অনিবার্য বন্দুকযুদ্ধে ইয়াবাসম্রাট নেই কেন?
23 May, 2018
পীর হাবিবুর রহমান
এপ্রিলের ২৩ তারিখ নিউইয়র্ক গিয়েছিলাম। নীল আকাশ, ভেসে বেড়ানো সাদা সাদা মেঘ, আর ঝলমলে রোদ নিয়ে ২৪ এপ্রিল সকালে নিউইয়র্ক শহরে যখন নামলাম, মনে হলো সামার শুরু হয়েছে। কিন্তু দেশের মতোই আবহাওয়ার বৈরী খেলা চলছিল। যখন তখন কালো মেঘ, ঝড়ো হাওয়া, বৃষ্টি এবং সঙ্গে কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস। ঠাণ্ডার কারণে শুরুতেই অসুখ বাঁধিয়ে বসলাম। দেশের বাইরে যখন থাকি, তখন সবকিছু থেকে দূরে থাকি। নিজের মতো ঘুম, ঘুরে বেড়ানো, আপনজনদের সঙ্গে প্রাণ খুলে আড্ডা। সব মিলিয়ে সময় কাটে নির্মল আনন্দে।
সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মরহুম আবদুজ জহুরের কন্যা ফাতেমা চৌধুরী স্বপ্না ও পঁচাত্তর-উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার চৌধুরী আনুলের আতিথেয়তায় মনে হয়েছে নিউইয়র্ক নয়, সুনামগঞ্জেই ছিলাম। তাঁদের পাশেই কবি-গীতিকার ইশতিয়াক রুপু থাকেন। ঘুম ভাঙলেই ডেকে এনে আড্ডা, রাত নামলেই জায়েদ চৌধুরী অপু, জোসেফ চৌধুরী, ছরওয়ার হোসেন ও রিফাত হোসেনকে নিয়ে রাতভর নিউইয়র্কে ঘুরে বেড়ানো। সমুদ্রশহর ও বিনোদনের রানী খ্যাত আটলান্টিক সিটিও দুই দিন ঘুরিয়ে এনেছে রিফাত। বয়সের ব্যবধান তাঁদের সঙ্গে যতই থাকুক, মানিয়ে নেওয়ার অস্বাভাবিক ক্ষমতা তাঁদের। সুনামগঞ্জের সংগীত পরিবারের সন্তান ডি চৌধুরী অসিত। সেখানে সংস্কৃতির জগতে নিজের জায়গা শক্ত করে নিয়েছেন। সময় দিতে তিনিও কার্পণ্য করেননি। ছোট বোন খুশির বর ড. শাহাদাত হাসান শিক্ষক হলেও কমিউনিটির সব খবর রাখেন। তাঁর মতো আওয়ামী লীগভক্ত আছে বলেই দলটি দুর্দিনে বৈরী সময় কাটিয়ে ওঠে।
স্বাধীনতা-উত্তর সুনামগঞ্জ ছাত্রলীগের সভাপতি নুরুজ্জামান চৌধুরী শাহী ও আনোয়ার চৌধুরী আনুলের বাগানের বারবিকিউ পার্টি জমেছিলবেশ। প্রবাসীরা বাড়ির পেছনে বাগানে এখন সবজি ফলানোর প্রস্তুতি শুরু করেছেন। একসময় প্রবাসীরা এস্টোরিয়ায় বসত গড়েছিলেন বেশি করে। এখন ছড়িয়েছেন সবখানে। ব্রোন্স, ব্রুকলিন, লং আইল্যান্ড ও জ্যাকসন হাইটসে অনেকে থাকেন। জ্যাকসন হাইটস ও জ্যামাইকায় বের হলে মনে হয় ঢাকার রাস্তায় হাঁটছি। দেখতে ভালোই লাগে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিয়মিত বিতর্কের ঝড়েই আছেন। একেক ইস্যুতে রোজ টিভি খুললেই তাঁকে নিয়ে বিতর্ক দেখা যায়। গণমাধ্যমের সঙ্গেও যুদ্ধে অবতীর্ণ তিনি। নিউইয়র্ক টাইমস ও সিএনএন তাঁকে যেমন ছাড়ে না, তিনিও সমালোচনার তীর ছুড়তে ভুল করেন না। এত বিতর্কের মধ্যেও কর্মসংস্থান বাড়িয়েছেন। আমেরিকান তরুণরা তার সমর্থক। গণতন্ত্রের প্রতাপশালী রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রেরই নয়, পৃথিবীর অন্যতম ব্যস্ত নগরী নিউইয়র্কের অলস রাতে ম্যানহাটন জেগে থাকে। সেখানে গভীর রাতে ঘুরতে ঘুরতে কেন জানি মনে হলো, পৃথিবী এখন সাংবিধানিক বা নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্রের কবলে। একদা অসাংবিধানিক ও অনির্বাচিত সামরিকতন্ত্র, রাজতন্ত্র বা একদলীয় কমিউনিস্ট স্বৈরতন্ত্রের কবলে ছিল। প্রবাসীরা যেখানেই থাকেন সারাক্ষণ হৃদয়ে দেশের জন্য গভীর আবেগ ও টান অনুভব করেন। মেধা, পরিশ্রম ও সততা দিয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠাই করেননি, সন্তানদেরও উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে মানুষ করেছেন। নানা পেশায় আজকের প্রজন্ম কিস্তিমাত করছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি-বাকরি করে বাংলাদেশিরা সেখানকার অর্থনীতিতে ভূমিকাই রাখছেন না, মূলধারার রাজনীতির সঙ্গেও সম্পৃক্ত হচ্ছেন। নিউইয়র্ক থেকে প্রবাসীরা কুড়িটির বেশি বাংলা সাপ্তাহিক প্রকাশ করেন। টেলিভিশন চ্যানেলও রয়েছে।
নিউইয়র্ক থেকে ঢাকায় আসার আগের দিন সেখানকার গণমাধ্যম ও সুধীজনদের সঙ্গে বন্ধু নঈম নিজামসহ আমাকে নিয়ে তারা একটি প্রাণবন্ত আড্ডা দিলেন। ঢাকায় সাংবাদিকতায় কাজ করা অনেক প্রিয়জন এখন নিউইয়র্কে সাংবাদিকতায় জড়িত। অনুজপ্রতিম হাসানুজ্জামান সাকীর প্রাণবন্ত উপস্থাপনায় অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা জমে উঠেছিল। ‘ঠিকানা’ সম্পাদক এম এম শাহীন, ‘আজকাল’ সম্পাদক মঞ্জুর আহমেদ, ‘বাঙালী’ সম্পাদক কৌশিক আহমেদ, ‘বাংলা টিভি’র সিইও আবু তাহের, ‘বর্ণমালা’ সম্পাদক মাহফুজুর রহমানসহ সবাই এসে হলরুম সরগরম করেছিলেন। অভিনেত্রী লুত্ফুন নাহার লতা, রেখা আহমেদ, কবি রওশন জাহানসহ অনেক সুধীজন এসেছেন। আকস্মিক উপস্থিত হয়ে প্রধানমন্ত্রীর ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আশরাফুল আলম খোকন সংবাদকর্মীদের বাংলাদেশের মহাকাশ অভিযান নিয়ে অনেক প্রশ্নের জবাব প্রাঞ্জল ভাষায় দিলেন। প্রবীণ ফটোসাংবাদিক লুত্ফর রহমান বীনুও সেখানে ছিলেন।
১৪ তারিখ সন্ধ্যার এই আড্ডার আগে রাজনীতিবিদ তোফায়েল চৌধুরীর আমন্ত্রণে প্রয়াত পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ওপর স্মৃতি সংসদের এক আলোচনা সভায় বক্তব্য দিতে হলো। তারও আগে নিউইয়র্কে সিলেটবাসীর সর্ববৃহৎ সংগঠন জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশন আমাকে ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইনকে নিয়ে সবার উপস্থিতিতে মতবিনিময় সভা করে। সেখানকার জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট বদরুল আনাম খান একজন অমায়িক ভদ্রলোক। সভায় অনেক বক্তা ছহুল হোসাইনকে আগামী জাতীয় নির্বাচনে সিলেট সদর আসনে প্রার্থী হওয়ার অনুরোধ করলে তিনি বললেন, অতীতে অনেক দায়িত্ব নিয়েছি। ভবিষ্যতে কোনো দায়িত্ব কাঁধে এসে পড়লে সেই চ্যালেঞ্জও নেব।
দেশে আজকাল অনেক ক্ষেত্রে সকালের মানুষ বিকালে চেনা যায় না। এক অস্থির-অশান্ত সময় মানুষকে বদলে দিচ্ছে। নির্বাসনে যাচ্ছে মানুষের সরলতা, মায়া-মমতা ও কোমলতা। ঠাঁই পাচ্ছে প্রতারণা, ধূর্ততা, রাতারাতি আখের গোছানো ও অসুস্থ প্রতিযোগিতা। প্রবাসে এখনো সেই সরল স্নেহ-মমতা অনেক প্রবাসীই ধরে রেখেছেন। প্রবাসীদের আন্তরিকতা দেশের জন্য গভীর প্রেম ও টান খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু এত গলাগলির মাঝে দেশের রাজনীতি নিয়ে নিজেদের দলাদলি ব্যথিত করে। অনেক প্রবাসীও মর্মাহত হয়ে তাদের কাছ থেকে দূরে থাকেন। সেখানকার মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত না হয়ে দেশের রাজনীতির সেখানকার শাখা সংগঠন তাদের নিয়মিত কোন্দল, দলাদলি এমনকি মিটিংয়ে মারামারি এবং চেয়ার ছোড়াছুড়িও ঘটায়। প্রবাসীদের সব অর্জন ও আনন্দ মাঝেমধ্যে এসব অপকর্মে ধূসর হয়ে যায়।
২৩ তারিখ ঢাকা থেকে যখন ইতিহাদে যাই, একই ফ্লাইটে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও গেছেন। পরদিনই শুনি আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপ আলাদা সংবর্ধনা সভার আয়োজন করে। দলের সবাইকে খুশি রাখতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দুটি সভায়ই যেতে হয়।
নিউইয়র্কে এখন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীর দলাদলি ও বিভক্তি বহুল আলোচিত ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমানের বিরুদ্ধে দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা-কর্মী অবস্থান নিয়েছেন। দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনার কাছে তারা তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। দেখাও করেছেন। তাদের অভিযোগ গেল বছর ১২ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সম্মেলন করার ঘোষণা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক দিলেও ড. সিদ্দিক তা হতে দেননি।
ড. সিদ্দিকুর রহমানের বিরুদ্ধে দল পরিচালনায় স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ এনে তারা বলেছেন, তিনি যখন খুশি যাকে-তাকে দল থেকে বহিষ্কার করেন। যাকে-তাকে পদ-পদবি দেন। বর্তমান কমিটির মেয়াদ অনেক আগে উত্তীর্ণ হয়েছে। সাত বছর আগে গঠিত এই কমিটির অনেকে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত। অনেকে নিষ্ক্রিয়। ড. সিদ্দিকুর রহমানের নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে দলের নেতা-কর্মীরা বড় ধরনের সভা-সমাবেশও করেছেন। সেখানে পঁচাত্তর-উত্তর দুঃসময়ে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে উঠে আসা বাকসুর সাবেক জি এস ড. প্রদীপ করসহ অনেকেই সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন। নেতা-কর্মীরা নতুন কমিটির আশায় দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার দিকে তাকিয়ে আছেন। তারা আশা করছেন, শিগগিরই যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের নতুন কমিটি ঘোষিত হবে।
ড. সিদ্দিকুর রহমানসহ অনেক নেতা বছরের দীর্ঘ সময় দেশে থাকেন। জাতিসংঘের অধিবেশন এলে প্রধানমন্ত্রীর সফর ঘিরে তারা সেখানে যান এবং তড়িঘড়ি করে সংবর্ধনা সভার আয়োজন করেন, এমন অভিযোগ নেতা-কর্মীদের পক্ষ থেকে দলের সভানেত্রীকেও দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির রাজনীতি নিয়ে দলাদলি আরও করুণ। অনেকে বলেন, সেখানে সভা ডাকলে তা শুরুর আগেই দলাদলি ও হাতাহাতিতে রূপ নেয়।
প্রবাসীদের মধ্যেও বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অনেক কৌতূহল ও প্রশ্ন রয়েছে। অর্থাৎ বিশেষ করে বিএনপি নির্বাচনে আসবে কিনা, নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে কিনা এ প্রশ্নই বড়। নিউইয়র্ক থাকাকালে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মাধ্যমে বাংলাদেশ মহাকাশ জয় করেছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে মহাকাশ জয়ের ঘটনা জাতির জীবনে এক বিস্ময়কর অর্জন এতে কোনো বিতর্ক নেই। শেখ হাসিনার হাত ধরেই আমাদের এখন সাবমেরিনই নয়, তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লবই নয়, বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জ করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো প্রকল্প সমাপ্তির পথে। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ দমনই নয়, একাত্তর ও পঁচাত্তরের খুনিদের ফাঁসিতে ঝোলানো, ছিটমহল সমস্যার সমাধান ছাড়াও ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সাক্ষী হচ্ছি আমরা।
কিন্তু স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও আমরা সুমহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর আজীবন সংগ্রামের চেতনায় একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শোষণমুক্ত মানবিক রাষ্ট্রের যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, তা আমরা এখনো বাস্তবায়ন করতে পারিনি। এখনো আমরা একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বিতর্কের মধ্যে ডুবে আছি। বহু রক্তের বিনিময়ে অর্জিত দেশ, বহু রক্তের বিনিময়ে অর্জিত গণতন্ত্র। কিন্তু কখনো মানুষ ভোটের নেতা, কখনো লুটের নেতা, কখনো বিনা ভোটের নেতা দেখেছে।
জাতির আজীবনের আরাধনা একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে জনগণের ভোটে নেতৃত্ব নির্বাচনই নয়, নিয়মিত ক্ষমতার পালাবদল। মানুষের আজন্ম আকুতি একটি উন্নত-আধুনিক বাংলাদেশের জন্য ব্যাপক উন্নয়নের পাশাপাশি সুশাসন নিশ্চিত। মানুষের বুকভরা আকুতি রাজনৈতিক বাণিজ্যিকীকরণের কবল থেকে রাজনীতির ধারাকে ভোগ-বিলাসের পথ থেকে ঐতিহ্যের ত্যাগবাদী, নির্লোভ, সততার পথে ফিরিয়ে আনা। জাতির জন্মের আকুতি কার্যকর সংসদ, জবাবদিহিতামূলক শাসনব্যবস্থা, সংবিধান ও আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নন এই সত্যকে প্রতিষ্ঠা করা। মনোনয়ন বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্য, তদবির বাণিজ্য ও কমিশন বাণিজ্যের কবল থেকে রাজনীতিকে মুক্ত করা। মানুষের প্রত্যাশা দলের ভিতর-বাইরে গণতন্ত্র। দলীয়করণের মাধ্যমে প্রশাসননির্ভর রাজনীতি নয়, জনগণনির্ভর রাজনীতির মাধ্যমে প্রমাণ করা জনগণই ক্ষমতার উৎস। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিকশিত সমাজে সব মত-পথের রাজনৈতিক শক্তির সৌহার্দ্যের সংস্কৃতি পুনঃস্থাপন।
১৬ মে বুধবার নিউইয়র্কের জে এফ কে এয়ারপোর্ট থেকে ঢাকায় ফেরার জন্য ইতিহাদের ফ্লাইটে যখন উঠলাম, তখন জানানো হলো টেকনিক্যাল কারণে উড়োজাহাজ আকাশে উড়তে বিলম্ব হচ্ছে। ৩টার ফ্লাইট ৬টায় আকাশে উড়ল। আবুধাবি যখন নামল, কানেকটিং ফ্লাইটটি তখন উড়ে গেছে। ইতিহাদ কর্তৃপক্ষ ১২ ঘণ্টাই এয়ারপোর্টে যাত্রীদের ফেলে রাখলেন। দীর্ঘ যাত্রা বিলম্ব হলেও হোটেলে নেওয়ার ব্যবস্থা করলেন না। রাত ১২টায় বিমান বাংলাদেশের ফ্লাইটে তুলে দিলে পরদিন সকালে চট্টগ্রাম হয়ে দক্ষতার সঙ্গে পাইলট তানভীর এনে নামালেন। ইতিহাদের অমানবিক আচরণ যাত্রীদের ব্যথিত করলেও কাউকে টুঁ-শব্দ করতে দেখলাম না। অথচ ইতিহাদের জায়গায় যদি বিমান বাংলাদেশ হতো তাহলে লঙ্কাকাণ্ড ঘটে যেত। নিউইয়র্ক প্রবাসীরা বন্ধ হয়ে যাওয়া ঢাকা-নিউইয়র্ক রুটে বিমান আবার চলাচল করুক এটা খুব বেশি করে চান।
যাত্রাপথের ভোগান্তিতে শারীরিক ও মানসিক ধকল এবং ঘুমের সময়ের তারতম্য সব মিলিয়ে এখনো স্বাভাবিক কাজের জগতে ফিরতে পারিনি। দেশে ফিরে দেখলাম প্রশাসননির্ভর সরকার মন্ত্রীদের সঙ্গে আমলাদের মোবাইল কেনার জন্য ৭৫ হাজার টাকা করে বরাদ্দ দিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা রঙ্গরস হচ্ছে। ভিতরের খবর না জানলেও অভিজ্ঞতা বলে এটি রাজনীতিবিদ নয়, আমলাদেরই চিন্তার ফসল। আমলাদের গাড়ি কিনতে ব্যাংক সুদের হার নাকি কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ব্যাংক ঋণের পরিমাণও নাকি বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যে বরাদ্দ তাতে তারা মারহাবা মারহাবা করছেন।
নিউইয়র্কে এক সভায় বলেছিলাম, বাংলাদেশের আগামী প্রজন্ম ধর্মান্ধ উগ্রবাদী শক্তি, দুর্নীতিগ্রস্ত লুটেরাগোষ্ঠী ও মাদক-মাফিয়াদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে। দেশে ফিরে দেখলাম সরকার মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নিয়েছে। ‘চলো যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে’ এ স্লোগান তুলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযানে নেমেছে। মাদকের বিরুদ্ধে এ অভিযানে বন্দুকযুদ্ধে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত অনেকের নিহত হওয়ার সংবাদ এসেছে। ইয়াবার মরণনেশা গোটা দেশের তারুণ্যকে ধ্বংসের পথে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। যে পরিবারে একজন মাদকাসক্ত রয়েছে, সে পরিবারের সব সুখ-শান্তি হারাম হয়ে যাচ্ছে। ঐশীর মতো একটি কোমলমতি মেয়ে বাবা-মায়ের অগাধ স্নেহ ভুলে ইয়াবার কারণে নিষ্ঠুরের মতো খুন করতে দ্বিধা করেনি।
মাদক মানুষের প্রাণশক্তিকেই শেষ করে দিচ্ছে না, শারীরিকভাবে পঙ্গুই করছে না, হতাশার চাদরে জীবনের সব ভবিষ্যৎ অন্ধকারেই টেনে নিচ্ছে না, মেধা ও মননশীলতাকেও শেষ করে দিচ্ছে। একেকজন মাদকসেবী একেকটি পরিবারের অভিশাপ থেকে গোটা জাতির অভিশাপ হয়ে উঠেছে। উদাত পাঞ্জাব সিনেমায় দেখেছিলাম, পাঞ্জাবের এমন কোনো ঘর নেই যেখানে একজন মাদকসেবী নেই। বাংলাদেশে ইয়াবার আগ্রাসন মেধাবী তারুণ্যকেই নয়, টিনএজদেরও সর্বনাশা নেশার পথে টেনে নিচ্ছে। মাদকের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধ অনিবার্য ছিল। বন্দুকযুদ্ধে যারা নিহত হচ্ছে, তাদের বেশির ভাগই অতিসাধারণ। যাদের কাছে ১০০ থেকে সর্বোচ্চ ৮০০ পিস ইয়াবা পাওয়ার খবর আসছে। এ অভিযানকে স্বাগত জানাই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ যাতে এ সুযোগে কোনো অপকর্মে না জড়ান, সে দিকটি কর্তৃপক্ষের মনিটরে থাকা জরুরি। একই সঙ্গে প্রশ্ন থাকে, সব কটি বন্দুকযুদ্ধে যারা নিহত হয়েছে, তাতে কেবল মাদকের সঙ্গে জড়িত গরিব সাধারণ মানুষেরই পরিচয় এসেছে। অনিবার্য মাদকবিরোধী এ বন্দুকযুদ্ধে এখন পর্যন্ত একজন ইয়াবা বা মাদক মাফিয়ার নিহতের সংবাদ নেই কেন? যারা বহন করে, যারা খুচরা ব্যবসায়ী বন্দুকযুদ্ধে কেবল তারাই নিহত হলে আর বড় বড় ইয়াবা ব্যবসায়ীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকলে অভিযান জনসমর্থন হারাবে। বন্দুকযুদ্ধে নিহত না হোক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে বড় বড় ইয়াবা ব্যবসায়ী গ্রেফতার হোক— এটি মানুষের প্রত্যাশা। আইনের আওতায় এনে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হোক। ইয়াবা মোড়লরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকলে অভিযান প্রশ্নবিদ্ধ হবে। সরকারকে এ অভিযান পরিচালনার জন্য অভিনন্দন জানিয়ে বিষয়টি গভীরভাবে চিন্তার অনুরোধ করছি। শুধু মাদক ব্যবসায়ী নয়, দেশের অর্থ বিদেশে পাচারকারী দুর্নীতিগ্রস্ত লুটেরা চক্রের বিরুদ্ধে আগামীতে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করা দরকার।
নিউইয়র্ক থাকাকালে উপমহাদেশের প্রাচীনতম ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্রের লড়াইয়ে অবদান রাখা ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলন সম্পন্ন হয়েছে। ছাত্রলীগের ইতিহাসে কমিটি ঘোষণায় এত বিলম্ব অতীতে আর কখনো হয়নি। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা যাচাই-বাছাই করে ছাত্রলীগের কমিটি দিতে যাচ্ছেন বলে এই বিলম্ব শুনেছি। সম্মেলনে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ছাত্রলীগের নেতৃত্ব হবে সমঝোতায়, না হয় ভোটে। সমঝোতার পথটিই নিয়েছেন। ছাত্রলীগের উপযুক্ত মেধাবী নেতৃত্ব উপহারদান তাঁর অঙ্গীকার। সবার প্রত্যাশা আদর্শবান, ত্যাগী সাহসী সংগঠনের প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ নতুন নেতৃত্ব নির্বাচিত হবে। যাঁরা ক্যাম্পাস, মধুর ক্যান্টিন, সাংগঠনিক তৎপরতা ও সংগঠনের কার্যালয়ে নিজেদের সরব রেখেছে এবং দলীয় শৃঙ্খলা মেনে চলেছে সেই মেধাবীদের মধ্যে নেতৃত্ব নির্বাচিত হবে। মাদকাসক্ত, মাদক ব্যবসায়ী, ছাত্রীদের উত্ত্যক্তকারী, রেজিস্ট্রার বিল্ডিং, নগর ভবন, শিক্ষা ভবন, বিদ্যুৎ ভবনসহ নানা এলাকায় যারা টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত, তারা নেতৃত্বের বাইরে থাকবে— এমনটাই সবার প্রত্যাশা। শুধু পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ডই নয়, অর্থনৈতিক দিক এবং ব্যাংক হিসাবের লেনদেন ও সেই সঙ্গে কোনো ব্যবসায়ীর হয়ে কাজ করেন কিনা তাও বিবেচনায় আনা জরুরি। ছাত্র রাজনীতিই নয়, ছাত্রলীগের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা মেধাবী, আদর্শবান, কমিটেড নিয়মিত ছাত্রদের মধ্য থেকে ভদ্র পরিশীলিত, মার্জিত সৃজনশীল ছাত্রছাত্রীরা ছাত্রলীগের নেতৃত্বে অভিষিক্ত হবে— এটিই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, পূর্বপশ্চিমবিডি ডট নিউজ।
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন