অখন্ড বাংলা, অখণ্ড ভারত, অখণ্ড পাকিস্তান নাকি বাংলাদেশ?
আপডেটেডঃ ২২ জানুয়ারি ২০১৬।।
এম নূরুন্নবীঃ অখন্ড বাংলা, অখন্ড পাকিস্তান, অখন্ড ভারত এধরনের নানা অখন্ড কথাবার্তা এখন শুনা যাচ্ছে। কেউ আবেগের বশবর্তী হয়ে বলতেছেন, কেউ আবার হীনমন্যতা থেকে বলতেছেন। বাংলাদেশকে আমরা শক্তিশালী জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে নানা অখন্ড স্লোগান ধারীরা এমনিতেই চুপ হয়ে যাবে।এখন দেখা যাক বাংলাদেশকে একটি শক্তিশালী জাতি হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব কিনা।
একটা রাষ্টের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সমুদ্র বন্দর থাকা, আমাদের দুটি সমুদ্র বন্দর রয়েছে- আরো একটি নির্মানের প্রক্রিয়া চলতেছে। আমরা দেখেছি সাম্প্রতিককালে নেপাল কিভাবে সমুদ্র বন্দর না থাকার কারণে সমস্যায় নিপতিত হয়েছে, তারপরও নেপালীরা অখন্ড ইন্ডিয়ার স্লোগান দিচ্ছে না, বরং সাময়িক কষ্টকে স্বীকার করে নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকতে চাচ্ছে।
একটা রাষ্ট্রের একক ভাষা থাকাটা রাষ্ট্রের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমাদের প্রতেবেশী ভারত কিংবা পাকিস্তানের একক কোনো ভাষা নেই, ফলে তাদেরকে লিঙ্গুয়া ফ্রাংকার আশ্রয় নিতে হয়। ইন্ডিয়ার বড় ভাষাগুলোর মধ্যে রয়েছে মারাঠি, গুজরাটি, বাংলা, হিন্দি, উর্দু, পাঞ্জাবি, তেলেগু, তামিল, মালায়লাম, উদিয়া, কান্নাডা সহ আরো বেশ কিছু ভাষা। ফলে হিন্দিকে কমন ভাষা হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। হিন্দিকে উত্তর ভারতীয়রা মেনে নিলেও দক্ষিন ভারতীয়রা হিন্দিকে গ্রহণ করতে নারাজ। ভারতের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৩০ কোটি যার মধ্যে প্রায় ৩০ কোটি লোকেরা মাতৃভাষা হিন্দি, বাকিদের আলাদা মাতৃভাষা রয়েছে।
পাকিস্তানের ক্ষেত্রে উর্দুকে লিঙ্গুয়া ফ্রাংকা হিসেবে ব্যবহার করা হয়, পাকিস্তানে মাত্র ৮% লোকের মাতৃভাষা উর্দু। পাকিস্তানের জনসংখ্যার মেজরিটি হচ্ছে নৃতাত্ত্বিক পাঞ্জাবি এবং তাদের মাতৃভাষা পাঞ্জাবি। এছাড়া পাঠানদের ভাষা হচ্ছে পশতু, বেলুচদের ভাষা বেলুচি, সিন্ধির ভাষা সিন্ধ এবং আজাদ কাশ্মীরের ভাষা কাশ্মিরি। বাংলাদেশে ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলি এবং বিহারীদের বাদ দিলে সবার মাতৃভাষাই বাংলা। ফলে অন্য কোনো ভাষাকে লিঙ্গুয়া ফ্রাংকা হিসেবে ব্যবহার করার দরকার নাই। একই ভাষা থাকার কারণে সরকারের নানা বার্তা, স্বাস্থ্য সচেতনতা তৈরী সহ নানা উন্নয়ন কর্মকান্ডে মানুষের কাছে খুব সহজেই পৌছা যায়।
ধর্মীয় ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মানুষ ভারত-পাকিস্তানের তুলনায় অনেক সহনশীল। এখানে ভারতের মত হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয়না কিংবা পাকিস্তানের মত শিয়া-সুন্নি বিরোধ নাই। বাংলাদেশের ৯০% মানুষই একই ধর্মের অনুসারী অর্থাত মুসলিম, অধিকাংশই সুন্নি এবং হানাফি মাজহাবের অনুসারী। এখানে বিরোধের জায়গা নেই বললেই চলে। ভাষা এবং বিশ্বাস দুই জায়গাতেই বাংলাদেশের মানুষগুলো সম-মানসিকতার। এমনকি নৃ-তাত্ত্বিক দিক থেকেও বাংলাদেশীরা একই নৃ-তাত্ত্বিক ধারা, প্রায় সবাই অনার্য জনগোষ্ঠির লোক। বাংলাদেশে আর্যরা প্রবেশ করতে পারেনি। অন্যদিকে ভারতে নৃতাত্ত্বিক দিক থেকে উত্তর ভারত এবং দক্ষিন ভারতের মধ্যে আর্য এবং দ্রাবিরীয় দ্বন্ধ রয়েছে।
বাংলাদেশের কিছু রাজনৈতিক বিরোধ বাদ দিলে এখানে আর কোনো বিরোধের অস্তিত্ব নাই। ভারতে যেমন কিছু অঞ্চল অনেক সমৃদ্ধ আবার কিছু জায়গায় মানুষ চরম দারিদ্র সীমার নিচে বাস করে, নিজেদের একটা টয়লেট পর্যন্ত নেই। বাংলাদেশের সব অঞ্চলের মধ্যেই উন্নয়নের দিক থেকে একটা সমতা রয়েছে। ভূ-প্রাকৃতিক দিক থেকেও সমগ্র দেশ একই, সমগ্র দেশই চাষাবাদের উপযোগী, উর্বর পলিমাটির দেশ বাংলাদেশ।
আঞ্চলিক সম্প্রসারনবাদ এবং আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদ মোকাবেলায় যে বুদ্ধিমত্তা প্রয়োজন- সেটা বুদ্বিজীবি এবং রাজনীতিবিদদের মধ্যে গড়ে উঠলেই বাংলাদেশীরা দুনিয়ার বুকে একটা শক্তিশালী জাতি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে। অখন্ড বাংলা,অখন্ড পাকিস্তান বা অখন্ড ইন্ডিয়ার পিছনে অহেতুক সময় নষ্ট করার প্রয়োজন নাই। বুদ্ধিবৃত্তিক দৈনতা কাটিয়ে উঠতে হবে, ৪৭ এবং ৭১ এর সমন্বয়ের মাধ্যমে শক্তিশালী জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলে সাম্রাজ্যবাদ মোকাবেলা করতে হবে।
নিচে অখন্ড বাংলা কিংবা অখন্ড পাকিস্তান কিংবা অখন্ড ভারত প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ আছে কিনা সে বিষয়ে আরেকটু আলোকপাত করা হল:
অখন্ড বাংলা
অখন্ড বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে পশ্চিমবঙ্গ কে ভারত থেকে স্বাধীনতা লাভ করে বাংলাদেশের কাছে আসতে হবে। ঐতিহাসিক নানা ঘটনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এটা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নাই।
১৯৪৭ সালে যখন অখন্ড বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সোহরাওয়ার্দি এবং আবুল হাসিম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন তখন বেঙ্গল কংগ্রেস এবং হিন্দু মহাসভা পশ্চিম বঙ্গকে বাংলা থেকে আলাদা করে ভারতে যোগ দেয়ার আন্দোলন চালিয়ে গেছেন। শরৎ বসু এবং কিরণ শংকর রায় অখন্ড বাংলার চেষ্টা করলেও গান্ধী-নেহেরু-প্যাটেলের বিরুধিতায় শেষ পর্যন্ত পিছু হটেন। বাংলা ভাগের জন্য ৭৬ টি জনসভা হয় বলে জানা যায়-এর মধ্যে কংগ্রেস একাই কমপক্ষে ৫৯ টি জনসভার আয়োজন করে। বারোটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয় হিন্দু মহাসভার উদ্যেগে, আর মাত্র পাচটি জনসভা হয় যৌথ উদ্যেগে (জয়া চ্যাটার্জি, বাঙলা ভাগ হল, ২০০৩)।
বাংলাদেশ-উত্তর পহেলা ২১ শে ফেব্রুয়ারী (১৯৭২ ) উদযাপনে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে অন্নদা শংকর রায়ের নেতৃত্বে বুদ্ধিজীবিদের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকাতে আসে। তাদের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে শেখ মুজিবর রহমান বলেন,
‘আমরা সতেরো কোটি বাঙালি একজোট হলে কিনা করতে পারি, ভারত জয় করতে পারি’। শেখ মুজিবের জনৈক সহযোগী আরও খোলাখুলিভাবে বলেন, আপনারা ভারতের অধীন রয়েছেন কেন? আমাদের সাথে মিশে গেলে স্বাধীন হবেন।’ জবাবে কলকাতার বুদ্ধিজীবী দলের নেতা এক সময়ের ঢাকার বিক্রমপুরের সন্তান অন্নদা শংকর রায় বলেন, ‘আমরা আপনাদের মত শুধু মাত্র বাঙালি নই, আমরা সেই সাথে ভারতীয়’ (অন্নদা শংকর রায়, ‘একুশে ফেব্রুয়ারী, ওদের আমাদেরও’ আনন্দবাজার পত্রিকা, ২১ ফেব্রুয়ারী ১৯৯৪)।
গাফফার চৌধুরী ভারতীয়দের মনস্তত্ব নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে বলেন;
”…দুই জার্মানির মতো কি দুই বাংলা, এমনকি ত্রিপুরা রাজা একদিন এক হয়ে যাবে? আমি তার সমূহ সম্ভাবনা দেখি না। যদি কেবল ভাষা জন্যই দুই অঞ্চল এক হতো, তাহলে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে ত্রিপুরা রাজ্যের আলাদা অবস্থান কবেই শেষ হয়ে যেতো! আমি একবার লন্ডনে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তিনি কি মনে করেন, কোনদিন দুই জার্মানির মতো দুই বাংলা এক হতে পারে? তিনি দৃঢ়ভাবেই মাথা নেড়ে বলেছিলেন, ‘আগামী পাঁচশ’ বছরেও নয়। (আবদুল গাফফার চৌধুরী, বাঙালির ভাষা-সাম্রাজ্য, বাঙালির অসমাপ্ত যুদ্ধ, জ্যোৎস্না পাবলিশার্স, ১৯৯৯, পৃঃ২৪)
এ ধরনের আরো অনেক উদাহরণ দিয়ে লেখার কলেবর বাড়াতে চাই না। বটম লাইন হচ্ছে পশ্চিম বঙ্গের লোকেরা হিন্দু আইডেন্টিটি বাদ দিয়ে বাংলাদেশের কাছে ফিরে আসতে রাজি নয়। তাছাড়া অখন্ড বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার অর্থ দুই বাংলা মিলে হিন্দুদের সংখ্যালঘু হয়ে যাওয়া, আর দুনিয়ার কেউ মাইনরিটি হতে চায় না।
অখন্ড ইন্ডিয়া
যেখানে কোনো মুসলমান খাসির গোস্ত খেলে সন্দেহ করা হয় গরুর গোস্ত খেয়েছে এবং এই সন্দেহে মুসলমানকে পিটিয়ে হত্যা করা হয় সেরকম একটা সাম্প্রদায়িক দেশের সাথে কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক মুসলিম একীভূত হওয়ার চিন্তা করতে পারে না। তাছাড়া হিন্দু এলিটরা সব সময় ভারতীয় জাতীয়তাবাদ এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদকে সমার্থক মনে করেন। সে কারণে বিজেপি নেতারা প্রায়ই মুসলমানদেরকে বাংলাদেশ কিংবা পাকিস্তান চলে যেতে বলেন অথবা হিন্দুদের অনুগত হয়ে থাকতে বলেন। গান্ধীও একই মানসিকতা পোষণ করতেন। গান্ধী বলেছেন; হিন্দু ধর্ম হল এক সমুদ্রের মত, যার দিকে সব নদী ধাবমান। এটা ইসলাম, ক্রিশ্চিয়ানিটি এবং আর আর সব ধর্মকে আত্বস্থ করতে পারে এবং একমাত্র তা করেই তার জন্য সমুদ্রের রূপ নেয়া সম্ভব। তা না হলে তাকে সামান্য এক নদী রূপে থাকতে হবে, যার মধ্যে কোনো বড় জাহাজ চলতে পারবে না (এম কে গান্ধী: ১৯৫৮)।
সহজ কথায় অহিন্দু জনগোষ্ঠিকে হিন্দু ধর্মের মহাসমুদ্রে মিশিয়ে দেয়া চাই। এটা শুধু গান্ধী নয়, সকল হিন্দু এলিট শ্রেনীর মানসিকতা। আবুল মনসুর আহমদ তার ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ বইতে বলেছেন রবীন্দ্রনাথও এই মানসিকতা ধারণ করতেন।ফলে অখন্ড ভারত মানেই হচ্ছে বাঙালি মুসলমানদেরকে দিল্লির এলিট হিন্দু তথা ব্রাহ্মনদের আনুগত্য করা, নিজেদের স্বকীয়তা বিসর্জন দেয়া। ব্রিটিশ শাসনামলের ১৯০ বছরেও এলিট হিন্দুদের সাথে বাঙালি মুসলমানদের অনেক দু:সহ অভিজ্ঞতা রয়েছে।
অখন্ড পাকিস্তান
যদিও পশ্চিম পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের জনগণ হিন্দু মহাসমুদ্রে মিশিয়ে যাওয়া থেকে বাচার জন্য এবং ব্রাহ্মন জমিদারদের অত্যাচার থেকে মুক্তির জন্য একসাথে আজাদী আন্দোলন করেছেন এবং প্রাথমিক আজাদী অর্জিত হয়েছে কিন্তু পরবর্তিতে উন্নয়নের অসমতা এবং ৭১ এর নির্বিচার হত্যার ফলে অখন্ড পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার আর কোনো সুযোগ নেই।
ভারত এবং পাকিস্তান দুই দেশই পারমানবিক শক্তিধর দেশ, সাম্প্রতিক সময়ে মালেয়শিয়া পাকিস্তান থেকে যুদ্ধ বিমান কিনার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।ভারত অনেক কিছুই নিজস্ব প্রযুক্তি ব্যবহার করে বানাচ্ছে ফলে অনেকে মনে করতে পারেন এসব দেশের সাথে একীভূত হলে আমরাও বুক ফুলিয়ে বলতে পারব আমরা পারমানবিক বোমা বানাতে পারি। এখন কথা হচ্ছে অন্যের অর্জন নিয়ে আমাকে গর্ব করতে হবে কেন?
বাংলাদেশ অনেক সামাজিক সূচকে ভারত এবং পাকিস্তান থেকে এগিয়ে রয়েছে। আমাদের রয়েছে নিজস্ব সমুদ্র বন্দর, ভাষা, ধর্মীয় দিক থেকে রয়েছে সম-মানসিকতা, আছে উন্নয়নের দিক থেকে অঞ্চলভিত্তিক সমতা। সমস্যার জায়গাটা হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিক দৈনতার কারণে নিজের ভাইকে নিজের দেশের মানুষকে শত্রু মনে করতেছি আর শত্রুকে বন্ধুর আসনে বসিয়েছি। ক্ষমতার জন্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহযোগিতা করতেছি।এখান থেকে বের হতে হবে। ৪৭ এর মুসলিম আইডেন্টিটিকে ধারণ করে, ৭১ এর বাঙালি আইডেন্টিটিকে ধারণ করে দুয়ের সমন্বয়ে জাতীয় আইডেন্টিটি তৈরী করতে হবে এবং সাম্রাজ্যবাদ মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।
প্রাসঙ্গিক পোষ্টঃ
কারা বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করলো এবং কার স্বার্থে-সুনীতি কুমার ঘোষ
হিন্দু অভিজাত শ্রেনীর রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সুবিধার জন্যই বাংলা ভাগ-নুরুল কবির
স্বাধীন ভারতে সংখ্যালঘু মুসলিমদের অবস্থা
হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা ও ১৯৪৭ সালের বাঙলা ভাগ-পর্ব ৫ – জয়া চ্যাটার্জী
অখন্ড বাঙলায় জিন্নাহ-মুসলিম লীগের সম্মতি, নেহেরু-কংগ্রেসের প্রবল আপত্তি
১৯০৫ সালের বাংলাভাগ ও পূর্ববাংলায় প্রতিক্রিয়া–মুনতাসির মামুন