কাশ্মীর স্বাধীন করতে বিভিন্ন শহরে হামলার হুমকি আল কায়েদা’র। পাকিস্তানকে চার টুকরা করার খায়েশ এবার ভারতের।
নিউইয়র্ক থেকে ড. ওমর ফারুক।। স্থানীয় সময়ঃ ২৮ ডিসেম্বর রাত সাড়ে সাতটা।।
কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে সমগ্র বিশ্বব্যাপী মুসলিম উম্মাহর উৎকণ্ঠার শেষ নেই। এরি মধ্যে আল কায়েদা’র মত সংগঠনের ভারতীয় ইউনিট হুমকি দিল যে, এ ভূখণ্ড মুক্ত করতে হলে কৌশলগত গেরিলা প্রক্রিয়ায় ভারতের গুরুত্বপূর্ণ শহরের বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা করা হতে পারে। ভারতের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহরকে যুদ্ধক্ষেত্র বানাতে হবে বলে এবার হুমকি দিল আল কায়েদা’র ভারতীয় শাখা এমন এক সময় যখন ভারত ও পাকিস্তান পরষ্পর সীমান্তে যুদ্ধংদেহি মনোভাব প্রদর্শনে ব্যস্ত। ইস্যু সেই কাশ্মীর নিয়েই। এর মধ্যে প্রাণঘাতী দ্বিপাক্ষিক সীমান্ত সংঘর্ষে দু’ পক্ষেরই সশস্ত্র ব্যক্তিদের প্রাণ হানি ঘটেছে। কলকাতা-দিল্লী-বেঙ্গালুরুর নাম করে শহরগুলোতে হামলার হুমকি দিয়ে ভিডিও বার্তা দিল সংগঠনটির এক মুখপাত্র উসামা মেহমুদ। এ শহরগুলোতে হামলার তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, এতে সেনাবাহিনী কাশ্মীর সীমান্ত নিয়েই শুধু বেশি জড় হতে পারবে না। দেশের আরও অন্য শহরগুলোতেও তাদের স্থানান্তর ঘটাতে হবে। ফলে কাশ্মীর সীমান্ত কিছুটা অরক্ষিত হবে। তবে এবার আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়। আর তা হল, আগে ভারতের বিভিন্ন শহরে হামলার উল্লেখ করলেও কলকাতায় হামলার কথা আল কায়দার মত কোন সংগঠনের মুখে এই প্রথম শোনা গেল। কিন্তু, ‘কাশ্মীরএর আজাদী’-এর সঙ্গে এই শহরগুলোর ওপর হামলার সম্পর্ক কী? সে বিষয় নিয়ে ভাবছিলেন রাজনীতিক বিশ্লেষকরাও। গত ২৬ ডিসেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, রাতে অনলাইন জিহাদি মঞ্চে একটি ভিডিও প্রকাশ করে সেই ব্যাখ্যাই দিয়েছে এ দেশে আল কায়দার দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা উসামা মেহমুদই। কাঁপা হাতে তোলা ভিডিও ফুটেজে শোনা গেল মেহমুদের হুমকিঃ ভারতীয় সেনা ও হিন্দু সরকার পরিচালিত এ ভূমিকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করতে হবে। তার কথায়, “কলকাতা, বেঙ্গালুরু বা দিল্লী যদি আক্রান্ত হয়, তবেই হুঁশ ফিরবে। এবং কাশ্মীরের ওপর থেকে মুঠো আলগা হবে।” ওই নেতার দাবি, কাশ্মীরকে হাতে রাখতে এ মুহূর্তে উপত্যকায় মোতায়েন রয়েছে প্রায় ৬ লাখ ভারতীয় সেনা। অন্য শহরে আক্রমণ তীব্র হলে সেই সেনা সরাতে বাধ্য হবে ভারত। আর তখনই কাশ্মীরের উপর থেকে সেনা মোতায়েন হালকা হবে। আর তাতেই নাকি মুক্তির স্বাদ পাবে স্বাধীনতা পিয়াসী কাশ্মীর উপত্যকা!’
মুম্বই, বেঙ্গালুরু, দিল্লীর মত বড় শহরে এ রকম হামলা এর আগেও একাধিক বার হয়েছে। কিন্তু, ২০০২ সালে আমেরিকান সেন্টারে হামলা ছাড়া এখনও পর্যন্ত কোন বড়সড় হামলা কলকাতায় হয় নি। কিন্তু, সেই কলকাতার নাম এ বার আল কায়দার মুখে! যদিও গোয়েন্দারা বলছেন, আগে কলকাতার নাম স্পষ্ট ভাবে না করলেও পূর্ব ভারতের কথা আল কায়দার মুখে শোনা গিয়েছে। তাঁদের দাবি, আল কায়দা প্রথম যখন ভারত আক্রমণের হুমকি দিয়েছিল তখন পশ্চিম ভারতের পাশাপাশি পূর্ব ভারতকেও ‘টার্গেট’ করে। দু’দিক থেকে আক্রমণ তীব্রতর হলে ভারত বিপর্যস্ত হয়ে যাবে বলেও জানান হয়েছিল। তবে, এ বারের মত সেই সময় কলকাতার নাম সরাসরি উচ্চারণ করে নি তারা।
গোয়েন্দারা আরও জানিয়েছেন, ভারতীয় উপমহাদেশে আল কায়দার শাখা সংগঠন আনসারুল্লা বাংলা টিম। যারা মূলতঃ বাংলাদেশে নাস্তিকদের খতম করার অভিযোগে অভিযুক্ত। নাম পাল্টে তারা এখন আনসার আল ইসলাম। সম্প্রতি তাদের তিন সদস্য কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ)-এর হাতে ধরা পড়েছে। এবং তাও কলকাতাতেই। এতদিন গোয়েন্দাদের ধারণা ছিল, বাংলাদেশে ধর্মহীন ও ইসলাম বিরোধী নাস্তিকরাই তাদের লক্ষ্য ছিলেন। কিন্তু, এ তিন জনকে গ্রেফতার করে জেরা করার পর তাঁরা ভাবিত। কেন ওই তিন জনকে দিয়ে এ রাজ্যে ‘রেকি’ করানো হচ্ছিল, তা খোঁজার চেষ্টা করছেন গোয়েন্দারা। অতীতে, আজ থেকে প্রায় বছর ১২ আগে, কলকাতারই বন্দর এলাকায় আল কায়দার নামে কুপন বিক্রি হতে দেখা গিয়েছিল। টাকাও তোলা হয়েছিল সেই সময় প্রচুর। তাই, মেহমুদের হুমকি ফের গোয়েন্দাদের ভাবাচ্ছে।
একটি সর্বভারতীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, উপমহাদেশের মাটিতে জিহাদি আন্দোলনের বীজ বুনতে এ শহর এখন জঙ্গি সংগঠনের নজরে। কলকাতাসহ অন্য শহরগুলো কেন আল কায়দার মুখে উঠে আসছে? মেহমুদের ভিডিওতেই সেই জবাব মিলছে। তার মন্তব্য, “উপমহাদেশে জিহাদি আন্দোলন জোরদার করার প্রয়োজন এসেছে। পাশাপাশি, কাশ্মীরের মানুষের পাশে গোটা অঞ্চলের সকল মুসলমানের দাঁড়ানো উচিত।”
সাক্ষাৎকার ভিত্তিক ওই ভিডিওতে কাশ্মীরে নিজেদের কৌশল নিয়েও কথা বলেছে মেহমুদ। তার দাবি, বহু মুজাহিদিন কাশ্মীরের জন্য পাকিস্তানে চলে গিয়েছে। এখনও যাচ্ছে। এ বিষয়ে পাক সেনার ভূমিকা নিয়েও সমালোচনা করে সে। পাক সেনার জন্যই নাকি মুজাহিদিনরা নিজেদের কাজকর্ম বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সে ২০১২-য় পাক অধিকৃত কাশ্মীরে হিজবুল মুজাহিদিন জঙ্গি শেখ আহসান আজিজের উপর ড্রোন হামলার উল্লেখও করেছে। তবে, পাকিস্তানের মদদেই যে কাশ্মীর উপত্যকায় এসব সংগঠনগুলোর জোর তৎপরতা আছে, তা-ও শোনা গিয়েছে মেহমুদের মুখে। মেহমুদের দাবি, রাজনৈতিক ভাবে কাশ্মীর সমস্যা সমাধান হবে না। তার কথায়, “যে সমাধানসূত্রে কোনও রক্ত-ঘাম ঝরে না, জিহাদ নেই, মৃত্যু নেই, ক্ষমতার কেন্দ্রে কোন পরিবর্তন নেই— সেটা শুধুমাত্র শান্তিপূর্ণ এক অস্থায়ী চেষ্টা মাত্র।
পাকিস্তানকে চার টুকরা করার খায়েশ এবার ভারতেরঃ
অপমানের প্রতিশোধ চাইলেন সুব্রহ্মণ্যন স্বামী। কুলভূষণ যাদবের মা এবং স্ত্রীকে যে ধরনের হেনস্থার শিকার হতে হয়েছে পাকিস্তানে, তার একমাত্র প্রতিশোধ পাকিস্তানকে ভেঙে চার টুকরো করে দেওয়া। এমনই মন্তব্য করলেন বিজেপি সাংসদ সুব্রহ্মণ্যন স্বামী। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার জন্য এই মুহূর্ত থেকেই প্রস্তুতি শুরু হওয়া উচিত বলেও সুব্রহ্মণ্যন স্বামীর মত।
‘‘খুব দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটেছে…। পাকিস্তানকে ভেঙে চার টুকরো করে দেওয়ার জন্য তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করার সময়টা এ বার এসে গিয়েছে।’’ সংবাদমাধ্যমে গত ২৬ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার, এমনই মন্তব্য করেছেন সুব্রহ্মণ্যন স্বামী। উল্লেখ্য ভারত ও পাকিস্তান পারমানবিক অস্ত্র এর অধিকারী দক্ষিণ এশিয়ায় চির বৈরী দু’টি শক্তিশালী রাষ্ট্র। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন মুক্ত হয়ে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে অভ্যুদয়ের পর থেকেই এ দুটি দেশের বৈরিতা সব সময়ই ‘অব্যাহত ছিল। পাকিস্তানের সাথে ভারতের একাধিক যুদ্ধও সংগঠিত হয়েছিল। বিশেষ করে ধর্মীয় ইস্যুতে দাঙ্গা অভিবক্ত ভারত বর্ষে নিত্য নৈমত্যিক ব্যাপার ছিল । যে বিষয়টিকে সমাজ চিন্তক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও বুদ্ধিজীবীদের ভাবিয়ে তুলেছিল। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, যিনি আজীবন সেকুলার চিন্তা ও ধ্যান ধারণায় বেড়ে উঠেছিলেন এবং কংগ্রেসের মত সংগঠনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তিনিও শেষাবধি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র নির্মাণে এগিয়ে আসতে বাধ্য হন। শুধু তাই নয়, আলাদা হয়েও এ অঞ্চলে শান্তি মিলে নি। পরপর একাধিক বার দু’দেশের মধ্যে যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল। তারমধ্যে ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালের যুদ্ধ ছিল সবচেয়ে বেশি ভয়াবহ ও করুণ। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে ভারত ৬ শ ট্রাংক নিয়ে এক রাতের শেষ প্রহরে পাকিস্তানে অতর্কিত হামলা চালায় এবং তাদের প্রত্যাশা ছিল সকালের নাশ্তা তাদের ফৌজরা পাকিস্তানের সীমান্ত শহর লাহোরে গিয়ে করবে। সেবার পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম, উভয় অঞ্চলে সীমান্তে মোতায়েনকৃত অকুতোভয় সৈনিকরা ভারতীয় সে অিতর্কিত হামলা রুখে দেয়। সকালের নাশতা খাওয়ার বরাত আর ভারতীয় সেনাদের লাহোর গিয়ে করা হয়ে ওঠে নি। সে বার বিশেষ করে বাঙালি সৈনিকরা পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তে অত্যন্ত সাহসিকতা পূর্ণ আক্রমণ চালিয়ে পশ্চিমাঞ্চলীয় ভারতীয় হামলা রুখে দেয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিাঞ্চল আলাদা দুটি রাষ্ট্রে পরিণত হয়। পূর্বাঞ্চলীয় অংশটির নতুন নাম হয় বাংলাদেশ। সেটি বাংলাদেশিদের জন্য একটি স্বাধীনতা যুদ্ধ হলেও ভারত সেটিকে চির বৈরী দু’ রাষ্ট্র- পাকিস্তান ও ভারতের দ্বিপাক্ষিক যুদ্ধ বলে চালিয়ে দিতেই বেশি তৎপর।
ভারতীয় নৌসেনার প্রাক্তন কর্মী কুলভূষণ যাদবকে চরবৃত্তির দায়ে গ্রেফতার করেছিল পাকিস্তান। কুলভূষণ যে ভারতের গুপ্তচর নন, সে কথা নয়াদিল্লী বারবার জানিয়েছে। কিন্তু পাকিস্তান সে কথা মানতে নারাজ। সে দেশের সামরিক আদালত কুলভূষণ যাদবকে দোষী সাব্যস্ত করেছে এবং মৃত্যুদণ্ডের সাজাও ঘোষণা করেছে।
বিজেপি সাংসদ সুব্রহ্মণ্যন স্বামী।
পাকিস্তানে বন্দি কুলভূষণের সঙ্গে দেখা করার জন্য অনুমতি চেয়েছিল নয়াদিল্লী। ভারতীয় দূতাবাসের প্রতিনিধিকে দেখা করতে দেওয়া হোক বন্দি ভারতীয় নাগরিকের সঙ্গে, এমন আবেদনও জানিয়েছিল ভারত। কিন্তু সে আবেদন পাকিস্তান খারিজ করে দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত কুলভূষণের মা অবন্তীকে এবং স্ত্রী চেতনকুলকে তাঁর সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দেয় পাকিস্তান। গত ২৫ ডিসেম্বর, সোমবার, সেই সাক্ষাৎ হয়। সোমবার পাকিস্তান থেকে ফিরেই বিদেশ মন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গে দেখা করেছিলেন কুলভূষণের মা ও স্ত্রী। পাকিস্তানে গিয়ে তাঁদের কেমন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছে, সে কথা সুষমাকে জানিয়েছিলেন তাঁরা। তার প্রেক্ষিতেই মঙ্গলবার সরব হয় ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রণালয়। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত অসৌজন্য এবং চরম অভব্যতার অভিযোগ তুলে ঘটনার কড়া নিন্দা করা হয়।
মা ও স্ত্রীয়ের সঙ্গে কুলভূষণের ‘সাক্ষাৎ’ পর্ব ঠিক কেমন ছিল, বিদেশ মন্ত্রক সে তথ্য প্রকাশ্যে আনার পরেই সরব হন সুব্রহ্মণ্যন স্বামী। তিনি বলেন, ‘‘কুলভূষণের মা এবং স্ত্রীয়ের সঙ্গে যে আচরণ পাকিস্তানে করা হয়েছে, তা অনেকটা মহাভারতে বর্ণিত দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের মত।’’ এই অপমানের প্রতিশোধ নিতেই হবে— দাবি করেন বিজেপি সাংসদ। পাকিস্তানকে ‘ঈর্ষাপরায়ণ’ এবং ‘প্রতিশোধ পরায়ণ’ দেশ বলে আখ্যা দেন তিনি। পাকিস্তান সংক্রান্ত সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য সে দেশকে একাধিক খণ্ডে ভেঙে দেওয়াই একমাত্র পথ বলে সুব্রহ্মণ্যন মন্তব্য করেন। অবিলম্বে এবং অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করা উচিত ভারতের। মঙ্গলবার এমন কথাও বিজেপি সাংসদ বলেছেন।
[বিদেশি গণ মাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্ট অবলম্বনে।]
ড. ওমর ফারুক।। লেখক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, সামাজিক গবেষক এবং পরিব্রাজক। ইংরেজি সাাপ্তাহিক ঢাকা পোস্ট এডিটর, নিউইয়র্ক ভিত্তিক নিউজ পোর্টালঃ dailydhakapost.com এর এডিটর ইন চিফ এবং নিহাল পাবলিকেশনের স্বত্তাধিকারী। এ পর্যন্ত বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যাঃ ত্রিশটির বেশি।