এবার স্যাটেলাইটের ছবি প্রকাশ।। ২৮৮ রোহিঙ্গা গ্রাম পোড়ানোর প্রমাণঃ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ

October 21, 2017 1:05 am0 commentsViews: 28

ড. ওমর ফারুক।। নিউইয়র্ক, তারিখঃ ২১ অক্টোবর ২০১৭।

মাত্র এক মাসের মধ্যে ২৮৮টি রোহিঙ্গা গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়ার প্রমাণ পাওয়ার তথ্য দিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন।  হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) নামে বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত এ মানবাধিকার সংগঠনটি বলেছে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযান শুরুর পর এখন পর্যন্ত  প্রায় তিন শটি রোহিঙ্গাদের গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়ার তথ্য  প্রমাণ পাওয়ার গিয়েছে। স্যাটেলাইট ছবি বিশ্লেষণ করে ওই মানবাধিকার সংস্থাটি বলেছে, গত ২৫ অগাস্ট হতে ২৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ওইসব গ্রামের হাজার হাজার বাড়ি আংশিক কিংবা পুরোপুরি ভষ্মীভূত হয়েছে, যে বাড়িঘরগুলোর বাসিন্দা ছিলেন মূলত রোহিঙ্গা মুসলমানরা।

গত ১৮ অক্টোবার (মঙ্গলবার) এইচআরডব্লিউর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কৃত্রিম উপগ্রহ হতে পাওয়া ছবি বিশ্লেষণ করে দুটি বিষয় তাদের কাছে স্পষ্ট হয়। একটি হল প্রথমত, সেনা অভিযানের মধ্যে এই জ্বালাও-পোড়াওয়ের মূল লক্ষ্যই ছিল রোহিঙ্গাদের গ্রাম। স্যাটেলাইট ছবিতে এমন অনেক স্থান দেখা গেছে, যেখানে রোহিঙ্গা গ্রামের ধ্বংসাবশেষের পাশেই রাখাইনের বৌদ্ধদের গ্রাম রয়েছে পুরোপুরি অক্ষত।

আর দ্বিতীয়ত, মিয়ানমার সরকার সেনা অভিযান বন্ধ হয়েছে বলে দাবি করলেও তারপরও নতুন নতুন গ্রাম জ্বলতে দেখা গেছে স্যাটেলাইটের এ ছবিতে।

মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি আন্তর্জাতিক চাপের মুখে গত ১৮ আগস্ট প্রথমবারের মত রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে ভাষণ দিতে এসে দাবি করেন যে, ৫ সেপ্টেম্বরের পর রাখাইনে আর কোন দমন অভিযান চালানো হয় নি।

তবে এইচআরডব্লিউ বলেছে যে, ৫ হতে ২৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে অন্তত ৬৬টি গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়ার প্রমাণ তাদের হাতে থাকা স্যাটেলাইট ছবিতেই রয়েছে।

রাখাইনের ৩০টি পুলিশ পোস্ট ও একটি সেনা ক্যাম্পে সমন্বিত হামলার পর ২৫ আগস্ট হতে সেনাবাহিনীর এই দমন অভিযান শুরু হয়, এটিকে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে স্বয়ং জাতিসংঘ।

অপরদিকে মিয়ানমার সরকার ওই হামলার জন্য রোহিঙ্গা গেরিলাদের একটি দলকে দায়ী করছে। সেনাবাহিনীর এই দমন অভিযানকে তারা বলছে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই’!

এইচআরডব্লিউর এশিয়া বিভাগের উপ-পরিচালক ফিল রবার্টসন এক বিবৃতিতে বলেছেন, রাখাইনের সাড়ে ৫ লাখ রোহিঙ্গা মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কেনো পালিয়ে বাংলাদেশে গেছে, ওই স্যাটেলাইট ছবিতেই তা স্পষ্ট হয়েছে।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে “বার্মিজ মিলিটারি শয়ে শয়ে রোহিঙ্গা গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। হত্যা, ধর্ষণসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটিয়েছে তারা। প্রাণ বাঁচাতে রোহিঙ্গারা পালাতে বাধ্য হয়েছে।”

এইচআরডব্লিউর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাখাইনের মংডু, রাথেডং এবং বুচিডং এলাকার স্যাটেলাইট ছবি হতে ৮৬৬টি গ্রামের তথ্য তারা বিশ্লেষণ করে দেখেছেন। তারমধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মংডু এলাকা। ওই এলাকার ৬২ শতাংশ গ্রাম আংশিক কিংবা পুরোপুরি ভষ্মীভূত হয়েছে অভিযানের এই এক মাসের মধ্যে। মংডুর দক্ষিণাঞ্চলে ৯০ শতাংশ গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

খবরে বলা হয়েছে যে, কোনো কোনো স্যাটেলাইট ছবিতে বিভিন্ন এলাকায় একইসঙ্গে আগুন জ্বলার চিহ্নও পাওয়া গেছে। কোনো কোনো এলাকা জ্বলতে দেখা গেছে টানা বেশ কয়েক দিন ধরে।

এইচআরডব্লিউ বলেছে, মিয়ানমার সরকার গ্রামে গ্রামে এই নাশকতার জন্য বিদ্রোহীদের সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) এবং স্থানীয় রোহিঙ্গাদের দায়ী করে এলেও ওই দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ কখনও দেখা যায়নি।

পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া শতাধিক রোহিঙ্গার সাক্ষাতকার নেওয়ার কথা জানিয়ে মানবাধিকার সংস্থাটি আরও বলেছে, হামলা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের পেছনে রোহিঙ্গাদের দায়ী করেননি ওই সাক্ষাৎকারদাতাদের কেওই।

এইচআরডব্লিউর বিবৃতিতে আরও বলা হয়, রোহিঙ্গাদের গ্রামে গ্রামে যে মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটানো হয়েছে, তার নিরপেক্ষ তদন্ত মিয়ানমার সরকার করেনি, এমনকি কাওকে বিচারের মুখোমুখিও করা হয়নি!

এইচআরডব্লিউর বিবৃতিতে বলা হয়, “এই অবস্থায় জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে তারা জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনকে রাখাইনে তদন্ত করার সুযোগ দেন।”

এইচআরডব্লিউর বিবৃতিতে আরও বলা হয়, “সেইসঙ্গে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে মিয়ানমারের ওপর অবিলম্বে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হবে। রাখাইনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের পেছনে মিয়ানমারের যে সেনা কর্মকর্তারা রয়েছেন, তাদের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা এবং সম্পদ জব্দের পদক্ষেপও নিতে হবে। মিয়ানমারের সঙ্গে সব ধরনের সামরিক সহযোগিতাও বন্ধ করতে হবে জাতিসংঘের সদস্য সকল রাষ্ট্রকে।”

এইচআরডব্লিউর এশিয়া বিভাগের উপ-পরিচালক ফিল রবার্টসন বলেছেন, “বার্মায় ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র ও বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে লাখ লাখ মানুষের দুর্দশা একই মুদ্রার দুই পিঠ। রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধের জন্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়াতে হবে, সেইসঙ্গে সবার কাছে যেনো জরুরি সহায়তা পৌঁছায় সেটিও নিশ্চিত করতে হবে সকলকে।”

এদিকে রাখাইন রাজ্যের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করতে তাদের ওপর মিয়ানমার যে মানবতা বিরোধী অপরাধ করেছে তার জোরালো প্রমাণ রয়েছে  বলেছে অভিযোগ করেছে আন্তর্জার্তিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও।

বুধবার এই সঙ্কটের ওপর অ্যামনেস্টি একটি নতুন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর গণহত্যা, ধর্ষণ, নিপীড়ণ ও জোরপূর্বক দেশছাড়া করার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। একই সঙ্গে এ জাতীয় নিপীড়ণ বন্ধ করতে  মিয়ানমারের ওপর অস্ত্র অবরোধ এবং দেশটির উধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে অ্যামনেস্টি।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ, স্যাটেলাইট ছবি, ফটো, ভিডিও এবং অন্যান্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে অ্যামনেস্টি বলছে, ‘এতে উপসংহারে পৌঁছানো যায় যে হাজার হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ এবং শিশু একটি ব্যাপক ও পরিকল্পিত আক্রমণের শিকার হয়েছেন, যা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের সমান।’

বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ১২০ জন রোহিঙ্গা নারী এবং পুরুষের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে বলে অ্যামনেস্টি বলছে।

তবে মানবতার বিরুদ্ধে এসব কথিত অভিযোগের ব্যাপারে মিয়ানমার সরকারের বক্তব্য তাৎক্ষণিকভাবে জানা সম্ভব হয়নি।

এক বিবৃতিতে অ্যামনেস্টি বলছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রোম চুক্তিতে ১১ ধরনের অপরাধকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

রাখাইন রাজ্যের সহিংসতায় এধরনের ছয়টি অপরাধ চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে: খুন, বলপূর্বক নির্বাসন, নির্যাতন, ধর্ষণ, নিপীড়ন এবং অন্যান্য অমানবিক কর্মকাণ্ড। সবচেয়ে নৃশংস অপরাধের প্রত্যক্ষদর্শীরা এসব তৎপরতার জন্য মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পশ্চিমাঞ্চলীয় কমান্ড, ৩৩ লাইট ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন এবং সীমান্তরক্ষা বাহিনীকে দায়ী করেছে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের একজন পরিচালক টিরানা হাসান বলছেন, ‘এই নৃশংস অপরাধের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার পাওয়ার পথে প্রথম ধাপ হচ্ছে এসব অপরাধের কথা ফাঁস করে দেয়া। যারা এসব অপরাধ করেছে তাদের অবশ্যই বিচার করতে হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘আরেকটি ভুয়া অভ্যন্তরীণ তদন্তের নামে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী এসব ঘটনাকে কোনমতেই ধামাচাপা দিতে পারে না’

[আল জাজিরাসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্ট অবলম্বনে]

 

Leave a Reply

You must be logged in to post a comment.

Editor in Chief: Dr. Omar Faruque

Editor: Dr. Morjina Akhter

All contact: 400E Mosholu Parkway South Apt # A23,The Bronx, New York 10458, USA

Mob. 001.347.459.8516
E-mail: dhakapost91@gmail.com