জালালেরা মরে গিয়ে বেঁচে যায়!
ইফতেখায়রুল ইসলাম
পীরেরবাগে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযানে নিহত হন গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক মো. জালাল উদ্দীন, পিপিএম! দেশের জন্য জালালদের এই আত্মত্যাগে আমরা কি কখনো বলব অভ্যন্তরীন নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে ইন্সপেক্টর জালাল শহীদ হয়েছেন! যা-ই হোক সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ।
চাকরিজীবনে জালাল সাহেব কোনো শাস্তি পাননি বরং পেয়েছেন পুরস্কার; তাঁর সার্ভিস বুকটি ঝকঝকে পরিষ্কার! তাতে আসলে কী-ই বা আসে যায়! গত বছরের ১২৮ পুলিশ সদস্যের মৃত্যুর পর সংখ্যাটি এখন ১২৯!! একমাত্র পেশা যেখানে দায়িত্বের সর্বোচ্চ ত্যাগের নাম- মৃত্যু! এরূপ প্রতিনিয়ত মৃত্যুর ঝুঁকি পুলিশকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মুখোমুখি হতে হয়।
পুলিশ সদস্যের একটি ভুলের জন্য হাজারো বার পুলিশের প্রতিটি সদস্যকে ধরে ধরে গালিগালাজ করার মতো লোকের মোটেও অভাব নেই আমাদের দেশে। এমনকি এক পুলিশের অপরাধে পুরো ডিপার্টমেন্টকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো লোকের সংখ্যাও কম নয়।
কিন্তু এক পুলিশের ভালো কাজের স্বীকৃতি আমরা আবার পুরো বিভাগকে দিতে চরম কার্পণ্য বোধ করি! সত্যি সেলুকাস! কী বিচিত্র তাই না!
এতে আসলে কিছুই হয় না, মনের অন্দরমহলে ঝড় বয়ে যায় শুধু! তাতে কী হয়েছে পুলিশ শুধু তাঁর দায়িত্বই পালন করে! মরতে যে হবে তা জেনেই তো এসেছে, এত নাটকের আশ্রয় নেয়ার কি আছে তাতে।
আহা! জীবনটা ঠিক এই জায়গাতে এসেই হেরে যায়। অবদানগুলো ক্রমাগত বাক্যবাণে জর্জরিত হয়! তাতে কী হয়েছে, সাম্প্রতিক দুর্নীতিগ্রস্তের তালিকায় পুলিশ প্রথম বিশেও জায়গা পায়নি! পুলিশ তো পুলিশই! তাতেই বা কী হয় যে, পুলিশ তাদের অভ্যন্তরীণ পরিশুদ্ধির জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে! কিছু কি আদৌ হয়?
আহা! অভ্যন্তরীন বিষয়ে কত সদস্য শাস্তি পায় তা তো আপনাকে ধরে ধরে জানানোর সময় আমাদের হয় না! আপনারা জানবেনও না। আচ্ছা যতটা পরিশুদ্ধির ব্যবস্থা আমাদের এখানে রয়েছে তার সিকি ভাগ পরিশুদ্ধির ব্যবস্থা আপনার, আমার ও অবশিষ্ট সবার মাঝে রয়েছে তো?
জালালেরা মরে যায়, মরে গিয়ে মৃত হয়! তাঁর সহকর্মীরা জানাজায় অংশ নেন, পরদিন আবার ঝাঁপিয়ে পড়েন নিজেদের কাজে! কি আর হবে? আরও একটি মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১২৯ এর স্থলে ১৩০-ই হবে!
জালালেরা বেঁচে থাকে শুধু সারা জীবন স্ত্রী ও সন্তানদের সময় দেয়া থেকে বঞ্চিত করে। পরম আত্মীয়রাই কেঁদে কেঁদে সাগর বানায়, আর কারো চোখে এক ফোঁটা জলও আসে কী? আহা! জীবন! দেশের তরে জীবন দিলেও জালালদের জন্য কোথাও মোমবাতি জ্বলে না, কোথাও দুঃখ প্রকাশ হয় না, কারো ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচার আঁধার ও বিমর্ষতায় রাঙে না!
কি-বোর্ড বোদ্ধারা আর স্বপ্নে স্বপ্নে যুদ্ধ করা যোদ্ধারা জালালদের মৃত্যুতে কোনো ঝড়ও তোলেন না! পুলিশের মতো জনপ্রিয় টপিকের সঙ্গে শুধু কালিমা লেপনেই মুগ্ধতা আসে! স্যাক্রিফাইস- সে আবার কী জিনিস? সেসব ঠিক যায় না….!
জালাল, আপনি খুব ভুল সময়ে, ভুল কোলাহলের ভিড়ে হারিয়ে গেলেন! আমি মনে করি আপনি বেঁচেই গেলেন! যেখানে আপনি নেই সেখানেও আপনাকে অপরাধীর কাঠগড়ায় আর দাঁড়াতে হবে না!
কী করলেন এ জীবনটায়? না হতে পারলেন সন্তানের, না স্ত্রীর, না যাদের জন্য আত্মত্যাগ করলেন তাঁদের হতে পারলেন! আপনি বরং মরে গিয়েই বেঁচে গেলেন, আমাদের যে মরে গিয়েই বাঁচতে হয়।
লেখক: সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার (ডেমরা জোন), ডিএমপি।