পরিসরে পুনর্গঠন করেন। নতুন মুসলিম প্রদেশে মুসলমানরা শাসকগোষ্ঠীতে পরিণত হয় এবং এর নতুন সরকার প্রশাসনে স্থানীয় শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানদের চাকরির পদ, সুযোগ সৃষ্টি হয়। যা মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক উল্লাস, উদ্দীপনা, তাদের সম্প্রদায়গত উন্নতির পথ এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যতের অসীম সম্ভাবনার মসৃন পথ সৃষ্টি
করেছিল। ব্রিটিশ সরকার আধুনিক ঢাকা শহর নির্মাণের জন্য পরিকল্পনা করে। সেই অনুসারে শহরে কিছু রাজপথ, গুরুত্বপূর্ণ সরকারী ভবন নির্মাণ করা হয়। রমনা পর্যন্ত ঢাকার সীমানা বৃদ্ধি করা হয়। প্রাদেশিক সরকার প্রশাসন স্থানীয় অনগ্রসর মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষা প্রসারের ব্যাপক উদ্যেগ গ্রহন করে। ঢাকা অঞ্চলের মুসলমান ও তফসিল হিন্দু কৃষক ও প্রজারা ভূমিতে অধিকার লাভ করে এবং তাদের উপর হিন্দু জমিদার ও মহাজনদের শোষণ, নিপীড়ণ অনেকটা হ্রাস পায়। এর ফলে বাঙালী মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ, শিক্ষার হার অনেক বাড়ে। নব্য শিক্ষিত মুসলমানরা সরকারী চাকরিতে সর্বক্ষেত্রে অগ্রসরমান হিন্দুদের সাথে প্রতিযোগীতায় নামে। এই নতুন প্রদেশব্যবস্থা ১৯১১ সাল পর্যন্ত প্রায় ৬ বছর টিকে ছিল। কারণ কলকাতার বর্ণ হিন্দুদের সন্ত্রাসীবাদী স্বদেশী আন্দোলনের কারণে এবং ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী সুবিধার্থে ১৯১১ সালে পুনরায় বঙ্গভঙ্গ রদ করে পূর্ববাংলা ও আসাম, পশ্চিমবঙ্গ-বিহার-উড়িষ্যা প্রদেশ দু’টি বিলোপ এবং পূর্ববাংলা ও পশ্চিমবঙ্গ তথা দুই বাংলা ভূখণ্ডকে একত্রিত করে নতুন অখন্ড বাংলা প্রদেশ গঠন করে। উন্নত, সমৃদ্ধ, বড় শহর হিসাবে কলকাতা যুক্তবাংলার রাজধানী হয় এবং ঢাকা তার রাজধানীর মর্যাদা হারিয়ে পুনরায় বিভাগীয় সদরে পরিণত হয়। ব্রিটিশ আমলে পূর্ববাংলাকে কলকাতার হিন্টারল্যান্ড/পশ্চাৎপদ/অনগ্রসর অঞ্চল বলে অভিহিত করা হত। ঢাকাসহ পূর্ববাংলার মানুষ কলকাতা শহর ও তার মধ্যবিত্ত শ্রেণির উপর সব কিছুর জন্য নির্ভরশীল ছিল। সকল আধুনিক নাগরিক সুযোগ-সুবিধা, সরকারী প্রশাসনিক কর্মকান্ড, শিক্ষা, চাকুরী, আভিজাত্যবোধ, বিনোদন উপভোগ, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, রাজনৈতিক কারণে পূর্ববাংলার অধিকাংশ অভিজাত ও ঢনাঢ্য হিন্দু জমিদার, তাদের পরিবার কলকাতাতেই স্থায়ীভাবে বসবাস করত এবং সেখানে থেকেই তারা তাদের নায়েব-গোমস্তাদের দিয়ে পূর্ববাংলার জমিদারী পরিচালনা করত। ঢাকার প্রতিষ্ঠিত ও অগ্রসরমান অভিজাত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির বর্ণ হিন্দু পরিবারদের সন্তানরা কলকাতাতে পড়াশুনা শেষ করে চাকরি, পেশাগত, ব্যবসা ক্ষেত্রে প্রবেশ করত। সে সময় ঢাকার অভিজাতরা ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করত। ঢাকার জমিদার খাজা ও নবাব পরিবার ছিল ঢাকার সবচেয়ে বিত্তশালী, মর্যাদা সম্পন্ন, ক্ষমতাশালী, প্রভাবশালী পরিবার। তারা পুরান ঢাকায় আধুনিক পঞ্চায়েত সমাজ ও বিচার ব্যবস্থার পত্তন ও সুদৃয় করেছিল। উনবিংশ শতকের ত্রিশ দশকের দিকে ঢাকার অধিকাংশ মানুষ ছনের তৈরি ঘরে বসবাস করত।
১৯১১ সালের বঙ্গভঙ্গ রদের সময় থেকে ১৯৪৭ সালের বাংলা ও ভারত বিভাগ পর্যন্ত কলকাতা অখন্ড বাংলার রাজধানী এবং ঢাকা ঢাকা বিভাগের বিভাগীয় শহর ছিল। তবে বঙ্গভঙ্গের সময় থেকে হিন্দু প্রধান পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত রাজধানী কলকাতার বিপরীতে মুসলিম প্রধান পূর্ববাংলার সর্বপ্রাচীন, সর্ববৃহৎ, গুরুত্বপূর্ণ, উন্নত, নেতৃস্থানীয় প্রধান মুসলিম শহর হিসাবে ঢাকার আলাদা গুরুত্ব বরাবরই ছিল। কারণ ঢাকা ছিল পূর্ববাংলার প্রধান প্রাচীন গুরুত্বপূর্ণ নগর সভ্যতার কেন্দ্রস্থল এবং পূর্ববাংলা অঞ্চলের মানুষের চাকুরী, ব্যবসা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, সকল রাজনৈতিক কর্মকান্ড, আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল। ১৯২১ সালে ঢাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে এক দশকের ব্যবধানে ঢাকায় ক্ষুদ্র পরিসরে শিক্ষিত পেশাজীবী বাঙালী মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি/সমাজের পত্তন ঘটে এবং পরবর্তীকালে তাদের ভেতর থেকেই ঢাকাভিত্তিক বাঙালী মুসলিম বুদ্ধিজীবী শ্রেণি/সমাজের আবির্ভাব ঘটে। তারাই ছিল কৃষক-প্রজা দল ও তার আন্দোলন, মুসলিমলীগ ও পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম শক্তি। কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার সমর্থনে কলকাতার বর্ণ হিন্দুরা বাংলাবিভাগ আন্দোলন করায় ১৯৪৭ পুনরায় বাংলাবিভাগ হয়। অখন্ড বাংলার দক্ষিণ-উত্তরাঞ্চলের হিন্দু প্রধান বিভাগ, জেলা, অঞ্চলগুলো নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য গঠিত হয় এবং তা ভারতীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয়। অপরদিকে অবশিষ্ট সকল মুসলিম প্রধান বিভাগ, জেলা, অঞ্চলগুলো নিয়ে পূর্ববাংলা প্রদেশ গঠিত হয় এবং তা পাকিস্তান ইসলামি প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত হয়। ঢাকা হয় পূর্ববাংলা প্রদেশের রাজধানী। পাকিস্তান আমলেই ঢাকাকেন্দ্রিক বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং আধুনিক ঢাকা শহর প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ লাভ করেছিল। তখন অধিকাংশ অভিজাতদের বাসার এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান ভবনে দোতলায় উঠার সিড়ি সেগুন কাঠের হত। যেমন, ঢাকার আহসান মঞ্জিল, কবি নজরুল ইসলাম কলেজের পুরাতন ভবন এর উজ্জ্বল উদাহরণ। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে নির্মিত বহু বাসার সদর দরজার দেয়ালের উপরে মুসলিম জাতীয়তাবাদ, মুসলিমলীগ/পাকিস্তান আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে চাঁদতারা খচিত থাকত। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ঘোড়া দৌড়ের প্রতিযোগিতা হত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী আশির দশক পর্যন্ত ঢাকার অধিকাংশ বাড়ি দ্বিতল ও খোলামেলা ছিল। বিশেষ করে পুরান ঢাকার দোতালা বাসাগুলো পাশাপাশি লাগোয়া ছিল বলে এক বাসার ছাদ টপকে আরেক বাসার ছাদে ও বাসায় অনায়াসে যাতায়াত করা যেত। বিকালে বাসার ছাদে উঠে ঘুরাফেরা করার, আড্ডা দেবার ও নাস্তা করার রেওয়াজ ছিল। পুরান ঢাকার বাড়ির সামনে/মাঝে এক চিলতে খোলা উঠান থাকত এবং নতুন ঢাকার বাড়ির সামনে/পাশে ফুল-ফলের বাগান থাকত। পুরান ঢাকার অধিকাংশ বাড়ির সদর দরজা কাঠের এবং নতুন ঢাকার বাসাবাড়ির সদর দরজা লোহার গ্রিলের হোত। জানালা শিক ও কাঠের তৈরি হোত। অধিকাংশ একতলা/দোতালা মসজিদের ওজুখানার দিকে চৌবাচ্চা ও তাতে হরেক রকমের মাছ থাকত। গরুর গাড়ি ও ঢেলা গাড়িতে পণ্য-সামগ্রী পরিবহন করা হোত। গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার এবং তিতাশ গ্যাস লাইনের বাণিজ্যিক সংযোগ প্রদানের পূর্বে আশির দশক পর্যন্ত ঢাকার গৃহিনীরা মাটির তৈরি লাকড়ী চুলাতেই রান্না করত।
সবশেষে ১৯৭১ সালে যুক্তপাকিস্তানের অন্তর্গত পূর্বপাকিস্তান প্রদেশের বাঙালিরা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানের অবাঙালি শাসকগোষ্ঠী ও পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে যুক্তপাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা করে। ঢাকা হয় এর রাজধানী। মুঘল-ব্রিটিশ আমল থেকেই ঢাকা ঐতিহ্যগতভাবে বাজার ও গলি প্রধান শহর হিসেবে পরিচিত। প্রাচীন ঢাকা বায়ান্ন বাজার তিপান্ন গলির শহর বলেও পরিচিত ছিল। ফলে ঢাকার রাজপথ ও গলিগুলো পরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেনি এবং সেগুলো প্রশস্ত নয়। আর এলাকাভিত্তিক গলিগুলো আরো সরু। অধিকাংশ সরু গলিতেই পাশাপাশি দুটো রিক্সা যাতায়াত করতে পারে না। তবে মুঘল ও ব্রিটিশ আমলে ঢাকা পুরান ঢাকার অঞ্চলকে কেন্দ্র করেই বিকাশ লাভ করেছে। আর পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে ঢাকা সম্প্রসারিত হয়ে নতুন ঢাকা অঞ্চলের পত্তন ও বিকাশ ঘটেছে। সমগ্র ঢাকা শহরের প্রায় প্রতিটি অলিগলি, এলাকায় মসজিদ আছে। যা বিশ্বের অন্য কোন মুসলিম শহরে দেখা যায় না। ঢাকাবাসীর প্রধান যানবাহন রিক্সা। এজন্য ঢাকাকে মসজিদের নগরী এবং রিক্সার নগরী বলা হয়। ঢাকায় ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, শবে বরাত, ঈদে মিলাদুন্নাবী, দূর্গাপূজা ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য ও উদ্দীপনার সাথে পালন করা হয়। দেশজ উৎসব হিসাবে ঘুড়ি উড়ানোর সাকরাইন, বসন্ত বরণের পহেলা ফাল্গুন, বাংলাবর্ষ বরণের পহেলা বৈশাখ এবং পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাবে খ্রীষ্টীয় নববর্ষ থার্টিফাস্ট নাইট, ভেলেন্টাইন ডে উৎসবগুলো অত্যন্ত উৎসাহের সাথে জাকজমকপূর্ণভাবে, আনন্দ-উল্লাসের সাথে পালন করা হয়। বাংলা ভাষায় এই রাষ্ট্রটি চলছে। ফেব্রুয়ারী মাসে ঢাকায় বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে অমর একুশে বইমেলার আয়োজন এবং ২১শে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ দিবস/আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়। ঢাকার আশির দশকের পপ গায়ক ও ব্যান্ড গ্রুপগুলো আধুনিক বাংলা ব্যান্ড সংগীতের পথিকৃত। ঢাকার চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা ২০১৭ সালে জাতিসংঘের ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্য হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। ঢাকার টিভি নাটক বরাবরই কলকাতার টিভি নাটকের চেয়ে অনেক বেশি মানসম্মত, বহুমাত্রিক বৈচিত্র্যপূর্ণ, জীবনমুখী। ঢাকাকে এখন বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির রাজধানী বলা হয়। ঢাকাকে বিশ্বের অন্যতম অপরিকল্পিত, ঘন বসতিপূর্ণ এবং যানজটের শহর হিসেবে গণ্য করা হয়। ইতিহাসে বির্বতনের পথ ধরে মুঘল-ব্রিটিশ আমল থেকে পাকিস্তান-বাংলাদেশ যুগ পর্যন্ত ঐতিহাসিকভাবেই ঢাকা একটি অপরিকল্পিত জেলা-বিভাগীয় শহর, প্রাদেশিক-রাষ্ট্রীয় রাজধানী, মেট্টোপলিটন-মেগাসিটি হিসাবে গড়ে উঠেছে, বিকশিত হয়েছে, হচ্ছে। ঢাকা প্রাচীনকাল থেকেই পূর্ববাংলার নগর সভ্যতার মূল কেন্দ্রস্থল হিসাবে পরিগণিত হয়ে এসেছে। আর বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে রাজধানী ঢাকা এখন বাংলাদেশের সকল প্রকার রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের এবং জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রস্থল। ঢাকা থেকে এ অঞ্চলের বাঙালি মুসলমান শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশ সরকার পরিচালনা এবং বাংলাদেশকে শাসন করে থাকে। আমরা ঢাকাইয়ারা এবং সাধারণ ঢাকাবাসী এই কিংবদন্তি ঢাকার আদিবাসী এবং অধিবাসী। নিঃসন্দেহে এই ব্যাপারগুলো আমাদের সবার জন্য অত্যন্ত গর্ব ও আনন্দের ব্যাপার। চলবে।