কী ঘটেছিলো যে কারণে বঙ্গবন্ধু আপস-ফর্মুলা থেকে বেরিয়ে আসলেন
একথা বুঝতে কোনো অসুবিধা হওয়ার কারণ নেই যে, কোনো একটি ভাষণ (৭ মার্চ, ১৯৭১) অথবা কোনো একটি রেডিও থেকে বিশেষ বক্তব্য (২৬-২৭ মার্চ, ১৯৭১) অথবা পতাকা উত্তোলন (২ মার্চ, ১৯৭১) এবং ইশতেহার পাঠ (৩ মার্চ, ১৯৭১); এই ধরনের ঘটনা হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোনো বিষয় নয়। তাহলে ঘটনাগুলো কীভাবে ঘটলো এবং এ ঘটার পেছনের ইতিহাস কি?
বাংলাদেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে ‘নিউক্লিয়াস-বিএলএফ’-এর আট বছরের অদম্য সাহসী ও বিচক্ষণমূলক সাংগঠনিক উদ্যোগ এবং ’৭১-এর ১ মার্চ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত ঘটনাবলী ও নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধ নিয়ে হোমার-এর ‘ইলিয়াড’-এ বর্ণিত ট্রয় নগরীকে নিয়ে ঘটিত যুদ্ধের মতো কাব্যিক না হলেও উল্লিখিত কর্মযজ্ঞের মধ্যদিয়ে একটি জাতির নবজন্মের যে আত্মপ্রত্যয়ী ও গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার সূত্রপাত হলো তাকে নিয়ে ‘মহাকাব্য’ রচিত হতে পারে।
জাতিভিত্তিক একটি রাষ্ট্রের অভ্যুদয় কেবলমাত্র রাজনৈতিক-প্রাকৃতিক ইচ্ছার ফসল নয়। বহু দিনের বহু ঘটনার মধ্যদিয়ে যা, শত বছর ধরে অতিক্রম করতে হয় তাকে কেবলমাত্র ব্যক্তিবিশেষ বা গোষ্ঠী বিশেষের কার্যকলাপের মধ্যে সীমাবদ্ধ করলে সে জাতির সম্মিলিত প্রচেষ্টাকেও অসম্মান করা হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলন কেবল গণতান্ত্রিক অথবা সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্যে সীমাবদ্ধ করলে তাও স্বাধীনতার পুরো ইতিহাসকে তুলে ধরা তো হবেই না বরং তা হবে জাতি গঠনে শত বছরের বীরত্বব্যঞ্জক ঘটনাবলী এবং ত্যাগের ইতিহাসকে পরবর্তী বংশধরদের কাছে গোপন করে রাখারই অপকৌশল। কেন এই অপকৌশল? আমাদের নতুন প্রজন্ম একদিন অবশ্যই তা জানতে চাইবে।
মার্চ মাসের প্রথম ২৬ দিনের প্রতিটি ঘণ্টা, প্রতি ২৪ ঘণ্টা, পুরো সপ্তাহ এবং যতই ২৬ মার্চ ঘনিয়ে আসছিলো ততোই তখনকার জনগোষ্ঠীর মধ্যকার ছাত্র-যুবসমাজের যে অদম্য এবং সাহসী প্রত্যয়, অনেক জল্পনা-কল্পনা, অনেক পিছুটান, অনেক অনিচ্ছা এবং অনেক ধীরে চলার প্রচেষ্টাকে অতিক্রম করে স্বাধীনতার জন্য শেষ লড়াই সশস্ত্র যুদ্ধ সংঘটিত করার প্রস্তুতি নিয়েছিলো তা-ও প্রকাশিত হওয়া প্রয়োজন।
২২ মার্চ সংবাদপত্রসমূহে ইয়াহিয়া-ভুট্টো-মুজিবের আলোচনার সফলতা প্রকাশিত হলো।
পাকিস্তানকে রেখেই (নামে মাত্র হলেও) দুই অংশের দুই প্রধান মন্ত্রিত্ব নিয়ে এই আপস ফর্মুলা।
২৩ মার্চ এ আপস ফর্মুলার বহিঃপ্রকাশ ঘটলো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইয়াহিয়ার সৌজন্য সাক্ষাতের মাধ্যমে। আবার অন্যদিকে ২৩ মার্চ ছিলো পাকিস্তান দিবসের বিপরীতে ‘নিউক্লিয়াস’ ঘোষিত ‘প্রতিরোধ দিবস’ পালন কর্মসূচি।
২৪ মার্চ বঙ্গবন্ধু অনির্ধারিত সাক্ষাৎ করেন ইয়াহিয়ার সঙ্গে। জানাজানি হলো আপস-চুক্তি হবে না। তারই ফলাফল ২৫ মার্চে পাকিস্তানিদের আক্রমণ।
২৩ মার্চ গভীর রাতে ‘নিউক্লিয়াস’ ও ‘বিএলএফ’ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর চার ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক হয়। এই বৈঠকে কী ঘটেছিলো যে কারণে বঙ্গবন্ধু আপস-ফর্মুলা থেকে বেরিয়ে আসলেন।
বিভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ২৫ মার্চ রাতে স্বাধীনতার ঘোষণার বক্তব্য ও ভাষা নিয়ে কয়েক ধরনের বিবরণ (version) শুনতে পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণার প্রকৃত কথাগুলো কি তা আজো অজানা।
২৬-২৭ মার্চ চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার থেকে প্রচারিত তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান-এর আহ্বান সম্পর্কিত বিতর্কের অবশ্যই অবসান হওয়া প্রয়োজন।
বাঙালির স্বাধীনতার বিষয়টি কখন কোথায় কার দ্বারা সূত্রপাত ঘটেছিলো তার সম্যক উপলব্ধির জন্য ইতিহাসবিদরা প্রয়োজনীয় দলিল অবশ্যই খুঁজে বের করবেন। সেই ইতিহাস লেখার শুরুতেই ইতিহাসবিদদের মাথায় যে কথাটি থাকতে হবে, তা হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাটি আসে সাহসী ছাত্র-যুব নেতৃবৃন্দের বক্তব্য থেকেই। আর স্বাধীনতার জন্য ছাত্র-যুবকদের গোপন সংগঠন এবং তাদের কর্মকা- স্বাধীনতার প্রশ্নটিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত হওয়ার সুযোগ দেয়নি। তবে বাংলাদেশ প্রথম স্বাধীন হয় সাহসী ছাত্র-যুব নেতৃবৃন্দের বক্তব্য ও কর্মকাণ্ডের মধ্যদিয়ে যা আজ সবমহলে স্বীকৃত। এরপর যা কিছু ঘটেছে এবং যার যার যে অবদান অনস্বীকার্য সেগুলোকে স্বীকৃতি দিয়েই বলতে হবে স্বাধীনতার শুরুটা ঠিক কোনো ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দল দিয়েই হয়নি। ছাত্র-যুবসমাজের আপসহীন মনোভাব এবং কালোত্তীর্ণ সাংগঠনিক উদ্যোগ ও সংগঠনশক্তিই হবে স্বাধীনতার উপর লেখা সেই ‘মহাকাব্যে’র অন্যতম প্রধান উপাদান।
-সিরাজুল আলম খান