খোলাফায়ে রাশেদীনের উত্তরসূরী নিক আব্দুল আযীযে’র মৃত্যুদিবস ছিল ১২ ফেব্রুয়ারি।
নিউইয়র্ক থেকে ড. ওমর ফারুক।। স্থানীয় সময়ঃ ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ রাত দশটা।
মালয়েশিয়ার নিক আব্দুল আযীয ইন্তেকাল করেছিলেন ২০১৫ সলের ১২ ফেব্রুয়ারি। খুব নীরবেই দিবসটি বিশ্বাবাসী পার করে দিল। অবশ্য মালয়শিয়ায় তার মৃর্তুতে শ্রদ্ধা ও শোক জ্ঞাপন করা হয়েছে। ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনাই দারুস সালাম এবং এমন কি ফিলিপাইনের মিন্দানাও প্রদেশ ছাড়াও থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলাগুলো যেমন পাতানি ও নারাথিওয়াটসহ বিভিন্ন মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় ইসলামি সংগঠনের কর্মী ও নেতারা মালয়শিয়ায় জন্মগ্রহণকারী ইসলামিক স্কলার নিক আবদুল আজিজ নিক মেট এর মৃত্যুর দিবসটিতে দোয়া ও আলোচনা সভার আয়োজন করেছে বলে বিভিন্ন সূত্রগুলো আমাকে জানিয়েছে। আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ের প্রায় পনরটি বছর সে দেশে কেটেছিল। ঢাকা’র রমনায় অবস্থিত ‘ইঞ্জিনিয়ার্স িইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ’ সদর দফতরে জনসংযোগ কর্মকর্তার চাকরিতে ইস্তেফা দিয়ে ১৯৯১ সালের শেষ দিকে ‘ইউনিভার্সিটি কে বাংসাআন মালয়শিয়া’ তে এমফিল করার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যাই। এরপর পড়াশোনা ও অবশেষে চাকরি, এ ভাবেই জীবনের প্রায় পনরটি বছর কেটে যায়। জীবনের সোনালী দিনগুলোতে আমি তো ছিলাম বড্ড বেশি চঞ্চল, বড় বেশি আনমনা সবকিছুতেই। কোন পেশাতেই থিতু হতে পারি নি। ঘুরে বেড়ানোই যার যেন স্বভাব। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে বাংলাদেশের মানুষ বিজয় লাভের পর একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় তত্তাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল তখনর মাত্র। সে নির্বাচনে বেগম জিয়া’র নেতৃত্বাধীন বিএনপি নিরংকুশ বিজয় লাভ করে সরকার গঠন করল। সে সময় জুন ১৯৯১ সাল থেকে আমি ইংরেজি ম্যাগাজিন ‘ঢাকা পোস্ট’ বের করা শুরু করি। প্রথম সংখ্যাটি কভার স্টোরি করেছিলাম – ‘খালেদা জিয়াঃ আনকম্প্রোমাইজিং পারসোনালিট ‘। অবশ্য এ সময় আমি দক্ষিণ পূর্ব এশীয় বিভিন্ন দেশগুলো ব্যাপক ভাবে সফর করি। আমি সে সময়টিতে সে অঞ্চলের দেশগুলোর ভাষা ও সাংস্কৃতি সম্পর্কে অবহিত হতে চেষ্টা করি।
যাই হোক নিক আবদুল আজি নিক মেটের কথাতে ফিরে যাই। তিনি দীর্ঘ তেইশ বছর (১৯৯০-২০১৩) মালয়েশিয়ার কেলানতান রাজ্যের (সরকারি নাম দারুল না’ঈম) মুখ্যমন্ত্রীর দ্বায়িত্ব পালন করেন। তার রাজ্য শাসনের সময় কালকে এ যুগের ইসলামি খেলাফার শাসন কালের মতই বিবেচনা করা হয়। বর্তমান বিশ্বের এই খলিফায়ে রাশেদার উত্তরসূরী দাতু’ নিক আব্দুল আযীয বিন নিক মেট গত ২০১৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি রাত ৯;৪৫ মি. নিজ দেশ মালয়শিয়া ছাড়াও সারা বিশ্বের অগণিত ইমানদার মুসলমানদের শোকের সাগরে ভিাসিয়ে দিয়ে মহান আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের জন্য এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। ইন্না লিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজেউন। এ সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। মহান আল্লাহর দরবারে কায়মন বাক্যে দোয়া করি, তিনি যেন এ মরহুমের সব ভুলত্র ুটি ক্ষমা করে দিয়ে তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করেন।
নিক আব্দুল আযীয নিক মেট এর আব্বা নিক মেট বিন রাজা বিনজারও ছিলেন একজন ইসলামিক স্কলার এবং কেলান্তানের রাজধানী কোতা বারু থেকে ৭ মেইল দূরের গ্রাম পুলাও মেলাকা ইসলামি স্কুলের (পন্দো’ মেলাকা) প্রতিষ্ঠাতা। তিনিও ইসলামি শিক্ষার প্রথম পাঠ গ্রহণ করেন পিতার কাছে ঐ স্কুলেই। এরপর কেলানতানের সে সময়ের শ্রেষ্ঠ আলিম গুরু খুরাসান এর কাছে ইসলামের মৌলিক বিষয়ের উপর পড়াশোনা করেন। এরপর সে সময়ের অন্যতম প্রধান ‘তুয়ান গুরু’ হাজি আব্বাস হাজি আহমাদের কাছে থেকে তেরেংগানুর মাদ্রাসা ইত্তিফাক্বিয়াহ তে পড়াশুনা করেন। ১৯৫২ সনে ২১ বছর বয়সে তিনি ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসায় ইসলামি শরিয়ার উপর প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করেন। ৫ বছর পর সেখানে থেকে রওয়ানা দেন কায়রোর উদ্দেশে, এবং বিখ্যাত ইউনিভার্সিটি আল আযহার থেকে আরবি ভাষা ও ইসলামি শরিয়াহ্ বিষয়ে একাধারে স্নাতক ও মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬২ সালে তিনি স্বদেশে ফিরে আসেন এবং শিক্ষকতায় নিযুক্ত হয়ে যান। তিনি একাধারে ভাষা মালয়শিয়া, আরবি, উর্দু এবং তামিল ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন ।। ইংরেজি ভাষায় অত ব্যুৎপত্তি অর্জন না করলেও তিনি এ ভাষায়ও খুব ভাল ভাবে পড়ে অনুধাবন করতে পারতেন এবং প্রয়োজনে ইংরেজি ভাষায়ও বক্তব্য দিতে পারতেন। তিনি ১৯৬৩ সনে তুয়ান সাবারিয়াহ তুয়ান ইসহাক নামে একজন বিদুষী রমণীকে বিয়ে করেন এবং তাদের ৬জন ছেলে এবং ৪ জন মেয়ে। ছেলে নিক মুহাম্মাদ আব্দুহু একজন জনপ্রিয় সাংসদ।
শিক্ষকতা এবং বাগ্মিতার কারণে তিনি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সবার পরিচিত হয়ে ওঠেন, এবং সে সময় মালয়েশিয়ার একমাত্র সুসংগঠিত ও বৃহত্তর ইসলামি আন্দোলন ‘পার্টি ইসলাম সে মালয়শিয়া’ সংক্ষেপে যেটিকে PAS এ যোগ দেন। মিশরে থাকাকালীন সময় তিনি ইখওয়ানুল মুসলিমিন নামক সুসংগঠিত সাংগঠনিক কার্যক্রম দ্বারা ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত হন। তিনি সে সময় ইমাম আবুল হাসান নাদাওয়ি, সাইয়েদ কুতুব, মুহাম্মদ কুতুব, মরিয়ম জামিলা, হাসুনুল বান্না ও ইমাম আবুল হাসান নাদাওয়ীসহ বিভিন্ন খ্যাতিমান ইসলামি চিন্তাবিদ ও সংগঠকদের লেখা পুস্তকাদি ছাড়াও বিশ্বের অন্যতম সেরা ইসলামি চিন্তাবিদ তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশে ‘জামায়াতে ইসলামি’ এর মত সুসংগঠিত একটি বিশাল শক্তিশালী সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর সাহিত্য কর্ম ও তাফহিমুল কোরান পড়ে বিশ্ব ইসলামি আন্দোলন সম্পর্কে ব্যাপক জ্ঞান অর্জন করেন। নিজের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড, অনুপম চরিত্র ও গুণের অধিকারী নিক আবদুল আজিজ নিক মেট অল্পদিনের মধ্যেই শুধুই নিজ সংগঠন ‘পার্টি ইসলাম সে মালয়শিয়া’ এর কর্মী ও নেতাদের মাঝেই নয়, পুরো কেলানতান রাজ্য এমনকি সমগ্র মালয়শিয়ার মানুষের নিকট আদর্শ ইসলামি নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৬৭ সালে কেলানতানের হিলির পার্লামেন্টারি আসনের উপনির্বাচনে তিনি পার্টি ইসলাম সে মালয়শিয়া’র পক্ষ থেকে প্রতিদ্বন্ধিতা করে বিপুল ভোটের ব্যাবধানে দৌর্দণ্ড প্রতাপশালী ডাঃ মাহাথিরের নেতৃত্বাধিীন জোট ‘UMNO’ মালয়শিয়ান ভাষায় যে রাজনৈতিক জোটকে ‘বারিসান ন্যাশনাল’ বলে, সে সংগঠনের প্রার্থীকে পরাজিত করে রাজনীতি’র পরাবাস্তবতা ক্ষমতার প্রথম সিঁড়িতে পা রাখলেন। তার জনপ্রিয়তা এত বেশি ছিল যে, ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত প্রতিটি নির্বাচনে তিনি সেখান থেকে এমপি হয়েছিলেন। তাঁর সাথে প্রতিদ্বন্ধিতা করার মত কোন প্রার্থী বারিশান ন্যাশনাল দিতে পারে নি। বস্তুতপক্ষে নিক আবদুল আজিজ নিক মেট এর জন্যই সে সময় আমি লক্ষ্য করেছিলাম, কেলানতান এর রাজনীতির বিষয়টি ডাঃ মাহাথির মোহাম্মদের পুরো ক্ষমতাশীন সময়ের জন্য একটা বড় মাথা ব্যাথার কারণ ছিল বলেই দেখেছি। তিনি আমাদের বাংলাদেশে আওয়ামি লিগ সরকারের মতই নানান রকম হুমকি ধমকি দিতেন। কখনও কখনও উক্ত রাজ্যের নিয়মিত উন্নয়ন প্রকল্পে ফেডারেল সরকারের সাহায্য সংকুচিত বা বন্ধ করে দিতেন। জনগণকে নানান ধরনের ভোগান্তি দিতেন। অনেক সময় পার্টি ইসলাম সে মালয়শিয়া ‘র কর্মী ও নেতাদের নানান ধরনের হুমকি ও ভোগান্তি দিতে প্রয়াসী ছিলেন। জনসভায় মাহাথির অনর্গল কেলানতান ইসলামি সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতেন, তা লক্ষ্য করেছি। এত কিছুর পরও কোন ভাবেই কেলানতান রাজ্যে বারিসান ন্যাশনাল কোন সুবিধা করতে না পেরে অবশেষে রাজনীতির আরও কূট চাল দিলেন। তিনি নিক আবদুল আজিজ নিক মেটকে রাজনীতি থেকে নির্বাসনে দেবার কুটিল য়ড়যন্ত্র করেন। এ উদ্দেশ্যে ষড়যন্ত্র করে ঐ আসন এক সময় অবলুপ্ত করা হয়। কিন্তু ১৯৮৬ সালে তিনি বাচো’ পার্লামেন্টারি আসন (কেলানতানের আরেকটি আসন) থেকে নির্বাচন করে আবারও এমপি হন। তিনি কেলানতান রাজ্যের উন্নতি কল্পে ইসলামি আন্দোলন ‘পাস’ কে ঢেলে সাজাবার চেষ্টা করেন এবং এ দলটিকে এক অপ্রতিদ্বন্ধি একটি সুসংগঠিত ইসলামি দল হিসেবে মালয়েশিয়ায় প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯৮ সনে তিনি সেন্ট্রাল উলামা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন এবং সেই থেকে আমৃত্যু তিনি এই পদে বহাল ছিলেন। তাঁর জীবদ্দশায় এ পদে অন্য কোন ইসলামিক স্কলার নিজেকে যোগ্যতম ভাবতেই পারেন নি।
১৯৯০ সনের জাতীয় নির্বাচনে তিনি কেলানতান রাজ্যকে মালয়েশিয়ার শক্তিশালী সরকারি দল ’বারিসন ন্যশনাল’ এর হাত থেকে ‘পাসের’ আয়ত্বে নিয়ে আসার কৃতিত্বও আল্লাহ পাক তাঁকে দিয়েছিলেন। তাঁর সততা, আমলের জিন্দেগি এবং সর্বোপরি খোলাফায়ে রাশেদিনের সময়ের সাহাবাদের অনুকরণে জিন্দেগি শুধু তাঁর পার্লামেন্টারি আসনের দলীয় কর্মী ও নেতারাই নয়, সমগ্র কেলানতান বাসীকে নতুন জাগরণের পথ দেখিয়েছিল। পার্টি প্রধান হওয়ার সুবাদে তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বা [মালয়শিয়ান ভাষায় মুখ্যমন্ত্রীকে মেন্ত্রি বেসার, Mebtri অর্থ মন্ত্রী আর Besar অর্থ বড় বা মূখ্য] হিসেবে শপথ নেন এবং ১৯৯০ সাল থেকে ২০১৩ সন পর্যন্ত একাধারে ২৩ বছর এখান থেকে তিনি রাজ্য শাসন করেন। তাঁর প্রতিদ্বন্ধিতায় মাহাথির মোহাম্মদের বারসান ন্যাশনাল কোন যোগ্য নেতৃত্ব সেখানে দিতে পারে নি। এমনকি এখন পর্যন্ত এই রাজ্যটি ’পাস’ এরই আয়ত্বে রয়েছে। তিনি ১৯৯১ সনে দাতু’ ইউসুফ রাওয়ার কাছ থেকে ‘পাস’র প্রধান পদ লাভ করেন এবং সমগ্র মালয়েশিয়ায় সর্বপ্রথম তিনি ‘পার্টি ইসলাম সে মালয়শিয়া ‘ বা ‘পাস’ এর মত বৃহত্তর ইসলামি সংগঠনের রাজনীতিক ও আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে আবির্ভুত হন। তিনি রাজ্য শাসনকালে সরকারি বিলাসবহুল বাড়িতে বসবাসে অস্বীকৃতি জানান ও মসজিদের পাশে নিজের কাঠ দ্বারা নির্মিত সাধারণ বাড়িতে বসবাস করেছেন। এছাড়া সরকারি কোষাগারের অর্থ নিজের কাজে কোন অবস্থাতেই খরচ তো করতেন না, অন্য সরকারি খরচেও যথেষ্ঠ মিতব্যয়ীতার নীতি অবলম্বন করতেন। এছাড়াও তিনি বিদেশি বিভিন্ন দামী মডেলের গাড়ি ব্যবহারের সরকারি নিয়ম মেনে না নিয়ে মালয়শিয়ায় নিজ দেশের তৈরি গাড়ি ’প্রোটন সাগা’ বা ’প্রেটোন উইরা’ ব্যবহার করতেন।
যুক্তরাজ্যের একজন খ্যাতিমান ইসলামিক স্কলার ও শিক্ষক মাওলানা আবদুস সালাম আজাদী তাঁর এক লেখায় এ মহান ইসলামি ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন এভাবেঃ “আমি ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত মালয়েশিয়াতে ছিলাম। আমার রূম মেইট ইয়ুসরি জাহরি ও বন্ধু জাফরের কল্যানে এই মহান আলিম কে সামান্য সময়ের জন্য দেখার সুযোগ হয়েছে। তবে তার সম্পর্কে জেনেছি অনেক। একবার নেগরি সিমবিলানের পাসের আমীর জালালউদ্দিন সাহেবের কাছ থেকে নিক আব্দুল আযীযের বেশ কিছু কথা শুনতে পাই। তিনি ছিলেন দাতু’র ক্লাশ মেট। তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কেলানতানে পাস তথা ইসলামি আন্দোলন কে বিজয়ী করার জন্য দাতু নিক আব্দুল আযীয কী সব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তিনি তিনটি পদক্ষেপ কে খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছিলেন। এ পদক্ষেপ তিনটি হল নিম্নরূপঃ
প্রথমতঃ তিনি কেলানতানে এবং পরে সারা মালয়েশিয়ার ইসলামি মোর্চা গুলোকে খুব কাছাকাছি নিয়ে এসেছিলেন। তিনি তাবলীগের দিল্লীর মুরুব্বীদের কে দাওয়াত করে মালয়েশিয়াতে নিয়ে আসেন। এবং পলিটিক্সের ব্যাপারে তাদের সাথে একটা বোঝা পড়া করেন। তিনি মুরুব্বিদের বলেনঃ আপনারা পলিটিক্স করেন না, ওটা আমরা করি। আপনাদের জন্য যে কাজগুলো আমরা করব, তা হল, আমাদের সমস্ত মসজিদগুলোকে তাবলীগের কাজের জন্য আপনাদের কাছে ছেড়ে দেব। সেখানে মুসলমানদের নামাজি বানান, ইসলামের মৌলিক জিনিস শেখানো এবং এদের চরিত্র সংশোধনের কাজগুলোর দ্বায়িত্ব আপনারা নেন। আমরা অর্থ ও সুযোগ সুবিধা দিয়ে আপনাদের সার্বিক সাহায্য করব। এমন কি আমাদের বড় বড় প্রোগ্রামগুলোতেও আপনারা আসবেন। বয়ান দেবেন। তাদের যেভাবে আপনারা ভাল মনে করেন, রূহানিয়াত বাড়ানোর কাজে ব্যয় করবেন। পলিটিক্স করা যেহেতু হারাম না, কাজেই এটা করতে আপনারা কাউকে নিষেধ করবেন না। আর ভোট দেয়ার সময় কাকে ভোট দিতে হবে এটা না বলতে পারলেও ‘ইসলাম বিরোধী কোন শক্তিকে ভোট দেয়া যাবে’ এটা অন্তত বলবেন না। আরেকটা কাজ আপনারা করবেন, তা হল, আপনাদের মসজিদগুলোতে আমাদের ঢোকার সুযোগ দেবেন। পলিটিক্সের ব্যাপারে কথা না বলতে দেন, ইসলামের বিভিন্ন বিষয় আলোচনা বা সেমিনার করার সুযোগ দেবেন।
নিক আযীযের কথায় এত যুক্তিযুক্ত ছিল যে, তাবলীগ জামাআত ঐ বৈঠকেই বসে তার সাথে একমত হয়ে যায় এবং তার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার জন্য দিল্লীর নিযামুদ্দিনের মুরুব্বিরা তাদের মালয়েশিয়ান দ্বায়িত্বশীলদের কে নির্দেশ দিয়ে যান। শুধু তাবলীগ না, যারাই ইসলামের কাজ করত তাদের সাথে তিনি বন্ধুত্বের সম্পর্ক বজায় রাখতেন। আলআরকাম গ্রুপের সাথে মতানৈক্য থাকলেও তিনি সদ্ভাব বজায় রাখতেন। আবীমের আনওয়ার ইব্রাহিম তাকে সব সময় শিক্ষকের মর্যাদা দিয়ে এসেছেন। এক স্মৃতি চারণায় আনওয়ার ইব্রাহিম বলেনঃ যখনই ইসলামি ও রাজনৈতিক কোন ব্যাপারে আমি সিদ্ধান্ত নিতাম, তুয়াং গুরুর কাছে যেতাম। যখনই রাজনৈতিক সম্পর্কে কোন মারাত্মক বিভেদ দেখা দিত, তার হস্তক্ষেপ আমি কামনা করতাম। তার কোন কথাকেও ফেলতে চাইত না। তিনি ইসলামি দলগুলোকে এক করতে যেয়ে যা ছাড় দিতেন, তার জন্য নিজ পার্টি ’পাস’ এর কনফারেন্স গুলোতে সেজন্য তাঁকে অনেক হ্যানস্তার স্বীকারও হতে হত।
দ্বিতীয়তঃ তিনি যদিও পরিপূর্ণ ইসলামি রাষ্ট্রীয় বিধান প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাসী ছিলেন, তা সত্বেও তিনি অমুসলিমদের ব্যাপারে ছিলেন খুবই সচেতন শাসক ছিলেন। পাসের ভেতর তিনি সবার প্রবেশাধিকার দিয়েছেন, এবং তাদেরকেও বড় বড় দ্বায়িত্ব দিতে কার্পণ্য করেন নি। সবাইকে এক করার কাজে সারা জীবন ব্যয় করেছেন, ফলে তিনি ‘পার্টি ইসলাম সে মালয়শিয়া’কে অনেক গণমুখী করতে সক্ষম হয়ে হয়েছিলেন। তার সম্পর্কে আজকে মালয়েশিয়ায় অমুসলিমরা যে দুঃখ বেদনায় আহাজারি করেন, তা খুবই লক্ষণীয়।
তৃতীয়তঃ তিনি ‘পার্টি ইসলাম সে মালয়শিয়া’ তে আলিমদেরকেই বড় বড় পদ দিয়ে গোটা দেশের আলিম সমাজকে কাছে নিয়ে আসেন। তার সাথে বিভিন্ন পেশার উচ্চ শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী ও প্রভাবশালী লোকদের কাছেও নিজের গ্রহণযোগ্যতা লাভে সক্ষম হন। ফলে গোটা মালয়শিয়াতে তার বিরোধী শক্তি ছিল মূলতঃ ইসলাম বিরোধী শক্তি অথবা মারাত্মক সেক্যুলার শক্তি। অধুনা মুসলিম দেশগুলোতে সবচেয়ে বিপদ হয়েছে, ইসলামি আন্দোলনগুলো ধ্বংস করতে সেক্যুলার শক্তির চেয়ে ইসলামের অন্য কায়েমী শক্তিগুলোও মারাত্মক নেতিবাচক ভূমিকা পালন করে। নিক আব্দুল আযীয সে দিক থেকে খুব ভাল অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হন।
তিনি ক্ষমতা পাওয়ার পাওয়ার পর যে সব কাজের মাধ্যমে ইসলামি রাস্ট্র ব্যাবস্থা কায়েমের চেষ্টা করেছেন তা মোটামুটি ভাবে িনিম্নরূাপঃ
১। মালয়েশিয়া সেক্যুলার দেশ হলেও তিনি নিজ রাজ্যকে ইসলামিকরণে চেষ্টা করেছেন। ইসলামি হুদূদ ল’ প্রতিষ্ঠার জন্য অনেক বার চেষ্টা করলেও ফেডারেল গভমেন্টের চাপে তাঁকে পরাভূত হতে হয়েছে। এরপরও ইসলামি শরীয়তের অনেক বিষয়কে তিনি আপন রাজ্যে এমনকি ফেডারেল সরকারেও প্রবেশে সক্ষম হয়েছিলেন। যেমনঃ ইসলামি কোর্টকে ফেডারেল কোর্টের প্যারালাল করেছিলেন। এতে করে কেউ যদি কোন ব্যাপারে সেক্যুলার কোর্টে না গিয়ে ইসলামি কোর্টে কেস করতে চায়, তাকে সে সুযোগ মালয়েশিয়াতে দেয়া হয়।
২। ইসলামি জীবন আচরণের প্রতি তিনি বেশ কিছু আইন করেন। মেয়েদের স্কার্ফ ও শালীন মালয়শিয়ান পোশাক (মালয়শিয়ান ভাষায়ঃ বাজু মালায়ু) পরার নির্দেশের সাথে সাথে পুরুষের মন রঞ্জনের জন্য অতিরিক্ত সাজসজ্জা গ্রহণ করাকে সরকারি অফিস সহকারিদের জন্য নিষেধ করে দেন। তিনি এটাকে ব্যভিচার বৃদ্ধির কারণ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তার এ সব নীতির কারণে মালয়েশিয়ার মধ্যে তার রাজ্যে সামাজিক সমস্যা ও অনাচার তুলনামূলক ভাবে অনেক কমে যায়।
৩। দেশবাসিকে অযথা খরচ কমিয়ে দেশের আয় বৃদ্ধিতে অর্থ সংরক্ষণ ও আভ্যন্তরীণ অর্থ উন্নয়নের একটা রূপ রেখা তৈরি করেন তিনি। তিনি তার বেতনের অর্ধেক নিতেন, অর্ধেক দান করে দিতেন। সরকারি বাস ভবনে না থেকে নিজের খুব সাধারণ ঘরে থাকতেন। ১৯৯৭ সালে মালয়েশিয়ায় রিসেশনের সময় বিয়ে শাদি বা পার্টিতে অতিরিক্ত খরচ করতে নিষেধ করে ওই বছর নিজের প্রদেশকে রিসেশান মুক্ত রাখতে পেরেছিলেন, যা ছিলো ফেডারেল সরকারের জন্য একটা দৃষ্টান্ত। মাহাথিরের মত ইসলামি আন্দোলনের দুশমন ও তার এই নীতিকে পছন্দ করে ছিলেন।
৪। তিনি রিসেশান তথা অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের জন্য বিশ্বের কয়েকটি মোড়ল রাষ্ট্রের পেশী শক্তির ব্যবহারকে দায়ী করেন। তিনি মনে করতেন, স্বর্ণের পরিবর্তে ব্যংক নোটের ব্যবহার বহু সমস্যার সৃষ্টি করেছে। যাদের রাজনৈতিক জোর যত বেশি, তারা এই কাগুজে নোটকে ফাঁকি দেয়ার মাধ্যম হিসেবে তত বেশি গ্রহণ করে। বিশেষ করে ১৯৯৭ সালে জর্জ সরোস কর্তৃক মালয়েশিয়ার শেয়ার বাজার ধ্বংস করে দেয়ার পর তিনি এ ব্যাপারে বেশি উচ্চকিত হন। পরে ২০১০ সাল থেকে তিনি কেলানতানে ইসলামি মুদ্রার প্রচলন করেন। যার নাম দেন দিনার ও দিরহাম।
৫। কেন্দ্রীয় সরকারকে বুঝিয়ে বিশেষ করে আনওয়ার ইব্রাহীমের বুদ্ধি ও সহযোগিতার কারণে মালয়েশিয়াতে ব্যাপক হারে ইসলামি ব্যাঙ্কিং ও ইন্সুরেন্স কোম্পানি সমূহের প্রসার লাভ করে। দাতু নিক আব্দুল আযীয এগুলোর পৃষ্ঠপোষকতাই শুধু করেন নি, কেলানতানে তার ব্যাপক প্রসার ঘটিয়েছিলেন। ইসলামি শিক্ষা ব্যবস্থাতেও তিনি আমূল পরিবর্তন আনেন। যদিও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে তার প্রদেশ খুব উন্নত হয় নি। কেননা বরাবরই ফেডারেল সরকার ইসলামি রাজ্য সরকারকে হ্যনস্তা করতে উন্নয়ন কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করত। কিন্তু সেখানে ধনী গরীবের ব্যবধান তিনি অনেক কমাতে সক্ষম হয়েছিলেন, সেটি দুর্মুখেরাও স্বীকার করবে।
৬। আনওয়ার ইব্রাহীমের সাথে পিকেআর কোয়ালিশান করে তিনি ইসলামি আন্দোলনের আধুনিক ধারা কে নতুন ভাবে পরিচিত করে তোলেন। এই ধারা টা অনেকটা ইউরোপীয় সেক্যুলার ধারার সাথে মিল রেখে করা। ইসলামি আন্দোলনের তার্কিশ সংস্করণও একে বলা যায়। এর মূল কথা হলঃ ধর্মের ব্যাপারে যদিও ছাড় দেয়া হবে না, তবু রাষ্ট্রে যে যার ধর্ম মেনে চলতে পারবে। এ কোয়ালিশনে চাইনিজ ও হিন্দুরা যুক্ত হয়। এটা করতে যেয়ে তাকে পার্টি ইসলাম সে মালয়শিয়া’ অর্থাৎ তাঁর দলের সংবিধানও রদবদল করতে হয়েছিল এবং দলের রক্ষণশীলদেরও যথেষ্ঠ বাধা ও সমালোচনার সম্মূখীন হয়েছিলেন। বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে তাঁকে এসব উদার নীতি গ্রহণ করতে হলেও ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও ইসলামি হুদূদ বাস্তবায়ন করায় তাঁকে কোন অসুবিধার সম্মূখীন হতে হয় নি। এসবই তিনি করেছেন মহান আল্লাহর ইচ্ছায় অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা ও উদার নীতিমালার সাথে। দলের অভ্যন্তরে নানান বিতর্ক থাকার পরও তিনি তারপরও আনওয়ার ইবরাহীমের সাথে করা ঐক্য বিনষ্ট করেন নি। বারিসন ন্যাশনাল বা UMNO বারবার চেষ্টা করেছিল, যাতে তিনি তাদের জোটের সাথে ঐক্য করেন। কিন্তু তিনি তা করেন নি।
এ মহান ইসলামি ব্যক্তিত্ব ও রাজ্যশাসক ইন্তেকাল করেছেন প্রস্টেট ক্যান্সারে ভুগে। ২০১৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি তাঁর বিশাল জানাযা নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। এতে মানুষের যে ঢল নেমেছিল, তা বর্ণাণাতীত, অসাধারণ ও বিস্ময়কর। তাঁর ইন্তেকালে বিশ্বের ইসলামি উম্মাহ ইসলামি আন্দোলনের একজন বলিষ্ঠ সংগঠক ও মহাপুরুষকে হারাল। আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফিরদাউস দান করুন। আমিন।
[২০১৫ সালে আবদুস সালাম আজাদী রচিত ও প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে কিছু কোটেশন নেয়া হল]
ড. ওমর ফারুক।। সুপরিচিত লেখক, কলামিস্ট, সামাজিক গবেষক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। ইংরেজি সাপ্তাহিক ঢাকা পোস্ট সম্পাদক ও নিহাল পাবলিকেশনের স্বত্বাধিকারী। তিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। তাঁর লেখা ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় গ্রন্থ সংখ্যা ত্রিশটিরও বেশি।