কাশ্মিরের আজাদী প্রশ্নে বাংলাদেশি মিডিয়ার ভয়াবহ দালালী
কাশ্মির ইস্যুতে আবারো সংকটে পড়েছে বাংলাদেশের মুলধারার সংবাদ মাধ্যমগুলো। বেশ কিছুদিন যাবত কাশ্মিরে ভারতীয় বাহিনীর আগ্রাসনে সেখানকার স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীদের উপর অতর্কিত হামলায় ২০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে মিডিয়ার বিক্ষিপ্ত প্রচারে চরম বিভ্রান্তি দেখা গেছে খবরটি নিয়ে।
বাংলাদেশের ৩২ ধারার বোঝা বহনকারী ‘স্বাধীন’ মিডিয়ার বহর এই ঘটনায় কাশ্মিরের স্বাধীনতাকামী জনগণকে এই নগ্ন হামলার পর কেউ কেউ নাম দিয়েছে “বিচ্ছিন্নতাবাদী” আবার অনেকে সরাসরি “সন্ত্রাসী” অথবা “জঙ্গি” বলেও উল্লেখ করেছে। তবে সব থেকে অদ্ভুত ব্যাপার হল চেতনাধারী বড় বড় মিডিয়া এসবের ধার না ধরে কাশ্মিরি জাতিস্বত্তার সংগ্রামের এই রক্তক্ষয়ী ঘটনাকে বেমালুম এড়িয়ে গিয়েছে। যেন তাদের পাঠকদের এই খবর জানার কোন দরকারই নাই।
বাংলাদেশি গণমাধ্যমের এভাবে পক্ষপাতী আচরণ খুব নতুন না হলেও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল কাশ্মিরের জাতিসত্তার মুক্তিসংগ্রামের লড়াইয়ের এই খবরটাকে প্রত্যক্ষভাবে এড়িয়ে যাওয়ার ঘটনাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
এটি তাৎপর্যপূর্ণ এ কারণে যে ভারতীয় অাধিপত্যের প্রভাব রাষ্ট্রযন্ত্র অতিক্রম করে যে আমাদের গণমাধ্যমের ভেতরেও প্রবেশ করেছে, সেটা যেন এর মাধ্যমে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠলো। গণমাধ্যমের এই একই চরিত্র দেখা গেছে আফগানিস্তানে মার্কিন বোমা হামলার ঘটনাগুলোতেও। কুন্দুজ প্রদেশের একটি মাদ্রাসায় সনদ ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে আফগান সরকারি বাহিনীর বিমান হামলায় শিশুসহ ৭০ এরও অধিক লোকের প্রাণহানি ঘটেছে। যে খবরটি আমাদের মূলধারার অনেক সংবাদপত্রে আসেই নি। সুতরাং গণমাধ্যমের এই পক্ষপাত্বিত্বমুলক প্রচার আমাদের পর্যবেক্ষনী চোখ এড়িয়ে যাবার সুযোগ নেই।
তবে তার আগে আমাদের জেনে নেয়া দরকার কি হয়েছিল সেদিন কাশ্মিরে। গত ৩১ মার্চ শনিবার ভোররাতে কাশ্মিরে ভারতীয় বাহিনী কথিত “জঙ্গিবিরোধী” অভিযানের নামে অতর্কিত হামলা চালায়। সেদিন রাতে মূলতঃ অনন্তনাগের একটি ও সোফিয়ান জেলার দুইটি এলাকায় অভিযান চালানো হয়। সেখানে দুই পক্ষের অন্তত ২০ জন নিহত হয়েছে বলে জানায় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। নিহতদের মধ্যে ১৩ জন কাশ্মিরের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, ৩ জন ভারতীয় বাহিনীর সদস্য এবং বাকি চারজন নিতান্তই বেসামরিক নাগরিক। ভারতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যম সুত্র জানায়, শনিবারের অভিযানে শোফিয়ান জেলার দ্রাগাদ গ্রামে নিহত হয় ৮ জন, অপর একজন নিহত হয় অনন্তনাগের দয়ালগামের অভিযানে। সেনাদের দাবি, দ্রাগাদ গ্রামে এক আইপিএস অফিসারের বাড়িতে লুকিয়ে ছিল হিজবুল মুজাহিদিন কম্যান্ডার জুবের তুরে ও তার সঙ্গীরা। স্বাধীনতাকামীদের আত্মসমর্পণ করতে বলার পাশাপাশি বাড়ির ১৪ জন বাসিন্দাকে বাইরে পাঠাতে বলে সেনারা। কিছুক্ষণ পরে বাসিন্দাদের বাইরে পাঠাতে রাজি হয় স্বাধীনতাকামীরা। তারপরে অভিযানে নামে ভারতীয় বাহিনী, শেষ পর্যন্ত সেখানে প্রাণ হারায় ৭ জন।
এসব তো গেলো ভারতীয় গণমাধ্যমের অবস্থা। অবশ্য কাশ্মিরের সংবাদ মাধ্যমগুলো বলছে ভিন্নকথা। কাশ্মিরী মিডিয়া গ্রেটার কাশ্মির জানায়, সেদিন হঠাত করেই ভারতীয় বাহিনী সোপিয়ানে হামলা চালায়। মূলত স্বাধীনতাকামী যোদ্ধারা সেসব এলাকায় অবস্থান করছে এমন সংবাদের ভিত্তিতেই সেই অভিযান চালানো হয়। ভারতীয় বাহিনী দাবি করেছে, সোপিয়ানে কাশ্মিরী যোদ্ধাদের সাথে তাদের ব্যাপক লড়াই হয়েছে। তবে নিহত যোদ্ধাদের ছবি বলছে ভিন্ন কথা। ছবিতে অধিংকাশ যোদ্ধার হাতে ও মুখে গুরুতর আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। এগুলো যে সম্মুখ সমরের বন্দুক যুদ্ধের আলামত নয় তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এই হামলার প্রতিবাদে কাশ্মিরের সাধারণ জনগণ রাস্তায় নেমে তীব্র বিক্ষোভ প্রদর্শন করলে ভারতীয় বাহিনী সাধারণ জনগণের ওপরেও ব্যাপক হামলা চালায়। বেদম ছররা গুলি এমন কি সরাসরি গুলির ঘটনাও আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোতে এসেছে।
যুক্তরাজ্যের ইন্সটিটিউশন অব কনফ্লিক্ট ম্যানেজমেন্ট তাদের পরিসংখ্যানে দেখিয়েছে, শুধু এই বছরেই অনন্তনাগের ও সোফিয়ান এলাকায় এরূপ হামলা হয়েছে আরও ৩টি। গত ২৪ জানুয়ারি সোফিয়ান জেলার চাইগুন্দ গ্রামে সেনাবাহিনীর হামলায় ২ জন সাধারণ নাগরিকসহ মারা যান মোট ৪ জন। এরপর গত ৪ মার্চ এবং ১২ মার্চ যথাক্রমে সোপিয়ানের পাহনো গ্রামে এবং অনন্তনাগের হাকোরা এলাকায় একতরফা হামলায় মারা যায় আরো অন্তত নয়জন স্বাধীনতাকামী কাশ্মিরী। সুতরাং ১ মার্চের ঘটনা যে বিচ্ছিন্ন নয় সেটা আন্দাজ করা যায়। এবার দেখা যাক, আমাদের দেশীয় গণমাধ্যমগুলো এই ঘটনাটিকে কিভাবে প্রচার করেছে।
আশ্চর্যজনক ভাবে লক্ষ্য করা গেছে কাশ্মিরের স্বাধীনতাকামী এবং সাধারণ জনগণের উপর হামলার চিত্র বাংলাদেশের মূলধারার গণমাধ্যমগুলো নিতান্তই গুরুত্বহীন এবং বিক্ষিপ্তভাবে প্রচার করেছে। ভারতীয় গণমাধ্যমের সাথে সুর মিলিয়ে ‘সন্ত্রাসী’ শব্দটিও দেখা গেছে বাংলাদেশের কোনো কোন মিডিয়ায়। অবশ্য ধরি মাছ না ছুই পানির মত করেই মাঝামাঝি একটি ভাল শব্দ খুজে নিয়েছে অনলাইন মিডিয়া ‘বাংলা ট্রিবিউন’। তারা কাশ্মিরের এই স্বাধীনতাকামীদের নাম দিয়েছে ‘প্রতিবাদকারী’। তবে সব থেকে চোখে পড়ার মত ব্যাপার হল, প্রত্যেকদিন রুটিন করে সকাল বিকাল দুইবার করে জাতির বিবেক হয়ে ওঠা ‘বহুল’ প্রচারিত দৈনিক ‘প্রথম আলো’ কাশ্মিরের এই সহিংসতা নিয়ে কোন সংবাদই প্রকাশ করেনি।
হয়তো এপার-ওপারের কেউ রাগবে বলে। ঘটনাটি এমন নয় যে, তাদের আন্তর্জাতিক ডেস্কের চোখ কাশ্মিরের এই হতাহতের ঘটনাটি এড়িয়ে গেছে। অথচ গত তিন দিনে সংবাদমাধ্যমটি ভারতের শিম্পাঞ্জি নিয়েও সংবাদ করেছে, সংবাদ দিয়েছে গরু নিয়েও। এমনকি ভারতের কোন গ্রামে বিনে পয়সায় ‘পর্ন’ দেখা যায়, সেটি নিয়েও তাদের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু কাশ্মিরের ২০ জনের বেশি হতাহতের কিংবা সেখানে হাজারো আহত মানুষ তাদের সম্মানীয় পত্রিকায় জায়গা পেলোনা। এই বিষয়ে কোন সংবাদ পাওয়া যায়নি এমন আরেকটি পত্রিকা হল নুরুল কবির সম্পাদিত নিউএজ পত্রিকাতেও। ডেইলি স্টারসহ অন্যান্য ইংরেজি পত্রিকা সংবাদ সংস্থা ‘এএফপি’র একটি গড়পরতা খবর প্রকাশ করে দায়মুক্তি নিলেও এই পত্রিকাটি সেসবের কিছুই করেনি।
প্রথম আলোর এই চরিত্র দেখা গেছে আফগানিস্তানে বিমান হামলায় সেখানের কুন্দুজ প্রদেশের একটি মাদ্রাসায় শিশুসহ শতাধিক মানুষ নিহত হবার ঘটনাকে ঘিরেও। আমি যখন এই লেখাটি লিখছি (৪ এপ্রিল, বিকাল ৫.১০), তখন পর্যন্ত প্রথম আলো এই বিষয়ে কোন সংবাদ দেয়নি। যদিও আজই ভারতের ‘পরীক্ষার খাতায় প্রেমপত্র’ সংবাদটি তারা বেশ গুরুত্ব দিয়েই ছেপেছে।
এসব ঘটনা যে শুধুই উদ্বেগজনক ঠিক তা নয়। বরং একই সাথে গণমাধ্যমের এই গণবিমুখ অবস্থান আমাদের মিডিয়া-কালচারের একটি সুক্ষ্ম দিককেও সামনে এনেছে। বিখ্যাত স্কলার এডওয়ার্ড সাইদ তার ‘কাভারিং ইসলাম’ বইতে দেখিয়েছিলেন, কিভাবে পশ্চিমা মিডিয়া আমাদেরকে একথা বিশ্বাস করাতে চায় বা বাধ্য করে যে তৃতীয় বিশ্বের প্রতিবাদী ও সচেতন আন্দোলনগুলো, বিশেষ করে ধর্মীয় পরিচয়-বহনকারী আন্দোলনগুলো মূলত ইসলামি-জঙ্গিবাদী আন্দোলন। যেমন, তুলনামূলক নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েও বাংলা ট্রিবিউন ইতিহাস পরিক্রমায় ক্রমেই সেখানকার (কাশ্মিরের) স্বাধীনতা আন্দোলনের ‘ইসলামীকিকরণ’ এবং হিজবুল মুজাহিদীন এর সক্রিয়তা” নিয়ে আলাদা করে উদ্বিগ্ন হয়। এই ধরণের চিন্তা ও রুচির প্রকাশের কারণে মূলধারার মিডিয়াকে মানুষের কাছে দিনকে দিন গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে।
অন্যদিকে এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অবাধ বিপ্লবের কারণে মূলধারার মিডিয়া কী প্রচার করল বা কী নিঃশব্দে এড়িয়ে গেল তাতে সচেতন জনগণের খুব একটা ক্ষতি হচ্ছে না। প্রতিনিয়ত ঘটনার খবর ও তার বহুমূখী ব্যাখ্যা এইসব সামাজিক মাধ্যমে মুহুর্তের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে। সেসব নিয়ে জমে উঠে নানা তর্ক-বিতর্কও।
পশ্চিমের এই সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব যে আমাদের সংবাদ মাধ্যমগুলিও সচেতন ভাবে আপন করে নিয়েছে, সেটা এই ঘটনার মাধ্যমে আজ স্পষ্ট। ফলে আদর্শিকভাবে দেশি মিডিয়াগুলোর সঠিক অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ তো হচ্ছেই, সাথে সারা দুনিয়ায় চলমান নানা জাতিগোষ্ঠীর মুক্তি সংগ্রামের লড়াইকে তুচ্ছ করে ক্ষমতার পদলেহন করারও এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। অন্যদিকে মিডিয়া যখন এসব আন্দোলনকে ইসলামোফোবিক জায়গা থেকে দেখে, তখন জেনারেশন টু জেনারেশন এই সব আন্দোলনের ব্যাপারে বাংলাদেশ তথা দুনিয়ার মধ্যশ্রেণীর তরুণদের মধ্যে নিজেদের অজান্তেই একধরণের নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়। কাশ্মির বা আফগানিস্তান বলতেই এরা কেবল বোঝে সুইসাইড স্কোয়াড, ট্যাঙ্কসহ জঙ্গিবাদীদের সাথে মুক্তির পতাকা হাতে পশ্চিমা বাহিনীর গুলোর শান্তি-প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ। এই বিকৃত মনোভাব তো সমাজের জন্য ব্যাপক ক্ষতিকর। এভাবেই তো একটা প্রজন্ম শুধু নিজেদের পক্ষের সব কিছু ভাল আর অপছন্দের সব কিছু ‘জঙ্গি’ এমন মানসিকতা পোষণ করার সুযোগ পাচ্ছে আর মিডিয়া সেটি প্রতিনিয়তই তাঁতিয়ে দিচ্ছে।
স্বাধীনতাকামী জনগণের সংগ্রামের ব্যাপারে আমাদের রাষ্ট্রনীতিতে অনেক ভাল ভাল কথা লেখা থাকলেও একচোখা দৃষ্টিভঙ্গির কারণে আমরা কার্যকর কোন কিছু হাসিল করতে পারছি না। এখনই সময় মিডিয়ার এই একতরফা প্রচারের বাইরে ঘটনা ও ঘটনার পেছনের বিষয়গুলোতে আমাদের সজাগ দৃষ্টি রাখার। তা না হলে এই যুদ্ধের আগুনের আঁচ যখন আমাদের গায়ে লাগবে আমরা ভুল রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে আরও বিপদের দিকে এগিয়ে যেতে থাকব কেবল। কিন্তু তা যেন কোনভাবেই না হয় সেটাই আমরা সবাই চাই।
জবান