জাফর ইকবালের উপর হামলাঃ নিরপেক্ষ মুসলমানগণ কী করণীয়।।
।।নয়ন চ্যাটার্জি।।
[মুসলমানদের উচিত নিরপেক্ষভাবে এ কাজের প্রতিবাদ করা, এবং বলা- “তোমরা রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতি দিয়ে বিরোধীদের যত ইচ্ছা দমন কর, কিন্তু ধর্মকে এভাবে মিথ্যা ব্যবহার করে মুসলমানদের বদনাম করতে পারবে না।]
ফয়জুর বলছে, “ভুতের বাচ্চা সোলায়মান’ লেখায় জাফর ইকবালকে হামলা করেছি”। (http://bit.ly/2oMZnw8) এ কথাটা আমি বিশ্বাস করি নি। কারণ ‘জাফর ইকবাল’ এ বইটা লিখেছে গত বছর বইমেলায়। ১ বছর গত হয়েছে, এ বছর বইমেলাও শেষ, কিন্তু এখন কেন হঠাৎ করে ফয়জুরের ঐ বইয়ের জন্য প্রতিশোধ নেয়ার কথা মনে পড়ল? পয়েন্টঃ সময়।
দ্বিতীয় প্রশ্ন যেটা জাগ্রত হয়, অনলাইন-ফেসবুক যারা ইউজ করে তারা সবাই জানে, এখানে মুসলমানদের ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে কটূক্তি কম হয় না। মুসলমানদের শেষ নবীকে নিয়ে ফেসবুকে হিন্দুরা প্রায়শঃ মন্দ কথা বলে। কিন্তু তখন কেন ফয়জুরদের ‘ধর্ম চেতনা’ জাগ্রত হয় না ? হঠাৎ আগেরকার ‘নবী’ সম্পর্কে এত কেন প্রবল ধর্মচেতনা জাগ্রত হল ?? পয়েন্টঃ ফয়জুরের গ্রহণযোগ্যতা।
ফয়জুরের ধর্মচেতনা জেগে উঠছে খুব ভাল কথা। কিন্তু সে এত অপরিপক্ষ হামলা চালালো কেন ? ছুরি না ব্যবহার করে সে বন্দুক বা আরও ভাল কোন অস্ত্র ব্যবহার করতে পারত, যা ব্যবহারে জাফর ইকবালের মৃত্যু নিশ্চিত হতে পারত। কিন্তু জাফর ইকবালের কন্ডিশন দেখে যা বোঝা যাচ্ছে, সে খুব গুরুতর কোন আঘাতপ্রাপ্ত হয় নি, হলে অন্তত জ্ঞান হারাত। কিন্তু সেটি হয় নি। সে হিসেবে ফয়জুর অবশ্যই হত্যার উদ্দেশ্যে জাফর ইকবালকে আঘাত করে নি। কিন্তু ধর্মীয় চেতনা দিয়েই যদি ফয়জুর হামলা করত, তবে অবশ্যই জাফর ইকবালকে সে হত্যা করতে চাইত। কিন্তু কেন ফয়জুর জাফর ইকবালকে হত্যা করতে না চেয়ে শুধু নূন্যতম আহত করতে চেয়েছে ? এর পেছনে কারণ কি ?
হামলাকারী ফয়জুর জাফর ইকবালের স্টেজ পর্যন্ত উঠেছে। সেখানে অপেক্ষা করেছে এবং সময় বুঝে হামলা করেছে। কারও সাহায্য ছাড়া এতদূর পর্যন্ত আসা স্বাভাবিক নয়। ধরে নিলাম কেউ তাকে এতদূর পর্যন্ত আসতে সাহায্য করেছে, কিন্তু তারা কে ? আমার হিসেবে, হামলার পর যে অতি উৎসাহী ছাত্ররা ফয়জুরকে গণপিটুনি দেয়, এদের ভূমিকা সন্দেহজনক। কারণ এটা চুরি বা ছিনতাই নয় যে, ধরা পড়ার পর গণপিটুনি দেবে। একজন শিক্ষকের উপর হামলা করা হয়েছে এবং হামলাকারীর অবশ্যই বিশেষ মোটিভ আছে। কিন্তু ভার্সিটির ছাত্ররা এত বোকা নয় যে, হামলকারীর মোটিভ জানতে না চেয়ে তাকে গণপিটুনি দেবে। কিন্তু এমনভাবে গণপিটুনি দেয়া হল, যেন সে মারাও যেতে পারত। এক্ষেত্রে যারা গণপিটুনি দিল, তারা হয়ত চেয়েছে ক) সে যেন তার মোটিভ বলার সুযোগ না পায়, খ) কে তাকে এতদূর পর্যন্ত নিয়ে এসেছে , তাদের নাম বলতে না পারে, গ) ফয়জুর যেন নিরপেক্ষ কোন ব্যক্তির সাহচার্যে না আসে। পয়েন্টঃ ফয়জুরকে ভাড়া করে আনলো কে ?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছে, জাফর ইকবালের ওপর হামলা ধর্মন্ধতার বহিঃপ্রকাশ। তিনি আরও বলেন, যারা এ ঘটনাগুলো ঘটায়, তারা মনে করে যে, একটা মানুষ খুন করলেই বুঝি তারা বেহেশতে চলে যাবে। তারা কোনদিন বেহেশেতে যাবে না, তারা দোযকের আগুনে পুড়বে। (http://bit.ly/2oNVQxK)
শেখ হাসিনার বক্তব্য দ্বারা একটি বিষয় ক্লিয়ার, ফয়জুর কোন বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি না, সে একটি কমিউনিটির সদস্য। কারণ তিনি স্পষ্ট করে ‘তারা’ ‘এরা’ শব্দগুলো ব্যবহার করেছেন। তার মানে শেখ হাসিনাও বুঝাতে চাইছেন, কোন একটি ‘ধর্মান্ধ কমিউনিটি’ আছে, যারা কথিত প্রগতিশীলদের হত্যা করতে চায়।
আমার জানা মতে, জাফর ইকবাল একজন মার্কিনপন্থী শিক্ষাবিদ। সে এবং তার ওয়াইফ সিআইএ’র পরিচালিত পাবর্য্ সংগঠন সিএইচটি কমিশনের সাথে যুক্ত। আরেকটি খবর, সম্ভবতঃ ট্রাম্পের উপদেষ্টা লিসা কার্টিস এখন বাংলাদেশে। লিসা কার্টিস বাংলাদেশে আসার পূর্বে তার সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিএনপির প্রতিনিধিদল অবশ্যই যোগাযোগ করেছে। হয়ত অনুরোধও করেছে, রাজনৈতিকভাবে বিএনপি’র পক্ষে এবং আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে কিছু করার জন্য। কিন্তু জাফর ইকবালের হামলা দ্বারা দেখা গেল, কোন একটি গোষ্ঠী বাংলাদেশে মার্কিন কূটনীতিক থাকা অবস্থায় এক মার্কিনপন্থী শিক্ষাবিদের উপর হামলা করল। ইতোমধ্যে অবশ্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলে দিয়েছে, এ হামলা বিএনপি করেছে। তার মানে বিএনপি লিসা কার্টিসকে দিয়ে যে গেম খেলতে চেয়েছিল, তার উল্টো গেম খেলা হয়েছে ফয়জুরকে দিয়ে। আমেরিকাকে উল্টো মেসেজ দিতে চেয়েছে, “বিএনপি তোমার লোকের উপর হামলা করে। বিএনপি উগ্রবাদী। ট্র্যাম্পের অবস্থান বিরোধী.. ..।ইত্যাদি”।
আরেকটি কথা, জাফর ইকবালকে রাখা হয়েছে, ঢাকা সিএমএইচ-এ এবং ফয়জুরকে রাখা হয়েছে সিলেট সিএমএইচ-এ। সুতরাং কোন গোযেন্দা সংস্থাটা দিয়ে কর্তাব্যক্তিরা প্ল্যান সাজিয়েছেন, তা আর মুখ ফুটে আমি বলতে চাইছি না।
পাঠকদের জন্য বলছিঃ এ ধরনের হামলাকে আন্তর্জাতিকভাবে বলে ‘ফলস ফ্ল্যাগ অপরেশন’। ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন হল এমন ধরনের মিলিটারি অথবা ইন্টেলিজেন্স অপারেশন, যেখানে দুনিয়ার সবাইকে বিভ্রান্ত করতে কোন একটি পক্ষ তার বিরুদ্ধ পক্ষের ছদ্মবেশ ধারণ করে নিজ দলের বা নিজ সমর্থকদের উপর এক বা একাধিক সহজে দৃশ্যমান আক্রমণ পরিচালনা করে। এ আক্রমণগুলোর প্রধান উদ্দ্যেশ্যই হল সবার সামনে প্রতিপক্ষকে হীন প্রমাণ করে প্রতিপক্ষের উপরে আক্রমণের বিশ্বাসযোগ্য অজুহাত পাওয়া। সামরিক ও ইন্টেলিজেন্স ইতিহাসে ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশনের অসংখ্য নজির পাওয়া যায়।
তবে সরকারি দল প্রতিপক্ষ দমন করুক, সেটা আমার সমস্যা নয়। কারণ রাজনীতিতে এক পক্ষ অন্য পক্ষকে দমন করতেই পারে। কিন্তু তিনি প্রতিপক্ষকে দমন করতে ‘ধর্ম’কে কেন ব্যবহার করবেন ? কেন ধর্মকে খারাপ ভাবে সবার সামনে উপস্থাপন করবেন ? তার ব্যক্তি রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করার ফলে, আজকে মুসলমান দেখলে সবাই জঙ্গী বলবে, দাঁড়ি-টুপি দেখলেই সন্দেহ করে বসবে। আমার মনে হয়, এসব ‘ফলস ফ্ল্যাগ অপরেশন’ খুব কমন হয়ে গেছে, সময় এসেছে মুসলমানদের এর বিরুদ্ধে বলার। মুসলমানদের উচিত নিরপেক্ষভাবে এ কাজের প্রতিবাদ করা, এবং বলা- “তোমরা রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতি দিয়ে বিরোধীদের যত ইচ্ছা দমন কর, কিন্তু ধর্মকে এভাবে মিথ্যা ব্যবহার করে মুসলমানদের বদনাম করতে পারবে না।