খিলাফতের কথা বললে কেন অনেকে আঁতকে উঠেন?
(প্রথম পর্ব)
।। মহিউদ্দিন।।
মুসলিম খিলাফতের কথা বললে অনেকই আজ আঁতকে উঠেন। কারণ তারা ইতিহাস জানতে চান না। খিলাফতের অপর নাম মুসলিম শক্তিও বলা যেতে পারে। তবে তা বুঝতে ইতিহাস বুঝতে হবে। মুসলিম বিশ্বের বর্তমান অবস্থা কিভাবে কেন এ অবস্থায় উপনীত হয়েছে তা জানতে হলে আমাদেরকে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ (First World War) সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা থাকা খুবই জরুরী। এখানে যে সব তথ্য উপাত্ত পেশ করা হবে তা মূলতঃ পাঠ্যপুস্তক, অনলাইন, মেইনস্ট্রিম ইতিহাস সোর্স থেকেই নেয়া। কোন তথাকথিত “ষড়যন্ত্র তত্ত্বের” (conspiracy theory) ব্যাপার নয়।
প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের (First World War) পূর্বে মুসলিম বিশ্ব মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল বলা যায়। আর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলেই পৃথিবীর মানচিত্রে ও রাজনৈতিক মেরুকরণে আসে বিরাট পরিবর্তন। অনেক পুরানো সাম্রাজ্যের পরিবর্তন ও পতন ঘটে ইউরোপিয়ান সাম্রাজ্যের নতূন রুপ নেয়, বদলে যায় অনেক দেশের ভৌগলিক সীমা রেখা। তবে সবচেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ত হয় মুসলিম উম্মাহ। অবসান হয় শত শত বছর ধরে চলে আসা মুসলিম খিলাফতের অস্তিত্ব। কীভাবে কেন তা হল বুঝতে ইতিহাস জানা অবশ্যই দরকার। এ নিবন্ধে সে বিষয়েই আলোকপাত করার চেষ্টা করব। এখানে আরেকটা কথা মনে রাখা দরকার যে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের ফলাফলই ছিল দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ সূচনার পিছনের প্রত্যক্ষ কারণ।
প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ (First World War ) কখন শুরু হয়?
মূলতঃ ইউরোপকেন্দ্রিক এ যুদ্ধ শুরু হয় ২৮ জুলাই ১৯১৪ এবং এর সমাপ্তি ঘটে ১১ নবেম্বর ১৯১৮ সনে । সামরিক ও বেসামরিক সহ ৭০ মিলিয়নের অধিক মানুষকে এ যুদ্ধে মোতায়েন করা হয়। মানব ইতিহাসে এত বৃহত্তম যুদ্ধের আয়োজন এটাই ছিল প্রথম। দীর্ঘ চার বছরের এ যুদ্ধে প্রায় ৯ মিলিয়ন সামরিক এবং ৭ মিলিয়ন বেসামরিক মিলিয়ে মোট ১৬ মিলিয়নের তথা ১ কোটি ৬০ লক্ষের অধিক মানুষ প্রাণ হারায়, যার মাঝে ছিল অসংখ্য গণহত্যা। যখন এ যুদ্ধের ঘোষণা করা হয়, তখন ইউরোপের অধিকাংশ রাজধানী শহরে মানুষ রাস্তায় নেমে আনন্দ উল্লাস করছিল। কেউ ভাবতে পারে নি যে, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহারে এ যুদ্ধ এত মর্মান্তিক পরিণতি বয়ে আনতে পারে। নিচের ডকুমেন্টারি ভিডিওটাতে একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা আছে।
প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের কারণঃ
১৯১৪ সালের ২৮ জুন বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভো শহরে অস্ট্রিয়ার যুবরাজ আর্কডিউক ফ্রানৎস ফার্ডিনান্ড এক সার্বিয়াবাসীর গুলিতে নিহত হন। অস্ট্রিয়া এ হত্যাকাণ্ডের জন্য সার্বিয়াকে দায়ী করে এবং ওই বছরের ২৮ জুন সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এ যুদ্ধে দু’দেশের বন্ধু রাষ্ট্রগুলো ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়ে। এভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৮) সূচনা হয়। তবে অস্ট্রিয়ার যুবরাজ হত্যাকাণ্ডই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের একমাত্র কারণ ছিল না। উনিশ শতকে শিল্পে বিপ্লবের কারণে সহজে কাঁচামাল সংগ্রহ এবং তৈরি পণ্য বিক্রির জন্য উপনিবেশ স্থাপনে প্রতিযোগিতা এবং আগের দ্বন্দ্ব-সংঘাত ইত্যাদিও প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের কারণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এক পক্ষে ছিল অস্ট্রিয়া, জার্মানি, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া। যাদের বলা হত কেন্দ্রীয় শক্তি। আর অপর পক্ষে ছিল সার্বিয়া, রাশিয়া, ব্রিটেনে, ফ্রান্স, জাপান, ইতালি ও আমেরিকা। যাদের বলা হত মিত্রশক্তি। আর মিত্রশক্তির তখন মূল শক্তি ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্য, যাদের বিস্তৃতি ইউরোপ আফ্রিকা থেকে দক্ষিণ এশিয়া পর্যন্ত। দক্ষিণ আফ্রিকাও তখন ব্রিটিশদের অধীনে। কানাডা, অস্ট্রেলিয়াও ব্রিটিশদের থেকে ১০০% স্বাধীন না তখন, নিউজিল্যান্ডে তো এখনও ব্রিটিশ রাজা/রাণী রাষ্ট্র প্রধান। বিশাল সাম্রাজ্যের কারণে ব্রিটিশদের সেনা প্রায় গোটা দুনিয়াতেই ছিল। ব্রিটিশদের এত কলোনির কারণেই মূলত যুদ্ধ এশিয়া ও আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমান যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা এ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
।।দ্বিতীয় পর্ব।।
প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের ফলে পৃথিবীর মানচিত্রে ও রাজনৈতিক মেরুকরণে যে বিরাট পরিবর্তন হয়েছিল এবং যার ফলে মুসলিম বিশ্ব কিভাবে বিপর্যস্ত হল। আর কিভাবে মুসলিমরা তাদের সম্মান ও স্বাধীন ভাবে চলার পথ বন্ধ করে দিল, তার কিছুটা ইংগিত এই পর্বে আছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ছিল ইউরোপীয়, কিন্তু তুরস্কের উসমানিয়া খিলাফত কেন এ যুদ্ধে জড়িয়ে গেল? তার পিছনেও অনেক কারণ ছিল।
উসমান (অটোমান) সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল উত্তর আফ্রিকার তিউনিসিয়া থেকে ইউরোপের হাঙ্গেরী, রাশিয়ার ক্রাইমিয়া থেকে পূর্বে জর্জিয়া পর্যন্ত। অন্যদিকে, মক্কা মদিনাসহ এক্ববারে ইয়ামান পর্যন্ত। অর্থাৎ ইউরোপের অস্ট্রিয়ান বর্ডার ও এশিয়ায় রাশিয়া ও ইরান বর্ডার পর্যন্ত। উসমানী শাসন পদ্ধতি চলত “মিল্লাত” ব্যবস্থায়। এটা ছিল বহু ধর্ম, বহুবর্ণ এবং বহু ভাষার বিভিন্ন ধর্ম ও তাদের স্থানীয় কালচার প্রেক্ষিতগত করে। অর্থাৎ এসব ক্ষেত্রে কোন অযাচিত হস্তক্ষেপ করা হত না। কাউকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করা হত না। এ বিষয়টি ইউরোপিয়ান স্কলারও স্বীকার করে থাকেন। শরীয়া আইনের ভিত্তিতে বিচারব্যবস্থা চলত। মুসলিমরা জাকাত দিত এবং বিধর্মীরাও নির্দিষ্ট হারে ট্যাক্স প্রদান করত।
উসমানী খেলাফতের শেষের দিকের সুলতানদের অযোগ্যতা, অদক্ষতা ও অপরিণামদর্শিতার কারণে, তখন তুরস্কে তরুণদের মাঝে, বিশেষ করে সেনাবাহিনীতে, একটি বিদ্রোহী গ্রুপ গোপনে সংগঠিত হতে থাকে। এরা রাজতন্ত্রের বিরোধী হয়ে পড়ে। এদেরকে “ইয়ং টার্ক” ( Young Turks ) বলা হত এবং এদের মধ্যে অমুসলিমরাও ছিল, এবং বলা হয় কিছু ইয়াহুদিও ছিল। এরা মূলতঃ সমাজের অভিজাত মহলের ধনী পরিবারের তরুণ যারা ইউরোপে পড়াশুনা করে আসা সেকুল্যার চিন্তাধারার একটি প্রভাবশালী মহলের সদস্য। যারা ইসলামের চেয়ে তুরস্ক জাতীয়তাবাদী চেতনায় বিশ্বাসী ও এ রকম চেতনায় আসক্ত ছিল বেশি। এদের সাথে ইউরোপীয় মহলের সংযোগ ছিল এবং খলিফা এদের চাপেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য হন। পরবর্তীতে এরাই খিলাফতের অবসান ঘটায়। এদেরই নেতৃত্বে ছিলেন মুস্তাফা কামাল পাশা আতাতুর্ক। এ ছাড়া এ সবের পেছনে আরও কারণ ছিল। ফরাসি বিপ্লবের দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে এবং ভিন্ন ধর্ম এবং ভিন্ন এলাকার সুলতানী শাসনে বসবাসরত জনগণের এলাকায় খুবই দ্রুত ভৌগলিক জাতীয়তাবাদের প্রসার ঘটে। একদিকে প্রাচীন টেকনোলজি এবং ধর্মীয় গোঁড়ামী অর্থাৎ নতুন কোন কিছু জানা বা শেখার বা সংস্কার মানে যদি বিদআ’ত হয়ে যায়, সে ভয়ে কুসংস্কারে আচ্ছাদিত সমাজ নির্ভর ও ধারক উসমানী শাসন ব্যবস্থা তুলনামূলক ভাবে দিন দিন শক্তি হারাতে থাকে। তাই যুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই কিছু দেশের খ্রিষ্টিয়ান প্রজাদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ফলে উসমানিয়রা তাদের সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা ইউরোপের বিভিন্ন এলাকার অনেক দেশ হারাতে হয়। । তুর্কিরা ভেবেছিল যুদ্ধে জয়ী হলে হারানো অঞ্চল পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে। এদিকে জার্মানির সঙ্গে তুর্কিদের ব্যবসায়িক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক আগে থেকেই গভীর ছিল। আজও লক্ষ লক্ষ তুর্কিরা জার্মানিতে আছেন।
তাই উসমানীয় সাম্রাজ্য কেন্দ্রীয় শক্তির পক্ষে (জার্মান সাম্রাজ্যের পক্ষের দেশগুলো) ১৯১৪ সালের নভেম্বরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেয়। উসমানীরা মধ্যপ্রাচ্য রণাঙ্গনে অংশ নিয়েছিল। যুদ্ধের প্রথমদিকে উসমানীরা বেশ কিছু বিজয় অর্জন করেছিল। এর মধ্যে গ্যালিপলির যুদ্ধ ও কুত অবরোধ অন্তর্গত।এসব যুদ্ধে মুস্তাফা কামাল পাশা নেতৃত্ব দিয়ে তুরষ্কের মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। তবে রুশদের বিরুদ্ধে ককেসাস অভিযানে ব্যর্থতার উদাহরণও রয়েছে। ১৯১৫ সালে রুশ ককেসাস সেনাবাহিনী পূর্ব আনাতোলিয়ায় অগ্রসর অব্যাহত রাখে।
আরবদের মাঝেও ইসলাম ছেড়ে ভৌগলিক আরব জাতীয়তাবাদের নেশা ছড়ান হয়। তাই মিত্র শক্তিরা তুরস্কের বিরুদ্ধে আরব বিদ্রোহের উসকানি দিতে থাকে।
উসমানীদের অধীনে আরবের মক্কার আমির বা গভর্নরকে বলা হত শরিফে-মক্কা। তখন হোসেন বিন আলী আল্ হাস্মি (Hussein ibn Ali al-Hashimi ) ছিলেন মক্কার শরিফ। তিনি রসুল (স:) এর বনি হাশেম বংশের ছিলেন বলে আরবদের মাঝে অত্যন্ত প্রভাবশালী ও শ্রদ্ধার ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাই ব্রিটিশরা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তাঁকে তুরস্কের সুলতানের বিপক্ষে দাঁড় করায়। বিনিময়ে তারা তাকে গোটা আরব জাহানের বাদশাহ করবে বলে প্রতারণামূলক আশ্বাস দেয়। অথচ তুরস্কের সুলতানেরা এ পরিবারের হাতে মক্কার শাসনভার ৭ শত বৎসর ধরে দিয়ে রেখেছিল। কিন্তু হোসেন বিন আলী আল্ হাস্মি বাদশাহ হওয়ার লোভে পশ্চিমা ষড়যন্ত্রে ঢুকে পড়েন।
এ ষড়যন্ত্র মিশনে প্রত্নতত্ত্ববিদের বেশে জনৈক টি ই লরেন্স ( T. E. Lawrence) নামের এক বৃটিশ গুপ্তচরকে নিযুক্ত করা হয়। সে মক্কার আমীরকে দিয়ে আরবদেরকে তুরষ্কের বিপক্ষে সামরিক বিদ্রোহের ইন্দন জোগাতে থাকে। ইতিহাসে এই ব্যক্তি “লরেন্স অফ এরাবিয়া” নামে পরিচিত।
এখানে জেনে রাখা দরকার যুদ্ধকালীন সময়ে মিত্র বাহিনী বিভিন্ন পক্ষের সাথে তিনটি প্রতিশ্রুতি বা চুক্তি করেছিল ।
১) আরবদের সাথে অর্থাৎ তাদের নেতা মক্কার আমীর শরিফ হুসেইন বিন আলীকে বলেছিল যে তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলে তাকে অখণ্ড আরবের (Independent United Arab land) স্বাধীন বাদশাহ করা হবে।
২) গোপন চুক্তি। যা ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের পরাজিত করার পর আরব দেশ সহ তুরষ্ক সাম্রাজ্যের সকল ভূখণ্ডকে কিভাবে মিত্র শক্তি (Allied Force) তাদের নিজেদের মধ্যে বণ্টন করবে তা নির্দারন। তখন রাশিয়া চেয়েছে তুরস্ক, ফ্রান্স চেয়েছে সিরিয়া ও লেবানন অঞ্চল ব্রিটিশরা নিয়েছে হেজাজ, জর্ডান এবং ইরাক ।
৩) ইহুদীদের জন্য পৃথক একটি রাষ্ট্র সৃষ্টির ওয়াদা ।
এদিকে মিত্রশক্তির তাদের নিজেদের মধ্যকার গোপন চুক্তিতে হোসেন বিন আলী আল্ হাস্মিকে যুক্ত আরব বিশ্বের কোন খলিফা বা শাসক করার কোন পরিকল্পনাই রাখে নি। বরং তারা এক সন্ধ্যাকালীন বৈঠকে কলমের খোঁচায় আরব ভুখন্ডকে তাদের মধ্যে পিঠা ভাগ করে নেয়। নিচের মানচিত্রে A & B এর মাঝখানে দেখতে পাবেন সে দাগ।
এদিকে এই চুক্তির খবর তখন আরবদের কানে আসলেও তাদেরকে মিত্রশক্তি বিশেষ করে ব্রিটিশরা বোকা বানাতে সমর্থ হয় এবং উসমানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ লাগিয়ে দেয়।
তাই ১৯১৬ সালে আরব বিদ্রোহ শুরু হলে তা মধ্যপ্রাচ্য রণাঙ্গনে উসমানীয়দের স্রোতকে উল্টে দেয়। ১৯১৮ সালের ৩০ অক্টোবর মুড্রোসের যুদ্ধবিরতি স্বাক্ষর হলে তা মধ্যপ্রাচ্যের লড়াইয়ের অবসান ঘটায় এবং এরপর কনস্টান্টিনোপল দখল ও উসমানীয় সাম্রাজ্যের বিভাজনের ঘটনা ঘটে। ১৯ শতকের শেষ চতুর্থাংশ ও ২০ শতকের প্রথম অংশে প্রায় ৭-৯ মিলিয়ন তুর্কি মুসলিম উদ্বাস্তু হাতছাড়া হওয়া ককেসাস, ক্রিমিয়া, বলকান ও ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপগুলো থেকে আনাতোলিয়া ও পূর্ব থ্রেসে চলে আসে।[৯১]
কনস্টান্টিনোপল ও ইজমির দখলের ঘটনার কারণে তুর্কি জাতীয় আন্দোলনের সূচনা হয়। পরবর্তীতে মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের অধীনে তুর্কিরা স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়ী হয়। ১৯২২ সালের ১ নভেম্বর সালতানাত বিলুপ্ত করা হয় এবং শেষ সুলতান ষষ্ঠ মুহাম্মদ ১৭ নভেম্বর দেশ ছেড়ে চলে যান। সালতানাত বিলুপ্ত হলেও এসময় খিলাফত বিলুপ্ত করা হয়নি। ষষ্ঠ মুহাম্মদের স্থলে দ্বিতীয় আবদুল মজিদ খলিফার পদে বসেন। ১৯২৩ সালের ২৯ অক্টোবর গ্র্যান্ড ন্যাশনাল এসেম্বলি তুরস্ককে প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে। ১৯২৪ সালের ৩ মার্চ খিলাফত বিলুপ্ত করা হলে[৯২]সর্বশেষ খলিফা দ্বিতীয় আবদুল মজিদ দেশত্যাগ করেন। শেষ হয় মুসলিম বিশ্বের শক্তির ও ঐক্যের শেষ নিশান!
তার পরের ইতিহাস হুসেন বিন আলী আল্ হাস্মির বংশের কারো পক্ষে একমাত্র জর্ডান ছাড়া আরবের কোথায়ও ক্ষমতায় থাকা সম্ভব হয় নি। এদিকে ব্রিটিশরা পিছন থেকে আল-সাউদ নামের আরেক পরিবারকে সহযোগিতা করতে থাকে যারা বর্তমান সৌদি আরবের রাজ পরিবার। বিশ্ব মুসলিম ঐক্যে এই শাসক গোষ্ঠীর ভূমিকা যে কী তা সবাই জানেন।
মিত্রশক্তি তাদের পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা আরব ভূখণ্ডকে বিভিন্ন ছোট ছোট রাষ্ট্রে বিভক্ত করে অনৈক্যের বীজ বপন করতে সফল হয়। যার ফলে আরবরা আজও গোলামীর শিকলে আবদ্ধ হয়ে আছে। আরব শাসকের কাছে ইসলামের আদর্শ বাস্তবায়নের মাধ্যামে সমাজে ন্যায় বিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠা, তাদের দেশের মানুষের স্বার্থ ও বিশ্ব মুসলিমদের স্বার্থ রক্ষা করার কোন উদাহরন নাই! মুসলিম হত্যার রক্তের দাগ যাদের হাতে তাদেরকেও তারা সর্বোচ্চ পদবীতে ভুষিত করতে দ্বিধাবোধ করে না!
ইতিহাসের শিক্ষাঃ
মজার ব্যাপার হল, ইউরোপ তথা পশ্চিমা বিশ্ব তাদের মাঝে বিভিন্ন যুদ্ধ করলেও আজ তারা একতাবদ্ধ এবং প্রযুক্তি ও টেকনোলজিতে অগ্রগামী। কিন্তু মুসলমানেরা আজও ঐক্যবদ্ধ হওয়া তো দূরের কথা, নিজেদের মধ্যকার বিভক্তি ও অনৈক্য যাতে আরও শত শত বছর চলতে পারে সেই পন্থা খুঁজতেই ব্যস্ত। আর ধর্মীয় নেতারাও সমাজকে পিছনে নিয়ে যেতে একে অন্যের সাথে সমালোচনা ও বিরোধিতার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। নিজেদেরকে আধুনিক শিক্ষা থেকে দূরে রেখে ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে যুগোপযোগী না করে সেই মান্ধাতা আমলের সংকীর্ণ মানসিকতা থেকে তাঁরা বাহির হতে চান না।
উপসংহারেঃ
খিলাফত সম্পর্কে আমার এক ভারতীয় মুসলিম বন্ধুর একটি কথা দিয়ে শেষ করছি, “রাসুল (স:) ওফাতের পর ইসলামের প্রাথমিক যুগে আমাদের মহান চার খলিফার শাসন আমলে, তারা তাঁদের প্রথম এবং প্রধান যে দায়িত্ব মনে করতেন তা ছিল ইসলামের আদর্শ তথা শরিয়াকে রক্ষা করা। অর্থাৎ সে আদর্শকে সর্বোচ্চ আসনে রাখা ছিল তাদের প্রথম কাজ। এই কাজ করতে গিয়ে তারা এক মিনিটের জন্যও জনগণের কল্যাণ ও আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কিছু ভাবতেন না।
আর পরবর্তীকালের রাজা বাদশাহ ও সুলতানেরা ক্ষমতায় গিয়ে মনে করতেন তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষা করা এবং তাদের দৌরাত্ম, প্রতাপ এবং শ্রেষ্ঠতা প্রতিষ্ঠা করাটাই ছিল প্রাইম ও প্রধান লক্ষ্য। তাদের কাছে ইসলামী আদর্শ বা শরিয়া রক্ষা করা হচ্ছে পরের ব্যাপার। মুসলিম শাসকদের মাঝে যেদিন থেকে এই মনোবৃত্তি ও প্রবণতা শুরু হয়েছে, সেদিন থেকেই তারা ইসলাম থেকে ধীরে ধীরে বহু দূরে সরে গিয়েছেন। তাই তুরস্কের সুলতানরাও তাদের সাম্রাজ্য বিস্তারে বাড়াবাড়ির উদাহরণ স্থাপনের উদাহরণ রেখে গেছেন? যা ছিল ইসলামী শরিয়া পরিপন্থী। এ সবের পরিণতিতে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহ এ বিশ্বে অবিশ্বাসীদের কাছে গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছেন। আর এই সাথে মুসলিম সমাজও ধর্মীয় গোঁড়ামী ও মূর্খতার কবলে নিমজ্জিত হওয়ার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়েছে।”
আসলে ইতিহাসের শিক্ষা নিয়ে বর্তমানকে সাজাতে পারলে যে কোন জাতির জন্য বয়ে আনে অশেষ কল্যাণ। কিন্তু দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হল মানুষ অতীত কিংবা নিকট কোন ইতিহাস থেকেই শিক্ষা নিতে চায় না। আর মুসলিমদের বেলায় তো এই নজির একেবারেই কম। অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহণ না করলে অবস্থার উন্নতি যে সম্ভব নয় এ কথাটি তাদের মাথায় ঢুকছে না। অতএব সুরঙ্গের অপর প্রান্তে আজ কোন আলোর আশা করা বাতুলতা মাত্র। কেননা মহান আল্লাহ বলেই দিয়েছেন যারা নিজেদেরকে নিজেরা সাহায্য করতে চাইবে না, তাদেরকে আল্লাহ সাহায্য করবেন না।
এপ্রিল ১২, ২০১৬ at ২:২৬ পূর্বাহ্ন (UTC 6) Link to this comment
এই লেখাগুলোতে আরও আলোচনার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়। কিন্তু নিজের ব্যস্ততা এবং কম্পিউটার সমস্যার কারণে আমার জন্য পেরে উঠা সম্ভব হচ্ছে না। এটা সন্দেহাতীতভাবে সত্য যে প্রথম মহাযুদ্ধ বৈশ্বিক পরিস্থিতি উলট-পালট করে দেয়। কিন্তু প্রত্যেক ল্যান্ডমার্ক ঐতিহাসিকতায় ক্রমান্বয়ে গঠিত অসংখ্য দ্বান্দ্বিক সূত্রের অস্তিত্ব থাকে। ইউরোপের ইতিহাস হচ্ছে চরমভাবে যুদ্ধের ইতিহাস। কোনো উপায়ে ১৬৪৮ সালে ধামা-চাপা এবং ভাগ-ভাটোয়ারার এক সমাধানে আসা হয় যাকে ওয়েস্টফেলিয়ান শান্তি-চুক্তি বলে উল্লেখ করা করা হয়। এতে প্রথমত ভৌগোলিক সার্বভৌমিক একটি ধারণায় আসা হয় এবং কেউ কোনো অজুহাতে কারো ভৌগোলিক সার্বভৌমিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না –এই স্বীকৃতি প্রধান হয়, যদিও প্রকৃত অর্থে যুদ্ধ তেমন একটা শেষ হয়ে যায় নি। ওয়েস্টফেইলিয়ান চুক্তি কালের ধারায় ভূখণ্ডভিত্তিক এক জাতীয়তার রূপায়ণ ঘটায়। কিন্তু ১৮শো, ১৯শো শতাব্দীতে তৃতীয় বিশ্বের সম্পদ লুটের যে হিড়িক পড়ে, যা বন্দুকের জোরে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত চলে, এবং পরে তা আদর্শিকভিত্তিতে (গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, সাম্য ইত্যাদির শিক্ষায়) দেশিয় লোক দিয়ে সেই ধারা চালানো হয়, এবং শিল্প-বিপ্লব যেহেতু ইউরোপীয় আধিপত্যবাদী দেশগুলোতেই হচ্ছিল তাই ওয়েস্টফেলিয়া-পূর্ব ও পরবর্তী রেষারেষি স্বার্থকেন্দ্রিকভাবে ভিতরে ভিতরে টগবগ করে ফুটছিল যা প্রথম মহাযুদ্ধে বিস্ফোরিত হয়। তবে এই যুদ্ধের আগ থেকে অর্থাৎ ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই ওসমান সাম্রাজ্যের দিকে তাদের নজর ছিল প্রকট। এই শতাব্দীতেই ইউরোপীয় অঞ্চলের কয়েকটি দেশকে ভাষা ও ভৌগোলিক জাতীয়তার পার্থক্যের ভিত্তিতে খৃষ্টিয়ান সম্প্রদায়কে উসকিয়ে ওসমান সাম্রাজ্য থেকে আলাদা করে নেয় এবং পরবর্তীতে তৃতীয় বিশ্বের কন্ট্রোলে এ দুটি উপাদান বেশ কার্যকরী প্রমাণিত হয়। প্রথম মহাযুদ্ধে ওয়েস্টফেলিয়ান চুক্তি সার্বিকভাবে মাটিতে লুটোপুটি খায়। যুদ্ধের লভ্যাংশ হিসেবে মুসলিম বিশ্বের ভাগবাটোরা আত্মতৃপ্তি ঘটায় এবং ইস্টার্ন রোমান শাসনের অবসান ঘটানো মুসলিম সাম্রাজ্যকে ধূলিসাৎ করে দেয়। ১১শো শতাব্দী থেকে চালানো ক্রুসেড-যুদ্ধ বিপুল শক্তিতে বিজয়ী হয়ে যায়।
তবে এই বিজয় বস্তুতান্ত্রিকতার ভিত্তিতে হওয়ায় তা সাধারণ ইউরোপবাসীর জন্য মঙ্গল আনতে পারে নি। আটারো এবং ঊনবিংশ শতাব্দী ব্যাপী শিল্প বিপ্লব ইউরোপীয় সমাজের তোলপাড় ঘটিয়ে দেয়। শিল্প-শ্রমে যোগ দিতে প্রথমে পুরুষ এবং পরে নারীরা শহরমুখী হয়। নানান ধরণের অপরাধ কর্মের উদ্ভব ঘটে। বেশ্যাবৃত্তির চরম প্রসার হয়। শ্রমিকগণ তাদের শ্রমের পূর্ণ মূল্য পায় নি, অনেক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। পূর্বপ্রথার মূল্যবোধের উলটপালটে ব্যক্তি জীবনে মানসিক উন্মত্ততা (alienation) প্রকাশ পায়। অধিকন্তু এই সময়ের ব্যাপ্তিতে (during these periods) সেক্যুলার ও নাস্তিক দর্শনের সয়লাব ঘটানো হয়। অধিকন্তু তৃতীয় বিশ্ব লুটের সিংহভাগ একটি বিশেষ শ্রেণীর হাতে কুক্ষিগত হতে থাকে। অতঃপর বিশ্ব যুদ্ধ সংঘটিত হলে তাতে যে ধ্বংসলীলা আসে তাতে মানুষের বিশ্বাসের অবশিষ্ট অংশকে হতাশা ও নিরাশায় নিক্ষেপ করে।
ওয়েস্টফেলিয়ান চুক্তিকে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হলেও তা বার বার লঙিত হয়। আমরা এখন পোস্ট-ওয়েস্টফেলিয়ান কালে বাস করছি। অর্থাৎ অন্যের সার্বভৌমিক অধিকারের নৈতিকতায় নই –যার শক্তি আছে সে যেকোনো অজুহাতে অন্যের ভূখণ্ডে প্রবেশ করতে পারে।
তবে আপাতদৃষ্ট বিরাট শক্তি ও প্রতিকূলতার মুখে ঈমানদারগণ তাদের নিজেদের বিশ্বাসের উপর আশান্বিত হয়েই চলতে হবে। অনেক শক্তি ও সাম্রাজ্য অতীটে ধ্বংস হয়েছে। অনেক শ্বংসের কথা কেউ কল্পনাও করতে পারে নি। ইউরোপে ওয়েস্টার্ন রোমান সাম্রাজ্য, অনেক ক্ষেত্রে, নিজেদের ক্ষমতার চাইতে বেশি প্রসারিত হয়ে পড়লে, সেগুলোর এডমিনিন্ট্রেশন ও কর্তৃত্ব ধরে রাখা সম্ভব হয় নি এবং আস্তে আস্তে অধোগতির শুরু হয়। ইতিহাসের অনেক ভূমিতে দাড়িয়ে কেউই সুদূর ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা বুঝতে পারে নি। কালের চক্রে কীযে নিহিত তা কেবল আল্লাহই জানেন। আমরা কেবল ঈমানের পথে চলতেই নির্দেশিত।
সুন্দর একটি বিষয় নিয়ে লিখেছেন। এভাবে আরও নির্বাচিত বিষয় নিয়ে লিখুন এবং দোয়া করি আল্লাহ আপনাকে এই তৌফিক দিন।
এপ্রিল ১৪, ২০১৬ at ১০:৪৪ পূর্বাহ্ন (UTC 6) Link to this comment
তবে আপাতদৃষ্ট বিরাট শক্তি ও প্রতিকূলতার মুখে ঈমানদারগণ তাদের নিজেদের বিশ্বাসের উপর আশান্বিত হয়েই চলতে হবে।
এটা ঠিক, মুসলিমদেরকে আজ মোকাবিলা করতে হচ্ছে এক সম্পূর্ণ ভিন্ন রিয়েলিটি। বর্তমান দূষিত (tainted) মিডিয়ার শিকারে আক্রান্ত হয়ে আজ বিশ্বজুড়ে অনেক মুসলিমরা বিভ্রান্ত। সহজ সরল মন মানসিকতার মানুষের পক্ষে অতি সহজেই মেরূপ্রবণ হত্তয়া সম্ভব। আজ মুসলিমরা ব্যস্ত মুল্লা পিটানো দেখতে তাই তারা বুঝতেই পারছে না যে আসলে কি হতে যাচ্ছে। মুসলিমদের পক্ষে এই নতুন ‘বিশ্ব-ব্যবস্থাপনা’ মোকাবিলা করতে শুধু পুরানো (Traditional) তথ্য ভাণ্ডার থেকে সবসময় রেফারেন্সের সরাসরি আক্ষরিক (Textual) অর্থ বুঝে সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে যে যত বেশী অনড় থাকতে চাইবেন তার পক্ষে পরিবর্তিত এ যুগে গ্রহণ যোগ্যতা অর্জন কঠিন হবে। আমি এখানে নীতিগত কোন বিষয়ে আপস করার কথা বলছি না।
আসলে আমাদের ট্র্যাডিশনাল স্কলারদের অক্লান্ত পরিশ্রমে রেখে যাওয়া যেসব মূল্যবান তথ্য ভাণ্ডার আমরা পেয়েছি সেখানে বর্তমানের অপরিহার্য অনেক তথ্যই হয়তবা খুঁজে পাওয়া যায়না। আর কোন তথ্য খুঁজে পেলেও অতীতের ব্যবহৃত পরিভাষা আর বর্তমানের ব্যবহৃত পরিভাষাতে খাপ খায় না। ফলে মুসলমানরা পুরানো তথ্য –ভাণ্ডার থেকে তথ্য-পুষ্ট হয়ে যখন বিশ্ব-ব্যবস্থাকে বুঝার চেষ্টা করছেন তখন বর্তমানের অনেক তথ্যই তাদের গোচরীভূত হচ্ছে না (they are missing the points) অনেক ক্ষেত্রে যা গোচরীভূত হচ্ছে-তার মাত্রাগত পরিসংখ্যানও প্রত্যাশিত মাত্রায় উপলব্ধি হচ্ছে না ।
তাই প্রথমত বর্তমান এই কমপ্লেক্স ‘বিশ্ব ব্যবস্থাপনাতে” (World Management) ইসলামকে কিভাবে রিলেট করা যায় তা বুঝা খুবই জরুরী । এ জন্য দরকার প্রচুর জ্ঞান ও গবেষণার। রাজনীতিতে গণতন্ত্র, অর্থনীতিতে ব্যাংকিং এগুলা হচ্ছে রিয়েলিটি যার অপব্যবহারে অনেক সমাজে শোষন যে চলছে না তা আস্বীকার করা যায় না । সত্যিকার মুসলিমদের কাজ হল এগুলার প্রচলিত প্রকৃতিকে বদলিয়ে দিয়ে ইসলামী আদর্শের বিকল্প প্রকৃতির উদাহরণ স্থাপন করা। এ প্রচেষ্টায় সবাই যে সঠিক হবে তা দাবী করা যায় না। তবে সে জন্য শুধু নেতিবাচক সমালোচনা না করে ইতাবাচক পরামর্শ দিয়ে এগুলাকে সঠিক পথে চলতে সাহায্য করতে হবে।
বর্তমান বিশ্বে চলছে যে একতরফা যুদ্ধ তা হচ্ছে ইসলামকে একটি আল্লাহ প্রদত্ত জীবন ব্যবস্থা হিসাবে যাতে কেউ চিন্তাও করতে না পারে সে ব্যবস্থা করা। সে জন্য তাদের মনে ভয় ভীতির সৃষ্টি করা, নিজেদের মধ্যে কোন্দল ও অনৈক্যের বীজ বপন করা এবং এ ব্যাপারে তারা শতভাগ সফল বলা চলে। ইসলাম বিদ্বেষীরা করে যাচ্ছে ক্রিয়া (action) আর মুসলিমরা করে যাচ্ছে শুধু প্রতিক্রিয়া (reaction)। সত্যি বলতে কি যতদিন মুসলমানেরা এই চক্রের বাহিরে আসতে পারবেনা ততদিন মুসলমানদের পরাজয় চলতেই থাকবে। মুসলিমদেরকে আগে ইতিবাচক ক্রিয়াতে ( positive action) যেতে হবে। নিজেদের ঘরকে ঠিক করতে হবে।
তাই আজ অনেকেই একমত হবেন যে, সে জন্য অপরিহার্য বিষয়াবলীর প্রতি যেমন ইসলাম ও রাষ্ট্রব্যবস্থা, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও ইসলাম, সংবিধানের সার্বভৌমত্ব ও সীমাবদ্ধতা, ইসলামপন্থী রাজনৈতিক, সামাজিক ও দাওয়াতী সংগঠনসমূহের কর্মের বিস্তৃতি ও সীমাবদ্ধতা, পলিটিকাল ইসলাম বনাম সৃফিবাদি ইসলাম, মুসলিম নারীদের ইসলাম প্রদত্ত অধিকার বনাম মুসলিম দেশের বর্তমান বাস্তবতা, নারী শিক্ষা, নারীর কর্মসংস্থান, নারী স্বাধীনতার সার্বভৌমত্ব ও সীমাবদ্ধতা, মুসলিম সমাজের পুর্নজাগরনের পথ ও পদ্ধতি, মুসলমানদের রিইসলামাইজড হবার পথ ও পন্থা, মুসলমানদের অন্তর্নিহিত চেতনাজাগ্রত করার কলা-কৌশল, আর্ট-শিল্পকলা, ভাস্কর্য, চিত্রাঙ্কন, গান, সিনেমা, নাটক, মিউজিক সম্পর্কিত বিষয়ে আলোচনার দরকার। এছাড়া আরো দরকার নতুন নতুন চিন্তার; পুরানো চিন্তার নতুন ব্যাখ্যার ।
তবে আশার খবর হচ্ছে বিশ্বব্যাপী ইসলামি দর্শনে বিশ্বাসী মুসলমানদের মাঝে এক নব জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। আমি মহান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করি এরা যেন কোরআনে উল্লেখিত “উলুল্ আলবাব্” এর সত্যিকার বৈশিষ্ট্য লাভ করতে পারেন। বিশ্বের বর্তমান সামাজিক রাজনৈতিক মেরুকরণ বিশেষ করে সমাজতন্ত্রের পতন ও পুঁজিবাদের দাপটের প্রেক্ষাপটে চিন্তাশীল মুসলিমদের চিন্তা ও কর্মের জগতে এসেছে এক পরিবর্তন এটা অস্বীকার করা যায় না।
ইসলামকে যারা মানতে চায় না কিংবা যারা ইসলাম বিদ্বেষী তারা এটা উপলব্ধি করতে পারছে বলেই নতুন নতুন ফন্দী আঁটছে যাতে এ জাগরণকে নিবিয়ে দিতে পারে। সে প্রচেষ্টায় এখনও তাদেরকে বিজয়ী দেখা যাচ্ছে । তবে সময়ের পরিক্রমায় এর পরিবর্তন যে হবেনা তা বিশ্বাস করা ঈমানী দূর্বলতা। মুমিনের জীবনে ইতিবাচক থাকাটা এবং আল্লাহর প্রতি নির্ভরতা তথা “তাওয়াকুল তু আলাল্লাহ” হচ্ছে ঈমানী দায়িত্ব।
এপ্রিল ১২, ২০১৬ at ৩:১৭ পূর্বাহ্ন (UTC 6) Link to this comment
ইতিহাসের অনেক ভূমিতে দাড়িয়ে কেউই সুদূর ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা বুঝতে পারে নি। কালের চক্রে কীযে নিহিত তা কেবল আল্লাহই জানেন। আমরা কেবল ঈমানের পথে চলতেই নির্দেশিত“
সহমত।
আসলে কালের পরিক্রমায় কোন এক সভ্যতার ২/ত শত বছরের ইতিহাস কিছুই না। আজ পৃথিবীর বস্তুতান্ত্রিক সভ্যতার যে অন্যায় দাপট চলছে পৃথিবী জোড়ে তারও শেষ একদিন হবে নিশ্চয়, হয়ত আমারা থাকব না। কিন্তু এ সারা জাহানের মালিক তো চিরস্থায়ী। তিনি সময় মত অবশ্যই হিসাব নেবেন সবার। এ বিশ্বাস নিয়েই মুমিনকে বাঁচতে হবে।
এ প্রসঙ্গে আমি মনে করি আজ মুসলিমদের সবচেয়ে বেশী যে বিষয়ে ভাবতে হবে তা হল তাদের মধ্যকার ঐক্য ও ভালবাসা সৃষ্টিতে কে কি ভূমিকা রাখতে পারে। আর সেটা শুধু মুখের কথায় হবে না বাস্তবে প্রমাণ করতে হবে।
পাঠ ও মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
এপ্রিল ১৫, ২০১৬ at ২:৫০ পূর্বাহ্ন (UTC 6) Link to this comment
জার্মানদের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধে নামার প্রেক্ষাপট পোষ্টে আলোচনা করা হয়েছে। মিত্র শক্তির সাথে যোগ দেয়া তখন সম্ভব ছিল না কারণ ওরা তুর্কীদের প্রতিবন্ধী ছিল। অটোমান সাম্রাজ্যকে আক্রমণ করা শুরু থেকেই মিত্র শক্তির অন্যতম লক্ষ্য ছিল। জার্মানরা বর্তমানে তুরস্ককে ভাল চোখে দেখে না তারা এখন তুরস্কের বুকে কুর্দিদের স্বাধীন রাষ্ট্রের পক্ষে সশস্ত্র বিদ্রোহে সাহায্য করছে বলে অভিযোগ আছে।
এপ্রিল ১৫, ২০১৬ at ১০:০৮ পূর্বাহ্ন (UTC 6) Link to this comment
প্রথমেই মহিউদ্দিন ভাইকে ধন্যবাদ জানাই আমার রিকোয়েস্ট রাখবার জন্য।
এই বিষয় নিয়ে অনেক বড় আকারে লেখা প্রয়োজন। ইংলিশে অনেক বই আছে কিন্তু বাংলাতে কোন বই আছে বলে আমার জানা নেই। আর এ বিষয়ে এজন্য জানা প্রয়োজন যে অটোমান সম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ ছিল জাতীয়তাবাদ। যে জাতীয়তাবাদের বিষ ক্রমেই মুসলিম বিশ্বকে দিন দিন দূর্বল থেকে দূর্বলতর করে দিচ্ছে। অথচ ইসলাম জাতীয়তাবাদের অনেক উর্ধ্বে। কুর্দি, আরব, বাঙ্গালী ইত্যাদি মুসলিম অধুষ্যিত জনগোষ্ঠীকে জাতীয়তাবাদে ভুগতে দেখলে দেখলে আমার খুব কষ্ট হয়, আবার করুণাও হয়।
এপ্রিল ১৫, ২০১৬ at ৮:০৫ অপরাহ্ন (UTC 6) Link to this comment
শ্রমিক ভাই, আপনাকেও ধন্যবাদ পরামর্শের জন্য।
জাতীয়তাবাদের বিষ ক্রমেই মুসলিম বিশ্বকে দিন দিন দূর্বল থেকে দূর্বলতর করে দিচ্ছে।
আমি আপনার সাথে একমত ইসলাম ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদকে স্বীকৃতি দেয় না। মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও নিরাপত্তার জন্য এটি ভাল না।
মুসলিম রাষ্ট্র বা সাম্রাজ্যে শাসকের অযোগ্যতা বা অন্য কারণে অনেক সময় অসমতা (disparity) শোষণ ও বঞ্চনা দেখা দিতে পারে। কিন্তু তার সমাধানে কেবল জাতীয়তাবাদের উদ্রেক জাগানো সহজ হলেও সেটা অনেক সময় উত্তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুলায় ঝাপ দেয়ার হঠকারী পদক্ষেপ হয়। আরবদের বিদ্রোহ সেটাই হয়েছে। মাথা ব্যথা সারতে ঔষধ ব্যবহার না করে মাথা কেটে ফেলা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। জাতীয়তাবাদ মানুষকে খুবই আত্মকেন্দ্রিক করে ফেলে। ইসলামের দৃষ্টিতে জাতীয়তাবাদ বিষয়ে এখানে কিছু ভাল কথা আছে পড়তে পারেন।