এত অল্প সময়ে ৫৭ সেনাকর্তা নিহতের ঘটনা বিরল
বেঞ্চের নেতৃত্বদানকারী বিচারপতি মো. শওকত হোসেন গতকাল সকাল ১০টা ৫৫ মিনিটে রায় ঘোষণা শুরু করেন। তার অল্প কিছু পর্যবেক্ষণ দেওয়ার পরই বেঞ্চের অপর সদস্য বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী তার পর্যবেক্ষণ দেওয়া শুরু করেন। গতকাল বিকাল পর্যন্ত তিনিই পর্যবেক্ষণ দেন। আজ সকালে বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার তার অল্প কিছু পর্যবেক্ষণ ঘোষণা করবেন। এর পরই রায়ের মূল অংশ (কার কী সাজা হবে সেই অংশ) ঘোষণা শুরু হবে। আজই এ রায় ঘোষণা শেষ হবে বলে আদালত জানিয়েছেন। রায়ে বিচারপতিদের ভিন্ন ভিন্ন পর্যবেক্ষণ থাকলেও মূল রায় সর্বসম্মতিক্রমে হবে বলে জানানো হয়।
বিচারপতি মো. শওকত হোসেন তার পর্যবেক্ষণে বলেন, পিলখানায় হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে দেশে একটা ভয়াবহ ও ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ওইদিন ৫৭ জন মেধাবী সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যা করা হয়। এমনকি বিডিআর (বিজিবি) মহাপরিচালকের স্ত্রীকেও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ও এত সংখ্যক সেনা কর্মকর্তা নিহত হয়নি। এটি ছিল নির্বিচারে হত্যা (মাস কিলিং)। ওই দিন দেশের সূর্যসন্তানদের হত্যা করা হয়। তাদের বিদেহী আত্মার প্রতি গভীর শোক ও সমবেদনা জানাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশের বিচার বিভাগের জন্য এটি একটি ঐতিহাসিক মামলা। এ মামলার বিচারকালে বেশ কিছু আইনগত প্রশ্ন ওঠে। আপিল বিভাগে রাষ্ট্রপতি রেফারেন্স পাঠান। আপিল বিভাগের সিদ্ধান্তের পর বিচার শুরু হয়। এ মামলায় আমরা ৩৭০ কার্যদিবস শুনানি গ্রহণ করেছি। ৮৫০ জন আসামির মধ্যে পলাতক ছাড়া বাকিরা এ রায় শোনার জন্য অপেক্ষা করছে। পাশাপাশি দেশের অনেকেই এ রায় জানতে চান। কেউ কেউ নির্ঘুম রাত কাটাবে। তাই আমাদের দায়বদ্ধতা আছে। এটি অনেক বড় রায়। আমরা একটা ভালো রায় দেওয়ার চেষ্টা করছি। তাই একটু ধৈর্য ধরতে হবে। রায়ে আমাদের আলাদা আলাদা পর্যবেক্ষণ থাকতে পারে। তবে গন্তব্য এক। রায়ের আদেশের অংশের বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী বলেন, ‘এত অল্প সময়ে এক সঙ্গে ৫৭ সেনা কর্মকর্তা নিহত হওয়ার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এ নজির কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। মহান মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে মোট ৫৫ জন সেনা কর্মকর্তা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছিলেন।’
পর্যবেক্ষণে তিনি বলেন, ‘আফ্রিকার রুয়ান্ডা ও কঙ্গোর গৃহযুদ্ধে ১৭ জন সেনা কর্মকর্তা নিহত হওয়ার নজির আছে। দক্ষিণ ফিলিপাইনের এক বিদ্রোহে ছয় সেনা কর্মকর্তা নিহত হয়েছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বাধিক সেনা কর্মকর্তা নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছিল ইন্দোনেশিয়ায়। সেখানে ১৯৬৭ সালে চীনপন্থি কমিউনিস্টদের সমর্থনে সংঘটিত সাত দিনের বিদ্রোহে ১০০ সেনা কর্মকর্তা নিহত হয়েছিল। আর পিলখানার ঘটনা তাকেও হার মানায়। ২০০৯ সালে মাত্র ৩০ ঘণ্টার বিদ্রোহে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যার ঘটনা ছিল অবর্ণনীয় বর্বরোচিত এবং নজিরবিহীন।’
বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী রায়ের পর্যবেক্ষণে আরও বলেন, পিলখানা ট্র্যাজেডি ও বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা পূর্বাপর আলোচনা ও পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয়, রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা বিঘেœর লক্ষ্যে একটি স্বার্থান্বেষী মহলের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত বাহিনীকে ধ্বংসের চক্রান্ত করে। সেই চক্রান্তকে রুখে দেওয়ার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাষ্ট্রনায়কোচিতভাবে গৃহীত দৃঢ় পদক্ষেপ অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। অন্যদিকে আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা, দেশের সার্বভৌমত্ব, আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় প্রশিক্ষিত, দক্ষ ও সুশৃঙ্খল প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনী, দেশের সংবিধান এবং গণতন্ত্রের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও অবিচল আস্থা রেখে চরম ধৈর্যের সঙ্গে উদ্ভূত ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি মোকাবিলার মাধ্যমে পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়ে তারা দেশবাসীর ভালোবাসা ও সুনাম অর্জন করেছে। ২০০৯ সালের বিদ্রোহের মূল লক্ষ্য ছিল সেনা কর্মকর্তাদের জিম্মি করে যে কোনো মূল্যেই তাদের দাবি আদায় করা। বাহিনীর চেইন অব কমান্ড ধ্বংস করে এ সুশৃঙ্খল বাহিনীকে অকার্যকর করা। প্রয়োজনে সেনা কর্মকর্তাদের নৃশংসভাবে নির্যাতন ও হত্যা করা, যাতে ভবিষ্যতে সেনা কর্মকর্তারা বিডিআরে প্রেষণে কাজ করতে নিরুৎসাহিত হন। এ ছাড়া সেনাবাহিনী ও বিডিআরকে সাংঘর্ষিক অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটনানোর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নবনির্বাচিত একটি গণতান্ত্রিক সরকারকে অস্থিতিশীলতার মধ্যে নিপাতিত করা। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নষ্ট করা। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট এবং জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ ক্ষতিগ্রস্ত করা। ওই বিদ্রোহ মাত্র ৪৮ দিনের একটি নবনির্বাচিত সরকারকে মারাত্মক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন করে যা ছিল, গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের জন্য প্রচ- হুমকিস্বরূপ।’
উল্লেখ্য, ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীতে তৎকালীন বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) সদর দপ্তর পিলখানায় বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে। রক্তাক্ত ওই বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী এ বাহিনীর নাম ২০১০ সালে পুনর্গঠন করা হয়। নাম বদলের পর এ বাহিনী বর্তমানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) নামে পরিচিত। এ বিদ্রোহে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন। এ ঘটনায় প্রথমে রাজধানীর লালবাগ থানায় হত্যা এবং বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়। পরে এসব মামলা নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তরিত হয়। এর মধ্যে হত্যা মামলার বিচার শেষ হয়েছে।
হত্যা মামলায় মোট আসামি ছিল ৮৫০ জন। ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ ড. মো. আখতারুজ্জামান এ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে বিডিআরের উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) তৌহিদুল আলমসহ ১৫২ জনকে মৃত্যুদ-, আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলী, বিএনপি নেতা নাসির উদ্দীন আহম্মেদ পিন্টুসহ ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন এবং সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদ-সহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয় ২৫৬ জনকে। আর অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস পান ২৭৭ জন।
নিয়ম অনুযায়ী রায় ঘোষণার কয়েক দিন পরই মৃত্যুদ-প্রাপ্তদের মৃত্যু অনুমোদনের জন্য মামলাটি ‘ডেথ রেফারেন্স’ হিসেবে হাইকোর্টে আসে। এ ছাড়া আসামিরা আপিল করেন। পাশাপাশি খালাসপ্রাপ্ত ২৭৭ জনের মধ্যে ৭৯ জনের শাস্তি চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। এসব আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের ওপর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানির জন্য ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি বিশেষ বেঞ্চ গঠন হয়। এর পর একই বছরের ১৭ জানুয়ারি এ বেঞ্চ পুনর্গঠন হয়। পুনর্গঠিত এ বেঞ্চে একই বছরের ১৮ জানুয়ারি রাষ্ট্রপক্ষের পেপারবুক উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে শুনানি শুরু হয়। গত ১৩ এপ্রিল শুনানি শেষে রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হয়।