ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলন এক কঠিন সংগ্রাম

July 16, 2018 11:08 pm0 commentsViews: 8

বদরুদ্দীন উমর

স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর বাংলাদেশ এখন কোন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে তার হাজার উদাহরণের মধ্যে ছাত্রদের চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলন অন্যতম। এ আন্দোলনের সর্বশেষ পরিস্থিতির ওপর দেশের প্রায় সব জাতীয় দৈনিকেই বিস্তারিত রিপোর্ট প্রকাশিত হচ্ছে।

গত ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শহীদ মিনার চত্বরে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের ওপর যে হামলা হয়েছে তার রিপোর্টের একটি অংশ এখানে প্রয়োজনবোধে উদ্ধৃত করা হল।

‘ফের ছাত্রলীগের হামলা’ শীর্ষক প্রথম পাতায় প্রকাশিত যুগান্তরের এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘কোটা আন্দোলনে গ্রেফতারকৃত নেতাদের মুক্তি ও নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মিছিলে হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ।

এতে অন্তত ১০ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। হামলা থেকে শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে গিয়ে লাঞ্ছিত হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষক। নিপীড়নের শিকার হয়েছেন কয়েকজন ছাত্রী। আর এসব ঘটনার খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে লাঞ্ছিত হয়েছেন কয়েকজন সাংবাদিক।

রোববার বেলা পৌনে ১১টা থেকে দুপুর সোয়া ১টা পর্যন্ত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও এর আশপাশের এলাকায় এসব ঘটনা ঘটে। ছাত্রলীগের হামলার কথা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জানিয়েও কোনো লাভ হয়নি। বরং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এদিকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঠেকাতে বহিরাগতদের এনে পাল্টা কর্মসূচি পালন করছে ছাত্রলীগ। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে এসব কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছে বদরুন্নেছা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ ও রাজধানীর বিভিন্ন ইউনিটের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা।

তাদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের অন্তত ৪০-৫০ জন নেতাকর্মীও ছিল (যুগান্তর, ১৬.০৭.২০১৮)।

এই রিপোর্টে শহীদ মিনার এলাকা থেকে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন এলাকায় কয়েক ঘণ্টা ধরে ছাত্রলীগ গুণ্ডাদের যে হামলা কোটা সংস্কার আন্দোলনের কর্মী ও তাদের সমর্থক শিক্ষকদের ওপর হয়েছে তার বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে।

ছাত্রলীগের এই গুণ্ডামি ও তাণ্ডব যে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই হচ্ছে তাই নয়, রাজধানী বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একই ধরনের আক্রমণ ছাত্রলীগের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে।

১৫ জুলাই সুপ্রিমকোর্টের ১৩ জন আইনজীবী ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে একটি আইনগত নোটিশ পাঠিয়ে বলেছেন, আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাদের অবগত করতে, কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতাকর্মীদের ওপর ছাত্রলীগের লোকরা যে হামলা করেছে তাদের বিরুদ্ধে তারা কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।

দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রক্টর ও রেজিস্ট্রারকে দেয়া এই নোটিশে আরও বলা হয়েছে, কোটা সংস্কার আন্দোলনের ছাত্রদের ওপর বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কর্মীদের হামলার বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে সে বিষয়ে লিখিতভাবে তাদেরকে যদি জানানো না হয়, তাহলে তারা তাদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যবস্থা করবেন।

আইনজীবীরা এই নোটিশ প্রদান করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ফারুক হাসান, মোহাম্মদ মশিউর রহমান, জসিমউদ্দীন ও রাশেদ খান এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তরিকুল তারেকের পক্ষ থেকে (উধরষু ঝঃধৎ, ১৬.০৭.২০১৮)।

সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবীদের এই নোটিশের কোনো জবাব দেয়ার ক্ষমতা যে ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নেই এটা বলাই বাহুল্য। কারণ উপাচার্য থেকে নিয়ে সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনই সরকারের পরম অনুগত ছাত্রলীগের পৃষ্ঠপোষক।

তবে প্রকৃতপক্ষে এদেরকে ছাত্রলীগের পৃষ্ঠপোষক বলা ঠিক নয়, কারণ এরা তাদের সব ধরনের অপকর্ম ও অপরাধের শরিক। ছাত্রলীগ যা করে চলেছে তা যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছাড়া কিছুতেই সম্ভব নয়, এটা সবাই বোঝে।

কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ যা করছে এ বিষয়ে তাদের কাছে রিপোর্ট চাওয়ার অর্থ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিজে কী করছে তার ওপরই রিপোর্ট চাওয়া। এ রিপোর্ট তারা কিছুতেই দেবে না এবং আইনজীবীরা তাদের নোটিশে যা বলেছেন সেটা যদি তারা কার্যকর করতে চান, তাহলে এ দুই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে তাদেরকে সুপ্রিমকোর্টে মামলা করতেই হবে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতারা নিজেরা কিছু ভুলভ্রান্তি করলেও এবং সরকার তাদের ওপর দমন-নির্যাতন চালিয়ে গেলেও এ আন্দোলন যে বন্ধ হচ্ছে না এর কারণ এটা দেশের অর্থনীতি ও সামগ্রিক পরিস্থিতির সঙ্গে সম্পর্কিত।

সরকার দিনের পর দিন বাংলাদেশের উন্নতি নিয়ে একঘেয়েভাবে ঢেঁড়ি পিটিয়ে গেলেও দেশে নানা ধরনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করেছে, যার মধ্যে বেকারত্ব অন্যতম ও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এর মূল কারণ, এখানে উন্নতি যা কিছু হচ্ছে সেটা দুর্নীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত।

দুর্নীতি ছাড়া বাংলাদেশের উন্নতির বিষয়টি চিন্তা করাও যায় না। যত উন্নতি তত দুর্নীতি। এর ফলে যে ধরনের উন্নতি হচ্ছে তার সঙ্গে তাল রেখে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। কর্মসংস্থান না থাকার কারণেই লাখ লাখ মানুষ দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে।

শুধু অদক্ষ লোকজনই নয়, বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য উচ্চশিক্ষা কেন্দ্র থেকে পাস করা যুবকরাও দেশের বাইরে অনেকে চলে যাচ্ছেন এবং তাদের ফেরার আর কোনো সম্ভাবনা নেই। তারা দেশের কৃষক-শ্রমিকের টাকায় লেখাপড়া শিখলেও দেশের অর্থনীতি ও জনগণের স্বার্থে কোনো অবদান রাখা তাদের দ্বারা সম্ভব হচ্ছে না।

এক্ষেত্রে লক্ষ করার বিষয়, প্রতিবছর দেশের লাখ লাখ ছাত্র শিক্ষাজীবন শেষ করলেও সবাই তো আর বাইরে যেতে পারছে না। তাদেরকে দেশেই থাকতে হচ্ছে। এবং দেশে থাকতে হলে তাদের কর্মসংস্থান দরকার। কিন্তু এই প্রয়োজনীয় কর্মসংস্থান দেশে নেই।

বর্তমানে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সরকার ও সরকারি দলের সঙ্গে সম্পর্কিত লোকজন শুধু যে ব্যাপকভাবে চুরি-দুর্নীতি করছে তাই নয়, তারা সীমিত কর্মসংস্থানের ওপরও হামলা করছে। এই হামলার ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্যই তাদেরকে এখন কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা করতে হচ্ছে।

এ বিষয়টি উপলব্ধি করতে না পারলে বর্তমানে ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলন ও তার ওপর সরকারের হামলাকে এর যথার্থ পরিপ্রেক্ষিতে দেখা সম্ভব নয়।

৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা একটা অযৌক্তিক ব্যাপার। মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে ৪৭ বছর আগে। তাতে যারা অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের অধিকাংশ বেঁচে নেই এবং কেউই কর্মক্ষম নেই। কাজেই তাদের পক্ষে চাকরি করা সম্ভব নয়। মুক্তিযোদ্ধা কোটা নামে যাদের কর্মসংস্থানের কথা বলা হচ্ছে তারা হতে পারে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান অথবা তাদের সন্তান।

কোনো দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের পর তাতে অংশগ্রহণকারীদের জন্য পুরুষানুক্রমে বিশেষ বিবেচনায় চাকরির সংস্থান অথবা নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা ইতিহাসে আজ পর্যন্ত দেখা যায়নি। এটা আওয়ামী লীগ সরকারের এক ব্যতিক্রর্মী ব্যবস্থা।

এর আসল উদ্দেশ্য মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের চাকরি দেয়ার নামে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্কিত ও তাদের তাঁবেদার লোকদের জন্য চাকরির ব্যবস্থা। আমলাতন্ত্র, পুলিশ, বিভিন্ন সরকারি সংস্থা ইত্যাদিতে ইতিমধ্যেই আওয়ামী লীগ নিজেদের লোক ভর্তি করে রেখেছে।

তাদের এই ব্যবস্থাকে একটা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা হিসেবে দাঁড় করানোর উদ্দেশ্যেই মুক্তিযোদ্ধা কোটার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই লুটপাটের অবসান ছাত্রদের আন্দোলনের মাধ্যমে যাতে হতে না পারে এজন্যই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য আন্দোলনারী এই ছাত্রদেরকে ‘তালেবান’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

সরকার তাকে এই চাকরি দিয়েছে। তিনি নিমক হারাম নন। তিনি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ মানুষের প্রবেশ বন্ধ করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সব মুখে দারোয়ানি পাহারা ব্যবস্থার ঘোষণা দিয়েছেন। তার এই ঘোষণার জন্য তাকে মাল্যভূষিত করা দরকার!

বিগত এপ্রিল মাসে ছাত্ররা কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু করার পর তা কয়েকদিনের মধ্যেই প্রচণ্ড আকার ধারণ করে। সেই আন্দোলনের শীর্ষে পরিস্থিতির আরও অবনতি আশঙ্কা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে সবধরনের কোটা উচ্ছেদের ঘোষণা দেন।

তার এ আহ্বানের ওপর বিশ্বাস রেখে নেতারা আন্দোলন সাময়িকভাবে স্থগিত রাখলেও সাধারণ ছাত্ররা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

এ পর্যায়ে আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়ে আসার সুযোগ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী তার সংসদ ঘোষণার মাধ্যমে আন্দোলনরত ছাত্রদের দেয়া প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করে আবার এক ঘোষণায় বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের ৩০ শতাংশ কোটা বাতিল হবে না, বহাল থাকবে!

মাত্র অল্পদিনের ব্যবধানে ছাত্র আন্দোলনের চড়াই-উতরাইয়ের অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর এই অবস্থান পরিবর্তন থেকেই বোঝা যায়, বলা যেতে পারে প্রমাণিত হয়, বাংলাদেশে চুরি-দুর্নীতির সঙ্গে বেপরোয়া লুটপাটের যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা থেকে সরে আসার ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর নেই।

যারা এখন কোটা সংস্কার আন্দোলন করছেন তারা যদি পরিস্থিতির এই দিকে দৃষ্টি না দেন, এর গুরুত্ব যদি উপলব্ধি না করেন, তাহলে এ আন্দোলন সঠিকভাবে পরিচালনা করা তাদের পক্ষে কঠিন হবে।

কারণ কী কারণে কোটা সংস্কারের প্রয়োজন হচ্ছে, কেন মুক্তিযোদ্ধা কোটা উচ্ছেদ করা দরকার এবং এসবের সঙ্গে সরকার ও সরকারি দলের লোকদের স্বার্থ কিভাবে জড়িয়ে আছে, এটা না বুঝলে ঠিক কিসের ও কার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হবে এটা সঠিকভাবে বোঝা সম্ভব নয়।

এটা তাদেরকে বুঝতে হবে যে, কর্মসংস্থানের ওপর শাসক দলের লুটপাটকে যেভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয়েছে, তারা প্রকৃতপক্ষে তার বিরুদ্ধেই আন্দোলন করছেন। এ আন্দোলন সহজ ব্যাপার নয়, এটা এক কঠিন সংগ্রাম।

১৬.০৭.২০১৮

বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল

উৎসঃ   juganto

Leave a Reply

You must be logged in to post a comment.

Editor in Chief: Dr. Omar Faruque

Editor: Dr. Morjina Akhter

All contact: 400E Mosholu Parkway South Apt # A23,The Bronx, New York 10458, USA

Mob. 001.347.459.8516
E-mail: dhakapost91@gmail.com