ছাত্রলীগের হাতে নাজেহাল শিক্ষক ছাত্রীদের মারধর।।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক তানজীম উদ্দিন খানকে শাসাচ্ছেন ছাত্রলীগ নেতারা-নিজস্ব ছবি কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদ, আটক শিক্ষার্থীদের মুক্তি, মামলা প্রত্যাহার ও নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে আবারো হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ। এতে কর্মসূচিতে অংশ নেয়া অন্তত ১৫ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। নিপীড়ন করা হয়েছে অনেক নারী শিক্ষার্থীকে। ছাত্রলীগের এ হামলা থেকে রেহাই পাননি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও। ঘটনার দৃশ্য ধারণ করতে গেলে এটিএন বাংলার এক সাংবাদিকের ওপর চড়াও হয় ছাত্রলীগ কর্মীরা। ভাঙচুরের চেষ্টা করা হয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যমের ক্যামেরা।
গতকাল দুপুরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এদিকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কর্মসূচির শুরুতে ছাত্রলীগ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টরের কাছে মুঠোফোনে নিজেদের ও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা চান কর্মসূচিতে অংশ নেয়া শিক্ষকরা। কিন্তু প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রব্বানী কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। উল্টো হামলা পরবর্তীতে সাংবাদিকদের কাছে নিজের প্রতিক্রিয়া জানতে গিয়ে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিস্থিতি অশান্ত করার চেষ্টা চলছে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এই ঘটনায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী যারাই জড়িত ছিল, আমরা বিশ্ববিদ্যালয় বিধি মোতাবেক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো।’ শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিতে অংশ নেয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ফাহমিদুল হক বলেন, ‘মানববন্ধনের শেষ পর্যায়ে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা আমাদের ঘিরে ফেলে। পরে আমরা রাজু ভাস্কর্যের দিকে যাওয়ার পথে শিববাড়ি মোড়ে শেখ রাসেল টাওয়ারের সামনে তারা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় এবং আমাদেরও লাঞ্ছিত করে।’
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সকাল ১১টায় পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচিতে অংশ নিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে শহীদ মিনার এলাকায় জড়ো হয় শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। এরপর সেখানে শিক্ষক ও নিপীড়নের শিকার শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা বক্তব্য রাখছিলেন। এর আগে সাধারণ শিক্ষার্থীদের এ কর্মসূচি ঠেকাতে সকাল সাড়ে ১০টা থেকে ‘কোটা আন্দোলনে নিপীড়িত শিক্ষার্থীবৃন্দ’র ব্যানারে সেখানে অবস্থান নেয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতাকর্মীরা। তাদের সঙ্গে ছিল আশপাশের বিভিন্ন কলেজের ছাত্রলীগ কর্মীরাও। একই সময় কাজী মোতাহার হোসেন ভবনের সামনে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের উপ-মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কমান্ডের ঢাবি শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক আল মামুনের নেতৃত্বে অবস্থান নেয় মুক্তিযোদ্ধা সন্তানরাও। বেলা ১১টার দিকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখার বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী শহীদ মিনার এলাকায় আসেন। এদের মধ্যে ছিলেন- কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার সম্পাদক সাইফ বাবু, আইনবিষয়ক সম্পাদক আল নাহিয়ান খান জয়, ত্রাণ ও দুর্যোগ বিষয়ক সম্পাদক ইয়াজ আল রিয়াদ, স্কুল বিষয়ক সম্পাদক জয়নুল আবেদিন, প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম শামীম প্রমুখ। এ সময় তারাও সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিপরীত পাশে অবস্থান নিয়ে উচ্চ স্বরে মাইক বাজাতে থাকে। যেখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অশালীন ভাষায় কটূক্তি করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ সময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ‘পাকিস্তানি রাজাকার শিক্ষকদের বহিষ্কার করতে হবে’, ‘শিক্ষকেরা জামায়াত-শিবিরের দোসর’, ‘পাকিস্তানি রাজাকার, পাকিস্তানে চলে যা’, ‘জামায়াত শিবির রাজাকার, এ মুহূর্তে বাংলা ছাড়’, ‘শিবির ধর, জবাই কর’সহ বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দেয়। এ সময় উত্তেজনা বিরাজ করে পুরো শহীদ মিনার এলাকায়। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাইকও বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে সাধারণ শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা শহীদ মিনার এলাকা ছাড়তে চায়। এ সময় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. ফাহমিদুল হক বলেন, ‘আমরা কোথায় বাস করছি। ক্যাম্পাসে ন্যূনতম প্রতিবাদ করার অধিকার পর্যন্ত নেই।’ এরপর শহীদ মিনারে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন শেষে মিছিল সহকারে টিএসসির রাজু ভাস্কর্যে সামনে যেতে চান শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। সেখানে কর্মসূচি সমাপ্ত করার ঘোষণা দিয়ে শহীদ মিনার ছাড়েন তারা। মিছিলটি শিব বাড়ির সামনে পৌঁছালে ছাত্রলীগ ও মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ডের সদস্যরা পেছন থেকে অতর্কিত হামলা চালায়। এ হামলায় অন্তত ১৫ শিক্ষার্থী আহত হয়। গায়ে ধাক্কা ও অশালীন ভাষায় গালিগালাজ করে হেনস্তা করা হয় শিক্ষকদের। ছাত্রলীগের ধাক্কায় মাটিতে পড়ে যান কয়েকজন শিক্ষক। এরপর শিক্ষকরা একপাশে গিয়ে দাঁড়ালে শিক্ষার্থীরা তাদের ঘিরে মানবপ্রাচীর তৈরি করে। এ সময় ছাত্রীরা হামলা থেকে বাঁচতে বঙ্গবন্ধু টাওয়ারসহ আশেপাশের শিক্ষকদের আবাসিক এলাকায় আশ্রয় নেয়। হামলার পর শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আবার শহীদ মিনারে গিয়ে অবস্থান নেন। এ হামলার নেতৃত্বে ছিলেন, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির উপ-মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক সম্পাদক আল মামুন, স্কুল ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক জয়নাল আবেদিন, আইন বিষয়ক সম্পাদক আল নাহিয়ান খান জয়, প্রশিক্ষণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম শামীম, প্রচার সম্পাদক সাইফ বাবু, সদস্য তানভীর রহমান সৈকত, ঢাবি শাখার সহ-সভাপতি রুম্মন হোসাইন, সাংগঠনিক সম্পাদক মামুন বিন সাত্তার, জহুরুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি আনোয়ার হোসেন, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আমিনুল ইসলাম বুলবুল, এসএম হলের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. সায়েম, বঙ্গবন্ধু হলের সভাপতি বরিকুল ইসলাম বাঁধন, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান সানী, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের সভাপতি তাহসান আহমেদ রাসেল, সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান তাপস, কবি জসিম উদ্দিন হলের সভাপতি আরিফ হোসেন, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মিলন।
হামলার পরে রাফিয়া তামান্না নামে এক শিক্ষার্থী সাংবাদিকদের বলেন, ‘ছাত্রলীগ প্রথম থেকে আমাদেরকে মানববন্ধনে বাধা দেয়ার চেষ্টা করেছে। তারা আমাদের শিক্ষকদের জামায়াত-শিবির বলে অপমান করেছে। আমরা মিছিল নিয়ে যাওয়ার সময় হামলা চালায়। সাংবাদিকরা এ দৃশ্য ধারণ করতে গেলে তাদের ওপরও হামলা চালায়।’
এর আগে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সমাবেশে বক্তব্য দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. ফাহমিদুল হক, অধ্যাপক ড. আবদুর রাজ্জাক, আন্তর্জাতিক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান, কোটা সংস্কার আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক মোহাম্মদ রাশেদ খানের মা সালেহা বেগম, সমাজকর্মী রাখাল রাহা প্রমুখ। রাশেদের মা সালেহা বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার মানিক (রাশেদ) সাধারণ ছাত্র। সে সরকারের বিরুদ্ধে কোনো সময় জড়িত ছিল না। রাজনৈতিক কোনো দল বা দেশের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্রে জড়িত নয়। আমার মানিক এমনকি আমরা কেউ কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত না। আমার মানিক শুধু চাকরির জন্য দাবি করেছিল, কোটা কমানোর জন্য আন্দোলন করছিল। ও তো কোনো অপরাধ করেনি। তারপরও ওকে এমনভাবে হয়রানি করা হচ্ছে কেন?’ তিনি বলেন, ‘আমার আর চাকরি দরকার নেই। আমার মানিককে প্রধানমন্ত্রী ক্ষমা করে দিলে, আমি ওকে বাড়ি নিয়ে যাব। ওকে আর কোনোদিন আন্দোলন করতে দেবো না।’ সহযোগী অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক খান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্রলীগকে ডেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছে। ভিসি ও প্রক্টর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছেন।’ এদিকে রাশেদের মা সালেহা বেগম যখন বক্তব্য রাখছিলেন তখন বিপরীত মুখে অবস্থান নেয়া ছাত্রলীগের জহুরুল হক হল শাখার সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আমিনুল ইসলাম বুলবুল নানাভাবে সালেহা বেগমকে কটূক্তি করেন। দুপুর দেড়টার দিকে এসএম হল শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. সায়েম এটিএন বাংলার ক্যামেরা ভেঙে ফেলার চেষ্টা করেন এবং কয়েকটি মোবাইল ফোন ভেঙে ফেলেন। এই বিষয়ে সাংবাদিকরা সায়েমের কাছে জানতে চাইলে তিনি দৌড়ে পালিয়ে যান। এরপর সাংবাদিকরা শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আরেকদফা তাদের দিকে তেড়ে আসে। তবে সাংবাদিকরা ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতি শান্ত করেন। সার্বিক বিষয়ে প্রক্টর অধ্যাপক গোলাম রাব্বানী বলেন, ‘আমরা সেখানে প্রক্টরিয়াল টিমকে পাঠিয়েছিলাম। দুই পক্ষের সঙ্গেই তারা কথা বলেছে। তবে তারা কেউই তেমন সহায়তা করেনি।’ তিনি বলেন, ‘এই ঘটনায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী যারাই জড়িত ছিল, আমরা বিশ্ববিদ্যালয় বিধি মোতাবেক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো।’ এদিকে হামলায় ছাত্রলীগের কেউ জড়িত ছিল না বলে দাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসাইনের। ঘটনার পর মধুর ক্যান্টিনে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, হামলায় ছাত্রলীগের কেউ জড়িত নয়। সেখানে কেউ গিয়ে থাকলে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গিয়েছে।
ধিক্কার! ভেবে অনুতপ্ত হই কেন শিক্ষকতায় এলাম!: ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাতে নাজেহালের শিকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক তানজীম উদ্দিন খান এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, মনুষ্যত্ব হারিয়ে যাওয়া শিক্ষকেরা প্রশাসনিক নেতৃত্বে আছে বলেই আমরা শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা কেউ নিরাপদ নই এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুধু আমাদের নাজেহাল আর শারীরিক আক্রমণই করেনি, ছাত্রলীগের তিনজন মাস্তান ভয় দেখানোর জন্য আমার বাসা পর্যন্ত মোটরসাইকেলে চেপে আরো দুজন পদব্রজে অনুসরণ করতে করতে এসেছে! এদের একজন আবার মোবাইল ফোন দিয়ে ক্রমাগত ছবি তুলছিলো!। আর ‘মহামান্য’ প্রক্টর অধ্যাপক গোলাম রাব্বানী বললেন, আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে যা খুশি তা করতে পারি না! প্রক্টরিয়াল বডিকে না জানিয়ে কেন শহীদ মিনারে গেলাম? ধিক্কার! ভেবে অনুতপ্ত হই কেন শিক্ষকতায় এলাম! আমাদের কেউ বা আমাদের পরিবারের কেউ কোন রকম শারীরিক বা মানসিক আক্রমণের শিকার হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ পুরোপুরি দায়ী থাকবে।