আমেরিকায় দরিদ্রতা।।
নিউইয়র্কের রাস্তায় গাড়ি অনেক গাড়ি চলছে। বিপুল সংখ্যক সুউচ্চ ভবন দাঁড়িয়ে আছে। বিকট শব্দে হর্ন বাজিয়ে চলছে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি, হাসপাতালের এ্যাম্বুলেন্স কিংবা পুলিশের গাড়ি। প্রতিনিয়তই এসব গাড়িগুলো যাচ্ছে। এ সব গাড়িগুলোর শব্দ শুনলে আপনি হয়ত মনে করবেন এ শহরটি বোধ হয় রোগী আর অপরাধীতে ভরা। তা হলে এত এ্যাম্বুলেন্স বা এত পুলিশের গাড়ি চলে কেন? আর ফায়ার সার্ভিসের গাড়িগুলোর অনবরত যাতায়াত দেখেও মনে হতেই পারে যে, এখানে মানুষগুলো এত বেক্কল কেন? শুধু আগুনই বুঝি লাগায়।
জন এফ ক্যানেডি, লাগুর্ডিয়া কিংবা আমাদের এই স্টুয়ার্ট আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরেও বিমান উঠানামা করছে অগুণতি। নিউইয়র্কের স্টক এক্সচেঞ্জও চাঙ্গা, অন্তত প্রতিদিনের ডো জোন্স, ন্যাসড্যাক অথবা এসএন্ডপি ফাইভ হান্ড্রেডের উঠানামায়। শপিং মল কিংবা রাস্তার ধারের গ্যাস স্টেশনগুলোতে ভীড়বাট্টা আগের চেয়ে একটু কম। নিত্য প্রয়োজনীয় খাবার কেনাকাটায় গ্রোসারিগুলোতে ভীড় লেগেই আছে। যদিও বাহারি পোশাক-পরিচ্ছদ কেনায় দ্বিতীয়বার চিন্তা করতে হচ্ছে। তথাপি জুয়েলারি দোকানগুলোতে কিছু মানুষ এখনো যাচ্ছে। এসব দেখে বোঝার উপায় নেই আমেরিকা নিদারুণ এক অর্থনৈতিক সঙ্কটে। এবং এই সঙ্কট দিনে দিনে ঘণীভূত ছাড়া কমার কোনো লক্ষণ নেই!
আমেরিকা ল্যাণ্ড অব ইমিগ্র্যান্ট। প্রতিদিন এখানে মানুষ আসছে, স্থায়ী বসতি গাড়ছে। নতুন যারা আসেন, তারা এতটুকুও আঁচ করতে ব্যর্থ হয় যে, আমেরিকার চাকুরির বাজার সঙ্কুচিত হতে হতে এখন প্রায় শূন্যের কোঠায় এসে ঠেকেছে! তাদের এই আঁচ করতে না পারার কারন, আমেরিকা সম্পর্কে সমৃদ্ধির পূর্ব ধারণা। আমেরিকার ঋজু বক্র হওয়ার এমনটা কথা ছিল না। আমেরিকান ড্রীম বলে কথা! স্বপ্ন ভাঙ্গতে কে চায়?
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক দূর্দশা কবে থেকে শুরু, এ প্রশ্ন যদি আপনি কাউকে করেন, তাহলে অন্তত আশি ভাগ উত্তর দেবেন ‘নাইন এলিভেন’। ২০০১ সালের এই একটি ঘটনাই কি আমেরিকার অর্থনৈতিক দূর্দশার জন্য দায়ী? নাকি পুজিবাদী বিশ্ব অর্থনীতিতে দশক অন্তর একবার এ ধরণের অর্থনৈতিক বিপর্যয়, ইতিহাসের প্রায় নিয়মিত ঘটনা! ইতিহাস অন্তত তাই বলে- ১৯৩০-এর মহামন্দার পরও আমেরিকা বহু মন্দাকাল অতিক্রম করেছে। খনিজ সম্পদে আমেরিকা তখনো প্রাচুর্যময় ছিল। বৈজ্ঞানিক আবিস্কার কিংবা অভিবাসী আগমণ তখনো বন্ধ ছিল না।
তবে আসলেই আমি তো বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ঘুরেছি। দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ তো খুব ভাল করেই চষে বেড়িয়েছি। আলহামদুল্লিাহ
আমেরিকার চলমান অর্থনৈতিক মন্দা সম্পর্কে নিউইয়র্ক টাইমস একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন ছেপেছে গত একুশে এপ্রিল ২০১৪তে পত্রিকাটির প্রথম পাতায়। এর শিরোনাম ছিল 50 years into war on poverty, Hardship hits back. প্রতিবেদনটি যদিও পশ্চিম ভার্জিনিয়ার ‘’ম্যাকডোয়েল’ নামে একটি কাউন্টিকে নিয়ে, প্রকৃতপক্ষে এটিই আমেরিকার চিত্র। যখন ঘটনাবলী মেলানোর চেস্টা করবেন, তখন বলা যায় ফলাফল একটাই হবে।
১৯৬৪ সালে জন এফ কেনেডি প্রেসিডেন্ট হয়ে এ কাউন্টিতে এসে ‘ফুড স্ট্যাম্প’ বা খাদ্যভাতা প্রবর্তনের ঘোষণা দেন। এরপর পর্যায়ক্রমে পুরো আমেরিকা জুড়ে ফুড স্ট্যাম্পের পাশাপাশি চালু হয় গরীবদের জন্য মেডিকেয়ার, মেডিকেইড, স্কুলে ফ্রী টিফিন ইত্যাদি কার্যক্রম। অবশ্য সামাজিক নিরাপত্তা বা সোশাল সিকিউরিটি ব্যবস্থা চালু হয়েছিল তারও আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের আমলে।
আজ পাচ দশক পর কেউ যদি প্রশ্ন করেন আমেরিকায় দারিদ্র বেড়েছে, না কমেছে, তাহলে চলুন দেখি ইউএস সেন্সাস ব্যুরোর রিপোর্ট কি বলে। ২০০০ সালে যেখানে দারিদ্র সীমার নীচে ছিল তিন কোটি মানুষ, ২০১৩ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫ কোটিতে। দারিদ্র ও বেকারত্বের কারণে অন্তত এক কোটি মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকান রাস্ট্রের নাগরিক যুক্তরাস্ট্র ত্যাগ করেছে, তা না হলে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা যে দ্বিগুণে দাঁড়াত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অন্তত ২৫টি বড় মেট্রোপলিটন নগরীতে দারিদ্রের হার বেড়েছে ৮ শতাংশ থেকে ১৯ শতাংশে। এটা মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৬ শতাংশ।
নিউইয়র্ক টাইমসের রিপোর্ট বলছে ৩৫৩টি কাউন্টিতে গত তিন দশকে অব্যাহত দারিদ্র বেড়েছে, এবং তা ২০ শতাংশের বেশি। দারিদ্রের বিবিধ সামাজিক প্রতিক্রিয়া আছে। এর প্রধানত একটি সামাজিক চিত্র হল- ৪৬ শতাংশ শিশু-কিশোর তাদের জন্মদাতা পিতা-মাতার সঙ্গে অবস্থান করে না। সাধারণত স্কুল ডিস্ট্রিক্ট-এর অফিসে পিতামাতার রেকর্ড রাখা হয়। সেখানে দেখা গেছে এসব শিশু-কিশোরের পিতামাতারা হয় কারাগারে, মারা গেছে, নয়ত সন্তানদের তাদের দাদী-নানীর কাছে ফেলে পালিয়ে গেছে।
এখন দেখা যাক, নিউইয়র্ক নগরীর ব্রোঙ্কসের বেশিরভাগ এলাকায় দারিদ্র সীমার নিচে অন্তত চল্লিশ শতাংশ মানুষ। কিন্তু ব্রঙ্কসেরই রিভারডেল এলাকায় দারিদ্র সীমার নিচে লোকের সংখ্যা মাত্র সাত শতাংশ। দেখা যাচ্ছে, ঢাকা, দিল্লি, ব্যংকক ইত্যাদি শহরের মত নিউইয়র্কেও দরিদ্র ও ধনীদের এলাকা বিভক্ত। এ বিভক্তি দরিদ্র ও সম্পদশালীদের মধ্যে। শহরের একটি অংশে আইনশৃঙ্খলা, স্কুল, কলেজ, চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত থাকলেও আরেকটি অংশে দেখা যাবে এর বিপরীত দৃশ্য!
যুক্তরাষ্ট্রে দারিদ্র সবচেয়ে বেশি গ্রামীণ এলাকায় এবং শহরগুলোর কেন্দ্রতে। বর্ণ বিচারে গ্রাম এলাকায় শ্বেতাঙ্গ, এবং শহর এলাকায় কালো এবং হিস্পানিকদের মধ্যে দরিদ্রের সংখ্যা সর্বাধিক। সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে এশীয় বংশদ্ভুতরা। এদের মধ্যে দারিদ্র যেমন কম, তেমনি এদের শিক্ষার হারও সর্বাধিক। যুক্তরাষ্ট্রে দারিদ্রসীমা কত? সাধারণত চারজনের পরিবারে বছরে ২৩ হাজার ডলারের নিচে আয় হলেই সেটি দরিদ্র পরিবার।
দারিদ্রের একটা রূপ আছে। এ রূপটি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে ধরা পড়ে খুব সহজে। গ্রাম এলাকায় অনুন্নত বাসস্থান, পুস্টিহীনতা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুস্প্রাপ্যতা ইত্যাদি। শহর এলাকায় থাকে আন্ধার বস্তি এলাকা। যেখানে গাদাগাদি করে বাস করে সমাজের দরিদ্র মানুষ। কিন্তু আমেরিকায় দরিদ্র মানুষদের কদাচিৎ চেনা যায়। এরা ভিক্ষা করে না। রাস্তায় জটলা পাকিয়ে গল্প করে না। এরা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বঞ্চিত নয়। তাহলে এদেরকে চিনবেন কি করে?
মুস্টিমেয় কিছু লোক হোমলেস বা গৃহহীন। এক কোটির পুরো নিউইয়র্ক নগরীতে হয়ত গৃহহীনের দেখা মিলবে হয়ত বড়জোর শতেক। এদেরকে দেখলেই চেনা যায় এরা হতদরিদ্র। তবে এরা চাইলে যে হোমলেস শেল্টারে রাত কাটাতে পারে, তাও সত্য।
তাহলে দরিদ্রদের চিনবেন কিভাবে। আপনাকে যেতে হবে কয়েকটি সূচকের কাছে। যেমন ড্রাগ কিংবা মাদকাশক্তির সংখ্যা কেমন। বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা কেমন। ক্যালোরি সর্বস্ব জাঙ্ক খাদ্য গ্রহণের ফলে দেহের স্থুলতা সমাজে কাদের মধ্যে বেশি। শহরের কোন এলাকাগুলোতে অপরাধ প্রবণতা খুবই মারাত্মক, ইত্যাদি।
নিউইয়র্ক, শিকাগোর অনেক এলাকায় আপনি দিনে দুপুরেও চলাচল করতে পারবেন না। শহরের অনেক এলাকায় আপনি হয়ত আপনার গাড়িটি পার্ক করে গেছেন। ঘন্টা খানেক পরে এসে দেখবেন, গাড়িটির কাঁচ ভেঙ্গে মূল্যবান জিনিষপত্র কেউ লুটে নিয়েছে, অথবা দেখা গেল পুরো গাড়িটাই গায়েব করে দিল! তৃতীয় বিশ্ব সম্পর্কে পশ্চিমাদের অনেক নাক সিটকানো আছে। কিন্তু অপরাধের এ প্রবণতা অন্তত তৃতীয় বিশ্বে এমন মারাত্মক নয়!
নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় যে ম্যাকডোয়েল কাউন্টির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে- সম্প্রতি দেউলে ঘোষণা করা ডেট্রয়েট নগরীর বাড়ি-ঘরের মত এখানকার ঘরবাড়ির প্রায়টির দরোজা জানালা ভাঙ্গা। দোকান-পাটের শার্টারে তালা। কেবলমাত্র প্রেসক্রিপশনে বিক্রয়যোগ্য ঔষধ এখানে ব্যবহৃত হচ্ছে মাদক হিসেবে। মাত্রাতিরিক্ত মাদক সেবনে মৃত্যুর হার এখানে জাতীয় গড়ের চেয়ে আট শতাংশ বেশি। ২০১১ সালে এখানে যে ১১৫টি শিশু ভূমিষ্ঠ হয়, তার মধ্যে চল্লিশ শিশুর জন্মে মাতৃগর্ভে থাকাকালে মায়েদের মাদক প্রীতির ক্ষতিকর প্রভাব দেখা গেছে।
আপনি যদি জিজ্ঞেস করেন, গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রে কলেজের সংখ্যা বেশি বেড়েছে, না কারাগারের সংখ্যা? উত্তরটি হবে কারাগারের। দারিদ্রের কারণে সমাজে অপরাধ প্রবণতা বেড়েছে। স্কুলে বেড়েছে ড্রপ আউটের সংখ্যা। একইভাবে কলেজ শিক্ষার ব্যয় ভার বেড়ে যাওয়ায় নতুন কলেজ নির্মাণ হয় না। কিন্তু তার বিপরীতে দীর্ঘ মেয়াদি বেকারত্বের কারণে যুবক তরুণদের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে মারাত্মক হতাশা।
কংগ্রেশনাল রিসার্চ কমিটির সাম্প্রতিক এক গবেষণায় সরকারকে ‘যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি’ প্রসঙ্গে সতর্ক করা হয়েছে । গত ত্রিশ বছরে কয়েদীর সংখ্যা ২৫ হাজার থেকে বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ১৯ হাজারে। প্রায় আট’শ গুণ বেশি! বিশ্বের যে কোন অংশের তুলনায় এ হার অনেক বেশি! বর্তমান সময়ে প্রতি এক লাখ লোকের মধ্যে অন্তত ৭১৬ জন কারাগারে।
ইউএস হিউম্যান রাইটস প্রোগ্রামের উপ-পরিচালক মারিয়া ম্যাকফারলেণ্ড বলেছেন, এটা যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় মানবিক সমস্যা যে, অপরাধিদের বড় অংশ দরিদ্র, সংখ্যালঘু জাতি গোষ্ঠীর এবং সমাজে যাদের কোন স্বীকৃতি নেই! সাম্প্রতিক সময়ে অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে কিশোর-তরুণরা। এটা সমাজের আরেকটি ক্ষতিকারক দিক!
তারপরও বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে দরিদ্রদের খালি চোখে সনাক্ত করা প্রায় কঠিন। কারণ এদের জন্য আছে বেশকিছু সামাজিক নিরাপত্তা। খাদ্য সহায়তা ফুড স্ট্যাম্প, বাসস্থান সহায়তা- সেকশন এইট প্রোগ্রাম, চিকিৎসা সহায়তা- ম্যাডিকেইড, গর্ভবতী মায়েদের জন্য উইক প্রোগ্রাম ইত্যাদি। সামরিক খাতের পর বাজেটের সবচেয়ে বড় অংশটি চলে যাচ্ছে এসব সামাজিক খাতে। আর এ জন্য সরকারের উপর করদাতাদের বিরক্তিও বাড়ছে দ্রুতগতিতে। সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় চাকরিজীবী অথবা ছোটখাট ব্যবসায়ী মধ্যবিত্তরা। তারা দেখছে, তাদের করের টাকায় সমাজে কিছু লোক কাজ না করেও দিব্যি দিন কাটিয়ে দিচ্ছে। কোন কোন পরিবারের উপার্জনশীলরা তিন-চার বা তারচেয়েও বেশি বছর ধরে বেকার। তাদের চাকরির আশাও দিনে-দিনে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে। এ পরিস্থিতি থেকে সহসা যে মুক্তি মিলবে, তেমন সম্ভাবনাও নেই।
এক সময় দারিদ্রের বিরুদ্ধেও মানুষ দাঁড়িয়েছে সম্মিলিতভাবে। কিন্তু আজ বিভক্তি সমাজের উঁচুতলার রাজনীতিকদের মাঝেই। ডেমোক্রেট এবং রিপাবলিকান এ দুই শিবিরে বিভক্ত পুরো যুক্তরাষ্ট্র। দুটি পক্ষই দারিদ্র থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে ব্যর্থ, এমন ধারণ পোষণ করেন পত্র-পত্রিকা পড়েন, রাজনীতির খোঁজ খবর রাখেন এমন সকলেই।