অতি সংগোপনেই চলে গেল স্যার সলিমুল্লাহর এবারের মৃত্যুবার্ষিকীও।

January 20, 2019 8:27 pm0 commentsViews: 91
তারিখঃ ২০ জানুয়ারি ২০১৯।। নিউইয়র্ক থেকে ড ওমর ফারুক।
১৬ জানুয়ারি ছিল নবাব স্যার সলিমুল্লাহর মৃত্যুবার্ষিকী।
[আমরা সেই সেই অকৃতজ্ঞ জাতি। অতি নীরবে ও সংগোপনেই চলে গেল এ মনিষীর মৃত্যুবার্ষিকী]
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত দেশের দু’টি, দু’টি নয়, মূলতঃ বুয়েটসহ তিনিটি ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ প্রতিষ্ঠায় মূখ্য ভূমিকা পালনকারী নবাব স্যার সলিমুল্লাহর মৃত্যুবার্ষিকী ছিল গত ১৬ জানুয়ারি। ভারতবর্ষে উচ্চশিক্ষার শুরু ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর। ১৮৫৭ সালে ভারতের বড়লাট লর্ড ক্যানিং ‘দ্য অ্যাক্ট অফ ইনকরপোরেশন’ পাশ করে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হল কোলকাতা, বোম্বে এবং মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়। এর আগে থেকেই ভারতবর্ষে উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা ছিল কিন্তু এ তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয় মূলত ইউরোপীয় মডেলে।অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মত কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মান ছিল উঁচু। আর এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ছিলেন মূলতঃ পশ্চিম বঙ্গের উঁচুতলার হিন্দু সন্তানরা।
[ “মূর্খের দেশে আবার কিসের বিশ্ববিদ্যালয়, তারাত ঠিকমতে কথাই বলতে জানে না!” অন্যত্র এক অনুষ্ঠানে এদেশের মানুষকে তীব্রভাবে কটাক্ষ করে রবী ঠাকুর বলেছিলেনঃ “সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ কর নি”। অথচ সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন, মৃত্যুদিন, সাহিত্য উৎসবসহ আরো অনেক অায়োজন ধুমধামের সাথে পালন করা হয়।]

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের আগে অবিভক্ত বাংলায় ১৯টি কলেজ ছিল। তার মধ্যে পূর্ব বাংলায় নয়টি। তবে সেটাই পর্যাপ্ত ছিল বলে মনে করেন নি তখনকার পূর্ব বাংলার মানুষ। ১৯০৫ সালে বাংলা প্রেসিডেন্সি ভাগ করে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে নতুন এক প্রদেশ করা হয়। যার প্রচলিত নাম বঙ্গভঙ্গ। পূর্ববঙ্গে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে আসা ছিল এই উদ্যোগের একটি অংশ। বঙ্গভঙ্গের এ সময়টা ছিল খুব অল্প সময়ের জন্য, মাত্র ছয় বছর। কারণ এরমধ্যেই পশ্চিম বঙ্গের হিন্দু নেতারা এই বঙ্গভঙ্গ রদের জন্য প্রবল আন্দোলন শুরু করেন । রবী ঠাকুরের জন্ম এবং প্রয়াণ দিবসের মাসখানেক আগে থেকেই বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর ঠিক উপরে দিকে কোনায় রবি বাবুর একটি ছবি যোগ হয়ে যায়।পত্রিকাগুলোর বিশেষ ক্রোড়পত্র ছাপানোর ধুম লেগে যায়। কিন্তু স্যার সলিমুল্লাহর জন্য কোন চ্যানেল বা পত্রিকা কিছুই করে না। এই স্যার সলিমুল্লাহ নবাব পরিবারের মালিকানাধীন ৬০০ একর জমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও বুয়েটের জন্য দিয়েছিলেন। তার নাম কেউ কখনও মনে করে না। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় দিবসেও না। কিন্তু ঢাবি প্রতিষ্ঠার প্রতিবাদে কলকাতায় অনশনেও যোগ দিয়েছিলেন যিনি। বিদ্রূপ করে বলেছিলেন, ‘ওটা মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়’ হবে।’ সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাবি’র পাঠ্যক্রমের গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে আছেন! সেই রবী ঠাকুরের জন্ম ও প্রয়াণ দিবস ঘটা করে পালিত হয় এই ঢাবি ‘তে। বাঙাল ’চেতনা’ শিখছে, কিন্তু কৃতজ্ঞতাবোধটা শিখল না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় শুধু কঠোরভাবে বিরোধিতা করেই ক্ষান্ত হন নি বরং তিনি ব্রিটিশদের সাথে রীতিমত দেন-দরবার করেছিলেন, যাতে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় না করা হয়। সে সময় রবীন্দ্রনাথ এক অনুষ্ঠানে দাম্ভিকতার সাথে বলেছিলেনঃ “মূর্খের দেশে আবার কিসের বিশ্ববিদ্যালয়? তারাত ঠিকমত কথাই বলতে জানে না!” অন্যত্র এক অনুষ্ঠানে এদেশের মানুষকে তীব্রভাবে কটাক্ষ করে রবী ঠাকুর বলেছিলেনঃ “সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ কর নি”। অথচ সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন, মৃত্যুদিন, সাহিত্য উৎসবসহ আরো অনেক অায়োজন ধুমধামের সাথে পালন করা হয়।

আর যে বঙ্গসন্তান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপকার সেই নবাব স্যার সলিমুল্লাহকে আজকের শিক্ষার্থীদের অনেকেই চেনাতো দূরের কথা, নামটাও জানে না। আমরা এতটা অকৃতজ্ঞ যে বলতেও লজ্জা লাগে।
  ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায়  নেপথ্য ভূমিকা পালন করেছিল নিঃসন্দেহে। সরকারি প্রশাসনিক এলাকা হিসেবে বঙ্গ বেশ বড় হওয়ার ফলে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে এটির শাসনকার্য পরিচালনা দুরূহ হয়ে পড়ে। বঙ্গভঙ্গের সূত্রপাত এখানেই। শাসনকার্য সুচারু রূপে ও সহজ করার জন্যে নতুন প্রদেশ স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। নতুন প্রদেশটির নামকরণ করা হয় “পূর্ব বঙ্গ ও আসাম”, যার রাজধানী হবে ঢাকা এবং অনুষঙ্গী সদর দফতর হবে চট্টগ্রাম। ১৬ অক্টোবর ১৯০৫ বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয়। পূর্ব বঙ্গের মুসলিমদের এই ধারণা হয় যে, নতুন প্রদেশের ফলে শিক্ষা, কর্মসংস্থান ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাদের সুযোগ বেড়ে যাবে। যদিও পশ্চিম বঙ্গের জনগণ এই বিভক্তি মেনে নিতে পারল না এবং প্রচুর পরিমাণে জাতীয়তাবাদী লেখা এই সময় প্রকাশিত হয়। রবী ঠাকুরসহ অনেকই এরকম পূর্ব বঙ্গের স্বার্থ বিরোধী আন্দোলন করেছিলেন। তাদের এ রকম মুসলিম বিদ্বেষী আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয়।
সৈয়দ আবুল মকসুদ তাঁর ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা’ গ্রন্থটিতে লিখেছেন এভাবেঃ  “শ্রেণীস্বার্থে রবীন্দ্রনাথও ছিলেন কার্জনের (লর্ড কার্জন) ওপর অতি ক্ষুব্ধ। কার্জনের উচ্চশিক্ষা সংক্রান্ত মন্তব্যের তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় কলকাতার হিন্দু সমাজে। তাতে রবীন্দ্রনাথও অংশগ্রহণ করেন। তিনি যে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন,তাতে কিছু ছিল যুক্তি, বেশির ভাগই ছিল আবেগ এবং কিছু ছিল ক্ষোভ”।
 
এই বঙ্গ একত্রিত করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে পূর্ব বঙ্গের জনগণের প্রতিবাদের ফসল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ”ঢাকাঃ স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী” গ্রন্থে লিখেছেন এভাবেঃ “বঙ্গভঙ্গ রদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। লর্ড লিটন যাকে বলেছিলেন স্পেল্নডিড ইম্পিরিয়াল কমপেনসেশন। পূর্ববঙ্গ শিক্ষাদীক্ষা, অর্থনীতি সব ক্ষেত্রেই পিছিয়ে ছিল। বঙ্গভঙ্গ হওয়ার পর এ অবস্থার খানিকটা পরিবর্তন হয়েছিল, বিশেষ করে শিক্ষার ক্ষেত্রে।” ১৯১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ। এর মাত্র তিনদিন পূর্বে ভাইসরয় এর সাথে সাক্ষাৎ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আবেদন জানিয়ে ছিলেন ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, ধনবাড়ীর নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক এবং অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। বহু প্রতিকুলতা পেরিয়ে অবশেষে বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে ১৯২১ সালে। অনেকেই বলেন university আর medical college প্রতিষ্ঠায় নওয়াব সলিমুল্লাহ’র অবদান ছিল, তিনি জমিও দান করেছিলেন এবং রবীন্দ্রনাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোর বিরোধী ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পেছনে নওয়াব সলিমুল্লাহ’র যথেষ্ঠ অবদান ছিল সেটা অনস্বীকার্য।
২০১৮ সালের পয়লা জুলাই বিবিসি বাঙলা বিভাগ ফারহানা পারভীন-এর লেখা “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা করেছিলেন যারা” নামে প্রতিবেদনে যারা পক্ষে কাজ করেছিলেন, তাদের সম্পর্কে লিখতে গিয়ে ফারহানা বলেনঃ ”ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা যে হয়েছিল নানা পক্ষ থেকে, সেটা ইতিহাস ঘাটলে তথ্য পাওয়া যায় “ সে বিরোধিতার মধ্যে রবী বাবুর নাম তো সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। উক্ত প্রতিবেদনে যারা উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলন, সে সম্পর্কে তিনি বলেন, ”কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আবশ্যকতা রয়েছে সেটা বোঝাতে এবং প্রতিষ্ঠার ব্যাপার অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন যাঁরা, তাদের কথা না বললেই নয়। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ। কিন্তু, হঠাৎ করে ১৯১৫ সালে নবাব সলিমুল্লাহের মৃত্যু ঘটলে নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী শক্ত হাতে এই উদ্যোগের হাল ধরেন। অন্যান্যদের মধ্যে আবুল কাশেম ফজলুল হক উল্লেখযোগ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় পূর্ব বাংলার হিন্দুরাও এগিয়ে এসেছিলেন। এদের মধ্যে ঢাকার বালিয়াটির জমিদার অন্যতম। জগন্নাথ হলের নামকরণ হয় তাঁর পিতা জগন্নাথ রায় চৌধুরীর নামে। “

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে বিরোধী হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় আর রাজনীতিক সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর নাম সৈয়দ আবুল মকসুদের ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা’ বইতে উঠে এসেছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু লোকজনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন বলে উল্লেখ করা হয়। ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১২ সালে তাঁর ঢাকা সফর শেষে কলকাতা প্রত্যাবর্তন করলে ১৯১২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ড. রাসবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল তার সাথে সাক্ষাৎ এবং ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতামূলক একটি স্মারকলিপি পেশ করেন।এ সংক্রান্ত বিভিন্ন বইতে উঠে এসেছে, লর্ড হার্ডিঞ্জ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, কী মূল্যে অর্থাৎ কিসের বিনিময়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতা থেকে বিরত থাকবেন?

শেষ পর্যন্ত স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য চারটি নতুন অধ্যাপক পদ সৃষ্টির বিনিময়ে তার বিরোধিতার অবসান করেছিলেন। পরবর্তীতে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য শিক্ষক নিয়োগে সহযোগিতা করেন। তার সঙ্গে ছিলেন স্যার নীলরতন সরকার

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে ১৯২১ সালে। সে সময়ের ঢাকার সবচেয়ে অভিজাত ও সৌন্দর্যমণ্ডিত রমনা এলাকায় নবাব স্যার সলিমুল্লািহর দানে প্রায় ৬০০ একর জমির উপর পূর্ববঙ্গ এবং আসাম প্রদেশের পরিত্যক্ত ভবনাদি এবং ঢাকা কলেজের (বর্তমান কার্জন হল) ভবনগুলো নিয়ে এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু হয়। তখন বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা করেছিল দু’টি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান ঢাকা কলেজ এবং জগন্নাথ কলেজ (বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়)
ঢাকা মেডিক্যালের ভবনটি ১৯০৪ সালে নবগঠিত প্রদেশ আসাম এবং পূর্ববংগের সচিবালয় হিসেবে তৈরি করা হয়, নতুন প্রদেশের স্বল্পস্থায়ী মেয়াদে এটি সচিবালয় হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। ১৯২১ সালে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার যাত্রা শুরু করে, ভবনটির কর্তৃত্ব পায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সেই সময় বিশাল এই ভবনের একপাশে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টার, একাংশে ছিল ছাত্রদের ডরমেটরি এবং বাকি অংশ কলা অনুষদের প্রশাসনিক শাখা হিসেবে ব্যবহৃত হত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে তখন পুরো ভবনটিতেই স্থাপিত হয় ‘আমেরিকান বেস হাসপাতাল’। তবে যুদ্ধ শেষে মার্কিনীরা চলে গেলেও ১০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালটি থেকে যায়।
 কথা ছিল গভর্ণমেন্ট অব ইন্ডিয়া ঢাকা ইউনিভার্সিটি করবে। সেই জন্য ১৯১০ থেকে কিছু টাকা ইন্ডিয়া গভর্ণমেন্ট আলাদা করে রাখত। ১৯২০-২১ এ এই টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ৬০ লক্ষ। কিন্তু এই ৬০ লক্ষ টাকা বেঙ্গল গভর্ণমেন্ট ডিড নট গিভ টু দি ঢাকা ইউনিভার্সিটি। তারা সে টাকাটা পুরো নিয়ে নিল।
 রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধী ছিলেন। তিনি বঙ্গভঙ্গেরও বিরোধী ছিলেন। ১৯০৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গভঙ্গ রদ করার প্রস্তাবকদের জন্য একটি গান ’আমার সোনার বাংলা’ লেখেন, যা অনেক পরে, ১৯৭২ সালে, বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতে পরিণত হয়। পশ্চিম বঙ্গের কিছু উচ্চমহলের মুসলমানরাও বঙ্গভঙ্গের বিরোধী ছিলেন।  তাদের ধারণা ছিল এতে করে তাদের কোন সুবিধা হবে না, শুধু পূর্ব বঙ্গের মুসলিমদের লাভ হবে। পূর্ব বঙ্গের মুসলিমদের মধ্যেও বঙ্গভঙ্গ নিয়ে দ্বিমত ছিল। বলা হয়ে থাকে রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধাচরণ করে পূর্ববঙ্গের জনগণ নিয়ে কটুক্তি করেন। তখন পশ্চিমবঙ্গের অনেকই এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে ছিলেন।
শুধু তাই নয়, “কেন্দ্রীয় সরকারের পূর্ব বাংলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত উদীয়মান মুসলমানদের মধ্যে তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি করে। চব্বিশ পরগণার জেলা মহামেডান এসোসিয়েশন ১৯১২-র ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যায় স্থাপনের বিরোধিতা করে। বলা হয় এর ফলে সমগ্র প্রদেশের মুসলমানদের শিক্ষাগত স্বার্থে পক্ষপাতদুষ্ট প্রভাব পড়বে এবং তাদের মধ্যে বিবাদের সৃষ্টি করবে।”(সূত্র : দি মুসলিম পত্রিকা)। দৈনিক আজাদের সম্পাদক মৌলানা আকরাম খান আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অর্থ বরাদ্দ করলে সাধারণ মুসলমানদের শিক্ষা সংক্রান্ত বিশেষ সুযোগ-সবিধা দানের ক্ষেত্রে অর্থের ব্যবস্থা করবেন না। মুসলমানদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা অপেক্ষা প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি (প্রাথমিক ও মাধ্যমিক) শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার উপর তিনি গুরুত্ত্ব আরোপ করেন। আবদুর রসুল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দলের সদস্য ছিলেন এবং তিনি ছিলেন ১৯০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলার জাতীয় শিক্ষা কাউন্সিলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। আবদুর রসুল আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় মুসলমানদের পক্ষে ‘বিলাসিতা’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। তার মতে কয়েকজন ভাগ্যবানের জন্য অর্থ ব্যয় না করে বেশিরভাগ মানুষের জন্য তা ব্যয় করা উচিৎ। মুসলমানদের মতে প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয় হবে একটি অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান, ফলে বাংলার মুসলমানদের বিশেষ কিছু লাভ হবে না। বরং গরীব অথবা যোগ্য মুসলমান ছাত্রদের বিশেষ বৃত্তির ব্যবস্থা এবং দু-একটি প্রথম শ্রেণীর কলেজ স্থাপন ইত্যাদি করলে মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তার সম্ভব হবে। রবীন্দ্রনাথ একা এর বিরোধিতা করেন নাই।

এক নজরে নবাব সলিমুল্লাহর জীবনীঃ
‘নবাব স্যার সলিমুল্লাহ’- একটা জীবন, একটা ইতিহাস।
নবাব সুলিমুল্লাহ যার জন্ম ১৮৭১ সালের ৭ ই জুন। ছোটবেলা থেকেই ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপ্রিয়। ফলে অভিজাত পরিবারের সন্তান হয়েও তিনি সাধারণ মানুষের কাছাকাছি অবস্থান করতেন। সাধারণ মানুষের দুঃখকে তিনি নিজের দুঃখ মনে করতেন। তিনি অকাতরে দান-খয়রাত করতেন।
— নবাব সলিমূল্লাহ যিনি সর্বপ্রথম পানীয় জল, ইলেকট্রিসিটি এবং টেলিফোন ব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে আধুনিক ঢাকার জন্ম দেন।
— নবাব সলিমূল্লাহ যিনি জীবনের প্রথম দিকে জনগণের কথা চিন্তা করে নবাবীর লোভ না করে মোমেনশাহীর ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
— নবাব সলিমূল্লাহ যিনি ১৯০৩ সালে বড় লাট লর্ড কার্জন ঢাকায় সফরে এলে তাঁর নিকট পূর্ব বাংলার সমস্যাগুলো তুলে ধরেন।
— নবাব সলিমূল্লাহ যিনি ১৯১১ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকার কার্জন হলে ল্যান্সলট হেয়ারের বিদায় এবং চার্লস বেইলির যোগদান উপলক্ষে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে নওয়াব আলী চৌধুরীকে নিয়ে পৃথক দুটি মানপত্র নিয়ে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানান।
— নবাব সলিমূল্লাহ যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য ঢাকার রমনা এলাকায় নিজ জমি দান করেন, বাবার নামে আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল (বর্তমানে বুয়েট) প্রতিষ্ঠা করেন।
— নবাব সলিমূল্লাহ যিনি ১৯০৬ সালে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী ও তাদের দোসরদের ক্রমাগত আক্রমন থেকে নিজস্ব ইতিহাস ঐতিহ্য এবং ধর্ম রক্ষায় প্রায় ছয় মাসের প্রচেষ্টায় পাক-ভারত উপমহাদেশে ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ’ গঠন করেন।
— নবাব সলিমূল্লাহ যার আন্দোলনের ফলে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক শিক্ষা বিভাগে মুসলমানদের জন্য সহকারী পরিদর্শক ও বিশেষ সাব ইন্সপেক্টরের পদ সৃষ্টি করেন।
— নবাব সলিমূল্লাহ যিনি বর্ণবাদী-ব্রাহ্মণ্যবাদী চক্রান্তে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদে শত বছরের অধিক চাষাভূষা, কোচোয়ান-দাঁরোয়ান ও গোলাম বানিয়ে রাখা মুসলিমদের কথা ভেবে প্রথম জেগে উঠেন, তারপর মুসলিমদের সংগঠিত করার কাজ শুরু করেন।
— নবাব সলিমূল্লাহ, যিনি ১৯০৫ সালে বঙ্গদেশকে দুই ভাগে ভাগ করে, ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও আসাম নিয়ে ঢাকাকে রাজধানী করে পূর্ববঙ্গ গঠন করেন।
— নবাব সলিমূল্লাহ, যিনি সুদূর তুরস্কের ভূমিকম্পে মানুষের কষ্টের কথা শুনে সাহায্যের জন্য টাকা-পয়সা পাঠিয়েছিলেন।
— নবাব সলিমূল্লাহ, যিনি মানুষকে তার সকল সম্পদ অকাতরে বিলিয়ে দিয়ে ঋণী হয়েছিলেন। সোনালী ব্যাংক সদরঘাট শাখায় এখনও তার বন্ধক রাখা সিন্ধুক “দরিয়ায়ে নূর” রক্ষিত আছে।
আচ্ছা আমরা ক’জন জানি এই মহান ব্যক্তির কথা? তার অসামান্য কীর্তির কথা? এই ঢাবি না থাকলে আজকে কারা ভাষা এনে দিতো আমাদের? এই ঢাবি না থাকলে কারা স্বাধীনতাকে এনে দিতো? এই বুয়েট না থাকলে কারা বিশ্বমানের ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার সুযোগ করে দিত?
আজ যত-শত আবর্জনারই আমাদের জ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে যেখানে এই মহান ব্যক্তিদের একটু জায়গা কোথায়?!

রহস্যজনক মৃত্যুঃ
ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহর পূর্ব পুরুষ ইংরেজদের দালালি করলেও নবাব সলিমুল্লাহ তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা নিয়ে তৎকালীন হিন্দু সমাজ এবং লাটের সাথে তার বাদানুবাদ হয়। কথিত আছে যে, বড়লাট রাজি ছিলেন না ঢাকায় কোন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে। এই নিয়ে নবাবের সাথে বড় লাটের তীব্র বিতর্ক হয়। নবাব সবসময় একটা ছড়ি নিয়ে ঘুরতেন। যখন বড়লাট রাজী হচ্ছেন না ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে তখন নবাব রেগে গিয়ে ছড়ি দিয়ে বড়লাটের টেবিলে বাড়ি মারেন। বড়লাটের দিকে এগিয়ে আসেন। তখন বড়লাটের হুকুমে বড়লাটের হিন্দু দেহরক্ষী নবাবকে গুলি করেন। পরে প্রচার করা হয় যে তিনি হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যায়। আজ নবাব সলিমুল্লাহ মৃত্যু বার্ষিকী। অথচ যার দান করা ৬০০ একর জমির উপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দাঁড়িয়ে আছে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে স্মরণ করা হয়না। মানুষের এমন অকৃতজ্ঞতা দেখে নবাব হয়তো কবর থেকেই বিস্মিত হচ্ছেন।
জ্বি, ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ আপনি আমাদের ক্ষমা করে দিন। [তথ্যসূত্রঃ বিবিসি, তীতুমির কলেজ ওয়েব ও অন্যান্য অনলাইন লিঙ্ক।]

Leave a Reply

You must be logged in to post a comment.

Editor in Chief: Dr. Omar Faruque

Editor: Dr. Morjina Akhter

All contact: 400E Mosholu Parkway South Apt # A23,The Bronx, New York 10458, USA

Mob. 001.347.459.8516
E-mail: dhakapost91@gmail.com