কী ছিল সেই কুখ্যাত ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি?
মেহেদী হাসান শান্ত
ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির শুরুটা হয় ১৯৭২ সালের ১৭ জুন ভোরবেলায়। ওয়াশিংটন ডিসির ওয়াটারগেট কমপ্লেক্সে অবস্থিত ডেমোক্র্যাটিক ন্যাশনাল কমিটির অফিস থেকে গ্রেফতার হয় একটি জালিয়াত চক্র। কোনো সাধারণ ডাকাতির ঘটনা ছিলো না এটি। তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রিচারড নিক্সনের পুনঃনির্বাচনী প্রচারণার সাথে সংযুক্ত ছিলো আটককৃত দুষ্কৃতিকারীরা। গ্রেফতারের সময় তারা ফোনে আড়ি পাতায় ও বিভিন্ন নথিপত্র চুরিতে ব্যস্ত ছিলো। ঘটনার পরপরই পুরো ব্যাপারটি ধামাচাপা দিতে নিক্সন আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় নি তার। ১৯৭৪ সালের আগস্টে পুরো চক্রান্তের হোতা হিসেবে প্রমাণিত হওয়ায় তাকে পদত্যাগ করতে হয়। নিইক্সনই হলেন আমেরিকার ইতিহাসে প্রথম পদত্যাগকারী প্রেসিডেন্ট। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি আমেরিকার রাজনীতিকে চিরতরে বদলে দেয়। অনেক আমেরিকানকে তাদের রাষ্ট্রে ক্ষমতাসীনদের নিয়ে নতুন করে ভাবতে শেখায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তখনকার অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতিই আসলে এমন কেলেঙ্কারির জন্ম দিয়েছিলো। এক মেয়াদে দায়িত্ব পালন শেষে ১৯৭২ এ যখন নিক্সন পুনরায় নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, সময়টা ছিলো ভীষণ সংকটাপন্ন। ভিয়েতনাম যুদ্ধে ইতোমধ্যেই জড়িয়ে গিয়েছিলো আমেরিকা। যুদ্ধে অংশগ্রহণ নিয়ে সমগ্র আমেরিকান সমাজই ছিলো দ্বিধাবিভক্ত। এমতাবস্থায় নিক্সন এবং তাঁর উপদেষ্টারা একটি শক্তিশালী নির্বাচনী প্রচারণা খুবই জরুরি বলে মনে করেছিলেন। এ ব্যাপারে তারা এতটাই আগ্রাসী হয়ে উঠেছিলেন যে শেষমেশ তা তাদেরকে বেআইনি গুপ্তচরবৃত্তিতে বাধ্য করে।
১৯৭২ এর মে মাসে তাই নিক্সনের প্রচারণা কমিটির কিছু লোক ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক কমিটির ওয়াটারগেট সদরদপ্তরে অনুপ্রবেশ করে চূড়ান্ত গোপনীয় কিছু তথ্য চুরি করে নেয় এবং তাদের ফোনের উপর নজরদারি করার ব্যবস্থা করে। উল্লেখ্য নিক্সনের দল ছিলো রিপাবলিকান পার্টি। আর আমরা সবাই জানি, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মূলত লড়াই হয় ডেমোক্র্যাট আর রিপাবলিকানদের মধ্যে।
ওয়াটারগেটে অবস্থিত ডেমোক্র্যাটিক ন্যাশনাল কমিটির অফিসকিন্তু ফোন ট্যাপ করার যন্ত্রটি ঠিকঠাক কাজ করছিলো না। তাই ১৭ জুন ৫ সদস্যের একটি দল আবারো ডেমোক্র্যাটিক অফিসে অনুপ্রবেশ করে। তারা ওই বিল্ডিং এর প্রতিটি দরজায় নতুন করে মাইক্রোফোন বসানোর সময় একজন নিরাপত্তারক্ষী তা দেখে ফেলে এবং পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ মুহূর্তেই ঘটনাস্থলে গিয়ে ওই ৫ গুপ্তচরকে হাতেনাতে ধরে ফেলে।
গুপ্তচরদের সাথে যে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সংযোগ রয়েছে তা সাথে সাথেই পরিষ্কার হয় নি, তবে তাদের থেকে হোয়াইট হাউজের নির্বাচন কমিটির ফোন নাম্বারের কপি উদ্ধার করা হয়েছিলো, যা গোয়েন্দাদের সন্দেহের উদ্রেক করে। ওই বছর আগস্টে নিক্সন জনগণের উদ্দেশ্যে এক বক্তৃতায় গ্রেফতারকৃত দুষ্কৃতিকারীদের সাথে হোয়াইট হাউজের সংযোগের বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করেন। জনগণও নিক্সনকে বিশ্বাস করে, বিপুল ভোটে তাকে দ্বিতীয় বারের মতো আমেরিকার প্রেসিডেন্টের পদে জয়যুক্ত করে।
কিন্তু অতি শীঘ্রই নিক্সনের মিথ্যে ফাঁস হয়ে যায়। জানা যায়, ঘটনার কিছুদিন পর গুপ্তচরদের মুখ বন্ধ রাখার জন্য তিনি তাদের লক্ষাধিক ডলার উৎকোচ দেন। অতঃপর নিক্সন ও তার সহযোগীরা এফবিআই এর তদন্ত ঠেকানোর জন্য সিআইএ কে ব্যবহার করেন; যেটি ছিলো আসল ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির থেকেও বড় অপরাধ। এ ধরণের কাজ করে নিক্সন তার ক্ষমতার অপব্যবহার করেছিলেন এবং ইচ্ছাকৃতভাবে আইন প্রয়োগে বাধা দিয়েছিলেন।
এদিকে ওয়াটারগেটের ঘটনায় মোট ৭ জন ষড়যন্ত্রকারীকে অভিযুক্ত করা হয়। এদের মধ্যে ৫ জন দোষ স্বীকার করে নেন, ২ জনকে জেলে প্রেরণ করা হয়।
পদত্যাগ ঘোষণা করছেন নিক্সনপ্রেসিডেন্টের মুখোশ উন্মোচনে বেশ কিছু মানুষ বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এদের মধ্যে ছিলেন ওয়াশিংটন পোস্টের রিপোর্টার বব উডওয়ার্ড ও কার্ল বার্নস্টেইন , মামলার অন্যতম বিচারক জন সিরিকা এবং সিনেটের তদন্ত কমিটির কিছু কর্মকর্তা। তার মধ্যেও ষড়যন্ত্রে জড়িত ব্যক্তিরা প্রেসিডেন্টের চাপে সবকিছু ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
নিক্সনের হাতেগোনা কিছু সহযোগী; তখনকার হোয়াইট হাউস উপদেষ্টা জন ডীন যাদের মধ্যে অন্যতম, প্রধান বিচারকদের কাছে প্রেসিডেন্টের অপরাধের কথা স্বীকার করেন। তারা নিশ্চিত করেন, ওভাল অফিসে হওয়া সব ফোনকল ট্যাপ করতেন নিক্সন, ওই ফোনকলের টেপগুলো উদ্ধার করা গেলেই নিক্সনের কুকীর্তি প্রমাণিত হবে।
নিক্সন টেপগুলো নিরাপদে রাখতে ব্যর্থ হন। তার আইনজীবীরা দাবি করেন, প্রেসিডেন্ট তার বিশেষাধিকার বলে টেপগুলো নিজের কাছে গচ্ছিত রাখতে পারেন। কিন্তু সিরিকা ছিলেন নাছোড়বান্দা। তার সাথে যোগ দেয় সিনেট কমিটি এবং একজন স্বাধীন আইনজীবী আরকিব্যাল্ড কক্স। তাঁরা টেপগুলো খুঁজে পেতে উঠেপড়ে লাগেন।
কক্স যখন টেপগুলো পাওয়ার জন্য এক চুল ছাড় দিতে নারাজ, প্রেসিডেন্ট নিক্সন তাঁকে বহিষ্কারের আদেশ দেন। এর প্রতিবাদ হিসেবে বিচার বিভাগের অনেক বিচারক পদত্যাগ করেন। ১৯৭৩ সালের ২০ অক্টোবরের এ ঘটনা ইতিহাসে ‘স্যাটারডে নাইট ম্যাসাকার’ নামে পরিচিত। অবশেষে নিক্সন কিছু সংখ্যক টেপ বিচারকদের কাছে হস্তগত করার সিদ্ধান্ত নেন, কিন্তু অনেকগুলো তখনও নিজের কাছে রেখে দেন।
১৯৭৪ সালের শুরুর দিকে কেলেঙ্কারি ধামাচাপা দেয়ার সব চেষ্টা বিফল হয়ে যায়, যখন ওয়াটারগেট ষড়যন্ত্রের দায়ে আদালত নিক্সনের সাত সহযোগীকে দোষী সাব্যস্ত করে। কিন্তু মূল হোতা নিক্সনের কি হবে? বিচারকরা আসলে বুঝতে পারছিলেন না কিভাবে একজন ক্ষমতাসীন আমেরিকান প্রেসিডেন্টকে সাজা দেয়া যায়। তাই তাকে ষড়যন্ত্রের অনভিযুক্ত সহকারী আখ্যা দেয় আদালত। জুলাইতে সুপ্রিম কোর্ট নিক্সনকে সব ফোন রেকর্ডের টেপ আদালতে জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে আইনের খেলাপ, ক্ষমতার অপব্যবহার, সন্ত্রাসীদের মদদদান ও সংবিধানের বিধি লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত করে।
আগস্টের ৫ তারিখে নিক্সন তার কাছে থাকা টেপগুলো দাখিল করার পর আর কোনো সন্দেহই রইলো না যে এসবের পেছনে তার হাত ছিলো । মার্কিন কংগ্রেস কর্তৃক যখন তাকে অভিশংসন করা সময়ের ব্যাপার মাত্র, তখনই পদত্যাগ করেন তিনি। তখন আগস্ট মাসের ৮ তারিখ। যদিও নিক্সন কখনোই সরাসরি তার অপরাধ স্বীকার করেননি। তার ভাষ্যমতে পুরো ব্যাপারটি ছিলো তার বিবেচনার ভুল। তবে এই ঘটনা আমেরিকায় অবিশ্বাসের বীজ বুনে দেয়, আক্ষরিক অর্থেই যার বলি হতে হয় রবার্ট কেনেডি, মারটিন লুথার কিং এর মতো নেতাদের।