ইতিহাস পর্ব ১।।

August 1, 2018 10:59 pm0 commentsViews: 80
০১.এ একজনের কাহিনী নয়

“… আলীমুদ্দিন ছাতা মেরামতের কাজ করে। এ সময়টা তার জন্য ব্যস্ততার মৌসুম। রােজ বিকেলে বঙ্গোপসাগরের কালাে মেঘ পদ্মার উপর দিয়ে ভেসে যায়, আর মানিকগঞ্জে মুষলধারে বৃষ্টি নামে।শহরের প্রধান বাজারের রাস্তায় আলীমুদ্দিন এক পায়ের উপর আর এক পা আড়াআড়িভাবে রেখে বসে ছেঁড়া ছাতা সেলাই করে, জোড়া তালি দেয় এবং ছাতার শিক মেরামত করে। সাইড বিজনেস হিসেবে পুরান তালা মেরামত করে, পুরান চাবিও সরবরাহ করে।

এমন মৌসুমেও আলীমুদ্দিন ক্ষুধার্ত। বলল, “যেদিন বেশী কাজ মেলে, সেদিন এক বেলা ভাত খাই। যেদিন তেমন কাজ পাই না সেদিন ভাতের বদলে একটা চাপাতি খাই। আর এমন অনেকদিন যায় যেদিন কিছুই খেতে পাই না।”তার দিকে এক নজর তাকালেই বুঝা যায়, সে সত্যি কথাই বলছে। সবুজ লুঙ্গীর নীচে তার পা দুটিতে মাংস আছে বলে মনে হয় না। আলীমুদ্দিন যে ছাতা মেরামত করে, সেই ছাতার মতই তার নিজের পাঁজর ও মেরুদণ্ড বের হয়ে আছে।

ঢাকার ৪০ মাইল উত্তরে মহকুমা শহর মানিকগঞ্জ। ১৫ হাজার লােকের বসতি। তাদের মধ্যে আলীমুদ্দিনের মত আরাে অনেকে আছে। কোথাও একজন মােটা মানুষ চোখে পড়ে না। কালু বিশ্বাস বলল, “আমাদের মেয়েরা লজ্জায় বের হয় না— তারা অর্ধনগ্ন।”মানিকগঞ্জে এ অবস্থা কেন ? — মানুষের খাবার নেই, কাপড় নেই। “মুক্তি যুদ্ধের পর থেকে জিনিসপত্রের দাম বেড়েই চলেছে। চাল-ডাল কেনার সামর্থ্য কারাে নেই। সরকার বলেছিল আজাদীর পর সুদিন আসবে। আমার ভাই মুক্তিযুদ্ধে মারা গেছে। আমি আমার এই পা হারিয়েছি। সরকার কিছু করে নাই”—

কথাগুলাে বলল মনসুর আলী। মনসুর আলী একজন চাষী। বয়স পাঁয়তাল্লিশ। ১৯৭১ সালে পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা হয়ে লড়েছে। একটা পা হারিয়েছে।

বাঁশের ক্র্যাচ্‌ ও লাঠির মাঝে দেহের সমতা রাখতে গিয়ে মনসুর আলীর হাত কাঁপছিল। ঘাড়ে ঝুলান জীর্ণ থলি থেকে লাল সুতায় বাঁধা, শত হাতের ছোঁয়ায় বিবর্ণ একটা কাগজ বের করে দেখাল। শিরােনামায় লেখা রয়েছে “প্রধানমন্ত্রীর রিলিফ ও ওয়েলফেয়ার ফাণ্ড”।
মনসুর আলী বলল, শহরের সরকারী কর্মচারীরা তাকে বলেছে, “এ ফাণ্ড থেকে টাকা পাওয়ার কথা ভুলে যাও।” সে অভিযােগ করল, “আমি ভিক্ষুক নই, কিন্তু বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে খাবার ভিক্ষা করতে বাধ্য হয়েছি। নইলে আমি মরে যাব।”
আলীমুদ্দিনের কাহিনী গােটা মানিকগঞ্জের কাহিনী, বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের কাহিনী, শত শত শহর-বন্দরের কাহিনী। এ পর্যন্ত বিদেশ থেকে ৫০ লাখ টনেরও বেশী খাদ্যশস্য বাংলাদেশে পাঠান হয়েছে। কিন্তু যাদের জন্য পাঠান হয়েছে তারাই পায়নি। খাদ্যদ্রব্য ও জিনিসপত্রের দাম অসম্ভব বেড়ে গেছে, কিন্তু লােকের আয় বাড়েনি, বরং কমেছে।

আবদুল হাদীর মত মধ্যবিত্ত লােকদেরও একই কাহিনী। হাদী স্থানীয় বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের একাউন্টেন্ট। মাসিক উপার্জন তার ১৬ পাউণ্ডের সামান্য বেশী। হাদীর বয়স তিরিশ। বিবাহিত। তার তিনটি শিশু-সন্তান আছে। ব্যাংকের সামনে কর্দমাক্ত রাস্তার ওপাশে একটি করােগেটেড শেডের এক অংশে হাদী সপরিবারে বাস করে। খাওয়া-দাওয়া ও বাসা ভাড়া বাবৎ যা খরচ হয় তা তার উপার্জনের দ্বিগুণ। হাদী বললেন, “এভাবে আর কতদিন চলবে জানি না।”
মানিকগঞ্জের প্রায় সকলের মত হাদীও গত মার্চ মাসের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগকে ভােট দিয়ে জয়যুক্ত করেছিলেন। কিন্তু এখন, হাদী বলতে লাগলেন, “রেশনের দোকানেও কিছু পাওয়া যায় না। ওদিকে সরকারী মহলে অর্থের একটানা অপব্যয় চলছে। আগামী নির্বাচনে যে কেউ ভাত-কাপড় দিতে পারবে তাকেই ভােট দেব।” হাদীর হিসাব মত মানিকগঞ্জে মুজিবের সমর্থন শতকরা ৬০ ভাগ কমে গেছে।

বাংলাদেশে যে এত বিপুল পরিমাণ খাদ্য-সামগ্রী এসেছে, তার কি হ’ল ? “কি হয়েছে তা সকলেই জানে। সব ভারতে পাচার হয়ে গেছে।” — হাদী জবাব দিলেন।
সর্বত্রই শােনা যায় যে, প্রচুর পরিমাণ গম ও চাল ভারতে পাচার হয়ে যায়। স্বাধীনতার পর আট/দশ মাস পর্যন্ত ধারণা করা হত যে, স্থানীয় রাজনৈতিক চাইরা রিলিফের গম ও চাল আত্মসাৎ করে কালোবাজারে বিক্রী করেন। এখন এসব কালােবাজার পর্যন্ত পৌঁছায় না, পথেই উধাও হয়ে যায়।

বিদেশ থেকে যে খাদ্য-শস্য আসে, তা চাটগাঁ বন্দরে তদারক করেন জাতিসংঘের বাংলাদেশস্থ রিলিফ অফিস। যেই মাত্র জাহাজ থেকে খাদ্যশস্য, ময়দা, চিনি, রান্নার তেল ইত্যাদি নামান হ’ল, অমনি তাদের তদারকী শেষ হয়ে গেল। বিতরণ ব্যবস্থার কর্তৃত্ব বাংলাদেশ সরকারের হাতে। শেখ মুজিব আভ্যন্তরীণ বিলি-বণ্টনে বিদেশীদের তদারকী বরদাশত করতে রাজী নন। যদিও বিতরণের সুবিধার জন্যে জাতিসংঘই বাংলাদেশ সরকারকে ৭২৩টি লরী খয়রাত দিয়েছেন। এসব লরীর কয়েকশ’ ঢাকা ও চাটগাঁর রাস্তায় পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে। অনেক রাজনীতিবিদ ও তাদের পরিবারের সদস্যরা এগুলি ব্যক্তিগত বাহন হিসাবেও ব্যবহার করছেন।
চাটগাঁয়ের গুদাম থেকে খাদ্যসামগ্রী দেশের অভ্যন্তরে নারায়ণগঞ্জ ও খুলনা বন্দরে আনীত হয়। সেখান থেকে তা গরু-গাড়ী, লরী, ট্রেন ও ছােট ছােট নৌকায় করে স্থানীয় সরবরাহ ডিপােতে নিয়ে যাওয়া হয়।

এই পর্যায়েই বিতরণ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। প্রাইভেট ডিলাররা তাদের বরাদ্দ ঠিকই নেয়, কিন্তু রেশনের দোকানগুলোতে সম্ভবতঃ অর্ধেক মাত্র সরবরাহ করে। খাতাপত্রে কিন্তু দেখায় যে, পুরা সাপ্লাই দেওয়া হয়েছে। বাদবাকী খাদ্যশস্য তারা সীমান্তের ওপারে পাচার করে দেয়।
বিদেশ থেকে সাহায্যস্বরূপ যে চাল ও গম আসে, সরকার যা ক্রয় করেন এবং দেশে যা উৎপন্ন হয়, সব মিলে দেশের সকল মানুষের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থার তিক্ততম পরিহাস এই যে, যাদের প্রয়ােজন, তারাই পায় না॥”
— লুই সিমনস / গার্ডিয়ান (লণ্ডন) – মার্চ ৩০, ১৯৭৪
০২.
দেউলিয়া হতে চলেছে
“… “স্বাধীনতার পর বত্রিশ মাসে আমরা যা’ কিছু করেছি, বন্যা এসে সব ধ্বংস করে দিয়েছে।”— দুঃখ করে বললেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর মতে বন্যা পাকিস্তানের পঁচিশ বছরের অবহেলার ফল ছাড়া আর কিছু নয়। তিনি তীব্রভাবে অস্বীকার করেন যে, বাংলাদেশ বন্যানিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয়েছে, যদিও অধিকাংশ পর্যবেক্ষকই এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ। উপরন্তু শেখ মুজিব ফের আশা করছেন যে, বহিঃর্বিশ্ব বাংলাদেশের জাতীয় বিপর্যয়ে সঠিকভাবে সাড়া দেবে। গত দুই বছরে কমপক্ষেও ৩ হাজার ৫ শত মিলিয়ন মার্ক সাহায্য দেবার পরও উন্নতির কোন লক্ষণ না দেখে বহিঃর্বিশ্বের ক্রমশঃই ধারণা হচ্ছে যে, বাংলাদেশ একটা ‘তলাবিহীন পিপে’।

সে যাই হােক, ১৯৭০ সালের প্রবল জলোচ্ছাসের সময় এবং বার মাস পরে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালীদের আবেদন দুনিয়া জুড়ে যে সাড়া জাগিয়েছিল, সে তুলনায় এবারকার বন্যা পরিস্থিতিতে বিদেশী সাহায্য নেহাৎ নগণ্য। এ সময় জরুরী অবস্থা মােকাবেলা করার জন্য ঢাকা যেখানে বৈদেশিক মুদ্রায় ৭৯৩ মিলিয়ন জার্মান মার্ক ও আরো ৩৯৩ মিলিয়ন জার্মান মার্কের প্রয়ােজনীয়তার কথা বলছে, সেখানে আজ পর্যন্ত দ্রব্যাদিসহ ২৫ মিলিয়ন মার্কও এসে পৌঁছেনি। একই সময় এই ধারণাও দৃঢ়তর হচ্ছে যে, বাংলাদেশ সরকার নিজেদের অক্ষমতা ঢাকবার জন্য ‘স্কেপ গোট’ খুঁজে বেড়াচ্ছেন এবং বিশেষ করে জনসাধারণের দুঃখ-দুর্দশার উপর তাদের নীতি প্রতিষ্ঠিত করতে প্রয়াস পাচ্ছেন।

অদ্ভুত ব্যাপার এই যে, সরকার এ বছরের বন্যার ক্ষয়-ক্ষতির যে হিসাব দিয়েছেন, তা’ চলতি বছরের উন্নয়ন পরিকল্পনার ঘাটতির প্রায় সমান। প্রকাশ থাকে যে, সে ঘাটতি অর্থ দফতর যে-কোনভাবে বৈদেশিক সাহায্যে পূরণ করতে চেয়েছিলেন।
বন্যায় আক্রান্ত হওয়ার আগেই বাংলাদেশে দেউলিয়াপনার ছায়া দেখা যাচ্ছিল। অধিকন্তু, ইহা সত্য যে, গত জুন মাস থেকেই বাংলাদেশ স্টেট ব্যাংকের গ্যারান্টি সত্ত্বেও বিদেশী ব্যাংকগুলো ‘লেটার অব ক্রেডিট’ প্রত্যাখ্যান করে আসছে। এক কথায়, বাংলাদেশ সরকার যদি বিদেশে এ বিশ্বাস জন্মাতে অপারগ হন যে, ভবিষ্যতে বৈদেশিক সাহায্যের সঙ্গে আভ্যন্তরীণ প্রচেষ্টা আরো ব্যাপক হবে, তাহলে দেশ অপ্রতিরােধ্য গতিতে দেউলিয়াপনার দিকে এগিয়ে যাবে॥”
— ওয়ার্নার এ্যাডাম / ফ্রাংকফুর্ট এলজেমাইন (পশ্চিম জার্মানী) – আগস্ট ২০, ১৯৭৪
০৩.
মিথ্যা আর দুর্নীতি বেড়েই চলেছে
“… প্রতি সপ্তাহে বাংলাদেশ থেকে ভয়াবহ খবর আসে। আমরা আমাদের এশীয় সংবাদদাতা মিঃ কারলস উইডামকে ‘এশিয়ার পর্ণ কুটীরে’ পাঠিয়েছিলাম। সেখানকার পরিস্থিতির তিনি যে মূল্যায়ন করেছেন, তা অত্যন্ত ভীতিপ্রদ : লােভী বাংলাদেশ সরকারের কর্তারা বন্যাপীড়িত লােকদের জন্য দেওয়া আন্তর্জাতিক খয়রাত আত্মসাৎ করে মােটা হচ্ছেন। সাহায্যকারী দেশগুলো এ সম্পর্কে ওয়াকেফহাল, ফলে তারা আর সাহায্য দিতে ইচ্ছুক নয়। কিন্তু এদিকে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ প্রতিদিন গরীব থেকে আরাে গরীব হচ্ছে।
এমন কি আদর্শবাদীরাও বাংলাদেশ সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে পড়েছেন। প্রথমদিকে বাংলাদেশ সরকারের হিসাবে বন্যায় মৃতের সংখ্যা ছিল ২,০০০। এখন তা’ নেমে ১,৭০০-তে দাঁড়িয়েছে। এই বিভ্রান্তিকর তথ্যের জন্য কারো কারো মুখে মন্তব্য শােনা যাচ্ছে যে, তারা ঠিক জায়গা মত কমা বসিয়েছিলেন কিনা ? আরাে সন্দেহ করা হয় যে, বন্যা পরিস্থিতিকে ভয়াবহ করে দেখিয়ে বেশী সাহায্য আদায়ের উদ্দেশ্যে সরকারী হিসাব বাড়িয়ে তােলা হয়েছিল। তবে উন্নতি এবং উন্নয়নশীল দেশসমূহ এই বিষয়ে বেশ সচেতন। ফলে পুরান প্রবাদটিরই পুনরাবৃত্তি চলছে : “বাঙালীদের মাথা আকাশে, পা ধূলায় ও হাত অপরের পকেটে।”

এ ব্যাপারে কারাের সন্দেহ নাই যে, দুর্ভিক্ষ সামলাবার জন্য বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ সাহায্যের প্রয়ােজন। কিন্তু সাহায্যকারী দেশগুলোর ধারণা এই যে, বন্যার অজুহাতে বাংলাদেশ সরকার অধিকতর খয়রাত আদায় করে নিজেদের দুর্নীতির খােরাক যােগাতে চাচ্ছে।

যদিও বাংলাদেশ ১৯৭৩ সালের শেষ নাগাদ প্রায় ৪ হাজার মিলিয়ন ফ্র্যাংক সাহায্য পেয়েছে (এত কম সময়ে এত বেশী সাহায্য আর কোন উন্নয়নশীল দেশ কখনো পায়নি) তবুও সরকার বন্যা প্রতিরােধকল্পে কোন টাকাই বরাদ্দ করেননি। এক কোটি বেকার বাঙালীকে মাটির বাঁধ তৈরী, খাল খনন প্রভৃতি ফলপ্রসূ কাজে নিয়ােজিত করা যেত। এভাবে চীন ও ভারতে কাজ হয়েছে।
‘নিজের সাহায্যের জন্য নিজেও সাহায্য কর’—একথা বাংলাদেশে অর্থ হীন। কেননা, যত সাহায্য এসেছে, তা’ আওয়ামী লীগ নেতাদের ব্যক্তিগত পকেটে গিয়েছে। মিঃ টনি হেগেন — যিনি বাংলাদেশে জাতিসংঘের দেওয়া সাহায্যের চার্জে ছিলেন — প্রকাশ করেছিলেন যে, যাবতীয় খয়রাতি শিশুখাদ্য ও কম্বলের অতি অল্পই ঠিক জায়গায় পৌঁছেছে। বাদবাকী কালােবাজারে বিক্রী হয়েছে অথবা পাচার হয়ে ভারতে চলে গেছে। সে অবস্থার আজো পরিবর্তন হয়নি। ঢাকার সংবাদপত্রে যখন ঘােষণা করা হ’ল যে বন্যা পীড়িতদের জন্য এক উড়ােজাহাজ ভর্তি গুড়া দুধ বিমান বন্দরে আসছে, ঠিক তার পরদিনই ঢাকার হােটেল ম্যানেজাররা ওগুলাে কিনতে বাজারে তাদের লোক পাঠিয়ে দিলেন। বস্তুতঃ এইভাবেই বাংলাদেশে বন্যার্তদের জন্য দেওয়া বিদেশী সাহায্য বিতরণ করা হয়ে থাকে।

যে সরকার শিয়ালকে হাঁস পাহারা দিতে দিয়েছেন, অর্থাৎ যে সরকার কুখ্যাত জোচ্চোর (দেশে ও বিদেশে) গাজী গােলাম মােস্তফাকে জাতীয় রেডক্রসের সভাপতি নিযুক্ত করেছেন, সে সরকার সম্পর্কে কোন কিছুতেই বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। মােস্তফা এ পদ পেয়েছেন, যেহেতু তিনি ঢাকা আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন।
এই গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকায় তার অনেক বেশী মওকা মিলেছে। তিনি শুধু গুড়া দুধই কালোবাজারে বিক্রী করেননি, অনেক ঔষধ-পত্রও আত্মসাৎ করেছেন। বাংলাদেশ রেডক্রসের সভাপতি এখন ৩৭টি ঔষধের দোকানের মালিক।
এ ধরনের বিবেকবর্জিত কাজের ফল চাক্ষুষ দেখতে হলে ৩ মাইল দূরে পুরান ঢাকার গেণ্ডারিয়া স্কুলে যাওয়া যেতে পারে। স্কুলটি এখন বন্যায় ঘর-বাড়ী হারিয়েছে এমন দুই হাজার পাঁচশ লােকের আশ্রয়স্থল। সারি সারি কঙ্কালসার শিশুরা শুয়ে আছে — এত দুর্বল যে, ওদের কাঁদবার শক্তিটুকও লোপ পেয়েছে।
‘ক্যাম্প’-এর পরিচালককে জিজ্ঞাসা করা হল, সাহায্যকারী প্রতিষ্ঠান গুলাের কাছ থেকে তিনি কিছু পেয়েছেন কিনা? তিনি জবাব দিলেন “হ্যাঁ — পেয়েছি, জাতীয় রেডক্রসের কাছ থেকে। দুর্ভাগ্যবশতঃ তা কাজে আসেনি। যে দুইটি সুইডিশ বিস্কুটের ও একটি ফরাসী শিশু-খাদ্যের বাক্স রেডক্রস দিয়েছিল, তা কীট আর পােকায় ভর্তি ছিল। এ সব খাদ্য গতকালকের উড়োজাহাজে আসেনি। ১৯৭০ সালের বিপর্যয়ের সময় থেকেই এগুলাে গুদামজাত হয়ে পড়েছিল॥”
— টাজেস আর্জগার / জুরিখ – আগস্ট ২৯, ১৯৭৪
০৪.
বাংলাদেশ আজ দেউলিয়াত্বের পথে
“… বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি লোক দুনিয়ার দরিদ্রতম মানুষের শ্রেণীভুক্ত। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে বার্ষিক গড়পড়তা মাথাপিছু আয় তিরিশ পাউণ্ডের কাছাকাছি, যা দিয়ে ঢাকা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হােটেলে, যেখানে অধিকাংশ ইউরােপীয়ানরা অবস্থান করেন — একটি রুম দু’রাতের জন্য ভাড়া নেওয়া যায়। বাংলাদেশের জন্মের পর থেকে যে বৈদেশিক সাহায্য এসেছে তা ইতিপূর্বেই দুই হাজার মিলিয়ন ডলারের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। অন্য কথায়, প্রতিটি পুরুষ, নারী ও শিশুর জন্য মাথাপিছু দশ পাউণ্ড করে সাহায্য এসেছে। এ ছাড়া বহু দাতব্য প্রতিষ্ঠানও মােটা রকমের সাহায্য দিয়েছে। এই উদার দান যুদ্ধোত্তর দুর্ভিক্ষ এড়াতেও ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা ঘাট মেরামতে দেশকে সাহায্য করেছে। কিন্তু ক্রমেই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, এই সাহায্যের উপযুক্ত ব্যবহার হয়নি।

ভূমিহীন কৃষকদের অবস্থা স্পষ্টতঃই দিনে দিনে আরো ভয়াবহ হয়ে উঠছে। রিলিফের মাল কালােবাজারে বিক্রী এত ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল যে, রেডক্রস-এর আন্তর্জাতিক সংসদ এক পর্যায়ে বাংলাদেশ থেকে একেবারেই চলে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সারা দুনিয়া সাহায্য দিয়ে বাংলাদেশকে প্লাবিত করে দিয়েছে। এর পরিমাণ ‘মার্শাল পরিকল্পনার’ সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। অথচ ঢাকা থেকে মাত্র ৩৫ মাইল দূরে গত সপ্তাহে একটি শিশু মেয়ে গাছের পাতা খাচ্ছিল বেঁচে থাকার জন্য। ওর কাহিনী আদৌ নজীরবিহীন নয়!
বাংলাদেশ আজ দেউলিয়া, এর কল-কারখানা স্তব্ধ। শতকরা ৪ ভাগ যানবাহন — যা চাউল পরিবহনে অপরিহার্য — ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। দেশটির প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী পাটের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। পাটকল ও পরিবহন ব্যবস্থা পুরাদমে চালু রাখার জন্য অতিরিক্ত কল-কব্জা আমদানী করার সামর্থ্য এ সরকারের নেই। ২ কোটি ৬০ লক্ষ শ্রমিকের এক তৃতীয়াংশ বেকার। চাউলের দাম বহুগুণ বেড়ে গেছে, অথচ মানুষের আয় বাড়েনি। এই দু:খ দৈন্যের একটা ফলশ্রুতি বেপরােয়া খুন-খারাবী। দশ দিন আগে বােমা বিস্ফোরণের ফলে বাংলাদেশের বৃহত্তম সার কারখানা বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। ঐদিনই চারটি চালের গুদাম লুষ্ঠিত হয়েছে এবং কয়েকজন আওয়ামী লীগের ক্ষমতাসীন সদস্য খুন হয়েছে॥”
— জন সােয়ালন / দি সানডে টাইমস্ – সেপ্টেম্বর ২২, ১৯৭৪
০৫.
বাংলাদেশ ট্রাজেডি
“… এমন এক দিন ছিল যখন শেখ মুজিব ঢাকার রাস্তায় বের হলে জনসাধারণ হাত তুলে “জয় বাংলা”— বাংলাদেশের জয়ধ্বনিতে মেতে উঠত। আর আজ যখন স্বীয় বাসভবন থেকে তিনি অফিসের দিকে যান, তখন দু’দিকে থাকে পুলিশের কড়া পাহারা। পথচারীরা সজ্ঞানে তার যাতায়াত উপেক্ষা করে। জাতির পিতাও আর গাড়ীর জানালা দিয়ে হাত আন্দোলিত করেন না — তার দৃষ্টি থাকে সামনের দিকে নিবদ্ধ।
বাংলাদেশ আজ বিপজ্জনকভাবে অরাজকতার মুখােমুখি। লাখ লাখ লােক ক্ষুধার্ত। হাজার হাজার মানুষ অনাহারে আছে। অনেকে না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে। মফঃস্বল এলাকায় স্থানীয় কর্মচারীরা ভয় পাচ্ছে যে, আগামী তিনটা মাস খুব দুঃসময় যাবে।
ক্ষুধার্ত মানুষের ভীড়ে ঢাকায় দম বন্ধ হয়ে আসে। এখন আবার চলছে বন্যা উপদ্রুতদের ভীড়। গত তেত্রিশ মাসে ঢাকার জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে তিরিশ লাখে। নতুন যারা ভীড় করছে তারা এমন নােংরা বাড়ীতে থাকে যার তুলনা দুনিয়ার কোথাও নেই। কোথাও যদি বিনামূল্যে চাল বিতরণ করা হয়, সেখানে শরণার্থীদের মধ্যে মারামারি লেগে যায়। বুদ্ধিজীবীরা বলেন, এই ক্ষুধার্ত জনতা ক্ষেপে গেলে তাদের রক্ষা নেই।
বাংলাদেশ আজ দেউলিয়া। গত আঠার মাসে চালের দাম চারগুণ বেড়েছে। সরকারী কর্মচারীদের মাইনের সবটুকুই চলে যায় খাদ্য-সামগ্রী কিনতে। আর গরীবরা থাকে অনাহারে। কিন্তু যতই বিপদ ঘনিয়ে আসছে, শেখ মুজিব ততই মনগড়া জগতে আশ্রয় নিচ্ছেন। ভাবছেন, দেশের লােক এখনও তাকে ভালবাসে — সমস্ত মসিবতের জন্য পাকিস্তানই দায়ী — আর বাইরের দুনিয়া তাঁর সাহায্যে এখনাে এগিয়ে আসবে এবং বাংলাদেশ উদ্ধার পাবে। নিছক দিবাস্বপ্ন!
মুজিব সম্পর্কে বরাবরই সন্দেহ ছিল। নেতা হিসেবে থাকার আজো তাঁর আকর্ষণ রয়েছে। তিনি আবেগপ্রবণ বক্তা। তার অহংকার আছে — সাহস আছে। কিন্তু আজ দেশ যখন বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখনও তিনি দিনের অর্ধেক ভাগ আওয়ামী লীগের চাঁইদের সাথে ঘরােয়া আলাপে কাটাচ্ছেন। যিনি বাংলাদেশের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বহু ছােটখাট বিষয়েও সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, তিনি আজ আত্মম্ভরিতার মধ্যে কয়েদী হয়ে চাটুকার ও পরগাছা পরিবেষ্টিত হয়ে আছেন।
বাইরের দুনিয়া বাংলাদেশের দুর্নীতির কথা ফলাও করে বলে থাকে। সমাজের নীচুতলায় যারা আছে, তারা হয়ত আজ খেতে পেয়েছে — কিন্তু কাল কি খাবে জানে না। এমন দেশে দুর্নীতি অপরিহার্য।
তবে এমন লােকও আছে যাদের দুর্নীতিবাজ হবার কোন অজুহাত নেই। সদ্য ফুলে-ফেঁপে ওঠা তরুণ বাঙালীরা হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের শরাবখানায় ভীড় জমায়। তারা বেশ ভালই আছে। এরাই ছিল মুক্তিযােদ্ধা – বাংলাদেশের বীর বাহিনী। গেরিলাযুদ্ধে এরা পাকিস্তানকে হারিয়েছে। তাদের প্রাধান্য আজ অপরিমেয়। রাজনৈতিক দালালী করে ও ব্যবসায়ীদের পারমিট জোগাড় করে তারা আজ ধনাঢ্য জীবন যাপন করছে। সরকারী কর্মচারীদের তারা ভয় দেখাচ্ছে। নেতাদের উপর প্রভাব বিস্তার করছে এবং প্রয়ােজন হলে অস্ত্র প্রয়ােগ করছে। এরাই হচ্ছে আওয়ামী লীগের বাছাই করা পােষ্য।
আওয়ামী লীগের ওপর তলায় যারা আছেন, তারা আরাে জঘন্য। যাদের মুক্ত করেছেন সেই জনসাধারণের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে তারা আজ ফুলেফেঁপে উঠেছেন। অবশ্য তাদের অসদুপায়ে অর্জিত অর্থ আজ সহসা বিলিয়ে দিলেও সাধারণ মানুষের অবস্থা তাতে ভাল হবে না। প্রতিটি মানুষ কেবল নিজের কথাই ভাবছে — ভাবছে আগামীকাল তার কি হবে ?
শুনতে রূঢ় হলেও কিসিঞ্জার ঠিক কথাই বলেছেন : “বাংলাদেশ একটা আন্তর্জাতিক ভিক্ষার ঝুলি।” ত্রাসজনক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকার বর্তমান বিপর্যয়ের মােকাবেলা করার চেষ্টা করছেন।
আন্তর্জাতিক সমাজ তার পুতুল বাংলাদেশ সম্পর্কে ধৈর্যহারা হয়ে পড়েছে। গত ৩২ মাসের রিলিফ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে — এই কঠোর সত্যের মুখােমুখি হয়ে রিলিফকর্মী এবং কুটনৈতিক মিশন ও জাতিসংঘের অফিসাররা বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশের লােকদেরকেই দোষারােপ করছেন॥”
— জনাথন ডিম্বলবী / নিউ স্টেটসম্যান (লণ্ডন) – সেপ্টেম্বর ২৭, ১৯৭৪

তথ্যসূত্র বাংলাদেশঃ বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর / সম্পা : মুনিরউদ্দীন আহমদ ॥ [ নভেল পাবলিশিং হাউস – জানুয়ারী, ১৯৮৯ । পৃ: ৫৭৯-৫৮৭ ]

Kai Kaus

Leave a Reply

You must be logged in to post a comment.

Editor in Chief: Dr. Omar Faruque

Editor: Dr. Morjina Akhter

All contact: 400E Mosholu Parkway South Apt # A23,The Bronx, New York 10458, USA

Mob. 001.347.459.8516
E-mail: dhakapost91@gmail.com