একটি সেমিনারের আত্মকথা।
নিউইয়র্ক থেকে ড. ওমর ফারুক। স্থানীয় সময়ঃ ২৪ মার্চ ২০১৮ সময়ঃ রাত ১১টা।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা’র হেডকোয়ারর্টার সুইজারল্যান্ডের রাজধানী জেনেভাতে ’যুদ্ধ বিধ্বস্ত বিশ্বে স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ও চিকিৎসায় সাম্প্রতিক উন্নতি’ বিষয়ক এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হল খুব সম্প্রতি। এতে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত জনপদে স্বাস্থ্য সেবা আরও জোরদার করার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক রেডক্রস সোসাইটিসহ অন্যান্য স্বাস্থ্য ও চিকিৎসায় কাজ করে সে সব সংস্থাগুলোর সাথে সমন্বয় আরও বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়া হয়।
অন্য সব আলোচনার মধ্যে যুক্তরাজ্য থেকে আগত প্রতিনিধি একজন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ক্যান্ডি স্বাস্থ্যব্যবস্থায় তার দেশের উন্নতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, ’আমাদের দেশে রয়েল লন্ডন হসপিটালে একবার একটা শিশু জন্মগ্রহণ করেছিল, যে ছিল জন্মগত ভাবে পঙ্গু। এ পৃথিবীতে সে একটা পা ছাড়াই পদার্পণ করেছিল। আমরা কৃত্রিম পা লাগিয়ে তাকে একজন পূর্ণ দেহের মানব শিশুতে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হলাম। সে ছিল বেশ ক’বছর আগের কথা। বর্তমানেও চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতিকল্পে প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে সব ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছেন বলে তিনি তার সুদীর্ঘ বক্তব্যে উপস্থিত প্রতিনিধিদের আশ্বস্ত করেন। তিনি আরও বলেন, সেদিনের সেই পঙ্গু হিসেবে জন্ম নেওয়া শিশু বর্তমানে বড় হয়ে অলিম্পিকে খেলছে এবং বিগত বছর সে ১০০ মিটার দৌড়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নও হল!
সেমিনারে জার্মানির চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. রবিন বলেন, আমাদের দেশে একটি শিশু জন্ম নিয়েছিল, যার দু’টি হাত ছিল না। আমরা কৃত্রিম হাত লাগিয়ে তাকে পূর্ণাঙ্গ মানব প্রজাতির একজন বানিয়ে দিলাম। পরবর্তীতে বড় হয়ে সে মুষ্টিযুদ্ধে স্বর্ণপদকও অর্জন করল!
এভাবে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি তাদের দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি ও সমৃদ্ধি সম্পর্কে বক্তব্য প্রদান করল।
বাংলাদেশ থেকে উক্ত সেমিনারে যোগ দিয়েছিল অধ্যাপক ড. বর্ণচোরা মজুমদার। তিনি একটি পাবলিক মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরও। তিনি এতসব দেশের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থার এত রকম উন্নতির কথা শুনে একটু ঘাবড়ে গেলেন। মুখ শুকিয়ে তো তার কাঠ।
এ সময় দেশে আর অন্য কারও সাথে মোবাইল ম্যাসেজে যোগাযোগ করে খুব তড়িৎ কোন পরামর্শ নেবেন, সে ব্যবস্থাও নেই। তখন বাংলাদেশ সময় গভীর রাত। যার সাথে পরামর্শ করবেন বলে ভাবতে পারেন, তিনি অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকলেও মদের বোতলে ও আরও কি একটাতে জানি বুদ হয়ে থাকেন।
কি আর করা। মনে মনে ’জয় বাংলা, জয় বাংলা’ জপতে লাগলেন। শেষে ঘোষকের পক্ষ থেকে ঘোষণাও আসল যে, এবার সেমিনারে বক্তব্য দেবেন বাংলাদেশ থেকে আগত অধ্যাপক ড. বর্ণচোরা মজুমদার। তিনি উঠে রাজনীতির মঞ্চ কাঁপানো গলায় বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থার ভুয়সী প্রশংসায় অনর্গল বলে যেতে লাগলেন। কোনটি যে সত্য বলেছেন, কোনটি যে মিথ্যে বলেছেন, তার নিজেরও সেটি মনে নেই। অবশ্য পরবর্তীতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বুলেটিন পড়ে তিনি মার্কার পেনে দাগ দিয়ে দিয়ে মিথ্যা ভাষণটি পৃথক করলেন।
তার বক্তেব্যে এত বেশি হাত তালি পড়েছিল যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান Tedros Adhanomও অবাক হলেন। অধ্যাপক ড. বর্ণচোরা মজুমদারের বক্তব্যে ক্যান্সার চিকিৎসায় বাংলাদেশের ব্যাপক সাফল্যের কথা তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সত্য মিথ্যা দিয়ে তুলে ধরেন। এ সময় তার কাছে রক্ষিত ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাসিমের বক্তব্যের ফটোকপিও ছিল। নাসিম দাবী করেছিলেন, বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় উন্নতির চরম শিখরে আরোহন করেছে। এমনকি ঘাতক ব্যাধি ক্যান্সারের চিকিৎসা আমেরিকার মত দেশে পেতে ব্যর্থ হয়ে অনেক আমেরিকার নাগরিক এ রোগের চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশে ব্যাপক ভাবে ভীড় জমাতে শুরু করেছে। এ সময় একশটির ওপর বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা তো হাত তালি দিয়েছিলেনই, এবার স্বয়ং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান Tedros Adhanomও জোরসে হাতে তালি দিলেন।
সব শেষে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ সাফল্যের কথা বলে সকল প্রতিনিধিকে একটু মহাচিন্তায়ও ফেলে দিয়েছিলেন। তিনি অন্য প্রতিনিধিদের সাথে প্রতিদ্বন্ধিতা করতে গিয়ে বলেন, আপনারা স্ব স্ব দেশে ডিজএবল পিপল নিয়ে আপনাদের চিকিৎসা ব্যবস্থায় উন্নতির অনেক গল্পই বলেছেন। কিন্তু একজন জন্মগত ডিজএবলকে আমরা বাংলাদেশে কিভাবে চিকিৎসা সেবা ও পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় একজন শুধু মানব প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিতেই পরিণত করি নি। বরং সারা বিশ্বে পরিচিত একজন মানবে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছি। সকলই উৎসুক্য নিয়ে খুব মনোযোগী হয়ে তাকালেন ড. বর্ণচোরা মজুমদারের দিকে। তিনি এবার বললেন, আামদের দেশে একবার মেয়ে শিশু জন্ম নিয়েছিল। জন্মগত ভাবে তার শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ঠিকই ছিল। কিন্তু তার শরীরে দুটি অঙ্গ ছিল অনুপস্থিত। একটি হল মাথায় কোন ঘিলু ছিল না। আর অন্যটি হল, তার কোন হৃদপিণ্ড নেই। তার চিকিৎসাকল্পে আমরা তার মাথায় গোবর ঢুকিয়ে দিলাম। আপনারা হয়ত অবাক হবেন, সেই মহিলাই এখন বাংলাদেশের শীর্ষপদে অধিষ্ঠিত আছেন। আর হৃদপিণ্ডের বিষয়টি আমরা যেভাবে সমাধান করেছি, সেটি আরও অবাক করা চিকিৎসা পদ্ধতি। আমরা চিকিৎসকদের একটি টিম পৃথিবীর বহুদেশে অবস্থিত গভীর জঙ্গল খুঁজে খুঁজে বিভিন্ন হিংস্র প্রাণির হৃদপিণ্ড যোগাড় করেছি। সে জন্য আমাদের সরকারের ব্যয়ও হয়েছে অনেক। আমাদের নিজ দেশের রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছাড়াও ভালুক, সিংহ, শিয়াল, মনসা সাপ ও গণ্ডারের হৃদপিণ্ড থেকে নমুনা নিয়েছি। অন্য সব দেশ থেকেও বিভিন্ন হিংস্র জন্তুর হৃদপিণ্ড থেকে অংশ বিশেষ নিয়ে সেগুলোকে একত্র করেছি এবং অবশেষে তার দেহে সংযোজন করে দিয়েছি। এর ফলে সে নারীর শরীরে ‘কোন দয়া মায়া ও লজ্জার বালাই নেই’ বলেও তিনি দীপ্ত কণ্ঠে উল্লেখ করলেন। আছে শুধুৃ লজ্জাহীনতা, এক রাশ ক্ষোভ ও হিংস্রতা।
সকলই অবাক হলেন এবং ইংরেজি ভাষায় একটি গানও গাইতে লাগলেনঃ ’Blessed country!
Blessed Delegate! You are really Great! Bangladesh, Bangladesh!”
বাংলাদেশ প্রতিনিধির বক্তব্য শেষে নিউইয়র্ক থেকে মাইকেল নামে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, আপনাদের ক্যান্সার চিকিৎসার পদ্ধতি ও মেডিসিন সম্পর্কে একটু ব্যাখ্যা করলে আমরা সারা বিশ্বের জনগণ উপকৃত হতাম। সেমিনারে এবার বাংলাদেশ থেকে আগত প্রতিনিধি অধ্যাপক ড. বর্ণচোরা মজুমদার বলেন, আচ্ছা সে কথা বিশদ ভাবে ব্যাখ্যা করছি। তবে এর আগে আমাকে এক গ্লাস পানীয় সরবরাহ করুন। তড়িৎ গতিতে সেবিকা এসে হাজির। জানতে চাইলেন, আপনি তো মুসলিম মেজরিটি রাষ্ট্র থেকে এসেছেন, জিজ্ঞেস তো করতেই হয়, কী পানীয় সরবরাহ করা হবে, স্যার! এ কথাটি এখন একদম ভুলে যান, সেটি এখন মুসলিম রাষ্ট্র কাগজে কলমে। খুব শীঘ্রই তা বিতাড়নের প্রক্রিয়াও চলছে, জয় বাংলা। সেটি এখন মুশরেকি পদ্ধতির অনুশীলন ও ধাঁচে পূর্ণাঙ্গ সেকুলার রাষ্ট্র। আপনাদের সেকুলার মতাদর্শের সাথে কিন্তু আবার মিল খুঁজে বিভ্রান্ত হবেন না। এক নাগাড়ে বললেন তিনি।
যাই হোক, পুরাদস্তুর পানীয় সরবরাহ করা হল। তিনি বাম হাতে পানীয়ের লম্বা সাইজের গ্লাসটা দিয়ে আস্তে আস্তে চুক চুক শব্দ করে পান করছেন আর নিঃসংকোচে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতির আরও বিশ্লেষণমূলক বক্তব্য পেশ করতে থাকলেন। তার বক্তব্যে কি যে এক সম্মোহনী শক্তি ছিল, অনেকটা ৭ মার্চের ভাষণের মতই। পিনপতন নীরবতা গ্রাস করে ফেলল পুরো সেমিনার হলটিতে। তিনি বলতে থাকলেন এভাবেই, “আপনারা হয়ত অবাক হচ্ছেন যে, আমেরিকার মত দেশ থেকে ক্যান্সার রোগীরা তাদের দেশে চিকিৎসায় নিরাশ হয়ে বাংলাদেশ কেন যাবে! এটা তো ঠিক, ক্যান্সার একটি ঘাতক ব্যাধি। অনেক উন্নত মানের চিকিৎসা দিয়েও অনেক সময় রোগীর রোগ উপশম সম্ভব হয় না। ডাক্তারগণ যখন সে সব রোগীদের আর কোন বাঁচানোর সম্ভাবনা নেই বলে দেন, সে সব রোগীরাই মূলতঃ আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে যায়। তারা মূলতঃ রোগের যন্ত্রণা থেকে বাঁচার জন্য বাংলাদেশে যায়। কেননা ইতোমধ্যে বাংলাদেশ বিশ্ব মাঝে অনেক পরিচিতি লাভ করেছে। সেখানে বেঁচে থাকা অনেক সময়ই অনেক যন্ত্রণার ও কষ্টের । বিশেষ করে যারা সরকারের যে কোন ইতিবাচক বা নেতিবাচক কর্মকাণ্ড অন্ধ ভাবে সমর্থন দেয় না, তাদের জন্য। সে সব লোকদের জন্য বাংলাদেশে মৃত্যুটা খুব সহজলভ্য। অথবা নিদেন পক্ষে আদা পাগল হয়ে বেঁচে থাকার সুবর্ণ সুযোগটা বাংলাদেশে খুবই সহজ। যেটি আমেরিকার মত উন্নতদেশগুলোতে কঠিনই। যে সব রোগীরা মনে করে তাকে রোগযন্ত্রণা সহ্য না করে মরে যাওয়া ভাল, তারা বাংলাদেশে যায়। সেখানে ঔষধ বলতে ধুতুরা নামে এক ধরনের গাছ আছে। ইংরেজিতে উদ্ভিদবিদ্যার ভাষায় ধুতুরাকে কি বলে, এ মূহুর্তে আমি মনে করতে পারছি না। যতটুকু মনে হয়, এ গাছের নাম হল ঃ ডাস্ট ট্রি। যাই হোক এ গাছের এক ধরনের রস আছে, যেটি সাদা দুধের মত। সে রস খেলে মানুষ একটু অপ্রকৃতিস্থ হবার সুযোগ পায়। ফলে তার রোগ যন্ত্রণার কথা ভুলে যেতে সহজ হয়। স্যরি, আমি আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার অনেক গোপন কথা ফাঁস করে দিচ্ছি। তবে ফাঁস করে দেওয়াও আমাদের দেশের এখন একটা আপরিহার্য সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেমনঃ শিক্ষালয়ে পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস ছাড়াও চাকরিতে নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস ইত্যাদি সফলতার সাথে চলছে।
যাই হোক আমি ফাঁস করলেও সে গাছ তো আর আপনাদের আমি দেখাচ্ছি না, অতএব বুঝতে পারবেন না। সে গাছের রস খেয়ে আমাদের সরকারের যত নেতৃত্বস্থানীয় লোকজন আছে, তারা এখন উন্মাদ অবস্থায় আছে। যার কারণে রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদেরকে যতই সমালোচনা করা হোক না কেন, তাদের কোন লজ্জাই হয় না। তবে সে রসের মাত্রা সম্পর্কে জ্ঞান থাকা অপরিহার্য। মাত্রা বেশি হলে পরিধানের বস্ত্র ছিঁড়ে নদীতে ভাসিয়ে দিগম্বর ঘুরে বেড়ানোর স্বাদ জেগে বসতে পারে।
সবাই বিষয়টি জেনে আশ্বস্ত হল। অন্তত সুখের মরণের মত একটি দেশ আপাতত খুঁজে পাওয়া গেল।