এনআরসি ভারতের নিজস্ব বিষয়, আমাদের ভূমিকা নেইঃ ইনু। ইনু নীরব হলেও আসামের সাংসদ সুস্মিতা দেব সরব।

অসমের নাগরিক তালিকার চূড়ান্ত খসড়া থেকে বাদ পড়েছে প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষের নাম। ছবি: পিটিআই।
এনআরসি নিয়ে ভারতে যে উত্তাপেরই সঞ্চার হোক না কেন, তা যে বাংলাদেশকে সে ভাবে স্পর্শ করছে না, তা স্পষ্ট করে দিলেন সে দেশের তথ্যমন্ত্রী। বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু আনন্দবাজারকে বলেন, ‘‘অসমের অবৈধ অভিবাসী ইস্যুটি ভারতের নিজস্ব। বাংলাদেশ সরকারের এই বিষয়ে কোনও ভূমিকা নেই।’’
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য অসমের নাগরিক তালিকার চূড়ান্ত খসড়া থেকে প্রায় ৪০ লক্ষ লোকের নাম বাদ পড়ার পরে এই নিয়ে আলাপচারিতায় হাসানুল দাবি করেন, গত ৪৮ বছরে বাংলাদেশ থেকে ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলিতে কোনও বাংলাদেশি নাগরিক প্রবেশ করেছে এমন তথ্য দিল্লি সরকার বাংলাদেশকে জানায়নি। এমনকি, ভারতীয় কোনও সংবাদমাধ্যমেও এমন সংবাদ প্রকাশিত হয়নি। অসমে পঞ্জি থেকে আপাতত বাদ পড়া ৪০ লক্ষ বাঙালিকে ঘিরে যে সমস্যা, সেটি বাংলাদেশ কী ভাবে দেখছে? হাসানুল হক ইনু জানালেন, ভারতে অবস্থানরত ধর্মীয় এবং জাতিগত সংখ্যালঘুদের বিষয়ে মোদী সরকার যে নীতি অনুসরণ করে তাতে অসমের এই সমস্যার সমাধানে দিল্লিই যথেষ্ট, এখানে বাংলাদেশের কোনও ভূমিকা নেই। বাংলাদেশ এ ব্যাপারে কী অবস্থান নেবে? এই প্রসঙ্গে তথ্যমন্ত্রী বলেন, এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এর সঙ্গে বাংলাদেশের কোনও সম্পর্ক নেই। এই বিষয়ে এখন আমাদের কোনও মন্তব্যও নেই। আমরা আলোচনার সূত্রপাত করব না।’’ বাংলাদেশের মন্ত্রী অসমের বিষয়টিকে শতাব্দী প্রাচীন বলে উল্লেখ করেন। এই ঘটনার প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে কি? এমন আশঙ্কার উত্তরে মন্ত্রী জানালেন, অসমের উদ্ভূত পরিস্থিতি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের মাঝে কোনও ভাবেই প্রভাব বিস্তার করবে না।
অসম-মেঘালয় সীমান্তে মার খাচ্ছে বাঙালিরা, সংসদে সরব সুস্মিতা দেবঃ
এদিকে ভারতীয় সংবাদ সংস্থা বলছে, আসামের সাংসদ বাঙালি তাাড়নোর এ পদক্ষেপে র বিরুদ্ধে সংসদে সোচ্চার।
এদিকে নাগরিক পঞ্জি-র খসড়া প্রকাশের পর থেকেই বাঙালিদের চিহ্নিত করে মারা হচ্ছে অসম-মেঘালয় সীমান্তে। গত ১ আগস্ট, বুধবার সংসদে এই অভিযোগ করেন অসমের সাংসদ সুস্মিতা দেব। এই এলাকার বাঙালিদের নিরাপত্তার দাবিতে আজ চিৎকার করতে করতে সংসদের ওয়েলেও নেমে আসেন শিলচরের কংগ্রেস সাংসদ। সেদিন অধিবেশন শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই সরব হন সুস্মিতা দেব। তাঁর অভিযোগ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ এবং বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ শুধুই মৌখিক ভাষণে ব্যস্ত। তাতে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। উল্টে মার খাচ্ছেন বাঙালিরা। নাগরিক পঞ্জি-র খসড়া তালিকায় নাম না থাকা চল্লিশ লক্ষ বাঙালির অবিলম্বে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হোক, এই দাবি করেছেন তিনি। অসমের শিলচরের বাঙালি অধ্যুষিত এলাকার সাংসদ সুস্মিতা দেব। তাঁর অভিযোগ, নাগরিক পঞ্জি প্রকাশের সময় পর্যাপ্ত স্ক্রুটিনি করা হয়নি। এই দায়িত্বজ্ঞানহীনতার জন্যই আজ চারিদিকে দিশেহারা পরিস্থিতি।
গুয়াহাটির হাজার হাজার বাঙালির চোখে নাগরিক-আশঙ্কাঃ

জাতীয় নাগরিক পঞ্জিতে নাম ওঠেনি অসংখ্য সাধারণ মানুষের।
বছর তেত্রিশের কার্তিক পালের স্টিলের বাসনপত্রের ছোট্ট দোকানটা লালগণেশে রাস্তার উপরেই। পূর্ব গুয়াহাটির এই এলাকায় বাংলাভাষী মানুষের সংখ্যাটাই বেশি। বুধবার সকালে নাগরিক পঞ্জিকরণের কথা জিজ্ঞাসা করতেই, কার্তিকের নিরীহ মুখটা আরও বেশি কুঁকড়ে গেল। উল্টো দিকের দশকর্মা ভাণ্ডারের মালিক অভিজিৎ চক্রবর্তীর অভয় পেয়ে কার্তিক স্বীকার করেন যে এ বারের তালিকাতেও তাঁর নাম নেই।
জানা গেল, শুধু কার্তিক নয়, তাঁর পরিবারের কারওরই এই নাগরিক পঞ্জিতে নাম ওঠেনি। দোকানের উল্টো দিকের গলিতেই বাড়ি কার্তিকের। তাঁর পরিবারের বাকিদের সঙ্গে কথা বলার জন্য বাড়ি যেতে চাইলে প্রথমে রাজি হচ্ছিলেন না তিনি। শেষে প্রায় জোর করেই তাঁকে নিয়ে তাঁর বাড়িতে পৌঁছলাম।

সস্ত্রীক কার্তিক পাল।
গোবেচারা মুখেই কার্তিক বার বার অনুরোধ করছিলেন, তাঁর নাম যেন না লেখা হয়। খানিকটা অবাক হয়েই জিজ্ঞাসা করলাম, তাঁর এত আতঙ্কের কারণ কী? প্রায় দু’কাঠা জমির ওপর পুরনো অসম ছাঁদের টিনের চালের নিজের বাড়ি। সেই বাড়িতে বসেও স্বস্তিতে নেই কার্তিক। পরে অবশ্য কার্তিক তাঁর নাম দেওয়া বা ছবি তোলায় আপত্তি করেননি। আতঙ্কের কিছুটা কারণ জানা গেল তাঁরই পরশি দোলন দে-র কাছ থেকে। তাঁর নাম তালিকাভুক্ত হলেও স্ত্রী এখনকার সরকারি তালিকা অনুসারে নাগরিক নন। দোলন স্পষ্ট বলে দেন, তাঁর স্ত্রীর নাম বা ছবি দেওয়া যাবে না। তাঁর কথাতেও আতঙ্কের সুর: “এই এনআরসি লিস্ট বের করার পর থেকেই পড়শি মেঘালয়ে বাঙালিদের ওপর ব্যাপক উৎপাত চালাচ্ছে ওখানকার খাসি সংগঠনগুলি।” লালগণেশ, কালাপাহাড়, কলোনি বাজার, মালিগাঁও, আদাবাড়ি, পাণ্ডুর মতো গুয়াহাটি শহরের বাঙালি বসতিগুলিতে সব জায়গাতেই ছোট ছোট জটলা।
পুরনো বাসিন্দারা অনেকেই সেই সত্তরের দশকের শেষ ভাগের আসাম গণ পরিষদের অসম আন্দোলনের ভূত দেখছেন। উজ্জ্বল তখন কলেজ ছাত্র। তিনি এখনও মনে করতে পারেন, “এই পাণ্ডু বাজারের রাস্তাতেই যেখানে আপনি দাড়িয়ে আছেন, সেখানে আমার দাদার সারা দেহ ব্লেড দিয়ে চিরে ফেলে দিয়ে গিয়েছিল আন্দোলনকারীরা।” তিনি যদিও স্বীকার করেন অসমের পরিস্থিতি এখনও ওই রকম খারাপ নয়। তিনি বলেন, “এই এনআরসি প্রকাশ হওয়ার পর দিনই মেঘালয়ে বাঙালিদের ওপর অত্যাচার করা শুরু করে দিয়েছে খাসি বিভিন্ন সংগঠন।” তাঁর কাছ থেকেই জানা গেল, মঙ্গলবার গুয়াহাটি-শিলং রোড বা শিলং-শিলচর রোডে গুয়াহাটি থেকে যাওয়া এবং শিলচরের দিক থেকে আসা সব গাড়ি থামিয়ে তল্লাশি চালিয়েছে খাসি স্টুডেন্ট ইউনিয়ন। এই সড়কই বরাক উপত্যকার সঙ্গে বা ত্রিপুরার সঙ্গে গুয়াহাটির যোগাযোগের লাইফলাইন। এই রাস্তায় চলা দূরপাল্লার গাড়িতে প্রচুর বাংলাভাষী মানুষ যাতায়াত করেন। তাঁদের গাড়ি দাঁড় করিয়ে খাসি সংগঠনগুলি এনআরসি দেখতে চায়। বেশ কিছু যাত্রীকে ব্যাপক মারধর করা হয়েছে বলেও অভিযোগ।
অসমে কয়েক হাজার বাঙালি পরিবার অশনি সঙ্কেত দেখছেন।
সেই ঘটনার সূত্র ধরেই উজ্জ্বল বা শহরের আরও একটি বাঙালি প্রধান এলাকা ওদালবাকড়ার বাসিন্দা অভিজিৎ চক্রবর্তীর মতো হাজার হাজার বাংলাভাষী মানুষের মনে তৈরি হচ্ছে আশঙ্কার কালো মেঘ। আর তখনই মনে পড়ল, সকালে কথা বলা কার্তিক বা দোলনের মতো নেহাত ছাপোষা মানুষদের কথা। দোলন বলেছিল, “এনআরসি-তে নাম না থাকলে সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাব না, সেটা মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু সেখানেই কি শেষ? এর পর তো রাস্তাঘাটে বেরোতে গেলেই নাগরিক পঞ্জির সার্টিফিকেট চাইবে। শুধু এখানে নয়, যখন অন্য রাজ্যে যাব, তখন তো হোটেলেও থাকতে গেলে সেই সার্টিফিকেটই লাগবে।’’ দোলনের কথা অকাট্য।
ভয় ও আশঙ্কার মেঘ সরছে না নিতাই ঘোষের মুখ থেকে।
শুধু গুয়াহাটি শহরের মধ্যেই থাকা কয়েক হাজার বাঙালি যখন অশনি সঙ্কেত দেখছেন, তখন গ্রামেগঞ্জে থাকা কয়েক লাখ মানুষ, যাঁদের নাগরিক পঞ্জিতে নাম নেই, তাঁদের ভয়টা আরও বেশি। তাঁদের ভয় ডিটেনসন ক্যাম্প। সারা রাজ্য জুড়ে তৈরি হয়েছে ছ’টি এমন ক্যাম্প। যে সমস্ত ব্যক্তির পরিচয় বা নাগরিকত্ব নিয়ে সংশয় তৈরি হচ্ছে তাঁদের নামের আগে যুক্ত হচ্ছে ‘ডাউটফুল’ বা সন্দেহজনক। আর তার পরই ইচ্ছে করলে সরকার চালান করে দিতে পারে সেই ক্যাম্পে। নামনি অসমের বরপেটা, গোয়ালপাড়া, ধুবুড়ির মতো জেলাতে থাকা মানুষদের দাবি, সরকার যতই ক্যাম্প বলুক না কেন, এগুলো আসলে সব জেলখানা। কড়া পুলিশি পাহারায় থাকা ক্যাম্পে চালান হয়ে গেলে ফেরা কঠিন, এটা তাঁরা জানেন।
‘বাঙালি খেদাও’-এর ইতিহাস আর ডিটেনসন ক্যাম্পের জোড়া আশঙ্কাই এখন ‘নাগরিক’ না হতে পারা বঙ্গসন্তানদের রোজকার সঙ্গী এই ব্রহ্মপুত্র পারে।