ইসলাম বিরোধীদের অপপ্রচারের অন্যতম লক্ষ্য আয়েশা(রাঃ)।
মূল রচনাঃ নয়ন চৌধুরী, সম্পাদনাঃ ড ওমর ফারুক।
ইসলাম বিরোধীদের অপপ্রচারের অন্যতম লক্ষ আয়েশা(রাঃ) এর সাথে রাসুল(সাঃ) এর বিয়ে! অনেক মুসলমান ভাই বোন মাঝে মাঝে প্রশ্ন করেন “এটা না করলে কি পারতেন না? না করলেতো আজকে এই প্রপাগান্ডার সুযোগ ছিল না! ”
এই লেখনী শুধু তাদের জন্য! বন্ধুগণ, রাসুল(সাঃ) মাওলার নির্দেশ ছাড়া কিছুই করেন নি! সর্বজ্ঞ মাওলা ভবিষ্যত জানতেন বলেই তার প্রিয় হাবিবকে এই বিয়ের নির্দেশ দিয়েছিলেন ! নিচের লেখনীতেই আপনারা বুঝবেন, ইসলামের ইতিহাসে এই বিয়ের প্রভাব কত ব্যাপক ছিল!
রাসুল(সাঃ) এর প্রতিটি বিয়েই ছিল ইসলামের স্বার্থে!! আর ইসলামের জন্য সবচেয়ে বেশি ফলপ্রদ হয় আয়েশা(রাঃ) এর সাথে হুজুর পাক (সাঃ) এর এই বিয়ে!
ইসলাম প্রচারে হযরত আয়েশা (রাঃ) এর ভূমিকা ও তাঁর মর্যাদাঃ
রাসুল মুহাম্মদ (সা) এর স্ত্রীগণের মধ্যে হযরত আয়েশা (রাঃ) সম্ভবত সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তিত্ব। তিনি একাধারে রাসুল (সাঃ) এর স্ত্রী ও আবু-বকর (রা) এর কন্যা। রাসুলের (সাঃ) সাথে তাঁর মাত্র ৯ বছরে সংসার জীবন ছিল । রাসুলের (সাঃ) ওফাতের পর ইসলামের ইতিহাসে তাঁর রয়েছে এক গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা। আমি ধারাবাহিক কয়েকটি পোস্টের মাধ্যমে হযরত আয়েশা (রা) এর ইসলামে অবদান ও তাঁর মর্যাদা নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করব।
প্রথমেই শুরু করছি হযরত আয়েশা (রা) কতৃক বর্ণিত একটি হাদীস দিয়েঃ
হযরত আয়েশা (রা) বলতেন, আমি গর্বের জন্য নয় , বরং বাস্তব কথাই বলছি। আর তা হল, আল্লাহ তায়ালা এমন কয়েকটি বৈশিষ্ট্য দান করেছেন যা আর কাউকে দান করেন নি। ১. ফেরেশতা রাসুলুল্লাহকে (সা) স্বপ্নের মাধ্যমে আমাকে দেখিয়েছেন, ২. আমার সাত বছর বয়সে রাসুল (সা) আমাকে বিয়ে করেছেন, ৩. নয় বছর বয়সে আমি স্বামী গৃহে গমন করেছি, ৪. আমিই ছিলাম রাসুল (সাঃ) এর একমাত্র কুমারী স্ত্রী ৫. যখন তিনি আমার বিছানায় থাকতেন, তখন ওহী নাযীল হত, ৬. আমি ছিলাম রাসুল (সাঃ) এর সর্বাধিক প্রিয় স্ত্রী, ৭. আমাকে নির্দোষ ঘোষণা করে কোরআনে আয়াত নাযীল হয়েছে ৮. জীবরিলকে আমি স্বচক্ষে দেখেছি, ৯. রাসুল (সাঃ) আমার কোলে মাথা রেখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন, ১০. আমি তার খলিফা ও তার সিদ্দিকের কন্যা ১১. রাসুলুল্লাহর (সাঃ) জীবনের শেষ মূহুর্তে আমার মুখের লালা তাঁর মুখের লালার সাথে মিলেছে, ১২. আমার ঘরেই তাঁর কবর দেয়া হয়েছে। [সূত্রঃ সিয়ারু আলাম আন-নুবালা ৩/১৪০-১৪১]
হযরত আয়েশা (রাঃ) এর সীরাতের প্রতি যখন দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হয়, তখন কেবল সকল মহিলা সাহাবা নয় বরং অনেক বড় বড় পুরুষ সাহাবিদের তুলনায় তাঁর যে অনন্য বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় তা হলঃ
১. দ্বীনের তাৎপর্য বিষয়ে গভীর জ্ঞান।
২. ইজতিহাদির ক্ষমতা ও শক্তি
৩. আলোচনা ও পর্যালোচনার রীতি-পদ্ধতি
৪. গভীর অন্তর্দৃষ্টি
৫. প্রয়োজনীয় মতামত প্রকাশের ক্ষমতা
হযরত আয়েশা (রাঃ) সম্পর্কে কয়েকজন প্রথিতযশা সাহাবায়ে কেরাম, তাবে-তাবেঈন ও মুসলিম স্কলারের কিছু মন্তব্য উল্লেখ করা যায়ঃ
হযরত মুসা আশ’আরী (রা) বলেনঃ “আমরা মুহাম্মদ (সা) এর সাহাবীরা কক্ষণো এমন কোন কঠিন
সমস্যার মুখোমুখি হই নি, যে বিষয়ে আমরা আয়েশা (রা) এর নিকট জানতে চেয়েছি এবং সে সম্পর্কে কোন জ্ঞান আমরা তাঁর কাছে পাই নি “
প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আওফের (রাঃ) সুযোগ্য পুত্র আবু সালামা যিনি একজন অতি উচ্চস্তরের তাবেঈ ছিলেন, তিনি বলেনঃ “ রাসুলুল্লাহ (সা:) এর সুন্নাতের জ্ঞান , প্রয়োজনে কোন ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দান, আয়াতের শানে নুযুল ও ফরজ বিষয় সমূহে আমি আয়েশা (রা) অপেক্ষা অধিকতর পারদর্শীনি ও সুচিন্তিত মতামতের অধিকারী আর কাউকে দেখি নি “
হযরত উরউয়া ইবনে যুবায়ের (রাঃ) বলেনঃ “ আমি হালাল হারাম জ্ঞান, কবিত্ব, চিকিৎসা বিদ্যায় উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা (রাঃ) অপেক্ষা অধিক পারদর্শীনি কাউকে দেখি নি “
প্রখ্যাত তাবেঈ হযরত মাসরুখ (রঃ), যিনি হযরত আয়েশা (রাঃ) এর তত্ত্বাবধানে লালিত পালিত হন, একবার তাঁকে প্রশ্ন করা হলঃ উম্মুল মু’মেনিন আয়েশা (রাঃ) কি ফারায়েজ শাস্ত্র জানতেন? তিনি জবাব দিলেনঃ সেই সত্ত্বার কসম, যার হাতে আমার জীবন, আমি বড় বড় সাহাবীদেরকে তাঁর নিকট ফারায়েজ বিষয়ে প্রশ্ন করতে দেখেছি “
আল্লামা জাহাবী বলেনঃ “তিনি ছিলেন বিশাল জ্ঞান ভাণ্ডার। উম্মতে মুহাম্মদীর মধ্যে সার্বিক ভাবে মহিলাদের মধ্যে তাঁর মত বড় জ্ঞানী ব্যাক্তি নেই ।”
ইলম ও ইজতিহাদ বা জ্ঞানে আযরত আয়েশা (রাঃ) কেবল মহিলাদের মধ্যেই নন, বরং নারী ও পুরুষদের মধ্যে বিশেষ স্থান অধিকার করতে সক্ষম হন। কুরআন, সুন্নাহ, ফিকাহ, আহকাম বিষয়ক জ্ঞানে তার স্থান ও মর্যাদা এত উর্দ্ধে যে, ওমর (রাঃ) , আলী (রাঃ), আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ (রাঃ), আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) প্রমূখের সাথে তাঁর নামটি নির্দ্বিধায় উচ্চারণ করা যায়।
তাফসিরে জালালাইন কিতাবে প্রখ্যাত মুফাস্সির কিরামের যে তালিকা দেয়া হয়েছে, তাতে হযরত আয়েশা (রাঃ) কে তাফসিরকারকদের মধ্যে প্রথম থকে তৃ্তীয় স্থানে রাখা হয়েছে।
হাদীস বর্ণনাতেও হযরত আয়েশা (রাঃ) নিঃসন্দেহে অন্যতম প্রধান বর্ণনাকারীদের অন্যতম। যে সকল সাহাবীর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা এক হাজারের উর্দ্ধে, তাঁরা হলেন মাত্র ৭ জন। নিম্নে তাঁদের নাম ও বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা উল্লেখ করা হলঃ
০১. হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) – ৫৩৬৪
০২. হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রাঃ) — ২৬৬০
০৩. হযরত আবদুল্লাহ ইবন ঊমার (রাঃ) – ২৬৩০
০৪. হযরত যাবির ইবন আবদিল্লাহ (রাঃ) – ২৫৪০
০৫. হযরত আনাস ইবন মালিক (রাঃ) – ২৬৮৬
০৬. হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) – ২২১০
০৭. হযরত আবু সাইদ আল খুদরী (রাঃ) – ২২৭০
উপরে উল্লেখিত নামের পাশের সংখ্যা অনুযায়ী হাদীস বর্ণনকারী হিসেবে হযরত আয়েশা (রা) এর স্থান ষষ্ঠতম। অনেকের মতে, হযরত আবু হুরাইরা (রা) ও হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা) ছাড়া আর কেউ হযরত আয়েশা (রাঃ) চেয়ে বেশি হাদীস বর্ণনা করেন নি। তাঁদের মতে, অধিক হাদীস বর্ণনকারী হিসেবে হযরত আয়েশা (রাঃ) এর স্থান তৃ্তীয়। হযরত আয়েশা (রাঃ) বর্ণিত হাদীসসমুহের মধ্যে সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে ২৮৬ টি হাদীস সংকলিত হয়েছে। ১৭৪টি মুত্তালাক আলাইহি, ৫৪ টি শুধু বুখারীতে এবং ৬৯ টি মুসলিমে এককভাবে বর্ণিত হয়েছে। এছাড়া হযরত আয়েশা (রাঃ) এর অন্য হাদীসগুলো বিভিন্ন গ্রন্থে সনদ সহকারে বর্ণিত হয়েছে।
উপরের সংক্ষিপ্ত আলোচনা থেকে এতটুকু প্রতীয়মান হয় যে, নবী মুহাম্মদ (সাঃ ) এর স্ত্রী হযরত আয়েশা (রাঃ) ইসলামের ইতিহাসের একজন গুরুত্বপুর্ণ ব্যক্তিত্ব যার কাছ থেকে পবিত্র কুরআনের তাফসীর, হাদীস বর্ননা ও ইসলামি শরীয়তের অনেক জরুরী বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়েছে। হযরত আয়েশা (রাঃ) শুধু নবী (সাঃ) এর স্ত্রী হিসেবে নয় বরং একজন তাফসীরকারক, একজন রাবী, একজন ফকীহ ও মুজতাহিদ হিসেবে মুসলিম উম্মার কাছে চিরকাল শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত থাকবেন।
দু’জাহানের তারকা হিসেবেও হযরত আয়েশা (রাঃ)
রাসুল (সাঃ) প্রিয়তমা, ইসলামের ইতিহাসে মহিয়সী নারী, উম্মুল মু,মিনীন হযরত আয়েশা (রাঃ)র স্থান নারীকুলের মধ্যে সবার ঊর্দ্ধে। তাঁর সুদূরপ্রসারী চিন্তা-চেতনা, জ্ঞান-প্রজ্ঞা, শিক্ষা-দীক্ষা, ধর্ম-কর্ম, স্বভাব-
চরিত্র, ত্যাগ-তিতিক্ষা, সাধনা-প্রতিভায় তিনি যে উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত, তা বলাই বাহুল্য। তিনি একদিকে যেমন মহিলাকুলের মহা-মর্যাদা ও গর্বের তেমনি অনুপ্রেরণার উৎসও বটে। মা আয়েশা (রাঃ) এর তুলনা শুধু তিনি নিজেই। মিল্লাতে মুসলিমের সম্মানিত শিক্ষিকা হযরত আয়েশা (রাঃ) এর সমুদ্রসম জীবন কাহিনী সীমিত আকারে লেখা বড়ই কঠিন ও দুরুহ। তারপরও শুধুমাত্র সময়ের দাবীর কারণে এ ক্ষুদ্রতম প্রচেষ্টা!
আশাকরি ঈমানদার ভাই বোনেরা বুঝতে পেরেছেন রাসুলে পাক (সাঃ) কেন এ বিয়ে করেছিলেন এবং মাওলা কেন এ বিয়ের নির্দেশ দিয়েছিলেন! সর্বজ্ঞ মাওলা ভবিষ্যত জানতেন বলেই তার প্রিয় হাবিবকে এই বিয়ের নির্দেশ দেন, যার ফলে এ বিয়ের সিদ্ধান্ত ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে ফলপ্রদ বিয়ে বলে বিবেচিত!!