কেমন আছেন কবি আল মাহমুদ, সন্তানেরা কে কোথায়?
কবির স্বীকারোক্তিতেই এসেছে, জীবনের বাক বদলে বদলেছিলাম ঠিকই। হাঁতুড়ি-কাস্তে আর লাল ঝাণ্ডার আদর্শ ধারণ করেছিলাম। কিন্তু, ছোট্ট বয়সে কানে গেঁথে দেয়া আলেম বাবার প্রচেষ্টা তাকে শেষ পর্যন্ত সঠিক পথেই ফিরিয়ে রেখেছে।
এজন্য কবিকে গঞ্জনাও কম সইতে হয়নি। দেশমাতৃকার মুক্তির সংগ্রামে সরাসরি থেকেও শুনতে হয়েছে উল্টোটা। অবশ্য কবির ভাষ্যে, আমি কবি, সবার। কেউ আমাকে নির্দিষ্ট করতে পারেন না, শত চেষ্টা করলেও। আবার কেউ কারো পক্ষেও আমাকে স্থায়ী করে দিতে পারেন না।
কবি আল মাহমুদ ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মৌড়াইল গ্রামের মোল্লাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তিতাস নদীর পাড়েই বেড়ে ওঠা।
নগর জীবনে এসে বসবসাস মগবাজারে। বার্ধক্য জীবনে এসেছে। বছরেরও বেশি হলো, বাকশক্তি হারিয়েছেন। অবশ্য তারও বেশ আগে থেকেই কবি নিজ হাতে লিখতে পারেন না। বলে বলে যান, অন্যরা তা শুনে লিখে দেন।
কবি আল মাহমুদের কবিতায় বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের ঘ্রাণ, প্রকৃতি ও প্রেমের গুঞ্জনের উপস্থিতি প্রকট। তার রচনার ভাষা, নির্মাণশৈলী, বিষয়-বৈচিত্র্য হৃদয় ছোঁয়া। তিনি মাটি ও মানুষকে ভালবেসে সৃষ্টি করেছেন কালজয়ী সব পঙক্তিমালা—
আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেলো শেষে
হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে।
নদীর কাছে গিয়েছিলাম আছে তোমার কাছে
হাত দিও না আমার শরীর ভরা বোয়াল মাছে।
আধুনিক বাংলা কিশোর কাব্যেও আল মাহমুদ অপ্রতিদ্বন্দ্বী—
আমার কেবল ইচ্ছে করে
নদীর ধারে থাকতে
বকুল ডালে লুকিয়ে থেকে
পাখির মত ডাকতে।
সবাই যখন পড়ছে পড়া
মানুষ হবার জন্য
আমি না হয় পাখি হবো
পাখির মত বন্য।
আবার কবির আত্মপরিচিতিমূলক কবিতা ‘লোক-লোকান্তর’- এ প্রকাশ পেয়েছে গ্রামবাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, যা তাকে কতটা স্রষ্টা ও সৃষ্টির প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করেছে—
আমার চেতনা যেন একটি শাদা সত্যিকার পাখি,
বসে আছে সবুজ অরণ্যে এক চন্দনের ডালে;
মাথার ওপরে নিচে বনচারী বাতাসের তালে
দোলে বন্য পানলতা, সুগন্ধ পরাগে মাখামাখি
লোক থেকে লোকান্তরে আমি যেন স্তব্ধ হয়ে শুনি
আহত কবির গান। কবিতার আসন্ন বিজয়।
কবি আল মাহমুদ স্বাধীনতা সংগ্রামের সার্থক সৈনিক। মুক্তিযুদ্ধে চলাকালে ১৯৭১ সালে তিনি মুজিবনগর সরকারের স্টাফ অফিসার হিসেবে যোগ দেন। এরপর সদ্য স্বাধীন দেশে সাহসী দৈনিক গণকণ্ঠের সম্পাদক ছিলেন। পরে দৈনিক কর্ণফুলী ও কাফেলা সম্পাদনা করেছেন।
সম্প্রতি বাংলা ভাষার এই কিংবদন্তী কবিকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় চাউর হয়েছে, শেষ জীবনে সন্তানরা তাকে গ্রামের বাড়িতে একা রেখেছেন, অযত্ন আর অবহেলায়। বিনা চিকিৎসায় দিন কাটছে তার।
তারই স্বরূপ উদঘাটনে পরিবর্তন ডটকমের এই প্রতিবেদক মগবাজারে গিয়ে কবিকে পান, বড় ছেলের বাসায়। শয্যাশায়ী কবিকে ঘিরে সেবাযত্নে ব্যস্ত ছেলে, ছেলের বউ ও নাতিরা। সেখানেই কবির বিষয়ে জানান তার বড় ছেলে মীর মো. শরীফ মাহমুদ ও পুত্রবধূ শামিমা আক্তার বকুল।
শুরুতেই বাবার বিষয়ে চাউর হওয়া তথ্যের প্রতিবাদ জানান মীর শরীফ মাহমুদ, ‘এসব কথা মোটেই সত্য নয়। যারা বলছেন, তারা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়াচ্ছেন। কবি এবং কবির পরিবারকে সামাজিকভাবে হেয় করতেই এসব করা হচ্ছে।’
এরপরই তিনি জানান, তিনিসহ কবি আল মাহমুদের পাঁচ ছেলে— মীর মো. আরিফ (ব্যবসা), মীর মো. তারিক (অসুস্থ), মীর মো. মনির (ইউআইইউ’র ডেপুটি রেজিস্টার) ও মীর মো. আনিস (সিটি ব্যাংক)। আর তিন মেয়ে— আফিয়া মীর, তানিয়া মীর ও জুনিয়া মীর। তারা সবাই গৃহিণী। সব ভাই-বোন ঢাকাতে বসবাস করছেন এবং মগবাজার এলাকাতেই। নিজ নিজ ব্যস্ততার ফাঁকেও নিয়ম করে সবাই বাবার সঙ্গে মিলিত হন।
স্বামীর কথায় সংযোগ করেন শামিমা আক্তার বকুল, ‘আব্বার ছেলে-মেয়ে এবং আমাদের সন্তানাদিরা সবাই এই বাসার আশপাশেই থাকে। পরিকল্পনা করেই এভাবে সবাই আছি। একটা কিছু হলেই এখনো সবাই ছুটে আসে। রাত দু’তিনটা নাই, ফোন দিলেই সবাই বাসায় আসে।’
অবশ্য অভিযোগের সুরে তিনিই জানান, আব্বাকে নিয়ে এমন অপপ্রচার হঠাৎ কিংবা নতুন না। মাঝেমধ্যেই একটি গোষ্ঠী এমন কাজ করে। এসব শুনে তারা অবাক বনে যান।
বকুলের ভাষ্যে, ‘দু’তিন বছর আগের কথা। হঠাৎ ছড়িয়ে পড়ল, বরিশালের একটি মেয়েকে নাকি আব্বা বিয়ে করেছেন! সে সময়ে আমরা এর নিন্দা জানিয়েছিলাম। এরপর এসব আমরা আর আমলে নেই না। খুব বেশি বাড়াবাড়ি হলে জবাব দেয়ার চেষ্টা করি।’
অনেকটা আক্ষেপ করেই তিনি বলেন, ‘একজন গুণী ব্যক্তিকে নিয়ে এমন আজগুবি কথা ছড়ানো ঠিক না। যারা এসব করে, তাদের নিশ্চয় কোনো উদ্দেশ্য আছে। আব্বাকে তো অনেকবারই একটি দলের লোক বলে প্রচার করা হয়েছে। সেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকে এসব করা হয় কিনা আমরা বলতে পারব না। তবে প্রবীণ বয়সে এসে তার জন্যও এসব শোনা কষ্টের।’
এবার মীর শরীফ মাহমুদ বলেন, ‘যারা কবিকে নিয়ে এসব করছেন, তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। তাদের নিজেদেরই লজ্জিত হওয়া উচিত। এমন গুণী ব্যক্তি সম্পর্কে এ ধরনের মিথ্যাচার, ভুয়া প্রচারণার আমরা নিন্দা জানাচ্ছি।’
কবি আল মাহমুদের সার্বক্ষণিক দেখভাল করেন শরীফ মাহমুদ দম্পতি। তারা জানান, বাবা প্রায় এক বছর কথা বলতে পারেন না। চিকিৎসকরা বলেছেন— কবির তেমন কোনো সিরিয়াস রোগ নেই। যা সমস্যা, বার্ধক্যজনিত। ডায়াবেটিস, প্রেসার, হার্ট, প্রসাব-পায়খানা সব ঠিক আছে।
শরীফ মাহমুদ বলেন, ‘আব্বার নিউরোর কিছু সমস্যা আছে। নিউরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. আবদুল হাই দেখছেন। কয়েকবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। চিকিৎসকই পরামর্শ দেন, বাসায় রেখে পরিবারের সেবা-যত্নই কবির জন্য বেশি জরুরি। তার প্রেসক্রিপশনেই বাসাতে ওষুধ চলছে। মাঝেমধ্যে চিকিৎসক দেখেন।’
কবিকে দেখাশোনা করা পুত্রবধূ বকুল বলেন, ‘আমি তাকে (আল মাহমুদ) শ্বশুর ভাবি না। অনেক ছোট্ট বয়সে তিনি আমাকে পুত্রবধূ হিসেবে পছন্দ করে এনেছেন। নিজের বাবার মতোই মনে করি। তার মতো মানুষের সেবা-যত্ন করতে পারাকে আমার ভাগ্য বলে মনে করি।’
গুলশানের বাড়ির বিষয়ে কবিপুত্র বলেন, ‘গুলশানে বাড়ি নয়, একটা ফ্ল্যাট ছিল, আব্বা-মা থাকতেন। পরে আব্বা ওটা বিক্রি করে দেন। ফ্ল্যাট বিক্রির পুরো টাকা তিনি আমাদের ভাই-বোনদের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছেন।’
তিনি জানান, চিকিৎসাসহ আব্বার সব ধরনের খরচ আমরা পাঁচ ভাই মিলেই করে থাকি।
কবি আল মাহমুদের রচনার মধ্যে রয়েছে, কাব্যগ্রন্থ লোক লোকান্তর, কালের কলস, সোনালী কাবিন, মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো, অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না, বখতিয়ারের ঘোড়া, একচক্ষু হরিণ, দোয়েল ও দয়িতা, দ্বিতীয় ভাঙ্গন, নদীর ভিতরে নদী, না কোনো শূন্যতা মানি না, বিরামপুরের যাত্রী, বারুদগন্ধি মানুষের দেশ, সেলাই করা মুখ, তোমার রক্তে তোমার গন্ধ ইত্যাদি।
কবির সাড়া জাগানো উপন্যাস কাবিলের বোন, পানকৌড়ির রক্ত, উপমহাদেশ, ডাহুকি, যেভাবে বেড়ে উঠি, আগুনের মেয়ে, যমুনাবতী, চেহারার চতুরঙ্গ, যে পারো ভুলিয়ে দাও, ধীরে খাও অজগরী ইত্যাদি।
সাহিত্যকর্মের জন্য আল মাহমুদ পেয়েছেন একুশে পদক, বাংলা একাডেমিসহ অসংখ্য পুরস্কার।