এ কেমন যুক্তফ্রন্ট, এ কেমন আন্দোলন? বাংলাদেশে রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীদের হাল হকিকত।
নিউইয়র্ক থেকে ড ওমর ফারুক।
তারিখঃ ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮।।
তারা ঘুরেফিরে একই গান গেয়ে যায়, ‘আমাদের আন্দোলন কোন সরকারের বিরুদ্ধে নয়। কাউকে ক্ষমতায় আনতে নয়।’ তাদের কাউকে ক্ষমতায় আনার সেই সামর্থ কী তাদের আদৌ আছে? পাশ্চাত্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় কাউকে ক্ষমতায় আনতে পারে জনগণই। তারা কে? তাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হচ্ছে মূলত ফ্যাসিবাদী একটি শক্তির বিরুদ্ধে এবং একটি নিরপেক্ষ প্রশাসনের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্যই। অন্য কিছু নয়। তারা ঘুরেফিরে আরেকটি গতবাঁধা কথা বলে বেড়ায়। তারা রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন চায়।কি গুণগত পরিবর্তন তারা চায়, সেও ত নির্ধারণ হবে সংসদে। জনগণ কর্তৃক ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধি’রা সংসদে যাবে এবং তারা নির্ধারণ করবে। বৈধ সাংসদদের দ্বারা সে গুণগত মান নির্ধারণ হবে। তারা এক গণ্ডা বা দেড় গণ্ডা মানুষ আমাদের যে কী বুঝাতে চায়, কী পণ্ডিতি দেখাতে চায়, আমার বোধগম্য নয়। রাজনীতির গুণগত মান পরিবর্তন ত তখন হবে, যখন রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন পেশাজীবী তথা গোটা নাগরিক সমাজ নিজেদের চরিত্রের গুনগত পরিবর্তন আনবে, তখন। তারা যা বলে বেড়ায়, এগুলোর মাথা মুণ্ডু আমি কিছুই বুঝি না। মানুষ ভোটাধিকার পায় না এ জন সমর্থনহীন সরকারের অধীনে। এ সরকার পাশের দেশের ওপর মুখ গোল করে তাকিয়ে থাকে, সরকার প্রধান সে দেশে গিয়ে বলে আসে, আমাকে যদি ক্ষমতায় না আনতে পার, বাংলাদেশও পাকিস্তান হবে। তাহলে সে সরকারের বিরুদ্ধে নাকি কামাল, জামাল, কাদের, মান্না ও চৌধুরী সাবরা কথা বলবেন না। হাসি পায়, এমন সব বিনোদনমূলক রাজনীতিকদের বচন শুনে। আরও একটি কথা, বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা, তারে নিয়ে ফ্রন্ট কথা বলবে না। বাহ্ কি চমৎকার। তিনি গায়ের জোরে জনসমর্থিত ও জননন্দিত নেত্রী হন নি। নিরপেক্ষ নির্বাচনে এবং সে নির্বাচনগুলো হাসিনা ও তখনকার হাসিনার বান্ধব বিরোধীদল জামায়াতসহ বিভিন্ন বিরোধী দলের গ্রাহ্য ও সমর্থিত নীতিমালায় ও এমন কি তাদের প্রদত্ত নিরপেক্ষ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ফর্মূলায়ও, তিন তিনবার বিপুল ভোটে বিজয়ী প্রধানমন্ত্রী খালেদা’কে রাজনৈতিক কারণে জেলে পুরে রাখা যে হয়েছে, সে এখন সর্বজনবিদিত। সেই খালেদা’কে জেলে রেখে তাঁরা আন্দোলন করবে এবং দেশে বুঝি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারবে, এটা পৃথিবীর সব মানবকুল বিশ্বাস করলেও আমি করতে পারি না। আরও বলি, ধরুন ‘বা.আ.ল’ বা BAL প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী (রহ) যদি এখন বেঁচে থাকতেন এবং এসব মানব,কাক ও পক্ষীকুল নিয়ে যদি ফ্রন্ট বা এমন কোন এ রকম ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতেন, তাহলে তাঁর প্রথম দফা হত, রাজনৈতিক কারণে ডাহা ও কাল্পনিক অজস্র মিথ্যা মামলায় আটক ও নিরীহ বিরোধীদলীয় নেতার মুক্তি, দুই নম্বর বক্তব্য থাকত, গুমের রাজ্যে যাদের তিনি পাঠিয়েছেন, তাদের উদ্ধার করার দাবী, তিন নম্বর থাকত, দেশব্যাপী এখনও নিরীহ মানুষ যখন তখন গুম, গ্রেফতার, মিথ্যা মামলা উৎসব, জলের মত যাকে তাকে রিমান্ড, সম্প্রতি গড়ে ওঠা ন্যায় ও সুশাসনের দাবীতে কিশোর আন্দোলনে নির্যাতন, গ্রেফতার, রিমান্ড, জেল, হত্যা, ধর্ষণ, গুজব বলে প্রচার করে আড়ালের চেষ্টা এমন ইত্যাকার বিষয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত দাবী, এরপর কথা আসত, রাজনৈতিক সকল বন্দীদের মুক্তি এবং সরকারকে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে অবৈধ ও জনসমর্থনহীন সরকারকে বাধ্য করা।সে সবের কিছুই যখন দেখি না। তখন আমি নয়, দেশের সচেতন তথা সত্যিকার সুশীল সমাজের নাগরিকরা নির্বাক!
কাক, বক, চড়ুই পাখি আর টিয়া পাখির সাথে জোট করে লাভ নেই। সমীকরণ বড় জটিল । নির্বাচন যদি সঠিক হয় তাহলে জিততে বুঝি আবার আগের জোটের বাইরেও অন্য পক্ষীকুল মিলানো লাগে ?!ভোট যদি ঠিকমত হয়, তাহলে তো আপনাদের যে ভোট আছে, সেই ভোট কাস্ট করেই কূল পাবেন না ।চড়ুই আর টিয়া পাখি দরকার কেন হল !!তাও কঠিন শর্তের বেড়াজালে !? বুঝে দেখুন । বিএনপি জামায়াত জোট এ রকমই থাকুন । মুসলমান থাকুন । সেকুলার হয়ে পরকাল হারাতে যাবেন না । আমাদের দাওয়াত পৌঁছানো দরকার, পৌঁছালাম। শুনা না শুনা আপনাদের দায়িত্ব ।
প্রসঙ্গঃ বাংলাদেশের তথাকথিত রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবী এবং মহাজ্ঞানী সক্রেটিসের মহাপ্রয়ান।।
সক্রেটিসের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে ঠিক যেদিন, সেদিন সন্ধ্যায়। তখনকার নিয়ম অনুযায়ী পরিবারের সবাই এবং একান্ত শিষ্যরা তার চারপাশ ঘিরে আছেন। কারাগারের অন্ধকার ঘর। প্রধান কারারক্ষী এসে শেষ বিদায় নিয়ে গেলেন। তার চোখেও অশ্রু টলমল করছে। হায়, কি অদ্ভুত শাস্তি! যে মরবে সে ধীরস্থির, শান্ত। আর যে মারবে তার চোখে জল।
কারাগার প্রধান বললেন, ‘এথেন্সের হে মহান সন্তান, আপনি আমায় অভিশাপ দেবেন না। আমি দায়িত্ব পালন করছি মাত্র। এত বছর কারাগারে কাজ করতে গিয়ে আপনার মত সাহসী, সৎ এবং জ্ঞানী কাউকে আমি দেখিনি।’ মৃত্যুর ঠিক আগে সক্রেটিস তার পরিবারের নারী ও শিশুদের চলে যেতে বললেন। সুন্দর পোষাক পরলেন তিনি। শিষ্যরা সবাই কাঁদছে, কিন্তু সক্রেটিস যেন বেপরোয়া। মৃত্যুতে কি কিছুই যায়-আসে না তার? মৃত্যুদণ্ডটা চাইলেই তিনি এড়িয়ে যেতে পারতেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, দেবতাদের প্রতি ভিন্নমত প্রকাশ, রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র এবং তরুণদের বিপদগামী হতে উৎসাহ প্রদান।
নিয়ম অনুযায়ী খোলা মাঠে তার বিচার বসেছিল।বিচারক ছিলেন সমাজের ৫০০ জন জ্ঞানী মানুষ। এদের অনেকেই ছিলেন গ্রীসের রাজার একান্ত অনুগত। সক্রেটিসের মেধা এবং বিশেষত তরুণদের কাছে তার জনপ্রিয়তায় জ্বলন ছিল তাদের। সক্রেটিসকে খতম করার এমন সুযোগ তারা ছাড়বে কেন! তবুও হয়ত প্রাণে বেঁচে যেতেন সক্রেটিস। কিন্তু কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েও বিচারকদের নিয়ে উপহাস করতে ভুললেন না। ফলাফল ‘হ্যামলক বিষপানে মৃত্যু’। মৃত্যুর আগে এক মাস কারাগারে বন্দী ছিলেন তিনি। নিয়ম ছিল এমন। এই একমাসে কারারক্ষীরাও তার জ্ঞানে মুগ্ধ হয়ে গেল। তারা তাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করতে চাইল।সক্রেটিস বিনয়ের সাথে না করে দিলেন। বললেন ‘আজ পালিয়ে গেলে ইতিহাস আমায় কাপুরুষ ভাববে’। তিনি পৌরুষের সাথে মৃত্যুকে অপমানের জীবনের চাইতে শ্রেষ্ঠ বলে মানলেন। ঐ সন্ধ্যায় প্রধান কারারক্ষী চলে যাওয়ার পর জল্লাদ এলো পেয়ালা হাতে। পেয়ালা ভর্তি হ্যামলকের বিষ। সক্রেটিস জল্লাদকে বললেন ‘কি করতে হবে আমায় বলে দাও। তুমি আমার চাইতে ভাল জান।’ জল্লাদ বলল, ‘পেয়ালার পুরোটা বিষ পান করতে হবে, এক ফোটাও নষ্ট করা যাবে না।’ সক্রেটিস বললেন, ‘তবে তাই হোক’। তিক্ত বিষের পুরো পেয়ালা তিনি পানির মত করে পান করে ফেললেন। চারপাশে বসে থাকা শিষ্যরা চিৎকার করে কাঁদছেন। এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না কেউ। তখন জল্লাদ আরও কঠোর নির্দেশটি দিয়ে বলল, ‘নিয়মানুযায়ী আপনাকে এখন কিছুক্ষণ পায়চারী করতে হবে, যাতে বিষের প্রভাব পুরোটা শরীরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়িতে পারে’। হায় হায় করে উঠলেন সবাই। শুধু ম্লান হাসলেন সক্রেটিস। বললেন ‘আজীবন আইন মেনেছি, মৃত্যুতে আইন ভাঙব কেন’? দুর্বল পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটলেন কিছুক্ষণ, যতক্ষণ তার শক্তিতে কুলোয়। এরপর বিছানায় এলিয়ে পড়লেন। শিষ্যদের বললেন ‘তোমরা উচ্চস্বরে কেঁদ না, আমায় শান্তিতে মরতে দাও’। জল্লাদের পাষাণ মনেও তখন শ্রদ্ধার ভাব।বিনয়ে আর লজ্জায় মাথা নামিয়ে নিল সে। চাদর দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে নিলেন সক্রেটিস। একবার চাদরটা সরালেন। একজন শিষ্যকে ডেকে বললেন, ‘প্রতিবেশির কাছ থেকে একটা মুরগী ধার করেছিলাম আমি, ওটা ফেরত দিয়ে দিও’। এই ছিল তার শেষ কথা। ক্ষণিক পরই নিশ্চিত মৃত্যুর কোলে চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেলেন মহাজ্ঞানী সক্রেটিস।
তার শিষ্যদের মাঝে সেরা ছিলেন প্লেটো। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের এ ঘটনাগুলো প্লেটো লিখে রেখে গেছেন। প্লেটোর শিষ্য ছিলেন মহাজ্ঞানী এ্যারিষ্টটল, সর্বকালের জ্ঞানী মানুষের উপরের সারির একজন। মহাবীর আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেটের নাম আমরা সবাই জানি। এই বিশ্বজয়ী আলেকজান্ডারের শিক্ষক ছিলেন এ্যারিষ্টটল। প্রহসনের বিচারে সক্রেটিসের মৃত্যু হয়েছে ঠিকই কিন্তু মৃত্যু তাকে মারতে পারেনি। শিষ্যদের মাঝে জ্ঞানের আলো দিয়ে বেঁচে রইবেন তিনি অনন্তকাল। সত্য প্রকাশে যারাই লড়বে, একাত্তুর বছর বয়সে মৃত ‘সক্রেটিস’ তাদের কাছে উৎসাহের এক নাম হয়েই রইবে। [সক্রেটিস সংক্রান্ত বিষয়টি অনলাইন থেকে মূল বিষয় সংগৃহিত এবং সম্পাদি ও পরিবর্দ্ধিত।]
ড ওমর ফারুকঃ যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী শিক্ষাবিদ, লেখক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। ইংরেজি সাপ্তাহিক ঢাকা পোস্ট সম্পাদক, অনলাইন পোর্টাল ডেইলি ঢাকা পোস্ট চিফ এডিটর এবং নিহাল পাবলিকেশনের স্বত্ত্বাধিকারী। প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যাঃ প্রায় ত্রিশটির বেশি।]