কোনটা অপরাধ, কোনটা উসকানি।
মেঘ নামের ছেলেটি বাংলাদেশের এক দুর্ভাগা সন্তান। সাত-আট বছর আগে একরাতে খুন হয়েছিল তার বাবা-মা সাংবাদিক সাগর-রুনি দম্পতি। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের আশ্বাস দিয়েছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এত বছরে তার কিছুই হয়নি, হবে যে তার কোনো আলামতও নেই।
অন্য অনেক শিশু-কিশোরের মতো মেঘও রাস্তায় নেমেছিল নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময়। তার হাতে ধরা ব্যানারে সে নিরাপদ সড়ক শুধু নয়, চেয়েছিল নিরাপদ একটা বাংলাদেশ। এবং তার ‘মিম্মি-বাবা’র হত্যার বিচার। তার ছবিটা যেকোনো সংবেদনশীল মানুষকে থমকে দেওয়ার মতো। এ রকম থমকে দেওয়া, আবেগাপ্লুত করা বহু স্লোগান আর দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমেছিল আমাদের সন্তানেরা। কিন্তু এটি শুধু তাদের আন্দোলন ছিল না, শুধু তাদের আন্দোলন হওয়ার কথাও নয়।
রাস্তায় ফিটনেস আর লাইসেন্স ছাড়া যন্ত্রদানব শিশুদের পিষে মারে, রাজীবদের মতো যুবকদের হাত কেটে ফেলে দেয়, যে কারও জীবনপ্রদীপ নিভিয়ে দেয়। নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন তাই শিশু-কিশোরদের হলেও এটি ছিল সবার প্রাণের দাবি। এই দাবিতে শিশু-কিশোরদের তাই তাদের অভিভাবকেরা রাস্তায় নামতে দিয়েছিল। এই দাবির প্রতি তাই সবার সমর্থন ছিল, কারও কারও ছিল অংশগ্রহণও।
এটিই স্বাভাবিক, এটি হয়ে এসেছে এ দেশে সব সময়। কিন্তু সাম্প্রতিক আন্দোলন বিশেষ করে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি ভিন্ন অবস্থা। এই আন্দোলনের সমর্থনকারীদের ঢালাওভাবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে উসকানিদাতা হিসেবে, অংশগ্রহণকারী বা অংশ নেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশকারীদের আখ্যায়িত করা হচ্ছে অনুপ্রবেশকারী বা যড়যন্ত্রকারী হিসেবে।
শুধু দোষারোপ বা রাজনৈতিক আক্রমণের মধ্যেও বিষয়টি সীমাবদ্ধ থাকছে না, সরকার সত্যি সত্যি ‘অনুপ্রবেশকারী’ বা ‘উসকানিদাতা’দের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা করছে এবং গ্রেপ্তার করছে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষজনকে। আরও তদন্ত ও গ্রেপ্তারের হুমকি দিয়ে মন্ত্রী ও পুলিশের কর্তারা ভীতি ছড়িয়ে দিচ্ছেন সমাজে।
এসবের মাধ্যমে এ দেশের অতীত রাজনীতি ও নাগরিক আন্দোলনের ব্যাকরণ অস্বীকার করা হচ্ছে। পাল্টে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে এ দেশের মানুষের চিরন্তন অধিকারবোধ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মনোবৃত্তিকে।
২.
অতীতে আমরা মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার নানা আন্দোলন দেখেছি। আন্দোলন হয়েছে ইয়াসমীন হত্যার বিরুদ্ধে, এশিয়া এনার্জির বিরুদ্ধে, কানসাটে বিদ্যুতের দাবিতে, ছাত্রদের শিক্ষা অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টার বিরুদ্ধে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে। এমন অধিকাংশ আন্দোলন শুরু হয়েছিল অরাজনৈতিকভাবে; নেতৃত্বে ছিল সাধারণ মানুষ, নারী সংগঠন, পরিবেশবাদী, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক সংগঠন বা স্থানীয় জনগণ।
অরাজনৈতিকভাবে শুরু হওয়া অতীতের এমন বহু আন্দোলনে ঘোষণা দিয়ে প্রকাশ্যে যোগ দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ। যোগ দিয়েছেন সরাসরি অংশীজন নয় সমাজের এমন বহু বিশিষ্ট নাগরিক। আবার রাজনীতিবিদদের রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগ দিয়েছে নাগরিক সমাজের বিভিন্ন সংগঠন। বাংলাদেশে স্বাধীনতাসংগ্রাম চলাকালে বিশেষ করে ১৯৫২ থেকে ১৯৭০ সালেও বহুবার এমন হয়েছে।
এটাই বাংলাদেশ, এটাই সারা পৃথিবীতে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের চিত্র, অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে যেকোনো মানুষের প্রতিবাদ করার সর্বজনীন অধিকার। আদিবাসী, ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের আন্দোলনে আমরা কি শুধু তাদের অংশ নেওয়ার অধিকার আছে এই সীমারেখা বেঁধে দিই? তাহলে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন বা চাকরিতে বৈষম্য দূরীকরণের আন্দোলনের মতো সর্বজনীন ইস্যুতে অন্যরা সমর্থন দিলে বা অংশ নিলে কেন সরকার তাতে অন্যায় খুঁজে বেড়াবে? কেন তা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে?
৩.
সরকারের অভিযোগ, সমর্থনের নামে এসব আন্দোলনে উসকানি দেওয়া হচ্ছে, গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এই অভিযোগ সামান্য দু-একটা ক্ষেত্রে সত্যি হতে পারে। অভিনেত্রী নওশাবা বা একটি মেয়ে মুখে কাপড় বেঁধে ধর্ষণ হচ্ছে বলে যে প্রচারণা চালিয়েছে, তা ক্ষতিকর গুজব, এমনকি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য হুমকিস্বরূপ বিবেচিত হতে পারে। কিন্তু সরকারকে ভেবে দেখতে হবে এমন গুজবের প্রেক্ষাপট কীভাবে তৈরি হয়েছে সমাজে। অতীতে সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ কোটা আন্দোলনের ছেলেদের নির্মমভাবে পেটানো হয়েছে, হাতুড়ি দিয়ে প্রকাশ্যে একজনের পা গুঁড়া করে দেওয়া হয়েছে, শহীদ মিনারে একজন নারী শিক্ষার্থীকে চরমভাবে লাঞ্ছিত করা হয়েছে, ধর্ষণের হুমকি দেওয়ার কিছু অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব ঘটনা হত্যা, ধর্ষণের আশঙ্কা প্রচারে কি কোনো ভূমিকা রাখেনি?
সরকারকে বুঝতে হবে পুলিশ আর ছাত্রলীগকে অবাধে পেটানোর দায়মুক্তি দিলে আর গণমাধ্যমের ওপর বিভিন্নভাবে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করলে কিছু ক্ষতিকর গুজব রটতে পারে। কিন্তু সরকারকে এ-ও বুঝতে হবে, ফেসবুকের সব পোস্ট উসকানিমূলক নয়, এসব মানুষের সংহতি প্রকাশের অধিকার, প্রতিবাদ করার অধিকার। বিনা উসকানিতে প্রথম যখন স্কুল-কলেজের ছাত্রদের পেটানো হয় মিরপুরে, তখন কারও মনে হতে পারে প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসা উচিত সবার। হেলমেটধারী যুবক আর রাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনী যখন একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাদের সন্তানদের ওপর, তখন ক্ষুব্ধ হওয়ার বা আত্মরক্ষা করার অধিকার আছে তাদের।
সরকারকে বুঝতে হবে, কারও উসকানি বা কোনো যড়যন্ত্রের কারণে নয়, পুলিশ আর ছাত্রলীগের বর্বরতার চিত্র দেখেই ক্ষুব্ধ হতে পারে শহিদুল আলমের মতো একজন সংবেদনশীল মানুষ কিংবা ইস্ট ওয়েস্ট বা নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা। অপরাধটা আক্রমণকারীদের, প্রতিবাদকারীদের নয়।
পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, সরকার মানুষের ক্ষোভের যৌক্তিকতা বোঝার চেষ্টা করেনি; বরং অর্ধশতাধিক মামলা করেছে ‘গুজব আর উসকানিদাতা’দের বিরুদ্ধে, গ্রেপ্তার করেছে অনেক মানুষকে। কিছু মামলায় ‘অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি’দের আসামি করে আরও যে কাউকে এর আওতায় গ্রেপ্তারের সুযোগ রাখা হয়েছে। অনেক মামলা করা হয়েছে কুখ্যাত ৫৭ ধারায়, যেটিকে স্বয়ং আইনমন্ত্রী ত্রুটিপূর্ণ বলেছিলেন।
রাষ্ট্রের পুলিশ-গোয়েন্দারা এখন খতিয়ে দেখছে কার কোন বক্তব্য ছিল উসকানিমূলক। তাদের বিবেচনায় যাদেরটা মনে হচ্ছে উসকানিমূলক বা মিথ্যে তাদের গ্রেপ্তার করছে তারা। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, অনুমিত অপরাধ নিয়ে এত তোড়জোড় যে পুলিশের, সেই পুলিশের কোনো তৎপরতা নেই প্রকৃত অপরাধ সংঘটনকারীদের বিরুদ্ধে। হেলমেট, হাতুড়ি আর রামদা নিয়ে শিক্ষার্থী ও সাংবাদিকদের ওপর হামলাকারী কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। দুই মাস হয়ে গেছে, কোটা আন্দোলনের সময় ছাত্রলীগের যে ছেলেটি হাতুড়ি দিয়ে পেটানোর কথা গর্ব করে বলেছে ফেসবুকে, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডযোগ্য এই অপরাধ সংঘটনকারীকে বা এদের মতো সরকার-সমর্থক পেটোয়া বাহিনীর কাউকে গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ। কাউকে বিচারের আওতায় আনেনি রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠান। মানুষকে ক্ষুব্ধ করার জন্য এগুলোই কি সবচেয়ে বড় উসকানি নয়?
৪.
নির্বাচনের বছরে সরকারের উচিত ছিল সংযত, পরিণত ও সংবেদনশীল আচরণ করা। সরকার তা পারেনি, বরং আত্মঘাতীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষের ওপর। মাদকবিরোধী অভিযানের সময় সরকারের উচিত ছিল বদিকে গ্রেপ্তার করা, একরামদের হত্যা করা নয়। কোটা আন্দোলনের সময় সরকারের উচিত ছিল দ্রুত যৌক্তিক একটি সংস্কারের প্রজ্ঞাপন দিয়ে এই আন্দোলনের ফসল ঘরে তোলা, আন্দোলনের নেতাদের বিরুদ্ধে হামলা-মামলা করা নয়। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় উচিত ছিল কঠোর আইন করার ঘোষণা দিয়ে আর মন্ত্রী শাজাহান খানকে পদত্যাগ করিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা, শিশু-কিশোরদের পিটিয়ে আর ভয় দেখিয়ে ফেরত পাঠানো নয়। গণমানুষের দল হিসেবে আওয়ামী লীগের জন্ম, আওয়ামী লীগের বিকাশ। আমি অবাক হয়ে ভাবি, এই দল গণমানুষকে রুষ্ট করার ভুল একের পর এক করছে কীভাবে?
অবাক হয়ে ভাবি, অতীতে ক্ষুব্ধ হয়ে দলেবলে লগি-বৈঠা নিয়ে ঢাকায় চলে আসার ঘোষণা দিতে পারে যে দল, সেই দলই ক্ষুব্ধ মানুষের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে এত অসহিষ্ণু হয় কীভাবে?
[ড আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক, প্রথম আলোর সৌজন্য]