গুজব ছড়িয়ে দেবার কাহিনীতে কারাগারে পাঁচ নারী।।
১৯ আগস্ট ২০১৮।।
নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় ফেসবুকে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে গ্রেপ্তার পাঁচ নারী এখন কারাগারে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে উস্কানিমূলক ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়ানোয় তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তার হওয়া নারীদের মধ্যে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী ও মডেল রয়েছেন। ফেসবুকে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে ৪ আগস্ট থেকে ১৬ আগস্ট পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলাকালে অছাত্ররাও নানাভাবে ছাত্রদের পোশাক পরে অংশগ্রহণের প্রমাণ মিলেছে। এর মধ্যে ৪ আগস্ট হঠাৎ করেই ফেসবুকে গুজব ছড়ানো হয় যে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে কয়েকজন ছাত্রকে হত্যা এবং কয়েকজনকে ধর্ষণ করা হয়েছে। কেউ কেউ এমনও দাবি করেছেন, ধর্ষণ হয়েছে প্রকাশ্যেই।
এই গুজবগুলো ছড়ানো হয়েছে ফেসবুক লাইভে এসে বা সাক্ষাৎকারের মতো করে তৈরি করে সেই ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছেড়ে দিয়ে। দেশের পাশাপাশি বাইরে থেকেও ভিডিও ছড়িয়ে দিয়ে দেশবাসীকে শিক্ষার্থীদের পক্ষে নেমে আসার আহ্বান জানানো হয়।
আর এই প্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে শিক্ষার্থীরাও দলে দলে ছুটে যায় আওয়ামী লীগের ধানমন্ডির কার্যালয়ে। হামলাও হয় সেখানে। আর এই হামলায় শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক কর্মীরাও অংশ নিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে ক্ষমতাসীন দল।
তবে ওই দিন বিকালেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে এসব অপপ্রচার। ছাত্রদের দুটি প্রতিনিধি দল আওয়ামী লীগ কার্যালয় ঘুরে এসে তারাও গণমাধ্যমকে জানায় যে, এসব মিথ্যা। তবে এরপরও সামাজিক মাধ্যমে নানা কথা ছড়ানো হতে থাকে।
আর সরকার এই ঘটনাটিকে নিয়েছে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে। ভবিষ্যতে যেন গুজব ছড়িয়ে কেউ বিভ্রান্তি ছড়াতে না পারে সে জন্য একটি উদাহরণ তৈরির চেষ্টাও চলছে।
এরই মধ্যে পুলিশের মহাপরিদর্শক জাবেদ পাটোয়ারি জানিয়েছেন, তারা মোট ২১টি পোর্টাল চিহ্নিত করেছেন। তাদের সবাইকেই ধরবেন তিনি।
ফারিয়া মাহজাবিন ফেসবুকে যে অডিও রেকর্ডটি প্রচার করেছিলেন, সেটি প্রকাশ করে র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেছেন, গুজব ছড়িয়ে দেশকে চরম বিশৃঙ্খলাব দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। আর তারাও তা ঠেকানোর উদ্যোগ নিয়েছেন।
এসব গুজবের ঘটনায় এখন পর্যন্ত মামলা হয়েছে ৫১টি। ১৬ আগস্ট পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছেন ৯৭ জন। এরপরেও আরও বেশ কিছু গ্রেপ্তার আছে।
ব্যবসায়ী ফারিয়া মাহজাবিন: ১৬ আগস্ট রাত পৌনে ১২টায় গ্রেপ্তার হওয়া এই ব্যবসায়ী তিন দিনের রিমান্ডে রয়েছেন। রাজধানীর পশ্চিম ধানমন্ডি এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পরে ১৭ আগস্ট ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এ কে এম মঈন উদ্দিন সিদ্দিকীর আদালতে তাকে হাজির করা হয়। ফারিয়া কম্পিউটার সায়েন্সে লেখাপড়া করেছেন নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে। তিনি ধানমণ্ডি এলাকার একটি কফিশপের মালিক।
ইডেন ছাত্রী লুৎফন নাহার লুমা: এই তরুণী কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলনকারী বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক। তিনি ইডেন কলেজে পড়েন।
লুমাকে গত ১৫ আগস্ট ভোরে সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার বড়ধুল ইউনিয়নের ক্ষিপ্রচাপড়ি গ্রামের দাদাবাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
বৃহস্পতিবার তাকে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে পুলিশ। এসময় রাজধানীর রমনা থানায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে করা মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম কাজী কামরুল ইসলাম তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
স্কুল শিক্ষিকা সোনিয়া: ৫ আগস্ট পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় নুসরাত জাহান সোনিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয় কলাপাড়া থেকে। তিনি উপজেলার দক্ষিণ টিয়াখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা। তার বিরুদ্ধেও তথ্য প্রযুক্তি আইনে মামলা করা হয়েছে।
বিএনপি নেত্রী ফাতেমা বাদশা: ৩ আগস্ট শুক্রবার রাতে চট্টগ্রাম নগরীর ডবলমুরিং থানার সুপারিওয়ালা পাড়া থেকে আটক করা হয়। ফাতেমা বাদশা চট্টগ্রাম মহানগর মহিলা দলের সিনিয়র সহসভাপতি।
অভিনেত্রী কাজী নওশাবা: ফেসবুক লাইভে ছাত্র মৃত্যুর গুজব ছড়ানোর অভিযোগে ৪ আগস্ট রাতে রাজধানীর উত্তরা থেকে নওশাবাকে আটক করে র্যাব। তাকে এ নিয়ে দুই দফা রিমান্ডে নেয়া হয়। অসুস্থ হয়ে গেলে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
উস্কানি দেওয়ার অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ও স্লোগান-৭১ নামের সংগঠনের নেত্রী তাসনিম আফরোজ ইমিকে ১৪ আগস্ট রাতে আটক করে পুলিশ। পরে তাকে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়।
ঢাকাটাইমস
ষড়যন্ত্র21 Aug, 2018
রাজনীতিবিদদের এ এক আশ্চর্য ক্ষমতা। তাদের কোনো ক্লান্তি নেই। অবসাদ নেই। তারা বলে যান অবিরাম। একই কথা, একই তত্ত্ব। যে শিবিরেরই হোন না কেন অসুবিধা নেই।
মুখ একই, চেহারা শুধু আলাদা। যন্ত্রটি দেখতে কেমন? জন্ম তারিখই বা কবে? হলফ করে বলা কঠিন। তবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চেয়ে বেশি বয়সী- এটা নিশ্চিত। যদিও দুনিয়ার আর কোথাও সম্ভবত এ যন্ত্র অতোটা তৎপর নয়।
কানাকানি। দিনের আলো। রাতের অন্ধকার। অমুক ভবন। তমুক ভবন। বৈঠক। ষড়যন্ত্র। কোথায় কী হচ্ছে সব জানি। পত্রিকার ফাইল উল্টালেই দেখা যায়। দিন-তারিখ আলাদা। রাজনীতিবিদের নামও হয়তো আলাদা। কিন্তু তারা বলে যান একই কথা। ষড়যন্ত্র চলছে। সবসময়ই এটা চলে আসছে। কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হলো। আন্দোলনকারী নেতাদের বেশিরভাগই সরকারি দলের সহযোগী সংগঠনের নেতা ছিলেন। বলা হলো ষড়যন্ত্র চলছে।
কোটা আন্দোলনের ওপর ভর করে সরকার উৎখাতের চেষ্টা চলছে। আন্দোলনকারীরা একবারও সরকারের এমনকি সরকারের কোনো মন্ত্রীরও পদত্যাগ চাইলেন না। তবুও ষড়যন্ত্র তত্ত্বের প্রচার থামেনি। তারপর শুরু হলো শিশু শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। দাবি নিরাপদ সড়ক। ন্যায় বিচার। ইনসাফ। হ্যাঁ, কিছু স্লোগান রাজনৈতিক ছিল। রাষ্ট্র মেরামতের কথা বলেছে ওরা। আন্দোলনে যৎসামান্য অনুপ্রবেশের ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু মোটাদাগে এটা শিশু-কিশোরদের আন্দোলনই। এবারও হাজির ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। যথারীতি কাঠগড়ায় বিএনপি-জামায়াত। সঙ্গে নাগরিক সমাজও বাদ গেল না। মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট দাওয়াত খেতে গেলেন সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের বাসায়। ফেরার পথে আক্রান্ত হলো তার গাড়িবহর। দাওয়াতকে ঘিরে উত্থাপিত হলো ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। সর্বশেষ আলোচনায় আনা হয়েছে ওয়ান ইলেভেনের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। বলা হয়েছে, আরেকটি ওয়ান ইলেভেন আনার ষড়যন্ত্র চলছে। বিরোধী শিবিরও বসে নেই। নিত্য-নতুন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব হাজির করেন তারাও। প্রায়ই শোনা যায় খালেদা জিয়াকে রাজনীতি-নির্বাচন থেকে বাইরে রাখার ষড়যন্ত্র চলছে। জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে। এখন আবার বলা হচ্ছে, বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এরআগে বিরোধীদের আন্দোলনের সময় পেট্রলবোমার পেছনেও ষড়যন্ত্রকেই দায়ী করেছেন তারা। দায় নিতে যেন তারা রাজি নন।
শুরুতেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রে সবসময় ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আলোচিত হয়েছে। কখনো কখনো এ ষড়যন্ত্র বাস্তবেও ছিল। যে কারণে বেশকিছু মর্মান্তিক আর দুঃখজনক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পেছনে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের বিষয়টি একেবারেই স্পষ্ট। একই ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় কারাগারে হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে। কয়েক বছর পর প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে হত্যার পেছনেও ছিল ষড়যন্ত্র।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, রাজনীতিতে যে ষড়যন্ত্র থাকে না এটা সত্য নয়। আবার সবকিছুর পেছনেই যে রাজনীতিবিদেরা ষড়যন্ত্র খোঁজেন তাও ঠিক নয়। তত্ত্ব হিসেবে ষড়যন্ত্র পরে এলেও ক্ষমতার ইতিহাসের শুরু থেকেই এটা চলে আসছে। রাজাদের ঘরে এবং ঘরের বাইরের ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করেই ক্ষমতায় টিকে থাকতে হয়েছে। এ লড়াইয়ে নিহত আর বন্দির সংখ্যাও বহু। উইকিপিডিয়া বলছে, অক্সফোর্ড অভিধান অনুযায়ী ষড়যন্ত্র তত্ত্ব হচ্ছে ‘কোনো ঘটনা ঘটার পেছনে বিদ্যমান জটিল কোনো ষড়যন্ত্র, যা নির্দিষ্ট কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের মিলিত চক্রান্তের ফসল, বিশেষত যেখানে ধরে নেয়া হয় যে, কতিপয় গুপ্ত তবে প্রভাবশালী গোষ্ঠী (যাদের উদ্দেশ্য রাজনৈতিক ও শোষণমূলক) একটি ব্যাখ্যাহীন ঘটনার পেছনে দায়ী। অক্সফোর্ড সর্বপ্রথম এই পদটির ব্যবহারকারী হিসেবে দি আমেরিকান হিস্ট্রিকাল রিভিউর ১৯০৯ সালের একটি নিবন্ধের উদ্ধৃতি দেয়।
এই লেখা যখন তৈরি হচ্ছে তখন অনলাইন সংবাদ মাধ্যমগুলোতে চোখ বুলিয়ে দেখা গেল, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব পুরোমাত্রায় জীবিত। একটি শিরোনাম এমন, কিশোর-কিশোরীদের ঘাড়ে চড়ে ষড়যন্ত্র। এতে অবশ্য আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কারণ বাংলাদেশে সবসময়ই ষড়যন্ত্র জীবিত। সত্য এ দেশে বেশিরভাগ সময় নিহত হয়েছে। এমনকি সংসদও কখনও কখনও বিলুপ্ত থেকেছে। কিন্তু ষড়যন্ত্র কখনও মারা যায় নি। অবিরাম সে তার কাজ করে চলছে।
বৃটিশ আমলেও এ ভূমিতে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব উচ্চারিত হয়েছে। বহু মানুষকে বৃটিশরাজ বিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডও দেয়া হয়েছে। পাকিস্তান আমলেও পুরোমাত্রায় সক্রিয় ছিল ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা তো ইতিহাসেই ঠাঁই নিয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আশা করা হয়েছিল, হয়তো ষড়যন্ত্র তত্ত্ব মারা যাবে। কিন্তু না দিনকে দিন ষড়যন্ত্র নামক বৃক্ষের ডাল-পালা আরো বড় হয়েছে। এইসব ষড়যন্ত্রে উচ্চারিত হয়েছে নানা ভিনদেশি নামও। সব তত্ত্বই মিথ্যা, অসাড়। বাংলাদেশে যেন একমাত্র ষড়যন্ত্র তত্ত্বই সত্য। রাজনীতিবিদদের কথা শুনলে অন্তত তাই মনে হয়।
উৎসঃ মানবজমিন