জঙ্গিবাদ নিয়ে শেখ হাসিনার প্রশ্ন, আমার উত্তর
।।শেখ আদনান ফাহাদ।।
আলোকিত মানুষ মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর সন্ত্রাসী হামলায় তীব্র নিন্দা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জিজ্ঞেস করেছেন, হামলাকারীরা কেন এই অন্ধকারের পথে যাচ্ছে? প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও এর উত্তর খুব সহজ নয়। এর উত্তর খুঁজতে খুব প্রাসঙ্গিক দু/একটা বিষয়ে আমরা একটু নজর দিতে পারি। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং বর্তমান সময়ে চলা সিরিয়া সংকটের দিকে তাকালে সহজে এর উত্তর পাওয়া যাবে।
মুসলমানদের একটা অংশকে অপকর্মে নিয়োগ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের কুখ্যাত গোয়েন্দা বাহিনী যথাক্রমে সিআইএ এবং মোসাদ। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দোসর হয়ে কাজ করছে মুসলমানদেরই একটা অংশ। অত্যন্ত ধূর্ত এবং নিষ্ঠুর এই গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। ইসলামকে শান্তির পথ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে ইহুদিবাদী অন্ধকারের শক্তির এই ষড়যন্ত্র অনেক পুরনো।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যাকে বৈধতা দিয়েছিল এই সি আইএ। পরবর্তী সময়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকারীদের পুনর্বাসনকল্পে সব ব্যবস্থা নিয়েছিল এই কুখ্যাত গোয়েন্দা বাহিনীগুলো। ১৯৭১ এ শহীদ ৩০ লাখ মানুষের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল ইসলাম ধর্মের অনুসরণকারী। পাকিস্তানের মুসলিম সেনাবাহিনী আমাদের বাঙালি মুসলমানদের হত্যা করতে সামান্যতম দ্বিধাবোধ করেনি। বাঙালি মুসলমান, বাঙালি হিন্দু, বাঙালি বৌদ্ধ, খ্রিস্টান-সবার একটাই পরিচয় তাদের কাছে মুখ্য ছিল; সেটি ছিল বাঙালি।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনী নির্বিচারে মুসলমানদের হত্যা করেছে। তাদের এই গণহত্যায় দোসর হয়ে কাজ করেছে জামাত। জামাত আজ পর্যন্ত ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়ায় মুসলমান হত্যার বিচার দাবি করেনি। ফিলিস্তিনের চলমান মুসলমান হত্যাকাণ্ডে জামাত কোনোদিন একটা প্রতিবাদী শব্দ উচ্চারণ করেনি। সৌদি জোট যেভাবে ইয়েমেনে নির্বিচারে মুসলমান হত্যা করছে, সেখানেও বাংলাদেশের জামায়াত এবং অন্যান্য ইসলামি দলগুলোর কোনো সাহসী প্রতিবাদ করেনি। হজের সময় সৌদি প্রিন্সের বিলাসিতার বলী হওয়া শত শত বাংলাদেশির মৃত্যুতে একটা শব্দ ব্যয় করেনি আমাদের আলেম সমাজ।
আমরা সৌদি আরব নিয়ে নেতিবাচক কথা বলতে ভয় পাই। কারণ সৌদি আরবে আমাদের স্রষ্টা আল্লাহর ঘর আছে, আমাদের প্রিয়নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর রওজা মোবারক আছে। পবিত্র হজের স্থান যে দেশে সে দেশ আমরা কোনো ধরনের নেতিবাচক কথা বলতে ভয় পাই, খুব স্বাভাবিক। কিন্তু একবারও আমাদের মনে প্রশ্ন আসে না যে আমাদের আবেগ ও বিশ্বাসের সুযোগে কারা নিজেদের স্বার্থ হাসিল করছে। আমরা একবারও নিজেদেরকে প্রশ্ন করি না, সৌদি সরকারের মূল সহযোগী শক্তি কারা? জাজিরাতুল আরব কীভাবে সৌদি আরব হয়ে গেল? সউদ পরিবারের পূর্বপুরুষ কারা? ইসরায়েলের সঙ্গে এই সৌদি সরকারের এত দহরম মহরম কেন?
ইসলাম আমাদেরকে জেগে উঠার তাগিদ দেয়। কিন্তু আমরা মনে মনেও একটা প্রকট বাস্তবতাকে চ্যালেঞ্জ করতে ভয় পাই। স্রষ্টা আল্লাহ আর তাঁর প্রিয় নবীর মন আমরা তখনই জয় করতে পারব, যখন আমরা সমস্ত অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারব। আল্লাহর নবীর বাতলে দেয়া পথে আমরা নেই। থাকলে আমাদের মাদ্রাসার কোনো ছাত্র মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারকে আঘাত করতে পারত না। মনে আল্লাহর প্রেম থাকলে, নবীজির প্রতি মায়া থাকলে, ভালোবাসা থাকলে কেউ এত নৃশংস হতে পারত না। সরল মুসলমানদের কাউকে কাউকে বিপথে নিয়ে গিয়ে সন্ত্রাসী বানাচ্ছে, জঙ্গি হিসেবে তৈরি করছে মার্কিন ব্লক। আবার ইসলামি জঙ্গিবাদ নির্মূলের নামে সেসব রাষ্ট্রে হামলাও চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
আফগানিস্তানে তালেবান বাহিনী হাতে কলমে সৃষ্টি করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আবার তালেবান নিধনের নামে এরা পুরো আফগানিস্তানে ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে। আইএসও সৃষ্টি করেছে এই পশ্চিমা তেল ও অস্ত্র ব্যবসায়ীরাই। আইএসের নাম দিয়ে এরা এখন পুরো বিশ্বে নিজেদের ধর্মীয়, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিল করছে। সিরিয়ার দিকে তাকালে আইএস রাজনীতির বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়।
এখন সিরিয়াতে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের সেনাবাহিনী এবং রাশিয়ার সহযোগী সেনাবাহিনীর পাল্টা আক্রমণ চলছে। পাল্টা আক্রমণে ইহুদি শক্তির সৃষ্টি ফ্রি সিরিয়ান আর্মি পরাজয় বরণ করছে। তাই কৌশলে ফেসবুকসহ নানা মিডিয়াতে বাশার আল আসাদকে ভিলেন হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। আর আমাদের নরম মন গলে গলে যাচ্ছে। অথচ এই ধ্বংসযজ্ঞের সূচনা করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল। বাশার আল আসাদ-বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে এবং করছে মার্কিন ব্লক। আসাদের পক্ষে এগিয়ে এসেছে রাশিয়া। এই রাশিয়া ১৯৭১ সালে আমাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। রাশিয়ার অন্যতম মিত্র ইরান সিরিয়ারও মিত্র। মধ্যপ্রাচ্যে জোর করে সৃষ্ট রাষ্ট্র ইসরায়েলের অস্তিত্বকে নির্বিঘ্ন করার জন্য একটি ইরান এবং সিরিয়া বিহীন মধ্যপ্রাচ্য দরকার ইহুদি ব্লকের।
আবার ইরান এবং সিরিয়া নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। তাই সিরিয়াকে নিয়ে এত টানাটানি। কদিন আগে ইরানে সরকারবিরোধী আন্দোলনে প্রকাশ্যে সাপোর্ট নিয়ে এগিয়ে এসেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই পুরো প্রক্রিয়ায় আইএস-ধারণা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে কাজ করছে। রাশিয়া যখন ফ্রি সিরিয়ান আর্মিকে দমন করে তখন পশ্চিমা মিডিয়া প্রচার করে যে, বেসামরিক লোকজন নিহত। আবার ন্যাটো বাহিনী এবং ফ্রি সিরিয়ান আর্মি যখন গুলি করে সাধারণ মানুষ হত্যা করে তখন পশ্চিমা মিডিয়া প্রচার করে যে, এগুলো আইএস এর কাজ। আইএস ধারণা কাজে লাগিয়ে নানা দিক থেকে সুবিধা নিচ্ছে মার্কিন ব্লক। একদিকে ইসলামের বদনাম করা যাচ্ছে, অন্যদিকে নিজেদের সমস্ত অপকর্ম ঢাকতে পারছে।
প্রচুর অর্থ ব্যয় করে প্রকৃত ইসলামকে ধ্বংস করার জন্য এজেন্ট নিয়োগ করে রেখেছে এই মার্কিন ব্লক। এই অর্থের একটা অংশ বাংলাদেশেও আসে। সৌদি আরব এবং পাকিস্তানের মাধ্যমে এই অনুদানের টাকা বাংলাদেশে পাঠায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দেশের সাধারণ মানুষ মাদ্রাসায় প্রচুর দান-খয়রাত করে সত্যি। কিন্তু এর আড়ালে প্রচুর বিদেশি অনুদান আসে। মাদ্রাসা এবং সাম্প্রতিককালে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের মাধ্যমে জঙ্গিবাদের প্রভাব বিস্তৃত করা হচ্ছে। গুলশানের হোলি আর্টিজানে হামলাকারীরা সবাই ছিল উচ্চ শিক্ষিত ইংরেজি জানা ছেলে। যতদিন না পর্যন্ত এই দেশে মাদ্রাসা কিংবা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোর দায়িত্ব রাষ্ট্র না নেবে, ততদিন কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জঙ্গি রূপান্তর বন্ধ করে যাবে না। মাদ্রাসাগুলোর কাছে যেতে হবে। অতি প্রগতিশীলদের মতো নাক উঁচু করে চললে হবে না।
যে ছেলেটি মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের ওপর হামলা চালিয়েছে, তাকে মিসগাইড করেছে কে? ওর চাচা নাকি নিজেকে আওয়ামী লীগের নেতা বলে পরিচয় দিত! আওয়ামী লীগে কি জামায়াত নেতাদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে? হামলাকারী ছেলেটি যে মাদ্রাসায় পড়ে, তার অর্থায়ন কীভাবে হয়। লন্ডনের কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কি এখানে অনুদান দেয়? অর্থায়নকারীদের রাজনৈতিক কোনো পরিচয় আছে কি? এসব প্রশ্নের উত্তর জানা থাকলে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কঠিন প্রশ্নের সহজ উত্তর পাওয়া যাবে বলে আশা করি।
লেখকঃ শিক্ষক ও সাংবাদিক