অস্ত্রধারীদের পবিত্র ক্বাবা দখলের দুই সপ্তাহ

May 23, 2018 9:11 pm0 commentsViews: 104
MUNTAQIM CHOWDHURYঃ
মেহেদী (আঃ), ধর্মীয় শিক্ষা ও বিভ্রান্তি, এবং ধর্মাচার। এবং ধর্মীয় শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা…
মুহাররম মাসের এক তারিখ উপলক্ষে, অর্থাৎ হিজরি “নববর্ষ”(!) উপলক্ষে শুভেচ্ছা জানানো গত বছর প্রথম চোখে পড়ে; কিন্তু হিজরি নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাতে আমার ভয় হয়! প্রথমত, মক্কা থেকে মদিনায় আমি গিয়েছি, বর্তমানের মসৃণ পথে তাপানুকুল যানে করে গিয়ে থাকলেও, জানালা দিয়ে ভূপ্রকৃতি যেটুকু দেখা গেছে, তাতে কিছুটা হলেও ভাবতে পারি, নবী মোহাম্মাদ (সঃ) এর জন্য পথ কতটা বন্ধুর ও যাত্রা কতোটা কষ্টসাধ্য ছিল; এছাড়াও, প্রাণনাশের হুমকির মুখে নিজ জন্মভূমি ছেড়ে যাওয়া নিশ্চয় গভীর বেদনাদায়ক ব্যাপার। ঐ ঘটনা থেকে যে দিনগণনা শুরু হয়েছে, সেটাকে শুভেচ্ছা জানানোর কোনো উপলক্ষ মনে করা যায় না। তবে, “ভয়” হয় বললাম একারণে যে, আমার একটি বিশেষ পহেলা মুহাররম তারিখের ঘটনা মনে পড়ে যায়!
পহেলা মুহাররম, হিজরি ১৪০০ সাল। হজ্জের ভিড় কমে গেলেও, তখনও অনেকে মক্কা থেকে ফিরে যান নাই, একারণে মসজিদুল হারামের জামাতে যথেষ্ট ভিড় হয়। সেদিন ফজরে প্রায় পঞ্চাশ হাজারের বেশী মুসল্লি উপস্থিত, জামাত শুরুর আগ মুহুর্তে কিছু লোক দলবেঁধে কয়েকটি কফিন নিয়ে এলো, আজ যেনো জানাজার কফিন অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশীই এসেছে!
জামাতে ইমামতি করতে উদ্যত হয়েছেন শেখ মোহাম্মাদ আল সুবাইল, কিন্তু তা আর করা হলো না। ভিড় ঠেলে ইমামের নিকট পৌঁছে কফিন বহনকারীদের কয়েকজন তাকে সরিয়ে দিল, মেশিনগান বের করে শূণ্যে গুলি ছুঁড়লো। কেউ একজন চিৎকার করে উঠলো, “মাহদি (আঃ) আবির্ভূত হয়েছেন“!!!
অস্ত্রধারীদের সহযোগিরা কফিনের ঢাকনা খুলে সেখান থেকে আগ্নেয়াস্ত্র বের করে নিয়ে হেরেম শরিফের বিভিন্ন অংশে অবস্থান নিলো। গেটগুলো শিকল দিয়ে আটকে দিল, বাধা দিতে গিয়ে শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত নিরস্ত্র দুইজন সৌদী পুলিশ গুলিতে নিহত হলেন। হতবিহ্বল মুসল্লিরা সবাই কিছু বুঝে উঠতে পারার আগেই জিম্মি হয়ে গেলেন! অবশ্য নারী ও শিশুসহ অধিকাংশ জিম্মিকে পরে ছেড়ে দেয়া হয়।
ক্বাবার সামনে দাঁড়িয়ে জুহাইমান ইবনে মোহাম্মাদ ইবনে সাইফ আল ওতাইবি নামে একজন একদা বড় আলেম আবদুল্লাহ্‌ হামিদ মোহাম্মাদ আল কাহ্‌তানি নামে একজনকে “মাহদি (আঃ)” হিসেবে শনাক্ত করলেন, তার কাছে বায়াত গ্রহন করলেন। এরপর মুসল্লিদেরকে যোগ দিতে আহ্‌বান জানিয়ে অস্ত্রধারীরা সমবেতভাবে তার কাছে বায়াত গ্রহন করলো। হেরেম শরিফের মাইক ব্যবহার করে অস্ত্রধারী দখলদাররা তাদের বক্তব্য ও দাবী দাওয়া পেশ করতে থাকে।
হাদিস আছে, মাহদি (আঃ) এর নাম ও পিতার নাম এবং নবী মোহাম্মাদ (সঃ) এর নাম ও পিতার নাম এক হবে, এবং উঁনি মক্কার উত্তর দিকের অঞ্চল থেকে আসবেন। এই ঘটনার ক্ষেত্রে নামের দিকটি যেমন মিলে যায়, তেমনি সেদিনের “মাহ্‌দি”ও মক্কার উত্তরের বিখ্যাত নাজদ অঞ্চলের লোক। এছাড়া, প্রতি শতাব্দীর শুরুতে জীর্ণ বিশ্বাসীদেরকে চাঙ্গা করতে একজন মুজাদ্দিদ আবির্ভূত হন বলে কথিত আছে; সেই দিনটিও ছিল, হিজরি নতুন শতাব্দী শুরুর প্রথম দিন!
ইসলামের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান ক্বাবা ও মসজিদুল হারাম অস্ত্রের জোরে “দখল করে” আবির্ভূত হওয়া “মাহদি (আঃ)” এর অনুসারীদের দাবী ছিল, যেহেতু মাহদি (আঃ) আবির্ভূত হয়ে গেছেন, সেহেতু সৌদ বংশের রাজত্ব শেষ, সব বিশ্বাসিকে এই মাহ্‌দির আনুগাত্য স্বীকার করে নিতে হবে।

জুহাইমান আল ওতাইবি
এদের নেতৃত্বে ছিলেন জুহাইমান আল ওতাইবি। উনি নাজদ এর এক সম্ভান্ত পরিবারের সন্তান, মদিনায় প্রখ্যাত আলেম আবদুল আজীজ ইবনে বাজ এর খুব প্রিয়ভাজন শিষ্য ছিলেন। ওস্তাদের সালাফি সংগঠনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। আবদুল আজীজ ইবনে বাজ সৌদী সরকারের উচ্চপদে চাকুরিতে যোগ দিয়ে রিয়াদ চলে গেলে জুহাইমান আল ওতাইবি ওস্তাদের সমালোচনা করেন। তার অভিযোগ ছিল সৌদ বংশের রাজত্বে বিকৃত ইসলামের চর্চা হচ্ছে, ইসলাম বিপন্ন হচ্ছে, এরা “নিরাপত্তার জন্যে” পূণ্যভূমিতে অবিশ্বাসী আমেরিকানদেরকে ডেকে এনে সামরিক ঘাঁটি বানাতে দিয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
এপর্যায়ে উনি প্রথমে মসজিদে নববীর কাছে আস্তানা গাড়েন, এবং একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। সেই সময় মদিনা ইউনিভার্সিটির গ্রাজুয়েটরা দলে দলে এই সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়েছেন। তারা “বিশুদ্ধ ইসলাম” পালন ও প্রচারের আন্দোলন করতেন। এক পর্যায়ে সৌদী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে এই সংগঠনের ঝামেলা শুরু হয়। ঝামেলার একটি দিক উল্লেখ করি। মদিনায় তখন অন্যান্য শহরের মতো গানের টেপ-ক্যাসেট এসবের দোকান ছিল, গানের দোকানগুলো ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে উচ্চশব্দে গান বাজাতো। ওতাইবির সংগঠন এসব বন্ধ করার জন্যে দোকানীদেরকে বারবার অনুরোধ জানিয়ে, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবস্থা নেয়ার আহ্‌বান জানিয়ে, ব্যার্থ হওয়ায়, একসময় গানের দোকানে অতর্কিতে হামলা করে গানের টেপ ভেঙ্গে নষ্ট করা শুরু করে। এতে মদিনায় উচ্চশব্দে গান বাজানো বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এধরণের “আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া” কার্যক্রমের কারণে কর্তৃপক্ষের সাথে সংগঠনটির বিরোধ শুরু হয়, এবং পর্যায়ক্রমে দমন-পীড়নের মুখোমুখি হয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেতে বাধ্য হয়।
জুহাইমান আল ওতাইবি আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে এসে এই কান্ড ঘটানোর পরে যা ঘটেছে, তা মুসলিম বিশ্বের ইতিহাস সেদিনের আগে ও সেদিনের পরে – এই দুইভাগে ভাগ করেছে বলে আমার মনে হয়।
ক্বাবা ঘর কেউ অস্ত্রের জোরে দখল করতে পারে – এটা তখন কারো ভাবনারও অতীত ছিল। এছাড়া হারাম শরিফে মারণাস্ত্র বহন করা হারাম, তাই শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত পুলিশরা অস্ত্র ছাড়া ডিউটি করেন। মাইকে দখলকারীদের ঘোষণা শুনে, পুলিশের শ’খানেক সদস্যের একটি দল দখলমুক্ত করতে যায়, মুহুর্তের মধ্যে তাদের পাঁচ/সাতজন দখলকারীদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের তোপে উড়ে যান। এরপর, এই ঘটনার মাত্রা সম্পর্কে সৌদী কর্তৃপক্ষের কিছুটা হুঁশ হয়।
এটা ২০ নভেম্বর ১৯৭৯ সালের ঘটনা। হারাম শরিফ এইরকম অবরুদ্ধ অবস্থায় ছিল ৪ ডিসেম্বর ১৯৭৯ পর্যন্ত। ক্বাবা তাওয়াফ হয় নাই, মসজিদুল হারামে আজান ও জামাত বন্ধ ছিল!!!!!! হায়… হায়… হায়…
বাদশাহ্‌ খালেদ এই ঘটনা সামাল দেয়ার জন্যে দুই প্রিন্স – সুলতান ও নায়েফকে দ্বায়িত্ব দেন। মক্কা শহর থেকে সবাইকে সরিয়ে দেয়া হয়, সৌদীরা সব ইন্টারন্যাশনাল টেলিফোন সার্কিট সুইচড অফ করে দেয়, এয়ারপোর্টগুলো বন্ধ করে দেয়। তারা এই দখলের ঘটনা মিডিয়ার কাছে গোপন রেখে উদ্ধার অভিযান শেষ করতে চেয়েছিল। কিন্তু ওয়াশিংটন থেকে (!) আন্তর্জাতিক মিডিয়ার কাছে এই ঘটনা ফাঁস হয়ে যায়!
আমেরিকার সংবাদ মাধ্যম অবশ্য এই ঘটনাকে শিয়াদের কাজ হিসেবে সন্দেহ করা হচ্ছে বলে জানায়। ঘটনাটি ইরানে খোমেনীর বিপ্লবের বছর, যার উত্তাপ তখনো যথেষ্ট, খোমেনি বলেছেন মক্কা-মদিনা নিজেদের দখলে নিয়ে, সেখানকার বিদ্যমান ত্রুটিগুলো (ওদের দৃষ্টিতে) সংশোধন করলে পরেই তারা নিজেদের বিপ্লব সফল বিবেচনা করবেন। এর প্রেক্ষিতে, ইরানের পর শিয়ারা মক্কা-মদিনায় “বিপ্লব” শুরু করে দিল কি না, এরকম মনে করা একেবারে অস্বাভাবিক ছিল না।
দুঃসংবাদটি ছড়িয়ে পড়লে বিশ্বের দেশে দেশে মুসলিমরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। সন্দেহের তীর ছুটে যায় আমেরিকার দিকে। সদ্য সফল ইসলামি বিপ্লবের নেতা ইরানের আয়াতুল্লাহ্‌ খোমেনী তাৎক্ষণিক রেডিও ভাষনে সরাসরি আমেরিকাকে এই কাজের জন্য দায়ী করেন।
পাকিস্থানের সরকারি সংবাদ মাধ্যম পিটিভি সেদিন পাকিস্থান-ভারতের বেঙ্গালুর টেস্ট ম্যাচ সম্প্রচার করছিল, সেটা থামিয়ে পর্দায় নিউজকাস্টার আজহার লোধী হাজির হয়ে বেদনাহত কন্ঠে “মক্কায় পবিত্র মসজিদুল হারাম অস্ত্রধারীরা দখল করে নিয়েছে” মর্মে সংক্ষিপ্ত বিশেষ বুলেটিন পাঠ করেন, বিস্তারিত কিছু জানানো হয় নি। পিটিভি টেস্ট ম্যাচ সম্প্রচারে ফেরত না গিয়ে ক্বোরআন তেলাওয়াত, না’ত ইত্যাদি প্রচার করতে থাকে।
বিস্তারিত জানার জন্যে পাকিস্থানে লোকজন বিবিসি রেডিও (উর্দু) শুনতে থাকে। কিন্তু বিস্তারিত তথ্য কেউই সরবরাহ করতে পারছিল না, বিবিসি উর্দু রেডিও তেহরানের সূত্রে জানায়, খোমেনী এটাকে “আমেরিকান-জায়োনিস্ট লবি”র কাজ বলেছেন। কিন্তু, ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ়-বিহ্বল জনতা তথ্যসূত্র নিয়ে অতো মাথা ঘামানোর অবকাশ পায় নাই, জনমত আমেরিকার বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠে।
এর মাত্র কয়েক বছর আগে ঘটে যাওয়া সারা বিশ্বে শ্রদ্ধা ও ভালবাসা কুড়ানো সৌদী বাদশাহ্‌ ফয়সল হত্যাকান্ড সিআইএ এর চক্রান্ত বলে প্রায় সবাই বিশ্বাস করেন। এই এতো বড় দূর্ঘটনাটিও সাধারণ মানুষেরা আমেরিকার কাজ বলেই ধরে নিয়েছিলেন।
পরদিন পাকিস্থানের রাজধানী ইসলামাবাদে বিক্ষুব্ধ জনতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুতাবাস শুধু আগুনে পুড়িয়ে ক্ষান্ত হয় নাই, ভাঙচুর করে প্রায় মাটিতে মিশিয়ে দেয়। সপ্তাহখানেক পরে লিবিয়ার ত্রিপোলিতেও বিক্ষুব্ধ জনতা আমেরিকার দুতাবাস পুড়িয়ে দেয়। পৃথিবীর দেশে দেশে আমেরিকা বিরোধী বিক্ষোভ হয়।
বাংলাদেশে কেনো যেনো, অনেকের মধ্যে এই ঘটনা নিয়ে বিভ্রান্তি আছে। অনেকেই এই ঘটনাকে, শিয়াদের ক্বাবা দখলের ঘটনা হিসেবে জানেন! এবং, আমার মনে সন্দেহ, যেহেতু এক বড় সুন্নি আলেমের নেতৃত্বে এই অপকর্মটি ঘটেছিল, সেকারণে, সেটা চাপা দিতে, এদেশে অনেকে ইচ্ছাকৃতভাবে এটাকে শিয়াদের কাজ বলে চালিয়ে দিতে চান। এমনকি, তিন তিনটি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এক আলেম আমার সাথে এই নিয়ে তর্ক করেছেন; জবাবে আমি, আসুন কিছু রেফারেন্স ঘেঁটে দেখি প্রস্তাব করার পর উনি জানিয়েছেন, সেটার প্রয়োজন নাই, কারণ উনার আত্মীয় ঐ ঘটনায় জিম্মিদের একজন ছিলেন(?), প্রত্যক্ষদর্শির বয়ান শোনার পর, উনার আর কোনো ঘাঁটাঘাঁটির প্রয়োজন নাই!!!
যেহেতু ওখানে রক্তপাত নিষিদ্ধ, সেহেতু উদ্ধার অভিযানে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যাবহার নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। সৌদী কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্তের জন্যে আলেমদের শরণাপন্ন হয়। আলেমদের নেতৃত্বে ছিলেন সেই আবদুল আজীজ ইবনে বাজ। সিদ্ধান্তে পৌঁছতে উনাদের যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। একটি কারণ ছিল, জুহাইমান আল ওতাইবি ভয়ঙ্কর অন্যায় করে ফেলেছেন বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে বটে, কিন্তু এতবড় একজন আলেম একদম না বুঝে কিছুতো করার কথা নয় – এই চিন্তা কাজ করায়, তার বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত দিতে আলেমরা যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন বলে বিবেচনা করেছেন। এবং, বড় কারণ হলো, হেরেম শরিফে এর আগে রক্তপাত মাত্র একবারই হয়েছে, তাও সেটা নবী মোহাম্মদ (সঃ) এর উপস্থিতিতে, এবং সেই ঘটনায় রক্তপাতের নির্দেশ নবী (সঃ) নিজে থেকে চট করে দিয়ে ফেলেন নাই, ওহী আসার পর উঁনি নির্দেশনা দিয়েছেন।
আলেমরা সিদ্ধান্ত দিলেন, সামরিক বিশেষজ্ঞরা অন্য উপায় বের করতে না পারলে দখলদারদেরকে আত্মসমর্পনের জন্য যথেষ্ট আহ্‌বান জানিয়ে, তাতে কাজ না হলে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যাবহার করে রক্তপাতের ঝুঁকি নেয়া যেতে পারে। তবে কতো কম রক্তপাতের ঝুঁকিতে কাজটি সারা যায় – কর্মপরিকল্পনায় সেদিকে বিশেষ জোর দিতে হবে।
এর পরেও, সৌদী সরকারে একটি চিন্তা কাজ করেছিল, অন্তত তারা বলছিল যে, ভাবছে, তাড়াহুড়ো না করে, অব্যাহত আহ্‌বান জানিয়ে, সময়ক্ষেপনের মাধ্যমে খাদ্য সংকটে ফেলে ওদেরকে ক্ষুধায় কাতর করে কিছু করা যায় কি না।
আবার, একেবারে বসে না থেকে, সৌদী সামরিক বাহিনী কয়েকটি অভিযান চালায়; কিন্তু, দখলদারদের ভারি অস্ত্রের মুখে, এবং বিশেষত মসজিদের মিনারগুলো থেকে স্নাইপার অ্যাটাকে কাবু হয়ে সেসব অভিযান পন্ড হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, দখলকারীরা সংখ্যায় ছিল চারশত থেকে পাঁচশত জন। এরপর সৌদদের অনুরোধে ফ্রান্সের জিআইজিএন কমান্ডো পরামর্শ ও সহযোগিতার জন্য আসে, তারা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে নিজেরা অভিযান চালানো থেকে বিরত থেকে “মরতে প্রস্তুত” কমান্ডো দিয়ে অভিযান পরিচালনার পরিকল্পনা পেশ করে।
বিশ্বের এতো এতো “মুসলিম” দেশের মধ্যে ক্বাবা উদ্ধারে “মরতে প্রস্তুত” কমান্ডো হাজির করতে পারলো কেবল পাকিস্থান! ওদের এসএসজি কমান্ডোরাই শেষ পর্যন্ত মসজিদুল হারাম দখলমুক্ত করে। পাকিস্থানের এই নিয়ে গর্বের শেষ নাই, সৌদীরাও এজন্যে এখন পর্যন্ত পাকিস্থানীদেরকে আলাদা চোখে দেখে, যা সৌদী আরবে গেলে যে কারো কাছেই দৃশ্যমান হবে। সেই সময়ের পাকিস্থানী শাসক জেনারেল জিয়াউল হকও সৌদী আরবে বিশেষ সম্মানিত।
সেই ঘটনার প্রভাব বহুমুখী, প্রথম তাৎক্ষণিক প্রভাব, মক্কা-মদীনায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখন এতো জোরালো যে, নিরাপত্তারক্ষীদের সার্বক্ষণিক তটস্থ আনাগোনা, পান থেকে চুন খসলেই নিরাপত্তারক্ষীদের হিস্টেরিক আচরণ – প্রায়শ পূণ্যার্থীদের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ব্যাপারটি হারামাইন শরিফাইনের গাম্ভীর্যের সাথেও সাংঘর্ষিক; কিন্তু, কেউইতো আর ঐরকম কিছুর পুনরাবৃত্তি চাইবে না, তাই সবাইকেই এরকম অবস্থা মেনে নিতে হচ্ছে।
মক্কা-মদীনার পবিত্র মসজিদ দুটির প্রায় প্রতি ইঞ্চি জায়গা এখন একাধিক ক্যামেরার আওতায়। স্থাপনা দুইটির পুননির্মাণ (সংস্কার) কাজের পরে, প্রবেশ পথ এখন এতো বেশী হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, এখন আর কোনোভাবেই দখলে নিয়ে মুসল্লিদেরকে জিম্মি করার সুযোগ নেই। নিয়মিত পদাতিক বাহিনী দিয়ে দখল করা ছাড়া আর অন্য পথ নেই।
যেহেতু, একজন অনেক বড় আলেম ধর্মের প্রতি অনুরাগে অনুরাগে অন্ধ হয়ে এতোবড় অন্যায় কাজ করে ফেলেছিলেন, তাই, বাদশাহ্‌’র নির্দেশে ধর্মীয় শিক্ষা আরো জোরালোভাবে বিপুল পরিসরে ছড়িয়ে দেয়ার আয়োজন শুরু হয়; যেনো ধর্মের জোশে কেউ অধর্ম না করে ফেলে, প্রকৃত ধর্ম যেনো সবার কাছে পৌঁছতে পারে সে ব্যাপারে প্রচারণা ও প্রচেষ্টা জোরদার করা হয়। বাদশাহ্‌ খালেদকে এই বিচক্ষণতার জন্যে আমি স্যালিউট জানাই।
সৌদী আরবের অভ্যন্তরে ধর্ম শিক্ষা ও আচার অনুষ্ঠানে আরো নজরদারির আয়োজন করা হয়। যে কারণে, সেখানে তাবলীগ জামাতের পূর্বানুমতি প্রয়োজন হয়, মিলাদ পরিচালনাকারীকে লাইসেন্স নিতে হয়।
দেশের বাইরেও, সারা বিশ্বে বিশুদ্ধ ইসলাম প্রচারে, উগ্রপন্থা থেকে সতর্ক থাকার শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলায়, ইসলামি সেবা ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলায়, সরকারিভাবে যেমন যথাসাধ্য অনুদান দেয়ার চেষ্টা করা হয়, দেশের ধনাঢ্য ব্যাক্তিদেরকেও অনুরূপ অনুদান প্রদানে উৎসাহ দেয়া হয়।
কোনো বহিঃশ্ত্রু নয়, “আমেরিকান-জায়োনিস্ট লবি” নয়, “আকীদা ভ্রষ্ট শিয়ারা” নয়, – মেধাবী, সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষায় শিক্ষিত, ধর্মানুরাগী, দ্বীনের জন্যে পরীক্ষিত ত্যাগী, আলেম সমাজের সম্ভম কুড়ানো একজন সুন্নি আলেম এরকম কাজ করে ফেলেছিলেন। আমরা এথেকে কী শিখতে পারি? এতো বড় ঘটনার বিশ্লেষণে নিশ্চয় শিক্ষনীয় অনেক কিছুই বের হয়ে আসবে। তবে, প্রাথমিকভাবে আমার যা মনে হয়েছে, তা হলো, কাউকেই অন্ধভাবে সমর্থন করার সুযোগ নাই, এবং, ধর্মীয় বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছলেও, গোঁ না ধরে ভিন্নমত গুলোও শুনে দেখা ভাল। জমায়েত, আচার ও প্রচার প্রকাশ্যে করা উচিৎ, এবং, মত বিনিময় চালু রাখা উচিৎ।
প্রার্থনা করি, আল্লাহ্‌ আমরা মুসলিমদেরকে সত্যপথে থাকার দয়াটুকু করুন।

Leave a Reply

You must be logged in to post a comment.

Editor in Chief: Dr. Omar Faruque

Editor: Dr. Morjina Akhter

All contact: 400E Mosholu Parkway South Apt # A23,The Bronx, New York 10458, USA

Mob. 001.347.459.8516
E-mail: dhakapost91@gmail.com