জাপান কাহিনী: সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট এবং তারপর

September 3, 2018 10:31 pm0 commentsViews: 38

আশির আহমেদ

ষোল বছর বয়সের আকিরা আর তার মা। টোকিওর কেইহিন তোহকু লাইন শনিবারে তেমন ব্যস্ত থাকে না। প্রথম বগি থেকে সামনে বরাবর দেখা যায়। সেখানে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে ষোল বছর বয়সের ছেলে আকিরা। শুধু তাকিয়ে আছে বলা যাবে না। কী সব গুনছে। ট্রেন চলছে – ঝিকর ঝিকর ঝিকর ঝাঁ।

সারা বগিতে ১০ জনের মত যাত্রী। সামনের সীটে বসে আছে একটি মেয়ে। বই পড়ছে। ২০ বছর বয়স। বলা নেই কওয়া নেই, আকিরা মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরলো। আপত্তিকর জায়গায় হাত দিয়েছে, মুখ দিয়েছে। সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট। মেয়েটি চিৎকার দিল। দুই তিন জন লোক এগিয়ে এলো। ছেলেটিকে মেয়েটির কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিলো।

তারপর?

পাবলিক স্পেসে এমন ঘটনা বাংলাদেশে ঘটলে কী হতো? সৌদি আরবে? মিয়ানমারে? ভারতে? পাকিস্তানে?

টোকিওতে সর্বমোট ট্রেন স্টেশনের সংখ্যা ৮৮২। তার মধ্যে মেট্রো স্টেশনের সংখ্যা ২৮২। পুলিশ বক্সের সংখ্যা ৮২৬। পুলিশ বক্স (কো-বান) গুলো সাধারণত ট্রেন ষ্টেশনের কাছাকাছি থাকে। তার মানে মোটামুটি প্রত্যেকটি ষ্টেশনের কাছেই পুলিশ বক্স আছে। ছেলেটিকে পুলিশ বক্সে সোপর্দ করা হলো। কেউ গায়ে হাত তুললো না। পুলিশ ও কোন ধমক দিলো না। গার্জিয়ান ডাকা হলো। ছেলেটির মা উপস্থিত হলেন। ঘটনা শুনে প্রথমেই মেয়েটির কাছে ক্ষমা চাইলেন। পুলিশের কাছে একটু ব্যাখ্যা করার সময় চাইলেন।

পৃথিবীর সমস্ত বাবা মা দের এই একটা বড় দোষ/গুণ। যতই সমস্যা থাকুক না কেন, এক সময় মনে করেন – তাঁদের সন্তানই শ্রেষ্ঠ। সে কোন পাপ করতে পারে না। সে রাজপুত্র, সেই রাজকন্যা। সন্তানদের পাপকে হালাল ভাবে সাজানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু এই আম্মাজান আলাদা।

মহিলা ষোল সেকেন্ডে ষোল বছরের কাহিনি রিওয়াইন্ড করে দেখলেন। সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না তার ছেলে এই কাজ করতে পারে। ছেলেটি বড় হয়েছে একটা সমস্যার ভেতর দিয়ে। কিন্তু কোন শাস্তি মূলক অপরাধ কখনো করে বসেনি।

ছেলে যখন সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে তখনকার কথা। একদিন বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে বাড়ি ফিরল। “কিরে তোর ছাতা কোথায়?”

জিজ্ঞাস করতেই সে ক্ষেপে উঠলো-“হারিয়ে ফেলেছি।”

এটা ছিল তার জীবনের প্রথম মিথ্যা কথা। কারণ রাতের বেলা এক প্রতিবেশী এসে ছাতা ফেরত দিয়ে গেলো। স্কুল থেকে ফেরার পথে সে তার ক্লাসমেট ছাত্রীটিকে ছাতা দিয়ে সে নিজে ভিজে ভিজে বাড়ি ফিরেছে।

এই কাহিনী জানাজানি হবার পর, তার সে কী লজ্জা।

একবার আম্মাজান কিছুদিন হাসপাতালে ছিলেন। প্রত্যেক দিন ছেলে স্কুল থেকে মা কে দেখতে গিয়েছে। মা কে ছাড়া এক দণ্ড থাকতে পারেনি।

এইতো সেদিন। পরিবারের প্রথম সন্তান। কতো আনন্দ ফুর্তি করে ছেলেকে হাসপাতাল থেকে ঘরে তুললো। তারপর ১৫ টি জন্মদিন টুকুস টাকুস করে পার হয়ে গেল। ছেলে যুবকে পরিণত হচ্ছে।

আম্মাজান পুলিশের দিকে তাকিয়ে শুরু করলেন। নিজ মুখে যে কথাটি যে শব্দটি উচ্চারণ করতে সাহস পাননি, সেটাই আজ বলতে বাধ্য হলেন।

বাবাগো – ছেলেটি আমার অটিস্টিক। এই দেখেন ডাক্তার সার্টিফিকেট। ছেলের এই ঘটনার জন্য আমি দায়ী। আমি তাকে চোখে চোখে রাখিনি। বিশ্বাস করুন, এই ঘটনা এই প্রথম। বাসায় ছোটখাট ঘটনা ঘটালে ও ঘরের বাইরে এটাই প্রথম।

পুলিশ ইমোশনাল হতে পারেন না। তাকে ৩ টি স্টেপ মেনে চলতে হয়।একটা ডকুমেন্ট লিখতে হয়।

১) গেনজো কাকুনিন- ঘটনা কী ঘটেছে তার বর্ণনা

২) কেইই – ইতিহাস। আগে এই ব্যাক্তিদের দ্বারা একই ঘটনা ঘটেছে কিনা তার কাহিনি

৩) বউসি তাইও- আরেকবার যে ঘটবে না তার নিশ্চয়তা।

পুলিশ (১) আর (২) লিখলেন। (৩) এ গিয়ে থামলেন। আরেকবার যে এই ঘটনা ঘটবে না তার নিশ্চয়তা চাইলেন, আম্মাজানের কাছে। আম্মাজান সেই দায়িত্ব নেবার আগে ডাক্তারের কাছে পরামর্শ চাইলেন।

ডাক্তার ব্যাখ্যা দিলেন- “ছেলেটি বয়ঃসন্ধিতে পা দিয়েছে। একজন সুস্থ স্বাভাবিক ছেলের মস্তিষ্ক এই সময়ে অনেক কল্পনায় ভরপুর থাকে। এরা মেয়েদের শরীর আবিষ্কার করতে কৌতূহলী হয়ে ওঠে। টক জাতীয় খাবার দেখলে আমাদের পেপসিন মিউসিন জাতিয় এনজাইম গুলো যেমন সক্রিয় হয়ে ওঠে, তেমন। শুধু মানুষ নয় মোটামুটি সমস্ত প্রাণীকুলে ও একই অবস্থা। তবে মানবকুল তার সন্তানদের সঠিক শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন। এই কারণে সে নিজেকে সামাল দিতে পারে। এই ছেলেটি তা পারেনি। ছেলেকে চোখে চোখে রাখতে হবে। ”

এই ঘটনা ২৮ বছর আগের কাহিনি। এই ছেলে আজ ৪৪ বছরের যুবক। আগে যেমনটি ছিল তেমনটিই আছে। বিয়ে করেনি। ২৮ টি বছর ছেলেকে চোখে চোখে রেখেছেন। বড় ধরনের কোন ঘটনা না ঘটালেও ছোট খাট একাধিক কাহিনি ঘটিয়েছে।এই মহিলা বার বার পুলিশকে ব্যাখ্যা করেছেন।

ভাগ্যিস এই ছেলের জাপানে জন্ম হয়েছিল। না হয়, হয়তো একটা নিউজ হতো – “গণপিটুনিতে ধর্ষকের …” অথবা “ধর্ষক কে হাতুড়ি পেটা দিয়ে পুলিশে দেয়া হয়েছে। মা এসে হাতজোড় করছেন, ছেলেকে আর যেন মারা না হয়, ছেলেটি অসুস্থ”।

ভদ্রমহিলার বয়স ৭৬। তেমন কোন আগাম নোটিস ছাড়াই দুনিয়া ছাড়লেন দুই সপ্তাহ আগে। তার স্বামী একজন প্রফেসর। ছেলের দেখাশোনার দায়িত্ব এতদিন মা ই পালন করেছেন। আজ থেকে ছেলেকে চোখে চোখে রাখার দায়িত্ব তার। নিজ সন্তান বলে কথা। সৃষ্টি প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশি করেই ভালোবাসার শক্তি দিয়ে পিতামাতাদের পৃথিবীতে পাঠান। না হয় এতো প্রতিকূলতার মধ্যে একজন সন্তানকে বড় করার দায়িত্ব নেন কীভাবে?

লেখক: এসোসিয়েট প্রফেসার, কাইউসু ইউনিভার্সিটি, জাপান

Leave a Reply

You must be logged in to post a comment.

Editor in Chief: Dr. Omar Faruque

Editor: Dr. Morjina Akhter

All contact: 400E Mosholu Parkway South Apt # A23,The Bronx, New York 10458, USA

Mob. 001.347.459.8516
E-mail: dhakapost91@gmail.com