জামাল খাশুকজি আর ফিরবেন না?

October 13, 2018 9:45 pm0 commentsViews: 85

শেখ ওমর রাসেলঃ  প্রিন্সেস ডায়ানার সাথে প্যারিসে ১৯৯৭ সালের ৩১ আগস্টে এক কার দুর্ঘটনায় নিহত হয়ে ডোডি আল ফায়েদ সারা বিশ্বে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছিলেন। তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম সেরা সেলিব্রেটি সুন্দরীর প্রেমিক হিসেবে প্লেবয় ডোডি ফায়েদ ছিলেন বিশ্ব মিডিয়ার আলোচিত চরিত্র।

২১ বছর পর ডোডি ফায়েদের মামাতো ভাই জামাল আহমাদ খাশুকজি (৬০) এখন বিশ্ব মিডিয়ায় আলোচিত চরিত্র। গত ২ অক্টোবর সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশুকজি তাঁর তুর্কি বাগদত্তা হাতিজা জেঙ্গিস [তুর্কি ভাষায় বানান Hatice Cengiz; বাংলা/উর্দু উচ্চারণে নামটি হবে খাদিজা চেঙ্গিস]-কে ইস্তাম্বুলের সৌদি কন্স্যুলেটের বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে নিজে কন্স্যুলেটের ভেতরে ঢোকেন। ৩৬ বছর বয়সী হাতিজাকে বিয়ে করার জন্য জামালের প্রয়োজন ছিল ১ম স্ত্রীর সাথে ডিভোর্সের ডকুমেন্টটি সৌদি কন্স্যুলেট থেকে সংগ্রহ করা।

কিন্তু সেই যে জামাল সৌদি কন্স্যুলেট ভবনে ঢুকলেন, তিনি আর হাতিজার কাছে ফিরে এলেন না। হয়ত ফিরে আসতে পারলেন না। পুরো দুনিয়া থেকেই তিনি এখন নিখোঁজ।

জামালের এই ফিরে না আসাই এখন মধ্য প্রাচ্যসহ সারা পৃথিবীর অন্যতম আলোচিত সংবাদ।

কেননা জামাল খাশুকজি কোন সাধারণ প্রেমিক মাত্র নন। তিনি সৌদি আরবের অত্যন্ত ধনাঢ্য ও প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান। তাঁর দাদা মুহাম্মদ খাশুকজি (১৮৮৯–১৯৭৮) ছিলেন সৌদি রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা রাজা আবদুল আজিজ আল সৌদের ব্যক্তিগত চিকিৎসক। খাশুকজি ছিলেন তুর্কি। তাঁদের পারিবারিক পদবি “খাশুকজি”ও মূলত একটি তুর্কি শব্দ। তুর্কি ভাষায় খাশুকচি (Kaşıkçı) অর্থ চামচ নির্মাতা। মুহাম্মদ খাশুকজির ভাই আবদুল্লাহ খাশুকজি ছিলেন তুরস্কের উসমানিয়া খিলাফতের অধীনে মদিনায় কর্মরত মুহতাসিব [market supervisor]. সেই সূত্রে মুহাম্মদ খাশুকজিও পরিবারের সাথে মদিনায় বসবাস করেন এবং ওই অঞ্চলেই বিয়ে করেন।

সৌদি রাজপরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে মুহাম্মদ খাশুকজির পরবর্তী বংশধরেরা বিপুল ধনসম্পদ ও প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্জন করেন। বিশেষত মুহাম্মদ খাশুকজির ছেলে আদনান খাশুকজি ছিলেন ১৯৮০-এর দশকে বিশ্বের আলোচিত ধনী ব্যবসায়ী। অস্ত্র ব্যবসায়ী হিসেবে আদনানের ব্যাপক পরিচিতি ছিল। আদনানের বিলাসী জীবনযাপন, বড় বড় ব্যবসায়িক বিনিয়োগ তৎকালীন বিশ্বে বহুবার আলোচনায় এসেছে। The Richest Man in the World নামে ১৯৮৬ সালে আদনানের জীবনী প্রকাশিত হয়েছিল। ফিলিপিন্সের সাবেক ফার্স্ট লেডি, সেলিব্রেটি রাজনীতিক ইমেলদা মার্কোসের সাথে আদনানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল।

১৯৮০ সালে আদনানের তৈরি প্রমোদতরী (super-yacht) “নাবিলা” ছিল তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ প্রমোদতরী। এক সময় (১৯৯০ সালের দিকে) ডোনাল্ড ট্রাম্পও এটি কিনে নিয়েছিলেন।

প্রমোদতরীটির নাম আদনান দিয়েছিলেন তাঁর মেয়ে নাবিলার নাম অনুসারে। নাবিলা খাশুকজি হলিউডে বেশ কিছু সিনেমায় অভিনয় করেছেন। তিনি মূলত ব্যবসায়ী।

মুহাম্মদ খাশুকজির মেয়ে সামিরা ছিলেন আরবের বিশিষ্ট সাংবাদিক, সাহিত্যিক। প্রিন্সেস ডায়ানার সেই আলোচিত প্রেমিক ডোডি ফায়েদ ছিলেন সামিরার ছেলে।

মুহাম্মদ খাশুকজির আরেক ছেলের ঘরের নাতি হলেন এখনকার আলোচিত সাংবাদিক জামাল খাশুকজি। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করেছেন তিনি। তিনি ছিলেন আরবের খ্যাতিমান লেখক ও সাংবাদিক। আল আরব নিউজ চ্যানেলসহ আরো কিছু আরব মিডিয়ায় প্রধান সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন জামাল।

সৌদি রাজপরিবারের সাথে জামালের সুসম্পর্কই ছিল। ১৯৮০ দশকে সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধের সুবাদে আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনের সাথেও জামালের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। ১৯৯০ দশকে জামাল কয়েকবার ওসামার সাক্ষাৎকার নেন। আফগানিস্তানের তোরা বোরা পাহাড়ের ঘাঁটিতেও ওসামার সাথে সাক্ষাৎ করেন জামাল। তবে ৯/১১-এর হামলার পর ওসামার সাথে তিনি সম্পর্ক ছিন্ন করেন।

সৌদি রাজপরিবারের সাথে ২০১৬ সাল পর্যন্তও তেমন কোন বিরোধ ছিল না জামালের। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্য প্রাচ্য নীতির সমালোচনা করায় ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে সৌদি সরকার জামালকে সেদেশের মিডিয়ায় নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। সেই থেকে দ্বন্দ্বের শুরু।

জামাল এর পর সৌদি আরবের ইয়েমেনে হামলার সমালোচনা করেন। জামাল মূলত মুসলিম ব্রাদারহুডের গণতান্ত্রিক ইসলামী রাজনীতির সমর্থক। মিডিয়ায় নিষিদ্ধ করার পর জামাল সোশ্যাল মিডিয়া, বিশেষত টুইটারে, লিখতে থাকেন। বিভিন্ন ইস্যুতে জামাল সৌদি রাজা সালমান ও ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সালমানের সমালোচনা করেন। ফলে সৌদি সরকার ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে জামালকে টুইটারেও নিষিদ্ধ করে।

এর পর তিনি সৌদি আরব থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যান এবং ওয়াশিংটন পোস্টে লেখালেখি শুরু করেন। নিখোঁজ হওয়ার আগে পর্যন্ত জামাল ওয়াশিংটন পোস্টেই লিখতেন। সৌদি আরবের সাথে কাতার, লেবানন, কানাডার সাম্প্রতিক বিরোধগুলোর ক্ষেত্রে জামাল সৌদি রাজপরিবারের সমালোচনাই করতেন। আরো বহু ইস্যুতে জামাল সৌদি রাজা ও ক্রাউন প্রিন্সের সমালোচনা চালিয়ে গেছেন।

এমন অবস্থায়ই ইস্তাম্বুলের সৌদি কন্স্যুলেটে ঢুকে গায়েব হয়ে গেলেন জামাল খাশুকজি। [বংশীয় পদবির ইংরেজি বানান “Khashoggi” হওয়ায় বাংলাদেশী মিডিয়ায় অবশ্য তাঁর নামটি “খাসোগি” লেখা হচ্ছে।]

সৌদি সরকারের দাবি, জামাল কন্স্যুলেটের পেছনের একটি দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেছেন।

কিন্তু তুরস্ক সরকার ও মার্কিন মিডিয়ার দাবি অনুসারে, কন্স্যুলেটের ভেতরে একটি সৌদি গোয়েন্দা টিম নৃশংসভাবে জামালকে হত্যা করেছে এবং পরে তাঁর দেহ কেটে টুকরা টুকরা করে কন্স্যুলেটের বাইরে নিয়ে গেছে।

জামালকে হজম করা অবশ্য খুব সহজ হবে না।

ইতোমধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, ফ্রান্সের এমানুয়েল মাক্রোঁ ও তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এই ইস্যুতে সরব হয়েছেন। তাঁর নিখোঁজ এবং হত্যার খবর নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

জামালের নিখোঁজ হওয়ার প্রেক্ষাপটে ব্রিটিশ ধনকুবের রিচার্ড ব্রানসন সৌদিতে ১০০ কোটি ডলার মূল্যের দু’টি পর্যটন প্রকল্প বাতিল করে দিয়েছেন। অক্টোবরের শেষে সালমানের আহ্বানে রিয়াদে অনুষ্ঠেয় ব্যবসায়ী নেতাদের সম্মেলনেও অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত জানাচ্ছেন অনেকে। ইকোনোমিস্টের প্রধান সম্পাদক জ্যানি মিন্টন বেডোসসহ কয়েকজন সাংবাদিকও যাচ্ছেন না সেখানে। উবার, ভিয়াকমের মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারাও সেই সম্মেলন বয়কটের ঘোষণা দিয়েছেন।

মার্কিন ও ইউরোপিয়ান মিডিয়া জামাল ইস্যুতে সৌদি সরকারের সমালোচনায় মুখর।

নিউইয়র্ক পোস্ট-এর খবরে এসেছে, জামালের হাতে থাকা ‘অ্যাপল ওয়াচের’ মাধ্যমে সৌদি কন্স্যুলেটে তাঁকে নির্যাতন এবং হত্যার মুহূর্তের অডিও রেকর্ডিং তাঁর ফোন এবং আইক্লাউডে পৌঁছে গেছে!

তুর্কি সরকারও বলছে, তাদের কাছে জামালকে হত্যা ও গুমের তথ্যপ্রমাণ আছে!

কিন্তু জামালের ফিরে আসার আশা ছাড়তে রাজি নন ইস্তাম্বুলের একটি বিশ্বিবিদ্যালয়ে পিএইচডির ছাত্রী হাতিজা জেঙ্গিস—হ্যাঁ, জামালের সেই বাগদত্তা। সিএনএন-এর Christiane Amanpour [যিনি রানা প্লাজার ঘটনার পর শেখ হাসিনার আলোচিত সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন]-কে দেয়া এক ইন্টারভিউতে হাতিজা জানান, তিনি এখনো আশা করেন যে জামালকে খুন করা হয়

Missing Saudi Journalist Jamal Khashoggi with his fiance Hatice Cengiz

নি! [tinyurl.com/ya4npojz]

হাতিজা এখনো ভাবছেন, জামাল ফিরে আসবেন!

জামাল কি সত্যিই একদিন ফিরে আসবেন? নাকি জামালের ফুফাতো ভাই ডোডি ফায়েদের মত তিনিও মর্মান্তিক মৃত্যুর মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে নিজের পরিচয় জানিয়ে গেলেন?

Leave a Reply

You must be logged in to post a comment.

Editor in Chief: Dr. Omar Faruque

Editor: Dr. Morjina Akhter

All contact: 400E Mosholu Parkway South Apt # A23,The Bronx, New York 10458, USA

Mob. 001.347.459.8516
E-mail: dhakapost91@gmail.com