ইন্টারনেট আসক্তিঃ এ শতাব্দীর ভয়াল এক অভিশাপ
।। ঢাকা থেকে সানজিদা আহমেদ।।
বহু মানুষ আছে, যারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে রেখেও তাদের মাথার মধ্যে প্রধান চিন্তা থাকে, কখন ইন্টারনেটে বসবে। এ অবস্থাকেই ইন্টারনেট আসক্তি হিসেবে অভিহিত করতেই পারি। মানসিক ব্যধিগ্রস্ত লোকদের নিয়ে যারা গবেষণা করেন, তাদের দৃষ্টিতে সপ্তাহে ৩৮ ঘন্টা বা তার বেশি ইন্টারনেট ব্যবহার করলে সেটি ইন্টারনেট আসক্তির পর্যায়ে পড়ে। অনেকই আছেন, ইন্টারনেট ছাড়া থাকতে পারে না, বাদ দিতে গেলে দুশ্চিন্তা, বিষণ্ণতা ও অন্যান্য সমস্যা দেখা দেয়। এসব লোকদের কাছে ইন্টােরনেট বিনোদেনের প্রধান উৎস। আরও একটা বৈশিষ্ট্য এসব আসক্তদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। তারা অনেক সময় নিজের ইন্টারনেট ব্যবহারের সময়টাকে লুকিয়ে রাখতে চায়। প্রয়োজনে তা নিয়ে মিথ্যা বলে। সাধারণত শিশু বা অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানেরা মা বাবা বা অভিভাবকের কাছে ইন্টারনেট ব্যবহারের সময়টা অনেক সময় লুকায়, এটিকে আসক্তি বলা ছাড়া উাপায় কি? ইন্টারনেট আসিক্ত লোকদের আরও একটা বৈশিষ্ট্য হল, তাদের নিকট অনেক সময় বাস্তব জীবনের ঘাত প্রতিঘাত ভাল না লেগে বা সেগুলো মোকাবেলা না করে তারা ভার্চুয়াল জীবনকে বেশি গুরুত্ব দিতে প্রয়াসী।
ইন্টারনেট আসক্তির ধরনের রকমফেরঃ
সাইবার সেক্স, সাইবার রিলেশন প্রবলেম, পর্ণোগ্রাফি, অনলাইন গ্যাম্বলিং বা জুয়া, ইন্টারনেট গেমিং, ফেসবুক আসক্তি, কম্পালসিভ ডেবিলিটেটিং ডিসঅর্ডার।
শারিরীক প্রতিক্রিয়াঃ
ঘাড় ও কোমর ব্যাথা, মাথা ব্যাথা’, আই স্ট্রেন (চোখে অস্বাভাবিক চাপজনিত সমস্যা) হয়।
মানসিক প্রতিক্রিয়াঃ
অনিদ্রা, অতিরিক্ত টেনশন বোধ, বিষণ্ণতা, যৌন সমস্যা, অপরাধ প্রবণতা, মনোযোগ কমে যাওয়া।
পারিবারিকঃ অতিরিক্ত ইন্টারনেট আসক্তি পারিবারিক সম্পর্কের ভয়াবহ অবনতি ঘটায়। দাম্পত্য কলহের একটি প্রধান কারণ হল এটি। ফেসবুক চ্যাটিং ও সাইবার সেক্স-এর কারণে অনেক পরিবার ভেঙ্গেছে। সেরকম ক’টি উদাহরণ দেব। ভুরে ভুরে উদাহরণ আছে। আমেরিকার ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট ইলেকশনে ডেমোক্রেট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটেনের নির্বাচনী ক্যাম্পেনে ভাইস চেয়ার হিসেবে নিযুক্ত ও পরে হাবি Anthony David Weiner এর ইন্টারনেট আসক্তি ও সাইবার সেক্স ক্যালেংকারির কারণে তাঁকেও সে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। Huma Abedin এবং তার হাসব্যান্ড সাবেক কংগ্রেসম্যান Anthony David Weiner এর বিষয়টি সেলিব্রিটি মানুষদের মধ্যে অন্যতম একটি আলোড়িত ঘটনা। অহরহ এমন সব ঘটনা ঘটছে। কি বিশিষ্ট ব্যক্তি, কি সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। ইন্টারনেট আসক্তি মানুষের জীবনকে কুরে কুরে শেষ করে দিচ্ছে। তবে অনেক সময় কিশোরীরা সহজেই অনাকাঙ্ক্ষিত বিভিন্ন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে ও নিজেদের জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।
পেশাগতঃ অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করে এসব আসক্তরা। তারা বিষণ্ণতা ও অনিদ্রায় ভোগে। সেটি থেকে রেহাই পেতে সারারাত নেট চালায়। তারাপর সারাদিন ঘুমায়। অনেক সময় এসব মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাপন বিপন্ন হয়ে পড়ে। মাদকাসক্তির মতই ইন্টারনেট আসক্তি অনেক মানুষকে কুরে কুরে নিঃশেষ করে দেয়।
ইন্টারনেট আসক্তি একবার যদি কারো ভেতর বাসা বাঁধে, তা থেকে উত্তরণের উপায়ঃ এক্ষেত্রে তিন ধরনের পদ্ধতি সে সব আসক্তদের জন্য কাজে লাগানো যেতে পারে। সাইকোলজ্যিকাল, ফিজিক্যাল, সোশ্যাল প্রেসার।
সাইকোলজিক্যালঃ
প্রথমে সাইকো এডুকেশন দেওয়া এসব আসক্তদের। অতিরিক্ত ইন্টারনেট ব্যবহারের কুফল সম্পর্কে জ্ঞান দান অতি জরুরী। শুধু জ্ঞানদানই নয়, তা বাস্তবে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে তাকে আগ্রহী করে তুলতে প্রয়াস পাওয়া। ইন্টারনেটের সীমিত ব্যবহার মানুষের জীবনকে মহিমাময় করে তুলতেও পারে, কিন্ত অতিরিক্ত ইন্টারনেট ব্যবহারে জীবনকে জটিল ও সমস্যাগ্রস্ত করে তুলবে নিঃসন্দেহে। সেটি তাকে ভাল ভাবে বোধগম্য করতে সহায়তা করা। তাঁকে মানসিক ভাবে এমন করে তৈরি করতে হবে, যেন সে অতিরিক্ত আনন্দ না খুঁজে বাস্তব জীবনে আনন্দ বের করে নিতে এক সময় প্রয়াসী হয়। আগে মানুষ কি করত? হাল্গকা বিনোদনের পন্থা কি ছিলঃ গল্প করা, আড্ডা দেওয়া, বাগান করা, ঘুরে বেড়ানো, বই পড়া ইত্যাদি। এখন কেন সেসব মানুষের জীবন থেকে হারিয়ে যাবে? জীবনের শত ব্যস্ততার মাঝে যদি ইন্টারনেট ব্যবহার করতে মানুষ অজস্র সময় বের করতে পারে, তাহলে প্রিয়জন বা নিজ সন্তান কিংবা মা বাবার েসাথে কি একটু আধটু গল্প করে সময় পার করতে পারে না? পরিবারকে অধিক সময় দেওয়া, বিশেষ করে স্বামী ও স্ত্রীদের, পারিবারিক জীবন যাপন ইন্টারনেটে শেয়ার করাতে নিরুৎসাহিত করা, ইন্টারনেটের কুফল সম্পর্কে মিডিয়ার সহায়তায় জনসচেতনতা সৃষ্টি, বাস্তব জীবনকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া, দৈনন্দিন কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখা। বই পড়ার অভ্যাসটা আস্তে আস্তে কি মানব জীবন থেকে নির্বাসিত হয়ে যাবে? বিশেষ করে ধর্মীয় কিতাবাদি পাঠ ও অধ্যায়ন অনেকেরই কম হচ্ছে। অনেকের হচ্ছেই না। এজন্য ইন্টারনেট আসক্তি থেকে নিজেকে মুক্ত করে পবিত্র ধর্মীয় গ্রন্থাদি অধ্যয়ন, ধর্মীয় পুস্তক পাঠ ও অর্জিত জ্ঞান বাস্তব জীবনে অনুশীলনে প্রয়াসী হতে হবে।
ফিজিক্যালঃ
ইন্টারনেট আসক্তি খুব ভয়াবহ রুপ নিলে প্রয়োজনে মনোদৌহিক চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হতে পারে। সে বিষয়ে আমি আলোকপাত করতে পারছি না। সেটি চিকিৎসক বলবে। আমার মত একজন সামাজিক গবেষকের পক্ষে সে বিষয়ে কোন উপশম থিওরি দেওয়া অসম্ভব।
পর্ণোগ্রাফি আসক্তির ভয়াবহতাঃ
ইন্টারনেট আসক্তির একটি ভয়াবহ কারণ হচ্ছে পর্ণোগ্রাফি আসক্তি। এটা শুধু প্রাপ্তবয়স্করাই নয়, কিশোর কিশোরীরাও এখন এতে ভীষণ ভাবে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এটা মস্তিস্ককে চরম ভাবে উত্তেজিত করে। যার ফলে অবৈধ যৌনাচার, ধর্ষণের প্রবণতা জনিত ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অপরাধগুলো কিন্তু উন্নত বিশ্বে আমাদের মত হতদরিদ্র দেশের চেয়ে বেশি হচ্ছে। একজন টিনেজার কখনই পর্নগ্রাফির মত মানসিক কুপ্রভাব তাদের মস্তিস্কে বহন করতে পারবে না। শুধু টিন এজার কেন বলছি, বয়স্করাও পর্নোগ্রাফি আসক্তির ভয়াবহতায় প্রভাবিত ও বিধ্বস্ত। আজ সারা বিশ্বজুড়ে ভয়াবহ নৈতিক অবক্ষয় দেখা দিয়েছে। অনেক পর্নগ্রাফির দৃশ্যাবলিতে ১৮+ লেখা থাকে, তবে সমাজে এ নিয়মের কোন প্রতিফলন নেই। তাছাড়া প্রতিফলন দিয়েও বা কী হবে? প্রাপ্তবয়স্করা কি নিজেদেরকে প্রর্নোগ্রাফির কুফল ও কু প্রভাব থেকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে?
উন্নত বিশ্বে ইন্টারনেট অ্যাডিকশন সেন্টার আছে। সময়ের প্রয়োজনে আমাদেরও এই উদ্যোগ নিতে হবে।
আমাদের এ মানসিক রোগের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। যেন রোগীরা অন্তত চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ জীবনে ফিরে আসার সুযোগ পায়। উপরে উল্লেখিত কোন সমস্যার সম্মুখীন হলে এর জন্য চিকিৎসা সহায়তা করতে রয়েছে ক্রাইম রিসার্চ এন্ড অ্যানালাইসিস ফাউন্ডেশ (ক্রাফ) । অথবা যোগাযোগ করতে পারেন যে কোন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এর সাথে।
[বিদেশি পত্রিকা অবলম্বনে।]