আগে বিশৃঙ্খলা হত রাজপথে এখন হয় ব্যাংকিং খাতে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেস্টা দেশবরেণ্য অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন, রাজনৈতিক শাসনের ধরন পাল্টে গেছে। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। রাস্তার বিশৃঙ্খলা এখন ব্যাংকে প্রবেশ করেছে। এখন আর রাজপথে বিশৃঙ্খলা হয় না। বিশৃঙ্খলা হচ্ছে ব্যাংক খাতে। বিশৃঙ্খলা হচ্ছে অর্থনীতিতে। মানুষ এখন একটা ভীতিকর শান্ত পরিবেশের মধ্যে রয়েছে। এটা সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিপন্থী। আর্থিক খাতের বিশৃঙ্খলা অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি। এটা দেশের ইমেজ ক্ষুন্ন করছে। বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
অর্থ পাচারের ঘটনা বাড়ছে। এ সবই ঘটছে সুশাসনের অভাবে। জবাবদিহিতার সংকট ও স্বচ্ছতার অভাব দিনদিন প্রকট আকার ধারণ করছে। গত মঙ্গলবার, ১৭ জুলাই, হোসেন জিল্লুর রহমানের নিজ প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) ধানমন্ডির কার্যালয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিন‘কে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি এ সব কথা বলেন। সরকারের বাজেট বাস্তবায়ন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন, আর্থিক খাতের বিশৃঙ্খলা, কূটনৈতিক পলিসি, কর্মসংস্থানহীন জিডিপি প্রবৃদ্ধিসহ নানান বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন দেশবরেণ্য এই অর্থনীতিবিদ।
বাংলাদেশ প্রতিদিনঃ সামনে জাতীয় নির্বাচন। এটাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক পরিবেশ উত্তাল হতে পারে কিনা এবং এ মুহূর্তে সামষ্টিক অর্থনীতির ধারা কোন অবস্থায় রয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
হোসেন জিল্লুর রহমানঃ দেশের অর্থনীতি এখন স্থবির। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বাড়ছে অথচ কর্মসংস্থান সে হারে বাড়ছে না। বিনিয়োগের খরা কাটছে না। অন্যদিকে বর্তমান নির্বাচন কমিশন স্বেচ্ছা নিষ্ক্রিয়তার রোগে ভুগছে। মনে হচ্ছে আমি কিছু দেখছি না। আমি চোখ বন্ধ করে আছি। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মূল সূচক এখন পরিবর্তন হয়েছে। সেটা হলো নির্বিঘ্নে প্রতিযোগিতা হয়েছে কিনা, সুষ্ঠু পরিবেশ থাকছে কিনা— এসব। এখন তো ভোটের আগের দিনই ব্যালট বাক্স ভরাট করা হচ্ছে। আর শান্ত পরিবেশ সেটা তো এভাবেও বলা যায় যে মানুষকে পিটিয়ে দরজা বন্ধ করে রেখেও শান্ত পরিবেশ বজায় রাখা যায়। আবার ভয়ভীতি দেখিয়েও পরিবেশ শান্ত রাখা যায়। এসব তো সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিপন্থী। অথচ এখন কিন্তু এসবই হচ্ছে।
ফলে দেখতে হবে ভয়ভীতিহীন শান্ত পরিবেশ রয়েছে কিনা। তাই আমি বলব, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হলে নির্বাচন কমিশনকে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। এখানে একটা কথা মনে রাখতে হবে নির্বাচন করবে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করতে সরকারকেই ভূমিকা রাখতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্বিঘ্নে কাজ করতে দিতে হবে। আমরা সবাই চাই একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হোক। কেননা বর্তমানে দেশে শাসনব্যবস্থার বৈধতার সংকট রয়েছে, যেহেতু প্রায় অর্ধেকসংখ্যক এমপি বিনা ভোটে নির্বাচিত। এটার অবসান হওয়া অত্যন্ত জরুরি। না হলে আমাদের অর্জনগুলো প্রশ্নের মুখে পড়বে। স্বাধীনতার মূলনীতি তো সেটা ছিল না। মানুষ এখন নিজেকে অনেক কিছু থেকে গুটিয়ে রেখেছে। কেননা মানুষ এখন ঝামেলা এড়িয়ে চলতে চায়।
বাংলাদেশ প্রতিদিনঃ সরকারের বাজেট বাস্তবায়ন ও প্রকল্প ব্যয়ের স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতার বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী? অধিক স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পরামর্শ কী?
হোসেন জিল্লুর রহমানঃ বাজেট বাস্তবায়ন কতটা হচ্ছে সেটা বিষয় নয়। বিষয় হলো মানসম্মত বাজেট বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা। প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে অতিমূল্যায়িত হয়ে। পাশাপাশি আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা চলছে। ব্যাংকে বড় ধরনের জালিয়াতির ঘটনা ঘটছে। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি হচ্ছে। ভল্টের সোনা নিয়েও নানা কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। অপরাধ দমনের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটছে। এর পরও মানুষ কোনো কথা বলছে না। কোন প্রতিবাদ করছে না। কোথাও কোন মিছিল হচ্ছে না। অর্থাৎ একটা ভীতিকর শান্ত পরিবেশ বিরাজ করছে। এটা সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিপন্থী।
বাংলাদেশ প্রতিদিনঃ গত ১০ বছরে দেশের কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ ও বেকার সমস্যার সমাধান কতখানি হয়েছে বলে মনে করেন?
হোসেন জিল্লুর রহমানঃ প্রতি বছর জিডিপি বাড়ছে। জিডিপির এই পরিসংখ্যানগত তথ্য নিয়ে গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নও উঠেছে। তবে সাড়ে ৬ শতাংশ জিডিপি নিয়ে কারও কোনো প্রশ্ন নেই। প্রশ্ন হচ্ছে তার ওপরেরটা নিয়ে। কারণ দেশের বেসরকারি বিনিয়োগ আগের জায়গায় রয়ে গেছে। বলা হচ্ছে, সরকারি বিনিয়োগ অনেক বেড়েছে। কিন্তু অতিমূল্যায়িত প্রকল্প ব্যয় কি কখনো প্রমাণ করে যে বিনিয়োগ বাড়ছে?
এখন তো প্রকল্প ব্যয় অনেক বেশি। এমনকি পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় এখানে প্রকল্প ব্যয় বেশি। সেটাকে তো বিনিয়োগ বলা যাবে না। যার ফলাফল আমি দেখছি জিডিপি বাড়লেও কর্মসংস্থান সে হারে বাড়ছে না। ফলে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা জরিপ অনুযায়ী মানুষের আয় তো সে হারে বাড়ছে না।
বাংলাদেশ প্রতিদিনঃ আপনি কি মনে করেন দেশে আগের চেয়ে আয় ও অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়েছে?
হোসেন জিল্লুর রহমানঃ এটা পরিষ্কার যে, অল্প কিছুসংখ্যক মানুষের আয় অনেক গুণ বেড়েছে। অর্থমন্ত্রীও তা স্বীকার করেছেন। কিন্তু সেটা তো প্রমাণ করে না যে দ্রুত দারিদ্র্য বিমোচন হচ্ছে। তবে এটা ঠিক, গত কয়েক বছরে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য আমরা অনেক কাজ করেছি। তার সফলতাও পাচ্ছি। কিন্তু বৈষম্য কমাতে না পারলে দারিদ্র্য বিমোচনের সুফল পাওয়া যাবে না। দ্রুত দারিদ্র্য বিমোচন, জিডিপি প্রবৃদ্ধির বিশ্বাসযোগ্যতা হারানোর অন্যতম দুটি কারণ রয়েছে। সে দুটি হলো বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ এখনো ২১-২২ শতাংশে রয়েছে।
সেই সঙ্গে অতি মূল্যায়িত প্রকল্প ব্যয়। যাদের আয় বেড়েছে তাদের আয় অনেক গুণ বেড়েছে। আর যাদের বাড়েনি তারা কয়েক বছর ধরে একইরকম আয় করছে। এতে আয়বৈষম্যটা প্রতিনিয়তই বাড়ছে। যার সঠিক প্রতিফলন অবশ্য সরকারি হিসাবে অনেক সময় উঠে আসে না। এসব পরিসংখ্যানের ব্যাখ্যাও প্রয়োজন। যাদের আয় দ্রুত বাড়ছে তারাই হয়তো অর্থ পাচার করছেন। এর ফলে অর্থ পাচারের ঘটনাও বাড়ছে।
বাংলাদেশ প্রতিদিনঃ গত কয়েক বছরে ব্যাংক খাত থেকে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ বেরিয়ে গেছে। সরকার একটি ব্যাংক সংস্কার কমিশন গঠনের ঘোষণা দিলেও তা করে নি। এ বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
হোসেন জিল্লুর রহমানঃ আগে অর্থনীতিতে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার প্রভাব পড়ত আর এখন ব্যাংক খাতের বিশৃঙ্খলার প্রভাবে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে মানুষ এখন একটা বড় অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে, আর সেটা হল গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। আদৌ কোন নির্বাচন হবে কিনা, সেটা গ্রহণযোগ্য হবে কিনা, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় অনিশ্চয়তা।
কেননা এখন রাজনৈতিক শাসনের ধরন পাল্টেছে। ব্যাংকিং কমিশন গঠন করার ব্যাপারে সরকার কেন পিছু হটল সেটারও ব্যাখ্যা প্রয়োজন। এটা অবশ্য অর্থনৈতিক রাজনৈতিক শাসনের একটা বিষয়। ফলে সরকারের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক পলিসির ওপর সেটা নির্ভর করছে। যারা ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করছেন, অর্থ পাচার করছেন, শেয়ারাজারে বিশৃঙ্খলা করছেন— এসব ঘটনায় তাদের কারও শাস্তি হচ্ছে না। ফলে এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটছে।
বাংলাদেশ প্রতিদিনঃ সরকারের কূটনৈতিক কৌশল ও মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
হোসেন জিল্লুর রহমানঃ সরকার এখানে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে মানবিক দিক প্রকাশ করেছে। যার জন্য বিশ্বপরিমণ্ডলে আমাদের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল হয়েছে। কিন্তু এটা আমাদের জন্য অতিরিক্ত চাপ। এর অবসান হতে হবে। যে কোন মূল্যে তাদের ফেরত পাঠাতে হবে। মিয়ানমার সরকার যখন তাদের চাপ প্রয়োগ করে এ দেশে ঢুকিয়ে দিয়েছে তখন হয়ত বাধ্য হয়ে তাদের ঢুকতে দেওয়া হয়েছে। এখন তো বছরের পর বছর তাদের এখানে রেখে দেওয়া যাবে না। এটা একটা নতুন বাস্তবতা। এর জন্য কূটনৈতিকভাবে বিশ্ববাসীর সমর্থন আদায় করে তাদের ফেরত পাঠাতে হবে।
বাংলাদেশ প্রতিদিনঃ ব্যাংক খাতে স্থিতিশীলতা ফেরাতে কী করা প্রয়োজন বলে মনে করেন?
হোসেন জিল্লুর রহমানঃ এখন ব্যাংকিং খাতের বিশৃঙ্খলা ও আর্থিক খাতের সংকট নীতি নির্ধারিত বিশৃঙ্খলা। নিয়ম করেই অনিয়মকে মেনে নেওয়া হচ্ছে। এমনকি অনিয়মকে বৈধতা দিতে নিয়ম তৈরি করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক’কে আরও স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। ব্যাংকের মালিকরা যাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে কোন প্রভাব বিস্তার করতে না পারেন সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ প্রতিদিনঃ স্বাধীনতার মূলনীতি অনুযায়ী বাংলাদেশ সঠিক পথে এগোচ্ছে কিনা, বা ২০২১ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশ গঠনের যে লক্ষ্য তা সঠিক পথে রয়েছে কিনা?
হোসেন জিল্লুর রহমানঃ মানুষ এখন অনেক সামাজিক কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখছে। কারণ, সর্বত্র একটা ভীতিকর শান্ত পরিবেশ বিরাজ করছে। এখন সরকারের বা ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছার বাইরে কোনো কাজ হচ্ছে না। সরকারের ইচ্ছার বাইরে, এমনকি ভুল হলেও প্রতিবাদ করা যাচ্ছে না, এটা কিন্তু স্বাধীনতার মূলনীতি ছিল না। ফলে এসব নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে। এ বিষয়টা নিয়ে গভীরভাবে ভাবা দরকার। সরকার কিন্তু অনেক কিছু করেছে। এখন গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
বাংলাদেশ প্রতিদিনঃ রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত আমাদের শক্তিশালী প্রতিবেশী দেশ হিসেবে সঠিক সহায়তা দিয়েছে বলে মনে করেন কিনা?
হোসেন জিল্লুর রহমানঃ আমি মনে করি ভারত বাংলাদেশকে কখনই সেরূপ প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে মর্যাদা দেয়নি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে শক্তিশালী কোন অবস্থান আমাদের পক্ষে নেয় নি দেশটি। তারা মনে করে, বাংলাদেশ খুব সহজেই ম্যানেজ হয়ে যায় এমন একটি দেশ। যার প্রমাণও তারা পেয়েছে অনেক বার। বাংলাদেশ এমনিতেই একটা ভূরাজনৈতিক জটিল পরিবেশের মধ্যে অবস্থান করছে।
ফলে ভারত, চীন, জাপান, রাশিয়া সবাই এখানে বাণিজ্য করছে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়ত সুবিধা করতে পারছে না। ফলে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমরা এসব সহযোগী দেশের খুব একটা সহায়তাও পাচ্ছি না। এ সব কিন্তু কূটনৈতিক ব্যর্থতা নয়। আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দুর্বলতার কারণে আমরা আমাদের মর্যাদার জায়গায় নিয়ে যেতে পারছি না।
উৎসঃ বিডি প্রতিদিন