কবি ফররুখ আহমদের কী অপরাধ?
খবর পেয়েছি বিনা চিকিত্সায় কবি ফররুখ আহমদের মেয়ে মারা গেছে। এই প্রতিভাধর কবি, যাঁর দানে আমাদের সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে— পয়সার অভাবে তাঁর মেয়েকে ডাক্তার দেখাতে পারেন নি, ওষুধ কিনতে পারেন নি। কবি এখন বেকার। তাঁর মৃত মেয়ের জামাই, যিনি এখন কবির সঙ্গে থাকছেন বলে খবর পেয়েছি তাঁরও চাকুরি নেই।
মেয়ে তো মারাই গেছে। যারা বেঁচে আছেন, কি অভাবে, কোন অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে দিনগুলো অতিবাহিত করছেন, সে খবর আমরা কেউ রাখি নি। হয়ত একদিন সংবাদ পাব, কবি মারা গেছেন, অথবা আত্মহত্যা করেছেন। খবরটা শোনার পর আমাদের কবিতাপ্রেমিক মানুষের কি প্রতিক্রিয়া হবে?
ফররুখ আহমদের মৃত্যু সংবাদে আমরা কি খুশি হব, নাকি ব্যথিত হব? হয়ত ব্যথিতই হব এ কারণে যে, আজকের সমগ্র বাংলা-সাহিত্যে ফররুখ আহমদের মত একজনও শক্তিশালী স্রষ্টা নেই। এমন একজন স্রষ্টাকে অনাহারে রেখে তিলে তিলে মরতে বাধ্য করেছি আমরা।
ভবিষ্যত্ বংশধর আমাদের ক্ষমা করবে না, অথচ কবি ফররুখ আহমদের মরার সমস্ত ব্যবস্থা আমরাই পাকাপোক্ত করে ফেলেছি। আমরা তাঁর চাকরি কেড়ে নিয়েছি, তাঁর জামাই এবং অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনদের সত্ভাবে পরিশ্রম করে বাঁচবার রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছি। রাস্তা-ঘাটে কবির বেরোবার পথ বন্ধ করে দিয়েছি। প্রয়োজনীয় সবগুলো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে আমরা ত্রুটি রাখি নি।
কবি ফররুখ আহমদকে আমরা এতসব লাঞ্ছনার মধ্যে ফেলেছি, তার কারণ তো একমাত্র কবিতাই। ফররুখ আহমদের একমাত্র অপরাধ, তিনি একদা পাকিস্তানের সপক্ষে কবিতা লিখেছেন। তাঁর কবিতার একটি বিশেষ জীবনাদর্শ দুষ্টলোকের ভাষায় ইসলামি জীবনাদর্শ।
এখন কথা হল, তখন কি পাকিস্তানের সপক্ষে কবিতা লেখা অপরাধ ছিল? আমরা যতটুকু জানি পাকিস্তান এবং ইসলাম নিয়ে আজকের বাংলাদেশে লেখেন নি এমন কোন কবি-সাহিত্যিক নেই বললেই চলে। অন্য অনেককে বাদ দিয়েও কবি সুফিয়া কামালের পাকিস্তান এবং জিন্নাহর ওপর নানা সময়ে লেখা কবিতাগুলো জড়ো করে প্রকাশ করলে ‘সঞ্চয়িতা’র মত একখানা গ্রন্থ দাঁড়াবে বলেই আমাদের ধারণা।
অথচ ভাগ্যের কি পরিহাস কবি সুফিয়া কামাল বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি হয়ে মস্কো-ভারত ইত্যাদি দেশ সফর করে বেড়াচ্ছেন, আর ফররুখ আহমদ রুদ্ধদ্বার কক্ষে বসে অপমানের লাঞ্ছনায় মৃত্যুর দিন গুনছেন।
ফররুখ আহমদের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করে বাংলাভাষার সতীত্ব হানি করেছেন। কিন্তু কবি ফররুখ আহমদ নিজে বলেছেন, তিনি শব্দ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, কবিতার ক্ষেত্রে তা নিশ্চয়ই দোষনীয় নয়। বিশেষত বাংলাদশে এমন একটা সময় ছিল, কবি-সাহিত্যিকেরা উর্দু, ফারসি ঘেঁষা দেখাতে পারলে বর্তে যেতেন। তাদের অনেকেই এখন বাংলাদেশ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন রয়েছেন।
তাছাড়া ইংরেজি, জার্মান, সংস্কৃত ইত্যাদি ভাষা নিয়ে যাঁরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কবিতা, গল্প লিখতে চেষ্টা করেছেন, তাঁদেরকে সে সকল রচনার জন্য পুরস্কৃত করতেও আমাদের বাধছে না। ও সমস্তের ফলে যে বাংলাভাষা সমৃদ্ধ হচ্ছে সত্যিকার অর্থে সে বিচার কে করবে? অথচ অন্য কবি-সাহিত্যিক সকলে বাইরে রয়েছেন। কিন্তু শাস্তি ভোগ করছেন একা ফররুখ আহমদ—এ কেমন ধারা বিচার?
ফররুখ আহমদের বিরুদ্ধে যে দু’টি উল্লেখযোগ্য নালিশ রয়েছে, সেগুলো হল— তিনি রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে চল্লিশজন স্বাক্ষরকারীর একজন।
তিনি স্বশ্রদ্ধভাবে পাকিস্তানকে সমর্থন করেছেন। কিন্তু স্বাক্ষরদানকারী চল্লিশজনের অনেকেই তো এখনও বাংলাদেশ সরকারের বড় বড় পদগুলো অলংকৃত করে রয়েছেন। কিন্তু ফররুখ আহমদকে একা কেন শাস্তি ভোগ করতে হবে? পাকিস্তানের সমর্থক ছিলেন না কে?
আজকের বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী (শেখ মুজিব) স্বয়ং তো এক সময়ে পাকিস্তান আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। সাতই মার্চের পূর্ব পর্যন্ত তিনি পাশাপাশি জয়-বাংলা এবং জয়-পাকিস্তান শব্দ দু’টো উচ্চারণ করেছিলেন, তাহলে ফররুখ আহমদের অপরাধটা কোথায়? বলা হয়ে থাকে, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তিনি অনেকবেশি সাম্প্রদায়িক বিষোদগার করেছিলেন।
সেপ্টেম্বরের যুদ্ধের সমস্ত প্রমাণ এখনও নষ্ট হয়ে যায় নি। বাংলাদেশের সমস্ত লেখক-কবি-সাহিত্যিক সাম্প্রদায়িকতার প্রচারে কে কার চাইতে বেশি যেতে পারেন, সে প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন। কেউ যদি চ্যালেঞ্জ করেন আমরা দেখিয়ে দিতে পারি।
মানুষের স্মৃতি এত দুর্বল নয় যে, হিং টিং ছট ইত্যাদি প্রোগামগুলো ভুলে গেছে। ঐ সমস্ত প্রোগ্রাম যারা করেছে সংস্কৃতির সে সকল কলমধারী গুন্ডারা বাংলাদেশে বুক চিতিয়ে শিক্ষা-সংস্কৃতির আসন দখল করে আছে— কি আশ্চর্য। চাকরি হারাবেন, না-খেতে পেয়ে মারা যাবেন এক ফররুখ আহমদ।
এতসব দোষের মধ্যেও ফররুখ আহমদের কতিপয় গুণের কথা আমরা না-উল্লেখ করে পারছিনে। সেপ্টেম্বর যুদ্ধের পরে কবি ফররুখ আহমদকে যখন প্রাইড অব পারফরমেন্স দেয়ার কথা ওঠে, তিনি অস্বীকার করেছিলেন। আমরা শুনেছিলম, তিনি বলেছিলেন, একজন কবির ক্ষমতাদর্পীর হাত থেকে নেয়ার কিছুই নেই।
খবর পেয়েছিলাম, সে প্রাইড অব পারফরমেন্স এমন একজন সাহিত্যসেবীকে দেয়া হয়েছিল এখন যত্রতত্র তাঁর শোকসভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
সরকারি-বেসরকারি দলের সকলে তাঁর কথা মনে করে শোকাশ্রু বর্ষণ করছেন। মজার কথা হল, তিনিও দখলদার পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা বাধ্য হয়ে পাকিস্তানের সপক্ষে বক্তব্য রেখেছিলেন। যাকে নিয়ে এত লাফালাফি তিনি যদি বেঁচে থাকতেন আজ হয়ত কারাগারেই থাকতেন।
আমাদের কথা হল, ফররুখ আহমদের মত একজন শক্তিমান স্রষ্টার চাকরি কেড়ে নেয়া, সপরিবারে তাঁকে মৃত্যু-যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করার পেছনে ন্যায়-নীতিসঙ্গত যুক্তিটা কি হতে পারে?
আমরা বাংলাদেশের আরো একজন খ্যাতনামা কবির কথা জানি (কবি শামসুর রাহমান)। যিনি পাকিস্তানি দখলদার সৈন্যদের তত্ত্বাবধানে সর্বাধিক প্রচারিত বাংলা দৈনিকটির (দৈনিক পাকিস্তান) সম্পাদকীয় রচনা করেছিলেন। ঐ পত্রিকার চাকরি করেন আর একজন কবি সম্পর্কে কানা-ঘুষা শোনা যাচ্ছে যে, তিনি পাকিস্তানি মেজর ক্যাপটেনদের সাহায্যে নাম ভাঙ্গিয়ে লাহোর করাচি ছুটোছুটি করেছেন। কেউ যদি আমাদের বক্তব্যকে অসত্য মনে করেন, বাস্তব প্রমাণ দাখিল করতে পারব।
উৎসঃ আওয়ার ইসলাম