ক্যারিয়ারের জন্য সহবাস করলে ধর্ষিতা হয়েছে বলবে কেন? প্রশ্ন হার্ভের উকিলের
নিউইয়র্ক থেকে ড. ওমর ফারুক।। 
[“You want to eat the top and eat the bottom as well.” বাংলায় যে কথাটা দাঁড়ায়ঃ ’নারী! তুমি উপরেরটাও খাবে আবার নিচেরটাও খাবে।’ সে কেমন কথা!]
আপনারা ইতোমধ্যে আরও বেশি বার হার্ভে ওয়েনস্টেইনের নাম শুনে থাকবেন। তিনি হলিউড প্রযোজক হিসেবে বিশ্বের তাবত চলচ্চিত্র ও মিডিয়া জগতে নাম কামাই করেছিলেন, এর চেয়েও এখন বেশি আলোচিত ও সমালোচিত হচ্ছেন এক ঝাঁক নারীর ধর্ষণের অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক করে যাচ্ছে, সে নিয়ে। হলিউড প্রযোজক হার্ভে, যিনি যৌন নিগ্রহে অভিযুক্ত। মার্কিন আদালত পাড়া হার্ভেকে নিয়ে এক নতুন চ্যাপ্টার যেন।
২০১৫ সালে এক নারী হার্ভে উইনস্টেনের বিরুদ্ধে যৌন অভিযোগ করলেও তখন কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় নি তখন এবং এ নিয়ে নিজেদের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন আইনজীবীরা। তাঁরা বলছেন মি: উইনস্টেনের বিরুদ্ধে অভিযোগের যথেষ্ট প্রমাণাদি তাঁরা পান নি, ফলে তাঁকে অপরাধীও বলা সম্ভব হয় নি। তবে তারা এটাও বলছেন যে অস্কারজয়ী এই প্রযোজকের “নারীদের সঙ্গে অশালীন ব্যবহারের উদাহরণ রয়েছে”।
হার্ভে উইনস্টেন বলছেন, তার বিরুদ্ধে আনা বেশিরভাগ অভিযোগই মিথ্যা। সম্প্রতি এ মার্কিন প্রযোজকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ এনেছেন হলিউডের তিন অভিনেত্রী। ৬৫ বছর বয়সী এই প্রযোজকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ এনেছেন হলিউডের জনপ্রিয় তারকা অ্যাঞ্জেলিনা জোলি ও গিনেথ প্যালট্রো।
নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় এক লিখিত বিবৃতিতে হার্ভে উইনস্টেনের বিরুদ্ধে নিজেদের অভিযোগের কথা জানিয়েছেন অ্যাঞ্জেলিনা জোলি ও গিনেথ প্যালট্রো।
১৯৯৬ সালে মুক্তি পাওয়া ‘এমা’ সিনেমার প্রযোজক ছিলেন হার্ভে উইনস্টেইন।
ছবির প্রধান চরিত্র জেন অস্টেনের ভূমিকায় কাজ করেন গিনেথ প্যালট্রো।
মিস প্যালট্রো তাঁর দেওয়া বিবৃতিতে জানান, একবার নিজের হোটেল রুমে তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন হার্ভে উইনস্টেন। সে সময় তাঁর দেহে আপত্তিকরভাবে স্পর্শ করেন মি: উইনস্টেন এবং মিস প্যালট্রোকে কুপ্রস্তাব দেন।
গিনেথ প্যালট্রো তখন হলিউডের কম বয়সী এক উঠতি তারকা।
“আমার বয়স তখন খুব বেশি নয়। এরপর আবার হার্ভে উইনস্টেইনের ছবিতেই চুক্তিবদ্ধ হয়েছি, সেদিনের ঘটনায় আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমার বয়ফ্রেন্ড ব্র্যাড পিটকে এ কথা বলেছিলাম, সে তখন প্রযোজকের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। আমার মনে হচ্ছিল মি: উইনেস্টেন আমাকে চুক্তি থেকে বাদ দিয়ে দেবে”।
অন্যদিকে অ্যাঞ্জেলিনা জোলি জানান, ১৯৯৮ সালে ‘হার্ট’ ছবিটির মুক্তির সময় হার্ভে উইনস্টেন তাঁকে হোটেল রুমে ডেকেছিলেন।
“‘হার্ভে উইনস্টেইনের সঙ্গে কাজ করে আমার খুব খারাপ অভিজ্ঞতা হয়েছে। আর এ কারণে আমি এই প্রযোজকের সঙ্গে পরে আর কোনো কাজ করিনি, আমার অন্য নারী সহকর্মীদেরও এই বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছি”।
“নারীদের প্রতি এ ধরনের আচরণ মেনে নেওয়া যায় না, তা আপনি যে কোন দেশে যে কোন অবস্থানেই থাকুন না কেন” বলেন মিস জোলি।
একের পর এক যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠায় মার্কিন চলচ্চিত্র প্রযোজক হার্ভে উইনস্টেইনকে অস্কার বোর্ড থেকে বহিষ্কার করেছে কর্তৃপক্ষ। বিবিসি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, দ্য অ্যাকাডেমি অব মোশন পিকচার আর্ট অ্যান্ড সায়েন্সের পরিষদ সভায় দুই তৃতীয়াংশের বেশি ভোটে উইনস্টেইনকে বহিষ্কারের এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
৬৫ বছর বয়সী এই প্রভাবশালী প্রযোজক হলিউডের বিখ্যাত প্রযোজনা সংস্থা উইনস্টেইনের কো-চেয়ারম্যান এবং মিরাম্যাক্স ফিল্মসের প্রতিষ্ঠাতা। দ্য কিংস স্পিচ, শেক্সপিয়র ইন লাভ, পাল্প ফিকশন, গ্যাংস অব নিউইয়র্ক, ম্যালেনার মত বহু নামকরা চলচ্চিত্রের প্রযোজনা করেছেন হার্ভে উইনস্টেইন। তার প্রযোজিত সিনেমা এ পর্যন্ত তিনশ’র বেশি অস্কার মনোনয়ন পেয়েছে, জিতেছে ৮১টি অস্কার। তবে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠার পর উইনস্টেইনকে নিজের প্রযোজনা সংস্থা থেকেও বরখাস্ত হতে হয়েছে। এ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে ৮৪টিচ যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে।
নিউইয়র্ক টাইমস ও দি নিউইয়র্কার সম্প্রতি উইনস্টেইনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির দুটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যা পুরো হলিউডকেই কাঁপিয়ে দেয়। চলচ্চিত্র অভিনেত্রী, ফ্যাশন মডেল, এমনকি প্রযোজনা সংস্থার কর্মীদের ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার বেশ কিছু ঘটনা উঠে আসে সেখানে।
ওই প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর বহু তারকা অভিনেত্রীই এখন উইনস্টেইনের বিষয়ে মুখ খুলছেন। গিনেথ প্যালট্রো, অ্যাঞ্জেলিনা জোলি, অ্যাশলে জুডের মতো তারকারাও বিভিন্ন সময়ে উইনস্টেইনের যৌন অসদাচরণের শিকার হওয়ার কথা বলেছেন।
অ্যাকাডেমি অব মোশন পিকচার এক বিবৃতিতে বলেছে, উইনস্টেইনকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্তের মধ্যে দিয়ে তারা এই বার্তা দিতে চায় যে, চলচ্চিত্র শিল্পে যৌন হয়রানির বিষয়ে চোখ বন্ধ রাখার দিন শেষ।
উইনস্টেইন তার আচরণের কিছু বিষয়ের জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেও দাবি করেছেন, যৌন সম্পর্কের বিষয়গুলো সম্মতির ভিত্তিতেই ঘটেছে, ধর্ষণ বা নির্যাতনের কোনো ঘটনা ঘটেনি।
যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি যুক্তরাজ্যেও উইনস্টেইনের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ।
এদিকে যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘মি টু’ বা ‘আমিও’ হ্যাশট্যাগ দিয়ে পরস্পর অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করে নিচ্ছেন নারীরা। ফেসবুক-টুইটারজুড়ে এই ‘মি টু’ হ্যাশট্যাগের প্রচার চলেছে। পশ্চিমা অভিনেত্রী আলিসা মিলানো টুইট করেন, ‘যারা যৌন নিপীড়ন বা হয়রানির শিকার হয়েছেন, তারা যেন মি টু লিখে তার টুইটের রিপ্লাই দেন।’ এরপর তা ছড়িয়ে যেতে থাকে বিশ্বব্যাপী। অভাবনীয় সাড়াও মিলেছে। অভিনেত্রী আলিসা মিলান ‘র এ ক্যাম্পেইন শুধু আমেরিকা তথা পাশ্চাত্য এর দেশগুলোতেই সীমাবদ্ধ থাকে নি। এটি ছড়িয়ে পড়েছে, প্রাচ্যের দেশুগলোতেও।
কিন্তু এরমধ্যেই এ্যাটর্নি বেঞ্জামিন ব্রাফম্যান হঠাৎ এ সব ধর্ষণের আভিযোগকারী নারীদের বিরুদ্ধে ভিন্ন একটি বক্তব্য দিয়ে নতুন করে আলোচনার সূত্রপাত করলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এর আগে নারী বিষয়ক স্পর্শকাতর ইস্যুকে নিয়ে মন্তব্য করতে দ্বিধা থাকলেও এবার এ্যাটর্নি বেঞ্জামিন ব্রাফম্যান-এর এ বক্তব্যের পর অনেকের টনক নড়েছে বলেই মনে হয়। তাদের বক্তব্য সুস্পষ্টঃ “You want to eat the top and eat the bottom as well.” বাংলায় যে কথাটা দাঁড়ায়ঃ ’নারী, তুমি উপরেরটাও খাবে আবার নিচেরটাও খাবে।’ সে কেমন কথা!
বেঞ্জামিন ব্রাফম্যান আরও বললেন, হার্ভে ওয়েনস্টেইন নাকি একজন মজাদার মানুষ। নিউইয়র্কের সেরার সেরা এবং দাপুটে ক্রিমিনাল ডিফেন্স অ্যাটর্নি বলেই তাঁকে চেনে এ মহানগরীর নাগরিকেরা ব্রাফম্যানের মত একজন মানুষ, হার্ভে ওয়েনস্টেইনকে মজাদার বলে মনে করছেন! একই সঙ্গে তিনিই হার্ভে ওয়েনস্টেইনের হয়ে আইনি লড়াইও লড়ছেন। ‘ইভ অব অস্কার’-এ হঠাত্ ব্রাফম্যানের মুখে বিস্ফোরক মন্তব্য। এমন কথা শুনে কার্যত তাজ্জব গোটা দুনিয়া। হার্ভের আইনজীবী যা বলছেন, তা তো আসলে হার্ভেরই কথা! প্রশ্নও তুলছেন অনেকে। কী বলেছেন বেঞ্জামিন ব্রাফম্যান?
সম্প্রতি দ্য টাইমসকে দেওয়া একটি সাক্ষাত্কারে হার্ভের উকিল বলেছেন, ‘‘যদি কোনও মহিলা নিজের ক্যারিয়ার গড়ে তোলার জন্য হলিউড প্রযোজকের সঙ্গে সহবাস করেন, তাহলে সেটা কখনওই অপরাধ না, সেটা ধর্ষণও হতে পারে না।’’
তাঁর আরও মন্তব্য, ‘‘হলিউডে কাস্টিং কাউচের প্রবর্তক হার্ভে ওয়েনস্টেইন নন… আমার জন্মের আগে থেকেই ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে এমনই ধারণা রয়েছে মানুষের’’।
আর কয়েক ঘণ্টা পরই লস এঞ্জেলসে বসতে চলেছে ৯০তম অ্যাকাডেমি অ্যাওয়র্ডসের ঝলমলে অনুষ্ঠান। যদিও ‘ব্রিটিশ অ্যাকাডেমি অব ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন আর্টস’-এর সদস্যপদ ইতিমধ্যেই খুইয়েছেন হলিউড প্রযোজক ওয়েনস্টেইন। হয়তো গোল্ডেন গ্লোবের মত অস্কারের মঞ্চেও হলিউডে যৌন নির্যাতন নিয়ে প্রতিবাদ হবে। এই পরিস্থিতিতে হার্ভের আইনজীবী যে বার্তা দিলেন তাতে স্পষ্ট, হার্ভেকে সহজে ছুঁতেও পারবেন না তদন্তকারীরা।
গত অক্টোবরের গোড়া থেকে শুরু করে এখনও অবধি প্রায় একশো জন মহিলা মুখ খুলেছেন হার্ভের বিরুদ্ধে। যৌন নিগ্রহ থেকে ধর্ষণ, সব রকম অভিযোগই রয়েছে তাঁর নামে। লন্ডন, নিউ ইয়র্ক এবং লস অ্যাঞ্জেলস পুলিশ আলাদা আলাদা ভাবে তদন্তে নেমেছে তাঁর বিরুদ্ধে।
প্রথম এ বিষয়ে মুখ খুলেছিলেন অভিনেত্রী অ্যাঞ্জেলিনা জোলি এবং গেনিথ পাল্টরো। তার পরই একে একে আরও অভিযোগ সামনে আসে। অভিযোগকারিণীদের তালিকায় রয়েছেন সালমা হায়েকও।
[নিউইয়র্ক টাইম্স এ প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন অবলম্বনে।]