আমি একজন কবি, আমি রাজনৈতিক নেতা নইঃ কবি আল মাহমুদ।
প্রিয়ঃ কেমন আছেন? আল মাহমুদঃ ভালে আছি…
প্রিয়ঃ শুনলাম আজ সন্ধ্যায় একটা দাওয়াতে যাবেন…
আল মাহমুদঃ আমার গাড়িও নাই, লোকজনও নাই। তাই ইচ্ছা করলেই কোথাও যেতে পারি না। অনেক দাওয়াত থাকে, কিন্তু যাওয়া হয় না।
প্রিয়ঃ এই আশি বছরেও একটা গাড়ি কিনতে পারলেন না।
আল মাহমুদঃ আরে ভাই কি বলবে আর সে দুঃখের কথা। করতে পারি নি। ছেলেমেয়েদের কারণে হলে না। শুধু টাকা চায়। দিয়েছি টাকা। কিন্তু তারা তো আর কেউ আমার সঙ্গে থাকলে না।
প্রিয়ঃ দেশের প্রধান কবি এবং সিনিয়র সিটিজেন হিসেবে সরকার কি আপনাকে একটা গাড়ি দিতে পারে না…
আল মাহমুদঃ [একটু ভাবলেন চোখ তুলে] সে তো আর আমি জানি না। সরকার তো আমার বশ না।
প্রিয়ঃ শোনা যায়, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় থাকতে আপনাকে একটি বাড়ি দিয়েছিলেন উপহার…।
আল মাহমুদঃ এরশাদ সাহেব আমাকে কোনে বাড়ি টারি দেয় নাই। বনানীতে আমাকে একটা জমি দিয়েছিলে। আমি বাড়ি করেছিলাম সেখানে। বাড়িটা করেছিলাম লোন করে। এদিকে ছেলেমেয়েরা পড়াশোনার জন্য সব বিদেশে গেল। তাদের পড়ালেখার খরচ জোগাড় করতে টাকা লাগে না ভাই? ফোন দিয়েই বলে আব্বা টাকা পাঠাও, আব্বা টাকা পাঠাও। এক কোটি ষাট লাখ টাকায় বাড়িটা বিক্রি করে দিলাম। আমি একটা মানুষ কবি, আমার সোর্স অব ইনকাম কি?
প্রিয়ঃ লেখা…
আল মাহমুদঃ এত টাকা কোথায় পাবে, বাড়িটা বিক্রি করে দিলাম। তোমরা কি জানতে চাও বলে?
প্রিয়ঃ আপনি তো আশি পার করে ৮১ বছরে পা দিচ্ছেন। আপনি কি সকালের আকাশ হতে পারবেন না এ বয়সে?
আল মাহমুদঃ এই যে কথা আছে না যে, একটা পৃথিবী নষ্ট হয়ে গেছে। আরেকটা পৃথিবীর দাবি। আদায় করতে লাগবে সকালের আকাশের মত বয়স।
প্রিয়ঃ আপনার কি সকালের আকাশ হবার মত বয়স নেই?
আল মাহমুদঃ না নেই।
প্রিয়ঃ কেনে?
আল মাহমুদঃ বয়স হয়েছে না। বয়স তো শরীরে চিহ্ন রেখে যায়।
প্রিয়ঃ আপনি কি নিজেকে ওল্ড ভাবেন?
আল মাহমুদ: সত্যি কথা বলতে কি এক সময় সেটা অনুভব করি নাই। সারা দুনিয়া ঘুরে বেড়িয়েছি। পৃথিবীর সবগুলো বড় শহরের ফুটপাত দিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি। প্যারিস, নিউইয়র্ক, লন্ডন সব বড় শহর।
প্রিয়ঃ পর্যটক হয়ে ঘুরেছেন…
আল মাহমুদঃ হ্যাঁ, ঘুরেছি, খেয়েছি, সেখানকার কবিদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছি।
প্রিয়ঃ আপনার মনের বয়স কত ফিল করেন?
আল মাহমুদঃ [হাসলেন] মনের বয়স তো হিসাব করা যায় না।
প্রিয়ঃ মনের তো বয়স বাড়ে না।
আল মাহমুদঃ না বাড়বে না কেন, মনের বয়সও বাড়ে। কারণ কোন কোন ঘটনায় মন কষ্ট পায়, ধাক্কা খায়। এক একটা বছর পার হয় আর শরীরে ধাক্কা দিয়ে যায়।
প্রিয়ঃ ধাক্কাটা কি শরীরে লাগে? না মনে…
আল মাহমুদঃ মাঝে মধ্যে লাগে, মাঝে মধ্যে লাগে না।
প্রিয়ঃ আপনি তো ৮০ পার করে ৮১ তে পা দিচ্ছেন…
আল মাহমুদঃ আপনার বাড়ি কই?
প্রিয়ঃ হবিগঞ্জ, আপনার পাশের জেলা…
আল মাহমুদঃ হুম, হবিগঞ্জ আমার দাদুর বাড়ি। আমার দাদু জমিদার ছিল। একটু অত্যাচারীও ছিল। যাই হোক। সব জমিদারই অত্যাচারী ছিল। আমার দাদা ছিলেন আব্দুল ওহাব মোল্লা। মোল্লা হল আমাদের উপাধি। হ্যাঁ বলেন, আপনারা কিসের জন্য এসেছেন…?
প্রিয়ঃ আপনার সঙ্গে গল্প করতেই এসেছি…আপনার কথা শুনতে এসেছি।
আল মাহমুদঃ আপনার বাড়ি কোথায় রে ভাই…
প্রিয়ঃ হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ, গিয়েছেন নিশ্চয়ই। আমাদের একটা বড় রেল জংশন আছে…পাশেই খোয়াই নদী, সুতাং নদ।
আল মাহমুদঃ আমি যাই নি, যেতেও পারি হয়ত…মনে নেই।
প্রিয়ঃ আপনি কি এখন নিয়মিত লিখতে পারেন…যতটুকু জানি, আপনার চোখে সমস্যা আছে। দেখতে পারেন না ঠিক মত।
আল মাহমুদঃ নিজ হাতে এখন আর আমি লিখতে পারি না। আমার একটা নাতনি আছে, যখন টেলিফোন করি, সে আসে। আমি বলি, সে লিখে দেয়। ও আবার ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্রী। বাংলা ভাষা ভালে জানে না। আগের মত কাগজে কলমে লিখে যে কাটা কুটি করতাম, সেটা পারি না। সেটা করতে হলে একজন লেখককে নিঃসঙ্গ থাকতে হয়। কিন্তু সেই নিঃসঙ্গ থাকা আমার হয় না। যতদিন আমার বউ ছিলে। সে খুব সহযোগিতা করতে। লেখাপড়া বেশি জানতে না। কিন্তু খুব ভালে মনের মানুষ ছিল। গ্রামের মেয়ে ছিলে। আমার আব্বা পছন্দ করে বিয়ে করিয়েছিলেন। আমার বাবার বন্ধুর মেয়ে। আমার পাঁচ ছেলে তিন মেয়ের পুরো সংসারটা সে একা সামলিয়েছে। এখন মনে হয় যে, মানুষটা হঠাৎ মরে গেল।
প্রিয়ঃ তিনি মারা যাবার পর আপনার কি নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছিলে…?
আল মাহমুদঃ হ্যাঁ, শূন্যতা পূরণ হয় কি? পূরণ হয় না। আর সে যদি হয় নিজের স্ত্রী, তাহলে তো হয় না। বিয়ে করতে পারে মানুষ একটার পর একটা।
প্রিয়ঃ আপনি আর বিয়ে করলেন না কেন?
আল মাহমুদঃ আমার ইচ্ছেই করে নি।
প্রিয়ঃ আপনার লেখালেখির অনুপ্রেরণা কি আপনার স্ত্রী ছিলেন…
আল মাহমুদঃ বললাম তো, সে ছিলে গ্রামের মেয়ে। এ সব সে বুঝত না। সে আমার সাহিত্য তৈরিতে কোন সহযোগিতা করতে পারত না। কিন্তু আমি তাকে ভালবাসতাম খুবই। দেখতে ভাল ছিল। লম্বা চওড়া ছিল। গায়ের রং টকটকা ফর্সা ছিল। মনে হত যে, ইউরোপিয়ান । বলে না যে দুধের মত সাদা নারী ঐ রকম আর কি। তবে ফ্যাশন ট্যাশন পছন্দ করত না। গ্রামের মেয়েদের মত শাড়ি পরে থাকত। আমি মাঝে মধ্যে জোর করে বের করে নিয়ে যেতাম বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। কিন্তু সেখানে সে কারো সঙ্গে কোন কথা বলত না।
প্রিয়ঃ উনি বেঁচে থাকতে আপনার জন্মদিনে কী করতেন…
আল মাহমুদঃ তখন তো জন্মদিন তেমন কোন উৎসাহের সঙ্গে পালন হত না। তবে হত আমাদের বাসায় হত। আমার স্ত্রী নানা রকম মজার সব রান্না তৈরি করতেন। আমরা পরিবারের সদস্যরা মিলে সেই খাবার খেতাম আনন্দ নিয়ে। দু’একজন কাছের বন্ধুদের দাওয়াত দেওয়া হত। এই ছিল তখনকার জন্মদিনের আয়োজন।
প্রিয়ঃ এমনিতে আপনার কবিতা, গল্প আর উপন্যাসে যে নারী চরিত্র পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায়, আপনি নারী চরিত্রের প্রতি একটু বেশিই দুর্বল ছিলেন, মানে বেশি যত্নবান ছিলেন…।
আল মাহমুদঃ আমার একটা ছোট উপন্যাস আছে, যার নাম অর্ধেক মানবী। যার অর্ধেক শরীর মানুষের আর অর্ধেক শরীর অসার। সে চলতে পারত না, হাঁটতে পারত না। কিন্তু তার অর্ধেক শরীর ছিল খুবই সুন্দর। তার যে পেইন, তার যৌনক্ষুধা সব মিলিয়ে লেখাটা তৈরি করেছি। একজন বিদেশী কবি এই ছোট উপন্যাসটাকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন।
প্রিয়ঃ পেশাগত জীবনে তো আপনি একজন সংবাদকর্মী ছিলেন। তো আপনার লেখালেখির ক্ষেত্রে কি সংবাদপত্রের জীবন কোন ধরনের প্রভাব ফেলেছে?
আল মাহমুদঃ না, আমার লেখালেখির ক্ষেত্রে কোন প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে নি। এটার কারণ হল, আমি তো জন্ম থেকেই সংবাদপত্রের মানুষ।
প্রিয়ঃ মানে বুঝি নি…
আল মাহমুদঃ আমার আব্বা সংবাদপত্রের ম্যানেজার ছিলেন। আমার মা গৃহবধূ ছিলেন। লেখাপড়া তিনি বেশি জানতেন না। কিন্তু অত্যন্ত সুন্দরী ছিলেন দেখতে। আমাকে অনেকই জিজ্ঞেস করেন, আপনার মা দেখতে কেমন ছিলেন। আমি তখন বলি যে, আমার মাকে দেখলে ফেরেশতাও লজ্জিত হয়েছে। তিনি এত সুন্দরী ছিলেন।
প্রিয়ঃ আপনি কি একাকিত্ব ফিল করেন…
আল মাহমুদঃ ভাই এখন আর একাকিত্ব ফিল করি না। কারণ আমি সব সময়ই ব্যস্ত থাকি। মানুষ আসতেই থাকে। তো আমাদের একটা পারিবারিক নিয়ম হল, যদি কেউ আসে, তার সঙ্গে আমরা কথা বলি। আমার দশটা কাজ থাকলেও আমি তার সঙ্গে কথা বলি। এটা আমাদের পারিবারিক কালচারের মধ্যে আছে।
প্রিয়ঃ আপনার প্রেমের গল্প জানতে চাই…
আল মাহমুদঃ আরে শোন ভাই, প্রেম জিনিসটা যে কি সেটা শিখতে হয়। হৃদয়ের সকল আকুতি এক করে হোয়াট ইজ লাভ শিখতে হয়।
প্রিয়ঃ তার মানে আপনাকেও শিখতে হয়েছে।
আল মাহমুদঃ নিশ্চয়ই শিখতে হয়েছে। হোমার পড়লেই প্রেম শেখা হয়ে যায়।
প্রিয়ঃ সাহিত্যে যৌনতাকে আপনি কীভাবে দেখতে চান…
আল মাহমুদঃ শুধু সাহিত্য নয়, যৌনতা সকল ক্ষেত্রেই রয়েছে। এটা অতি প্রাচীন একটা রীতি। প্রেম বা যৌনতা মানুষকে যেমন ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে, তেমনি আবার প্রেম তাজমহলও গড়ে। তেমনি সাম্রাজ্য ধ্বংস করতে পারে, রাষ্ট্র ধ্বংস করতে পারে।
প্রিয়ঃ আপনি এক জীবনে কয়টি প্রেম করেছেন?
আল মাহমুদঃ [একটু চুপ থেকে ভাবলেন। তারপর বললেন] সে কাহিনী তো ভাই বলতে পারব না। আমার তো বইপত্র আছে। সেগুগলো খুঁজলেই আমার প্রেমের ইতিহাস পাওয়া যাবে। আচ্ছা, আপনারা কোথায় কাজ করছেন।
প্রিয়ঃ প্রিয়.কম এ আছি। এটা একটা অনলাইন সংবাদ মাধ্যম।
আল মাহমুদঃ প্রিয়.কম… আচ্ছা অনলাইন পত্রিকা। অনলাইন পত্রিকার সিস্টেমটা কি…
প্রিয়ঃ আপনার মোবাইলে বা কম্পিউটারে যদি ইন্টারনেট সংযোগ থাকে, তাহলে আপনি যে কোন অনলাইন পত্রিকা ঘরে বসেই দেখতে পারবেন ও পড়তে পারবেন। আপনার কি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে?
আল মাহমুদঃ না, আমি বিষয়টি সম্পর্কে খুব বেশি জানি না।
প্রিয়ঃ রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ অনেক কবির নামেই ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে…
আল মাহমুদঃ আমার নামেও তাহলে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে। আমার ভক্তরা হয়ত করেছে।
প্রিয়ঃ এর মাঝে তো আপনার সঙ্গে একটি মেয়ের ছবি দিয়ে কিছু লোক দুষ্টুমি করেছে ফেসবুকে…
আল মাহমুদঃ হ্যাঁ শুনেছি আমি বিষয়টি। এটা দুষ্টামি না বোকামি করেছে তারা। যে মেয়েটাকে নিয়ে এ কাজটি করেছে, সে মেয়েটি এত ইনোসেন্ট। বিষয়টি শুনেই আমার লজ্জা লেগেছে।
প্রিয়ঃ এবারের জন্মদিনের পরিকল্পনা কি আপনার?
আল মাহমুদঃ আমি তো বাসাতেই এবারের জন্মদিনটা পালন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার কিছু ভক্তরা প্রেসক্লাবে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। সেখানে আমাকে যেতে হবে। কিন্তু আমি তো গরীব মানুষ, ভাই। ওরাই টাকা জোগাড় করে অনুষ্ঠান করছে। কি আর করা, যেতে হবে।
প্রিয়ঃ আপনার রাজনৈতিক দর্শন সম্পর্কে জানতে চাই…
আল মাহমুদঃ হ্যাঁ, সেটা অবশ্য আছে। আমি কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে ধর্মে বিশ্বাস করি। যদিও আমি আনুষ্ঠানিক ভাবে সেটা করি না। আমি কিছু চাইলেই আল্লাহর কাছে চাই। লোকে বলে আল্লাহকে ডাকলে আল্লাহ কি শুনতে পায়? কিন্তু আমার কেন যেন মনে হয়, তিনি কথা বলেন।
প্রিয়ঃ এটা তো আপনার ধর্মীয় বিশ্বাস। প্রত্যেকেরই তার ধর্মের প্রতি বিশ্বাস রয়েছে। জানতে চাচ্ছিলাম, আপনার রাজনৈতিক অবস্থানের জায়গা। একটা বির্তক তো অনেক পুরাতন। সেটা হল, আপনি নাকি বাংলাদশে জামায়াতে ইসলামীকে সমর্থন করেন…!
আল মাহমুদঃ দেখেন, আমি কোনদিন এবং অতীতেও জামায়াত পন্থী ছিলাম না। এরা আমাকে জামায়াত বানিয়েছে। এবং যারা বানিয়েছে, তারা তো দৈত্য বানিয়েছে। এখন দৈত্য তারা সামাল দিতে পারে না। জামাতী কাউকে আমি চিনতামই না। কিন্তু আমার যারা ক্ষতি করতে চেয়েছিল, তারা এটা করেছিল। আর আপনাকে আমার বলতে কোন দ্বিধা নাই, তারা কিন্তু নাই। আমি কিন্তু আছি। কারণ আমি তো সাহিত্য করি। আমি কবিতা লিখি, গল্প উপন্যাস লিখি, আমাকে তো গুলি করে মারা যায় না। গুলি করে মারলেও আমি সাহিত্যে থাকব। না মারলেও থাকব।
প্রিয়ঃ কবিদের মধ্যে এক ধরনের রাজনৈতিক চর্চা সব সময় দেখা যায়। সরকারি দলের সমর্থনে যে কবিরা থাকবেন, তারা এক ধরনের সুযোগ সুবিধা পান, আর কোন রাজনৈতিক পরিচয় না থাকলে তার কোন মূল্যায়নই হয় না। কবিদের রাজনীতি নিয়ে আপনার চিন্তা কী?
আল মাহমুদঃ এসব রাজনীতি। আমি একজন কবি, আমি রাজনৈতিক নেতা নই। আমি সোজা সরল মানুষ। আপনি যদি আমাকে হৃদয় দিয়ে ভালবাসেন, আমিও আপনাকে হৃদয় দিয়েই ভালবাসব। আপনার সঙ্গে আমার বিনিময় হবে।
প্রিয়ঃ আপনকে তো মাঝে মধ্যে অভিনয়ে এবং বিজ্ঞাপনচিত্রের মডেল হিসেবে দেখা যায়…
আল মাহমুদঃ এগুলো আগে করেছি। আমি এখনও করব। আমি গরীব মানুষ, তাই না? তাই যে আমাকে পয়সা দিবে, আমি তার নাটকে বিজ্ঞাপনে কাজ করব।
প্রিয়ঃ আপনি কি সত্যিই গরীব…
আল মাহমুদঃ আমার তো কেউ নাই। ছেলেমেয়েরা যারা আছে, সবাই কাছে থাকে না। আমি বর্তমানে থাকি আমার বড় ছেলের বাসায়। সে একটা ছোট চাকরি করে। এক ছেলে বিল্ডিং তৈরি করে। সে আমাকে খুব চেষ্টা করেছিল তার কাছে নিয়ে যেতে। কিন্তু আমার যেতে মন চায় নি।
প্রিয়ঃ মৃত্যু নিয়ে আপনার ভাবনা কী?
আল মাহমুদঃ আমি তো ভাই মরণ নিয়া চিন্তা করি না। তবে মৃত্যু অবধারিত। জন্মিলে মরিতে হবে অমর কে কোথা কবে…কেউ অমর নাই। তুমি যখন জন্মগ্রহণ করেছ, তোমাকে মরতেই হবে, সেটা যুদ্ধে হোক, বিপ্লবে হোক আর অসুখ বিসুখে হোক। মৃত্যু এক অন্ধকার গহ্বর। কিছুই জান না তুমি। কারণ কেউ তো আর মৃত্যুর গুহা থেকে বের হয়ে আসে নি। সবাই অমর হতে চায়।
প্রিয়ঃ আপনিও নিশ্চয়ই চেয়েছেন অমর হতে…
আল মাহমুদঃ সবাই অমর হতেই চেয়েছে। কেউ পিরামিড বানিয়েছে, কেউ তাজমহল বানিয়েছে।
প্রিয়ঃ এখন আপনার সময় কাটে কিভাবে?
আল মাহমুদঃ শারীরিক অবস্থা ভাই খুব একটা ভাল না। আগে তো ঘুরে বেড়াতাম। এখন তো কারও সাহায্য না হলে বেরুতে পারি না।
প্রিয়ঃ আপনার আর কবি শামসুর রাহমান সম্পর্কে নানা ধরনের গসিপ শোনা যায়। আপনাদের সম্পর্ক নাকি ভাল ছিল না…
আল মাহমুদঃ শামসুর রাহমান হঠাৎ আসতেন আমাদের বাসায়। এসে চুপচাপ একা এক জায়গায় বসে থাকতেন। আমার ওয়াইফকে নাম ধরে ডেকে বলতেন যে, নাদিরা আমাকে চা দাও। শামসুর রাহমানের সঙ্গে যে আমার এই সম্পর্ক ছিল ,এটা তো কেউ ভাই বলে না। আমরা তো আর মারামারি কাটাকাটি দাঙ্গা হাঙ্গামা করি না। কবিতা লিখি। আমার ভাগ্যটাই খারাপ। সবাই আমার দুর্নাম করেছে।
প্রিয়ঃ কবি হিসেবে শামসুর রাহমানকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন…?
আল মাহমুদঃ সে কবি হিসেবে গ্রেট। মানুষ হিসেবেও ভাল। সব মানুষেরই একটা খারাপ দিক থাকে। তারও হয়ত ছিল। কিন্তু সেটা আমার জানা নেই।
প্রিয়ঃ সৈয়দ শামসুল হক সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
আল মাহমুদঃ ওনার লেখা আমার পড়া হয় নি। ওনার সম্পর্কে আমি খুব একটা জানি না। তার সঙ্গে আমার মেলামেশাও কম হয়েছে। তবে তার ওয়াইফ আনোয়ারা সৈয়দ হককে আমি জানতাম ,তার বিয়ের আগে থেকেই। এই মহিলা এক অসাধারণ মানুষ। তিনি মানসিক রোগীদের ডাক্তার ছিলেন। আমি তাকে শ্রদ্ধা করি।
প্রিয়ঃ আপনি তো ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন…
আল মাহমুদঃ ছিলাম শুধু না, এর জন্য আমি জেলও খেটেছি। পালিয়ে বেড়িয়েছি। লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে ঢাকায় এসে ভিক্ষুকের জীবন যাপন করতে হয়েছে। সেখানে আস্তে আস্তে দাঁড়িয়েছি নিজের প্রতিভার জন্য। আমি একজন দরবেশ মানুষ।
প্রিয়ঃ আপনি কি নিজেকে দরবেশ মনে করেন?
আল মাহমুদঃ জীবনের দিক থেকে তো তাই। আমার তো কোন লোভ নাই। লোভ লালসা আমি নিজের ইচ্ছায় ছেড়েছি। না হলে আমি অনেক ধনী হতে পারতাম।
প্রিয়ঃ আরও কত বছর বাঁচতে চান?
আল মাহমুদঃ বাঁচতে তো চাই দীর্ঘদিন। কিন্তু শারীরিক অবস্থা তো ভাল না।
প্রিয়ঃ আশি বছর কি খুব বেশি বয়স…
আল মাহমুদঃ একবারেই ফেলে দেবার মত না। আশি বছরে মানুষ বুড়ো হয়।
প্রিয়ঃ আপনাকে যদি আমরা আশি বছরের তরুণ বলি, তাহলে কি ভুল হবে?
আল মাহমুদঃ না আপনারা বলুন অসুবিধা কি? কিন্তু আশি তো আর সোজা কথা না। হেঁটে পার হতেও সময় লাগে। আশি বছর না, আশি দিন হাঁটেন।
প্রিয়ঃ তরুণ কবিদের সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?
আল মাহমুদঃ এখন আর তরুণ কবিদের লেখা পড়তে পারি না। আগে তো আজিজ মার্কেটে যেতাম লিটল ম্যাগ কিনে আনতাম। পড়তাম। কিন্তু এখন আর পারি না। অনেক তরুণরাই আমার কাছে আসে। আইসা অদ্ভুত সব প্রশ্ন করে।
প্রিয়ঃ আপনার পরবর্তী জেনারেশেনের কবিদের সম্পর্কে বলুন?
আল মাহমুদঃ নাম তো বলতে পারব না। নাম বলাটা ঠিকও হবে না। অনেকের কবিতাই আমার কাছে ভাল লাগে। তবে আমাদের কবিতায় যে প্রেম ছিল, ভালবাসা ছিল, বিচ্ছেদ ছিল- আজকালের কবিতায় সেটা খুঁজে পাই না।
প্রিয়ঃ সেটা কি সময়ের কারণে না লাইফ স্টাইলের কারণে…?
আল মাহমুদঃ আরে ভাই চোখ তো নষ্ট হইয়া গেছে। অনুভূতি ভোতা হয়, হয় না? মানুষ তো, নানা রকম অসুবিধা আছে। দেখেন কবিরা অন্ধ হয়েও লেখে। হোমার অন্ধ ছিল। তাতে কী হয়েছে? পৃথিবীর কবিতা তো আর অন্ধ না। [আমরা আরও কথা বলতে থাকি কবির সঙ্গে। নানান প্রসঙ্গে। সময় বয়ে যায় নীরবে…]