আফগানিস্তানে কিভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে চীন ও পাকিস্তান।।
অনন্ত ও সুদীর্ঘ যুদ্ধ হিসেবে উল্লেখিত চলমান আফগানিস্তানের মার্কিন-নেতৃত্বাধীন বাহিনীর যুদ্ধটি একই অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে, নিকট বা দূরবর্তী- কোনো মেয়াদেই সমাপ্তির কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না। সহিংসতা ও রক্তপাত যুদ্ধ-বিধ্বস্ত এ অঞ্চলটির সবচেয়ে সাধারণ বৈশিষ্ট্যে পরিণত হওয়ায় কয়েক দশক ধরে আফগান জনগণের কাছে যুদ্ধ হয়ে পড়েছে জীবনের অনিবার্য অংশবিশেষ। কিন্তু যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠার সবরকম প্রয়াসই কায়েমি স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট গ্রুপগুলো জোরালোভাবে রুখে দিচ্ছে। তারা শান্তি প্রতিষ্ঠার ছদ্মাবরণে নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
সব সামরিক শক্তি ব্যবহার করেও দুটি পর্যায়ে (২০০১-২০১৪ পর্যন্ত অপারেশন এনডুরিং ফ্রিডম এবং ২০১৫ সাল থেকে অপারেশন ফ্রিডমস সেন্টিনেল) আফগানিস্তানে মার্কিন যুদ্ধের এখন পর্যন্ত মুখরক্ষামূলক কোনো অর্জনও হয়নি। এর মধ্যেই ডোনাল্ড ট্রাম্প যে কায়দায় ফলপ্রসূ কিছু করতে চাইছেন, তা দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা যেমন খুবই কম, একইভাবে তা এই অঞ্চলে তার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার ও অন্যান্য দেশের কাছেও গ্রহণযোগ্য নয়। পাকিস্তানকে ‘আরো কিছু’ করার জন্য চাপ দেওয়ার মার্কিন কৌশলটির একটি সীমা আছে এবং পরীক্ষিত মিত্রকে সাহায্য প্রদান বন্ধ করায় লাভ হয়নি।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর কংগ্রেসকে অবহিত করেছে, ইসলামাবাদকে তার নীতি বদলাতে বাধ্য করার যে লক্ষ্য অর্জন করার জন্য মার্কিন সরকার পাকিস্তানকে নিরাপত্তা সহায়তা প্রদান স্থগিত করেছিল, তা ব্যর্থ হয়েছে। মার্কিন উপ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন সুলিভান বলেছেন, এমন কিছু ঘটেনি যেটাকে চূড়ান্ত ও অনড় বলা যেতে পারে। তারা আমাদের সাথে আলোচনায় নিয়োজিত রয়েছে। তবে নিরাপত্তা সহায়তার স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে নিয়ে অনেক কিছুর প্রয়োজন রয়েছে।
মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ডের (সেন্টকম) জেনারেল যোশেফ এল ভোটেল স্পষ্টভাবেই বাস্তবতা মেনে নিয়ে বলেছেন, দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখা এবং আফগান অঞ্চলের শান্তি নিশ্চিত করার ব্যাপারে পাকিস্তান একটি গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন মিত্র হতে পারে। তালেবানকে আলোচনার টেবিলে আনার চেষ্টা জোরদারের ক্ষেত্রে তা খুবই প্রয়োজনীয়।
তিনি বলেন, দক্ষিণ এশিয়া কৌশল বাস্তবায়নে আমরা খুবই ব্যস্ত। এটি করা হয়েছে তালেবানকে শান্তিতে আসতে বাধ্য করা এবং অত্যন্ত দীর্ঘ হয়ে পড়া যুদ্ধটির অবসান করার জন্য।
বিকল্পের অভাব
পাকিস্তানের প্রতি ত্রুটিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি থাকায় এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে সম্ভবত বিকল্প আছে খুবই কম। অবশ্য চীন পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিপিইসি) যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলটিতে নতুন আশার আলো হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। কারণ ৫৭ বিলিয়ন ডলারের সিপিইসিকে আফগানিস্তান পর্যন্ত সম্প্রসারণ করতে চায় চীন। আফগান মিডিয়ার খবর অনুযায়ী, এটি আফগানিস্তান পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়ে নাম হতে পারে চীন-আফগানিস্তান-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিএপিইসি)। এটি হলো এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা ও এর বাইরের দুনিয়ার সাথে চীনকে সংযুক্ত করার বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগে অংশবিশেষ।
পাকিস্তানে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও জিঙের মতে, কাবুল হতে পারে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের অংশ এবং চীন এ জন্য আফগানিস্তানের শান্তি প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ গ্রহণ করতে রাজি। তিনি বলেন, আফগানিস্তানে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলায় চীন উদ্বিগ্ন। আমরা শান্তি-প্রক্রিয়ায় ভূমিকা পালন করতে আবারো তৈরি হয়ে আছি। পাকিস্তান ও চীন উভয়েই ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী। আমরা আফগানিস্তানকে শান্তিপূর্ণ দেখতে চাই।
পাকিস্তান ও আফগানিস্তান উভয়ে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে অস্বস্তিকর অবস্থায় আছে। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করছে চীন। অবশ্য পাকিস্তান তালেবানকে সহায়তা করছে মর্মে আফগানিস্তানের অভিযোগের পর দুই দেশের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্কে বেশ অবনতি ঘটেছে। আফগানিস্তানে ভারতের প্রভাব সীমিত করার জন্য মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে তালেবান।
চীন, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের নিয়ে অনুষ্ঠিত প্রথম ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে বক্তৃতাকালে ওয়াঙ বলেছিলেন যে চীন, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানকে সংযুক্তকারী অর্থনৈতিক করিডোরটি পুরো অঞ্চলের জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে পারে, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির অতি প্রয়োজনীয় উন্নয়নকে বেগবান করতে পারে।
চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়োও জিঙ বলেন, উইন-উইন ভিত্তিতে আফগানিস্তানের দিকে তাকাচ্ছে চীন ও পাকিস্তান। সবার জন্য কল্যাণকর নীতির ভিত্তিতে চীন পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরকে আফগানিস্তানে নিয়ে যাওয়ার আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে।
সিপিইসিকে আফগানিস্তানে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে আফগানিস্তানের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ব্যাপক অগ্রগতি হবে। তবে এজন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাস্তবতা-বিবর্জিত যা চায়, তাতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। এখন আফগান নেতৃত্বকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা নিরীহ জীবন হানিকর এই যুদ্ধ কত দিন সহ্য করবে। আফগানিস্তানে এখন শান্তি আসতে পারে সিপিইসির মাধ্যমে। সূত্রঃ সাউথএশিয়ান মনিটর ।
লেখক ‘পারসেপশন ম্যানেজমেন্ট’ কোম্পানি সিএমসির সভাপতি ও সিইও। তিনি সুপরিচিত লেখক ও পাবলিক রিলেশন্স গুরু। বিভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ফোরামে তিনি পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেন।